#চৌধুরি_বাড়ি-২য় পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
আমি অচেনা জঙ্গল মাঠ দিয়ে ক্লান্ত দেহটাকে নিয়ে দৌঁড়ে চলছি। জানিনা কোথায় পাবো আমি নিরাপদ আশ্রয়। দেহটা আর চলতে চাচ্ছে না, তবুও বাঁচার জন্য আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটে চলা।
হঠাৎ বিজলি চমকে উঠলে দূরে তাকিয়ে দেখি শান্তিপুর রেলস্টেশন লেখা। আমি সেদিকেই দৌঁড়াতে শুরু করলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে এক সময় রেলস্টেশনে এসে পৌঁছালাম। বৃষ্টি আর ঝড়ের কারণে বিদুৎ নেই, এতো রাতে এখানে না আসবে কোন ট্রেন আর না থাকবে কোন মানুষ। আমি আরেকটু এগিয়ে যেয়ে একটা বেঞ্চ এ বসলাম। শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে। জোড় করে খুলে রেখেছি। ভয়ে মনে হচ্ছে দম আটকে যাবে। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয় আর মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই জেনো আমার জন্য অপেক্ষা করছে না। তবুও বেঁচে থাকার একটু আশা। ভোর হলেই হয়তো মানুষজন চলে আসবে আর আমি ফিরতে পারবো নিজের বাড়িতে। ভাবতে ভাবতে এক সময় দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসলো।
হঠাৎ করেই বিজলি চমকে উঠলে, আমার চোখ থেকে ঘুম চলে যায়। আমার চোখ পরলো কিছুটা দূরে থাকা আরেকটা বেঞ্চের দিকে, সেখানে দু’জন নারী বসে রয়েছেন। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর আবার কাঁপতে শুরু করলো। এতো রাতে এই নির্জন রেলস্টেশনে দু’জন নারী বসে থাকবে, তা কারোই কাম্য নয়। সত্যিই কি তারা মানুষ নাকি অন্য কিছু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না।
মনে মনে ভাবছি যদি অন্য কিছু হয়ে থাকে তবে নিশ্চই এতো সময় আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করতো। কিছুটা সাহস সঞ্চার করে আমি এগিয়ে যেতে থাকি সেদিকে। একদিকে ভয় অন্য দিকে দু’জন অপরিচিত মেয়ে মানুষ যাদের দিকে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে কেউ আমার জামাটা পেছন থেকে টেনে ধরে রাখছে। কিন্তু ভয়ে পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে পেছনে তাকালেই আমি ভয়ংকর কোন কিছু আমার সামনে চলে আসবে। হয়তো সেই বৃদ্ধা মহিলা যাকে চৌধুরি বাড়িতে কিংবি জঙ্গলে কাফনের কাপড়ে দেখেছি। নয়তো সেই দারোয়ানকে দেখতে পাবো যার সাথে পা লেগে আমি পরে গিয়েছিলাম।
এক’পা দু’পা করে যতই এগিয়ে যাচ্ছি মনে হচ্ছে ভয়টা ততই কমে যাচ্ছে। একটা সময় আমি তাদের খুব কাছাকাছি চলে আসলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে ঠিক মত তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করলাম আপনারা কি এখানেই থাকেন?
তারা এক সাথে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বুঝালো।
আমি নিজ থেকেই আবারও প্রশ্ন করলাম। এতো রাতে কি এখানে কোন ট্রেন আসবে?
তারা আবারও এক সাথে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বুঝালো।
আমি নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য তাদেরকে বললাম আমি সদর হাসপাতালের একজন ডাক্তার। এখানে একজন রোগী দেখার জন্য এসেছিলাম চৌধুরী বাড়িতে। রাত অনেক হয়েছে আর কোন গাড়িও পাচ্ছিলাম না। তাই হাঁটা শুরু করি, কিন্তু পথ ভুলে এখানে চলে আসি। আপনারা কি জানেন সদরের রাস্তাটা কোন দিকে?
আমার কথা শুনে তারা নিজেদের ভিতর কিছু একটা বলছিলো। আমি তাদের কথা বুঝতে পারছিলাম না।
হঠাৎ একজন নিচু স্বরে বলে উঠলো ঐ বাড়িতেতো কেউ থাকে না। ঐ বাড়ির সকলে এক রাতে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। এরপর থেকে ঐ বাড়িতে কখনো থাকে না।
মেয়েটার কথা শুনে আমার গলা সম্পূর্ণ শুকিয়ে আসলো। কি বলছে এরা। নিশ্চই আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই বলছে।
আমি একটু মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে বললাম আপনারা আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব বলছেন। আমিতো ঘন্টা খানেক আগেই একজন বৃদ্ধা মহিলাকে সে বাড়িতে দেখে আসলাম।
আমার কথা শুনে সাথে সাথেই দু’জন এক সাথে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকালো আর অমনি বিজলি চমকে উঠলো। দু’জন এক সাথে বলে উঠলো তাহলে কি আমরা মিথ্যা বলছি?
ভয়ে আমার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গেলো। কারণ যে দু’জন মেয়েকে আমার সামনে দেখছি তারা আর কেউ নয়। তারা দু’জন চৌধুরি বাড়ির ছোট দুই মেয়ে রূপা আর রূপালি। কি বিশ্রী ভাবে হেসে আমার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করছে। সেই সাথে তাদের ভয়ংকর চেহারা বের হয়ে আসছে। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আমি বুঝতে পারলাম আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। বাঁচার কোন উপায় নেই। আমার শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। চারিদিকের সব কিছু ঘোলাটে হতে থাকলো চোখের সামনে।
হঠাৎ করেই ট্রেনের হুইসেল কানে ভেসে আসলো। আমি সেদিকে ঘুরে দেখে সামনে তাকাতেই কাউকেই আর দেখতে পেলাম না। আমি মাটিতেই বসে পরলাম। কি হচ্ছে আমার সাথে, আমি বুঝতে পারছি না। আমি চারিদিকে বার বার ঘুরে তাকাচ্ছি। বৃষ্টি ক্রমাগত বেড়েই চলছে। ট্রেনের শব্দটা খুব কাছে চলে আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। গভীর রাত মনে হয় মালবাহী ট্রেন তার সামনের লাইট দু’টোই শুধু জ্বলে রয়েছে। বাকি বগী গুলোর লাইট নেভাবো। ট্রেনটা যতই কাছে এগিয়ে আসছে আমার বেঁচে থাকার বিশ্বাস ঠিক ততই বেড়ে চলেছে।
একটা সময় ট্রেন এসে থামলে আমি সেদিকে দৌঁড় দিলাম। আমি জানি এ ট্রেন খুব বেশী সময় দাঁড়াবে না। এতো রাতে না নামার মত কোন লোক আছে। না উঠার মত কেউ আছে আমি ছাড়া। ট্রেনের খুব কাছে আসতেই আবারও হুইসেল বেজে উঠলো। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে দৌঁড়ে একটা বগীতে উঠে পরলাম। কোন দিক না খেয়াল করেই একটা সিটে বসে পরলাম। কিছু সময়ের জন্য দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম। হুইসেল বাজলেও ট্রেন চলছে না। আমি একটু রিলাক্স হবার পরেই চোখ মেলে তাকালাম।
এতো সময় কোন কিছু খেয়াল না করে ট্রেনে উঠে পরলেও। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার পাশে একটা লাশবাহী খাটিয়া রয়েছে। তার সাথে কোন লোক জন নেই। আমি এদিক সেদিক তাকালাম। চিৎকার করে বলতে চাইলাম কেউ কি আছেন? কিন্তু আমার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আমি দাঁড়াবার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। একের পর এক বিপদ জেনো আমাকে ধরে বসেছে। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই, ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলো। হুট করেই লাশবাহী খাটিয়ার সামনের লাইট জ্বলে উঠলো। আর বাতাসে তার মুখের উপর থেকে সরে গেলো কাফনের কাপড়। আমার সামনে পরে রয়েছে সেই সুন্দরি মেয়ে রুম্পার লাশ।
আমি খুব কষ্ট করে সিট ছেড়ে বের হয়ে আসলাম। ভয়ে পা যেন চলতেই চাচ্ছিলো না। কোন রকমে বের হয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌঁড় দিয়ে কোন রকমে ট্রেনের দরজার সামনে চলে আসলাম। আমার সামনে শুধু এখন একটি রাস্তায় খোলা। এই চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পরা এতে হয়তো হাত পা কিছুটা কেটে ফেটে যেতে পারে। কারণ ট্রেন খুব বেশী রানিং হয়নি। আর দ্বিতীয় রাস্তা এখানেই বসে নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। আমি বাঁচার জন্য লাফিয়ে পরলাম। কয়বার পাল্টি খেয়ে একটা ল্যাম্পপোষ্টের সাথে যেয়ে আটকে গেলাম।
এ যাত্রায় নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো কেননা লাফ দেবার আগে আমার খেয়াল করার দরকার ছিলো সামনে কোন কিছু রয়েছে কিনা। আর কয়েক সেকেন্ড দেরি করে লাফ দিলে হয়তো ভয়ের বদলে ল্যাম্পপোষ্টে লেগেই আমার মৃত্যু হতো। আমি কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক দেখার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি। না কোন কিছুই বুঝতে পারছি না একমাত্র রেল লাইনের পথ ছাড়া বাকি সবই জঙ্গল চোখে পরছে। বৃষ্টিতে সমস্ত শরীর ভিজে গিয়েছে। আগের চেয়ে শরীরটা অনেক বেশী ভারী হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করেই কোথাও থেকে শিয়াল ডেকে উঠতেই ভয়ে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলাম।
কোথায় যাচ্ছি আমি জানি না। তবে রেল লাইন ধরে দৌঁড়িতে শুরু করলাম। আমার মনে হচ্ছে স্টেশন খুব কাছেই হবে। কেননা ট্রেন চলতে শুরু করার অল্প কিছু সময় পরেই আমি ট্রেন থেকে লাফিয়ে পরি। কিন্তু পথ যেনো শেষই হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে কেউ আমার পা পেছন থেকে টেনে ধরে রেখেছে। আমি খুব কষ্টে দৌঁড়াচ্ছি যে কোন সময় পরে যাবো রেল লাইনের উপরে। কিন্তু পথ জেনো শেষ হতেই চাচ্ছিলো না। আমি কি সত্যিই দৌঁড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম নাকি একই জায়গায় রয়েছি কোন কিছুর অনুভুতি আমি বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বুঝতে পারছিলাম আমার পক্ষে আর দৌঁড়ানো সম্ভব নয়। আমি আর পারবো না। আমার বেঁচে থাকার সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে আসছে। কেউ একজন বলেছিলো যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই নাকি রাত হয়। আমার আজ সেই অবস্থা কেন এতো রাতে আমি বের হতে গিয়েছিলাম রোগী দেখার জন্য। একটা সময় আমি আর পেরে উঠলাম না। পরে গেলাম রেল লাইনের উপরে। হঠাৎ বিজলি চমকে উঠলো। অল্প কিছুটা দূরে আরেকবার দেখতে পেলাম শান্তিপুর রেেলস্টেশন লেখা।
আমি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে শরীরটাকে ছেচড়ি নিয়ে যেতে থাকি সেই দিকে। আমাকে যে বেঁচে থাকতে হবে। এভাবে যে আমি মৃত্যুর ভয় নিয়ে মরতে চাই না।
#চলবে…