ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৩) কলমে #রেহানা_পুতুল

0
199

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৩)
কলমে #রেহানা_পুতুল
এহসানের কথাগুলো শুনে আমার দুকান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সহসা কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। নির্বোধের মত তার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলাম।

ভাবছি আমার চেনামুখ? কিন্তু কে এই লোভী,প্রলয়ঙ্কারী, বিধ্বংসী নারী?

পা ঘুরিয়ে ফের রুমে তার সামনে গেলাম। দেয়ালকে আশ্রয় করে দাঁড়ালাম।
জিজ্ঞাসু চোখে বললাম,
সুমনা নামের কাউকেতো আমি চিনিনা?

সুমনা তার ছদ্মনাম। কেউই জানেনা। তাই চেননা।

আসল নাম কি তাহলে?

সেটা না হয় পরে জানলে। আগে তাকে তুমি মেনে নাও। আমি এটাই চাই।
সহজ গলায় বলল সে আমাকে।

কিহহ বলে আমি হই হই করে উঠলাম। কর্কশ কন্ঠে হুংকার ছাড়লাম। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকে বললাম,
তোমার নিলজ্জতা, বেহায়াপনা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। তুমি মানুষ না জা’নো’য়া’র? এত বড় মেয়ে ঘরে তোমার। তিন তিনটি সন্তান তোমার। আয়রা বাবা বলতে অজ্ঞান। সেই তুমি কিভাবে পারলে,কেমন করে পারলে সন্তানদের জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির ভাগ বসাতে? তোমাকে দেওয়া তার মেসেজ দেখে বুঝলাম ইতঃমধ্যে তুমি তাকে বিয়েও করে ফেলেছ। এবং রীতিমতো বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার ও শুরু করেছে। মোবাইল তার নাম্বার কালাম দিয়ে সেইভ করেছে। হাউ ফানি! বলে ক্রুর হাসি হেসে উঠলাম।

সন্তানেরা এসব শুনলে বাবা জাতির উপরে তাদের ঘৃণা চলে আসবে। ছিহঃ! ভাবতেও আমার রূচিতে বাঁধছে। এই পুরুষ? তুমি না পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়? ধর্মের কথা বল? হাদিস বল? তোমার ধর্মে বুঝি বলে পরকিয়া করতে? এতে সওয়াব দিগুণ হবে? সেও বা কেমন মেয়েলোক? সব জেনেও তোমার গলায় ঝুলে পড়ল। যদি বিষয়টা এমন হয়,তোমাদের প্রেম বহুবছরের। তাহলে আগে কেন করনি? আর যেহেতু করাই গেলনা আগে। তাহলে জীবনের এই কঠিন পর্যায়ে কেন? সে কিসের নারী? যদি ত্যাগ দিতেই না শিখল? নাই জানল? হুহ!

সে এবার আমাকে ধমকে উঠল। গরম চোখে তর্জন গর্জন স্বরে বলল,
কোনকিছু না জেনে তাকে নিয়ে আর একটি শব্দ উচ্চারণ করলে তোকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব আমি।

এহসানের পরিবর্তিত হীন আচরণ দেখে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। মুহুর্তেই দুলে উঠল আমার গোটা পৃথিবী। অনুভব করতে লাগলাম আমার পায়ের নিচের মাটি ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি লবন ছিঁটে খাওয়া জোঁকের মত একটু একটু করে কুঁকড়ে যাচ্ছি হাত পা গুটিয়ে। আমার নিরীহ বেহাল দশা দেখে সে আড়ালে বিজয়ের হাসি হাসল।

আমার দিকে চেয়ে বলল,
শিলা একটু শান্ত হও। প্লিজ আমার কথা শোন। যদিও আমি জানি বিষয়টা অশান্ত হওয়ার মতই। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। এক অসহায় নারীর সহায় হওয়া আর তিনটে এতিম বাচ্চার মাথায় পিতৃস্নেহ দেওয়াই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য। এটাতো আমাদের নবীও করেছে আর হাদীসেও আছে।

আমি শূন্যচোখে অন্যদিকে মুখ করে আছি না শোনার বাহানায়। মনে মনে বলছি হায়রে বাটপার,শঠ,প্রতারক! ধোঁকাবাজের ও লিমিট থাকে। শ’য়’ তা’ ন লু’ ই’ চ্চা কোথাকার। হাদীস, ধর্মে, নবী কোনভাবে কিভাবে বলছে। এসব কি আমি জানিনা মনে করছিস।

সে বলতে শুরু করল,
আজ হতে ষোল বছর পূর্বের কথা। টগবগে যুবক আমি। উদ্দাম প্রেমের স্রোতে ভেসে যাওয়ার জন্য মোক্ষম সময়। চটুল বয়স। খুব মন চাইতো চুটিয়ে প্রেম করি। কিন্তু ভালোলাগার মতো কোন মেয়েই পাচ্ছিনা।
এদিকে যেহেতু আমি মাদ্রাসা লাইনে কয়েকবছর পড়াশোনা করেছি। তো সেখানের কঠোর বিধিনিষেধ ছিল মেয়েদের দিকে সরাসরি দৃষ্টি না দেয়া। এতে চোখের ও যেনা হয়। কিন্তু মন হলো দুরন্ত লাগামহীন ঘোড়া। কিভাবে থামাই। কিভাবে আটকাই। তবুও প্রেমটা আর হয়না আমার।

গ্রামের একটি প্রাইভেট ব্যাংকে জবে ঢুকেছি মাত্র। সেই ব্যংকে সুমনার একটি একাউন্ট ছিল। একদিন সকালে সে ব্যাংকে এলো। তার পরনে ছিল কালো একটি বোরকা। মুখে নেকাব পরিহিত। তবুও আন্দাজ করতে সময় লাগলনা আমার সে যে একটা যুবতী মেয়ে।
শুধু দীঘির কালো জলের মত তার স্বচ্ছ চোখদুটো দেখা গেল। আমি পলকেই সেই কাজলটানা নয়ন দুটির অতলান্তে তলিয়ে গেলাম।

তো ব্যাংকের ফরম পিলাপের বিষয়ে সে আমার কাছে হেল্প চাইল। আমি দেখিয়ে দিলাম। তার সাথে এসেছে সিনিয়র এক পুরুষ। সেই ভদ্রলোক একটু দূরে সোফায় বসা ছিল। আমি প্রসঙ্গগত সুমনাকে বললাম,
আপনার সাথের উনি কি আপনার মামা বা কাকা?

ও বলল,
নাউজুবিল্লাহ ভাইয়া। কি বলেন না জেনে। উনি আমার হাজব্যন্ড।

আমি তব্দা খেলাম শুনে। বেকুবের মতো এদিক ওদিক চাইলাম খানিক। এ যেন সূচনাতেই সমাপ্তি। শুরু না হতেই শেষ।
দূর্বার কৌতুহল নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
আপনি মেরিড? কোন গ্রামের বধু আপনি? আপনি কি উনার দ্বিতীয় স্ত্রী? আপনার এইজ…? বলে বললাম, সর‍্যি ডোন্ট মাইন্ড। বেশী বলে ফেললাম।

না না। আমি কিছু মনে করিনি ভাইয়া। এই প্রশ্ন রোজ কয়েকবার শুনতে হয়। আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আমার বয়স বাইশ। উনি আমার বাইশ বছরের সিনিয়র। এই পাশের গ্রাম আমাদের। সুজায়েতপুর। আর আমিই উনার প্রথম আমিই উনার শেষ।

আমি আর কিছুই বলতে পারলামনা। সেই কাজল চোখে ঠায় চেয়ে রইলাম ধ্যানমগ্ন মুনিঋষির মতো। সে অন্যের স্ত্রী। এটা জেনেও খানিক আগের সেই অসীম ভালোলাগাটা মিলিয়ে গেলনা। বরং সেটা আরো ঘনীভূত হলো জমাট বাঁধা ক্ষীরের মতন।

ব্যাংকের তার টাকার লেনদেনের সুবিধার্থে আমার মোবাইল নাম্বার টুকে দিলাম তাকে৷ উদ্দেশ্য যোগাযোগের মাধ্যম সৃষ্টি করা। এভাবেই তার সাথে মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প আলাপ হতো ফর্মাল স্টাইলে। আমাদের মাঝে সখ্যতা ঘটে। সখ্যতা রূপ নেয় বন্ধুত্বে।সময়ের রথে চড়ে তা হয়ে উঠে প্রণয়।

তার দুই বছর পর পারিবারিকভাবে তোমাকে বিয়ে করতে হয়। তবে জোর করে নয়। আমি তোমাকে পছন্দ করেছি এবং এখনো করি।

একথা শুনেই মন চেয়েছে তার জিহবাটা এক কোপে কেটে ফেলি। মিথ্যুক।
সে আরো বলতে লাগল,
যেহেতু সে অন্যের স্ত্রী। আমিও বিয়ে করে ফেলেছি। কিছুই করার নেই। ভালোবাসাকে জলাঞ্জলী দিয়ে দিলাম। একে একে সেও তিন সন্তানের মা হয়। আমিও হই তিন সন্তানের বাবা।

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মমলীলা। দুই বছর আগে আকস্মিক তার সেই বয়স্ক স্বামীটা মারা যায় ব্রেনস্ট্রোক করে। সে পড়ে গেল অকূল পাথারে। এ যেন দুজন দুজনকে পাওয়ার জন্য বিধাতা স্বয়ং একটা লুকানো রাস্তা বানিয়ে দিল।

আমি জহর গিলছি যেন জোর করে। হজম হচ্ছেনা কিছুতেই। আমার ভিতরটা ঠেলেঠুলে বের হয়ে সব উগরে দিতে চায় তার গায়ের উপরে। নিজের হাতকে মুঠোবন্দী করে বসে রইলাম। বুকের ভিতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নিরপরাধ আমাকে এহসান টেনেহিঁচড়ে একশো দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করল। আমি বাঁচবার আকূল চেষ্টায় ভুবন কাঁপিয়ে আর্তচিৎকার করছি। আর আমার তিন সন্তান মাকে রক্ষা করার জন্য দিগবিদিক প্রাণপণে ছুটাছুটি করছে। তারা কি সত্যিই পারবে তাদের শিলা মাটাকে বাঁচিয়ে তুলতে।

আচম্বিতে হা’রা’মিটা শক্ত করে আমার দুহাত চেপে ধরল। করুণ কন্ঠে বলল,
শিলা ওকে নিয়ে আসব আমাদের কাছে। তুমি মেনে নিলে সারাদুনিয়াও ওর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। সব তোমার কাছে। আমি তোমাদের দুজনকে আজীবন ভালোবাসায় আর যত্নে রাখব। আমার দায়িত্বের এতটুকু হেরফের হবেনা। এই তোমার মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি।

চলবে ঃ ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here