#বিবর্ণ_বসন্ত
৬ষ্ঠ_পর্ব
~মিহি
‘তন্বীইই!’ আচমকা সুমির চিৎকার শুনে সকলে চিলেকোঠার দিকে দৌড় দেয়। অনামিকা, সোহরাব দৌড়ে আসে। তন্বী চিলেকোঠার একপাশে পড়ে আছে। সামনেই একটা সাপ, লোকজনের উপস্থিতিতে সে দ্রুত পালিয়ে গেল। রাহেলা বানু এসে মেয়ের হাতে সাপের দাঁতের চিহ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠলো। অনামিকা সাপটাকে খেয়াল করেছে। বিষহীন সাপ, এর কামড়ে মৃত্যু হয়না। তবুও তন্বীকে ডাক্তার দেখাতে হবে। রাহেলা বানু ক্রমাগত কাঁদছেন। এমন করলে হয়তো তিনিই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। অনামিকা তাকে বোঝাতে গেল।
-‘ফুফু, কাঁদবেন না। বিষধর সাপ ছিল না, তন্বীর কিছু হবে না।’
-‘চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। তোমার দোষ সব। তুমি দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে।’
-‘কিন্তু ফুফু..’
-‘ফুফু কী বললো শুনতে পাওনি অনামিকা? তন্বীকে ঘরে নিতে হবে। তুমি সরো।’
অনামিকা এ মুহূর্তে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। সোহরাব তন্বীকে কোলে তুলে ঘরে শুয়ে দিল। অনামিকা ততক্ষণে ডাক্তার ডেকে ফেলেছে। রাহেলা বানুর চেঁচামেচি তখনো চলছে। অনামিকাকে দোষারোপ করেই যাচ্ছেন। নাদিম বেচারা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ডাক্তার এসে নিশ্চিত করলেন বিষধর সাপে কামড়ায়নি, ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তারপর রাহেলা বানু নিশ্চিত হলেন। নাদিমের সাথে মেয়ের প্রেমলীলা ধামাচাপা দিতে মেয়ের অসুস্থতার আশ্রয় নিতে চাইলেন তিনি।
-‘আমার মেয়ে অসুস্থ। তোমরা যাও ঘর থেকে আর নাদিম তুমিও চলে যাও।’
-‘কোনটা সত্যি তা তো জানা হোক আগে।’
-‘তোমার সাহস তো কম না অনামিকা। আমার মেয়ে অসুস্থ, এখন এসব কথা বলছো তুমি?’
-‘তন্বী চিলেকোঠায় কেন লুকাতে গেল? এ প্রশ্নের জবাব দিন। ও যদি কিছু না-ই করে থাকে ভয় কিসের?’
তন্বীর জ্ঞান ফিরেছে তখন। অনামিকার কথা সবটাই শুনেছে সে। ভয়ে ভয়ে নাদিমের দিকে তাকালো সে। ভয়ে কিছু বলতেই পারছে না সে।
-‘তন্বী মা আমার, তুই বল ঐ ছেলের সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নাই।’
-‘তন্বী, যদি তুমি মিথ্যে বলো তবে জেনে রাখো আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ।’
তন্বী বেচারা ধর্মসংকটে পড়লো। একদিকে মা তো অন্যদিকে নাদিম। সে যাবে কোথায়? আচ্ছা নাদিম কি সত্যিই তাকে ছেড়ে দিবে? তবে বাঁচবে কী করে তন্বী? ভয়ে ভয়ে তন্বী বলে উঠলো,’আমি নাদিমকে ভালোবাসি..’। বলতে দেরি, রাহেলা বানুর থাপ্পড় দিতে দেরি নেই। সজোরে তন্বীর গালে চড় বসালেন তিনি। দুর্বল শরীরের তন্বী ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। অনামিকা আর সোহরাব মিলে তাকে ধরলো। রাহেলা বানু বিলাপ করছেন। নাদিমকে রেগেমেগে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তন্বী আপাতত চুপ। বাড়ির পরিবেশ বেশ নিস্তব্ধ। সাজিয়া শেখ অবশ্য রাহেলা বানুর এমন অবস্থা দেখে কিছুটা হলেও কিছু হয়েছেন। তবে অনামিকা সোহরাবকে এত সহজে ছাড়বে না। কোনো কারণ ছাড়া সোহরাব অনামিকার গায়ে হাত তুলেছে। তাছাড়া রাইসার ব্যাপারটা এখনো ক্লিয়ার করা বাকি। অনামিকা সরাসরি সোহরাবের সামনে দাঁড়লো।
-‘কিছু বলবে অনামিকা?’
-‘হুম, রাইসার ব্যাপারে।’
-‘ঘরে চলো।’
-‘আমার চরিত্র নিয়ে যখন সবার সামনে সব বলতে পেরেছো তখন রাইসার ব্যাপারটা ঘরে কেন হবে? তোমাকে সবার সামনেই উত্তর দিতে হবে।’
-‘দেখো অনামিকা, বাড়ির পরিবেশ এখন ভালো না।’
-‘পরিবেশ খারাপ হওয়ার পিছনে সিংহ ভাগ কারণটা তুমি নও কি? না জেনে, না বুঝে এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়েছো। এখন আমার প্রশ্নের উত্তরও তোমায় দিতে হবে।’
সোহরাব বিরক্ত হলো। রাগে তার রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। অনামিকা মেয়েটাকে বিয়ে করা আসলেই তার জীবনের অন্যতম ভুল। সোহরাবের এখনো মনে পড়ে মায়ের কথাতেই বিয়েতে রাজি হয়েছিল সে। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সেখানেই করেছে। এখন না জানি রাইসার ব্যাপারে কী প্রশ্ন করবে ভাবতেই বিব্রতবোধ করলো সে। অনামিকার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে সোহরাবের ভাবনা ভঙ্গের অপেক্ষা করছে।
-‘বলো কী বলবে।’
-‘কাল রাতে তুমি রাইসাকে রাখতে গিয়েছিলে। এক্সাক্ট কয়টায় সেখানে পৌঁছেছিলে তুমি?’
-‘জেরা করছো তুমি আমাকে?’
-‘না, জেরা করছি না। আমি শুধু উত্তর চাইছি।’
-‘এই বোধহয় আটটা, সাড়ে আটটা।’
-‘আর ওর বাড়ি থেকে কখন বেড়িয়েছো তুমি?’
-‘আটটা পঁয়তাল্লিশের আগেই। ওখান থেকে আফিফের বাড়ি গিয়েছিলাম। এসব তো আমি আগেই বলেছি তোমাকে।”
-‘বেশ। মা, আপনি অনুমতি দিলে আমি আফিফ ভাই আর রাইসা আপুকে বাড়িতে ডাকতে পারি?’
সোহরাব চমকে উঠলো। অনামিকা এমন একটা কথা বলবে সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। অনামিকা কি কোনো কারণে সন্দেহ করছে তাকে? হঠাৎ এত জেরা? কেবল সন্দেহের কারণে নাকি সোহরাবের উপর সীমাহীন রাগ তার!
সাজিয়া শেখ একটু চিন্তায় পড়লেন। ঘরের ব্যাপারে বাইরের মানুষদের ডেকে জানানো বিষয়টা একটু দৃষ্টিকটুই মনে হচ্ছে তার যদিও নিজের ছেলেও অমানবিক আচরণ করেছে। বাইরের লোকের সামনে বাড়ির বউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে কিন্তু আবারো এমন একটা ঘটনা হোক তিনি তা চাচ্ছেন না। অনামিকা বুঝতে পারলো সাজিয়ার মনের কথা। ‘বেশ, আমি ওনাদের কাউকেই ডাকবো না।’ অনামিকার কথায় আশ্বস্ত হলো সোহরাব। যাক, শেষমেশ বিপদ কাটলো। পরে নাহয় অনামিকাকে সত্যিটা বলবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। এখন বললে সে নিশ্চিত বুঝতো না। সেদিন রাতে সোহরাব রাইসার পাথে কথা বলেছে দশটা অবধি। সে রাইসাকে বুঝিয়েছে আফিফের জীবন থেকে সরে যেতে। অনেক বোঝানোর পর রাইসা রাজি হয়েছে। কিন্তু এ কথা সবার সামনে বলে রাইসা আর আফিফের ব্যক্তিগত জীবনকে সবার সামনে আনতে চায়না সে। অনামিকা ঘরে ঢুকে সোহরাবের ফোনটা নিয়ে এলো।
-‘সোহরাব তুমি কি জানতে তোমার ফোনে অটো কল রেকর্ডিং হয়?’
-‘মানে?’
-‘এখনি বুঝবে।’
অনামিকা সকালের রেকর্ডিংটা চালু করলো যেখানে সে আফিফের সাথে কথা বলেছে। আফিফের বলা প্রত্যেকটা কথা প্রমাণ করে দিল সোহরাব সে রাতে আফিফের সাথে ছিল না। সোহরাব মুখ কাঁচুমাচু করে নিচের দিকে চেয়ে রইল। সে ভাবেনি অনামিকা এমন একটা বুদ্ধি বের করবে। অনামিকাকে সে যতটা চালাক ভেবেছিল, তার চেয়ে শতগুণ চালাক মেয়েটা। সাজিয়া রাগী দৃষ্টিতে সোহরাবের দিকে তাকালেন।
-‘সোহরাব এসব কী?’
-‘আম্মা আসলে…’
-‘কোথায় ছিলে তুমি? কেন মিথ্যে বলেছো?’
-‘আসলে আম্মা, আমার কিছু কাজ ছিল তাই..’
-‘মিথ্যে কেন বললে?’
-‘….’
-‘তুমি রাইসার সাথে ছিলে?’
সোহরাব নিশ্চুপ রইল। মায়ের চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলার সাহস তার নেই। সাজিয়া শেখ চেঁচিয়ে উঠলেন।
-‘সোহরাব, তুমি কি রাইসার সাথে ছিলে?’
-‘জ্বী আম্মা।’
সাজিয়া শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একমুহূর্তের জন্য তার সব এলোমেলো লাগল। অনামিকার দিকে তাকালেন তিনি। মেয়েটা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তিনি অনামিকার সামনে দাঁড়ালেন।
-‘অনু, সোহরাব অপরাধ করেছে। এর জন্য সে তোর কাছে দোষী। তোদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আমার কোনো কাজ নেই। তুই সোহরাবকে শাস্তি দিবি। ওর শাস্তিই প্রাপ্য!’
অনামিকা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে সাজিয়া শেখের দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর একটা অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসলো। সোহরাবের গালে সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে দিল অনামিকা। অগ্নিদৃষ্টি মেলে সোহরাব কেবল দেখলো।
-‘আমার উপর মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন আপনি। সত্যি না জেনে আমাকে কতটা আঘাত করেছেন সবাই দেখেছে। দিনশেষে যখন সব মিথ্যে প্রমাণ হলো একবার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। আমাকে কী ভেবেছেন? পাথর আমি? ব্যক্তিগত বিষয় ঘরে মেটাতে হয় এটুকু বুঝ তো আমারই আছে অথচ আপনার নাই। আপনার বিরুদ্ধে তো প্রমাণও দিলাম। এখন আমারো কি উচিত না থাপ্পড়সহ সব আঘাত ফিরিয়ে দেওয়া? আপনার চুলগুলো ধরার মতো হলেও হয়তো আপনার করা কাজটা রিপিট করতাম না। আপনি পশু হতে পারেন, আমি তো নই।’
-‘অনামিকা!’
-‘গলা নামিয়ে কথা বলুন সোহরাব! আমি আপনার বউ, আপনাদ কেনা ক্রীতদাসী নই। আমাকে আমার প্রাপ্য অধিকার আর সম্মান থেকে বঞ্চিত করার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়নি। আর এ থাপ্পড়টা স্ত্রী কর্তৃক একজন অযোগ্য স্বামীর প্রাপ্য ছিল।’
চলবে …