#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১০
মন মেজাজ ভালো না অথৈর।একটু আগে ওর মা এসে বলে গেছেন ওকে নাকি দেখতে আসবে।ওকে আর ইহানকে তাই আজ ভার্সিটি যেতে দেয়নি।ইহানও বেশ রাগারাগি করেছে এই নিয়ে।কিন্তু ওর মা বলছে ছেলের পরিবার নাকি অনেক ভালো।আর তাছাড়া দেখতে এসে তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাহ।অথৈ আর ইহানের রাগারাগিতেও কাজ হয়নি।অসহ্য লাগছে অথৈর।মাত্র ভার্সিটিতে উঠেছে ও।আর এখনই কিসের দেখাদেখি শুরু করে দিয়েছেন।অথৈ মন খারাপ করে ছাদে দোলনায় বসে আছে। না চাইতেও চোখে জল চলে আসছে অথৈর।হঠাৎ দোলনায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকায় অথৈ।দেখে ওর বাবা আজিজুর সাহেব এসে বসেছেন ওর পাশে।অথৈর মন খারাপ সেটা দেখে ওর বাবা মুঁচকি হাসলেন।আদুরে হাতে স্পর্শ করলেন মেয়ের মাথায়।বাবার স্নেহে যেন অথৈর চোখের বাধ ভেঙে গেল।চোখের জল গড়িয়ে পরল গাল বেয়ে।আজিজুর সাহেব যত্ন করে মেয়ের চোখের জল মুছে দিলেন।অথৈ ভেজা কণ্ঠে ওর বাবাকে বলে উঠল,
‘ বাবা?আমি কি তোমাদের কাছে বেশি হয়ে গিয়েছি?যে আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইছ?’
আজিজুর সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।আদুরে কণ্ঠে বললেন,
‘ কে বলেছে আমার মেয়ে আমাদের কাছে বেশি হয়ে গিয়েছে?’
‘ তাহলে বিয়ে কেন দিতে চাইছ?’
আজিজুর সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘ দেখ মা।বিয়ে আজ হোক কাল করতেই হবে। আর তাছাড়া দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না তাই নাহ?’
অথৈ কাঁপা গলায় বলল,
‘ কিন্তু আমি শুনলাম ছেলের নাকি আমাকে পছন্দ হলেই মা আমাকে এখানেই বিয়ে দিবে।’
‘ তুই ভুল শুনেছিস।দেখ মা পরিবারটা অনেক ভালো।এতো ভালো পরিবার সচরাচর দেখা যায় না।নিজেকে নিজে ভালো বললে হয় না মা।দশজন লোক যাকে ভালো বলে তারাই আসলে ভালো মানুষ।খোজখবর নিয়ে দেখেছি।আসলেই তারা অনেক ভালো।তুই সুখি হবি মা।আমরা কি কখনও তোর খারাপ চাইবো আমার সোনা মা?তুই তো জানিস আমরা তোকে কতোটা ভালোবাসি।মা আমার আমাদের ভুল বুঝিস নাহ।ইহানটাও রাগ করে আছে।তবে একদিন দেখিস এই আমাদের কথা শুনে এখানে বিয়ে করলে তুই নিজেই এসে আমাদের বলবি। বাবা আমার থেকে সুখি বোধহয় কেউ হবে না।আমার কথাটা মিলিয়ে নিস। আর তাছাড়া পছন্দ হলেও। আমরা শুধু বাগদানটা করিয়ে রাখব।এতো তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের মেয়েকে বিদায় দিবো না।এখন কান্না বন্ধ করে দে মা।তোর চোখের জল আমি সহ্য করতে পারি নাহ।এভাবে কাঁদলে আমি অপরাধবোধে ভুগব মা। ‘
অথৈ বাবার বুক থেকে উঠে সোজা হয়ে বসল।তারপর চোখের জলগুলো মুছে নিল।ওর বাবার প্রতিটা কথা ওর উপর খুব প্রভাব ফেলল।যেহেতু ওর বাবা আর মা বলছে ছেলেরা অনেক ভালো।তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হবে।মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে আজিজুর সাহেব গলা খাকারি দিলেন।অথৈ উনার দিকে তাকাতেই তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলে উঠলেন,
‘ তুই কি একেবারেই রাজি না?মানে তোর কি কোনো পছন্দ আছে মা?আমাদের বলতে পারিস। তাহলে আমি উনাদের মানা করে দেই।’
অথৈ বাবার কথায় আঁতকে উঠল।ওর বাবা উউল্টাপাল্টা ভাবছে।অথৈ দ্রুত নাবোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ না বাবা। এমন কিছুই না।তুই ভুল ভাবছ আমাকে।’
‘ ভুল ভাবছি না রে মা।শুধু জিজ্ঞেস করলাম।আমি জানি আমার মেয়ে এমন কিছুই করবেন না।’
অথৈ সস্তির নিশ্বাস ফেলল।আজিজু র সাহেব ফের বলেন,
‘ তাহলে কি তুই রাজি? ‘
অথৈ লম্বা শ্বাস ফেলল।মাথা দুলিয়ে বলে,
‘ হ্যা আসতে বলো।’
‘ মন থেকে বলছিস?নাকি আমাদের উপর রেগে আছিস এখনও?’
অথৈ ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তাকাল ওর বাবার দিকে।ওর বাবার কাধে মাথা রেখে উনার বামহাতটা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ উহু! একদম রাগ করে নেই আমি।আমি জানি আমার বাবা মা আমার জন্যে বেস্টটাই করবেন।’
‘ যাক মনে শান্তি দিলি মা।’
—————
অথৈ অস্থির হয়ে ঘরের এপাশ ওপাশ করে চক্কর কাটছে।গায়ে ওর নীল রঙের শাড়ি জড়ানো।তার উপর হালকা একটু সেজেছে।রিধিকে ফোন করেছিল। ও বলল রিধি নাকি ওর পরিবারের সাথে ওর মামার বাড়ি গিয়েছে।আর পিহুটা ফোনই ধরছে না।তাই আহিদকে ফোন করেছিল।ওইটা আর প্রিয়ান নাকি দূরে কোথায় ট্রিপে চলে গিয়েছে।আর এইজন্যেই পিহু রাগ করে কারো সাথে কথা বলছে নাহ।মাত্র একদিন ভার্সিটি ছুটিয়ে পেয়ে এদের তিড়িংতিড়িং শুরু।ওদের একটু মন খারাপও হলো।হঠাৎ করে এমন অথৈকে দেখতে আসবে ওর পাশে নেই।অথৈ ওদের মন খারাপ হয়েছে বুঝতে পেরে আর বেশি ঘাটলো না।ওরা অথৈর কথায় একটু শান্ত হয়।পরে ওরা ফোনে শুধু অথৈকে শান্তনা দিয়েছে।হঠাৎ ওর ঘরে আসলেন।উনাকে দেখেই অথৈ বুঝল তারা এসে পরেছে।অথৈর কেমন যেন ভয় লাগছে।গলা শুকিয়ে আসছে।মেয়ের শুকনো মুখ দেখে মিনহা বেগম বলে উঠলেন,
‘ ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।তোর বাবা আর আমারও এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল।আমাদেরই দেখ আমরা কতো সুখি।অভিভাবকদের দোয়ায় সবটা ভালই হয় মা।আমার কথা মিলিয়ে নিস।এখন একটু শান্ত হো।আমরা আছি তো।’
অথৈ মাথা দুলালো।ওর মা ওকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন।অথৈর চোখ নিচের দিকে।ভয়,অস্থিরতায় চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা।অথৈ দৃষ্টি নত রেখেই সালাম জানালো।কয়েকজনের কণ্ঠে একত্রে সালামের জবাব শোনা গেল।এর মাঝে শুধু একজন মেয়ে সেটা ও বুঝতে পেরেছে।এদিকে ইহানের চটরচটর কথা ওর কানে আসতেই ওর ভ্রু-কুচকে আসে।একটু আগেই না ওকে দেখতে আসবে সেজন্যে কি রাগারাগি করল।এখন এমন ফটফট করে কথা বলছে।ওর কণ্ঠে যেন আনন্দের ঝিলিক।আর এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা ওর কতো আগের চেনা।অথৈর রাগ লাগছে ইহানের প্রতি।হঠাৎ পাশ থেকে সেই চিকন মেয়েলি কণ্ঠের আওয়াজ ওর কানে আসল,
‘ দাদু আপনি ঠিক বলেছেন।মেয়েটা ভারি মিষ্টি।দেখি আন্টি ওকে আমার পাশে এসে বসান।’
মিনহা বেগম হেসে অথৈকে তার পাশে বসালো।মেয়েটি ফের বলে,
‘ এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?চোখ তুলে দেখবে না আমাদের?না দেখলে হবে?দেখি তাকাও আমাদের সবার দিকে।সবাইকে দেখে নেও।’
মেয়েটির জোড়াজুড়িতে অথৈ তাকাতে বাধ্য হলো।কিন্তু সামনে তাকাতেই ওর চোখ কপালে উঠে গেল।কারন ওর সামনে বসে আছে সেদিনের সেই লোকটা।যিনি মাঝরাস্তায় তার নাতির জন্যে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল ওকে।আতিক মাহাবুব অথৈর রিয়েকশন দেখে হেসে দিলেন।অথৈদের পরিবার উনার হাসি দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।মূলত তারা কিছুই বুঝতে পারছেন না।আতিক মাহাবুব অথৈর অবাক হওয়া মুখশ্রী দেখে ভ্রু নাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
‘ কি অবাক হলে মেয়ে?তুমিই তো বলেছিলে তোমার বাড়িতে যেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই।’
আজিজুর সাহেব উনার কথা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করেই ফেললেন,
‘ মানে বুঝলাম না।আপনি কি একটু বুঝিয়ে বলবেন?’
আতিক মাহাবুব হেসে উঠলেন।তারপর একে একে সেদিনের ঘটনা সব খুলে বললেন।কাহিনি শুনে বাকিরাও অবাক হলেন।পরক্ষনে সবাই হাসল। আতিক মাহাবুব এইবার হাসি থামালেন।তারপর অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘ এইদিকে তাকাও।সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’
তিনি তার ছেলেকে দেখিয়ে বলেন,
‘ এই হলো আমার ছেলে আরহাম মাহাবুব মির্জা।’
আরিয়ানকে দেখিয়ে বলে,
‘ এই হলো আমার বড় নাতি আরিয়ান তাশরিফ মির্জা।’
রোজাকে দেখিয়ে বলল,
‘ এই হলো আমার বড় নাতবউ আফরোজা উর্মি। আমরা ছোটো করে রোজা ডাকি।’
অথৈ একে একে সবাইকেই সালাম জানাল।
এরপর রুদ্রিককে দেখিয়ে বলে,
‘ এই হলো আমার ছোটো নাতি আরিহান রুদ্রিক মির্জা। যার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব এনেছি আমি।’
রুদ্রিকের দিকে তাকাতেই অথৈ যেন চারশো চল্লিশ বোল্টের ঝটকা খেল।চোখগুলো বেড়িয়ে আসার উপক্রম।ওর মুখটা হা হয়ে গিয়েছে।রুদ্রিক ওর দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে।আর অথৈ ভাবছে।রুদ্রিক?তার মানে রুদ্রিকের জন্যে ওকে বউ করে নিতে চাইছেন আতিক মাহাবুব।এদিকে অথৈয়ের রুদ্রিককে দেখে এমন ভয়ানক রিয়েকশন দিতে দেখে সবাই বেশ অবাক হলেন।রোজা ওর কানে ফিসফিস করে বলল,
‘ কি হলো অথৈ?তুমি রুদ্রিকের দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছ কেন?’
রোজার কথায় অথৈ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল।এইজন্যেই ও ভাবছিল ভাই হঠাৎ এইভাবে কেন নিজের মুড পরিবর্তন করে নিল।অথৈ দুহাতে মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিল।রুদ্রিকের সাথে ওর বিয়ে? ভাবলেই তো কেমন একটা লাগছে।না এটা হতে পারে না।এটা সম্ভব না।রোজা অথৈকে এমন করতে দেখে প্রশ্ন করল,
‘ কোনো সমস্যা অথৈ?’
‘ ন…না।আমি ঠিক আছি।’
মুখে এটা বললেও ওর মন জানে ও ঠিক নেই।এর মধ্যে আতিক মাহাবুব বলেন,
‘ মেয়ে আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে আজিজুর সাহেব।এইবার নাহয় ছেলেমেয়েদের আলাদা করে কথা বলতে পাঠানো হোক।তাদেরও তো মতামতের গুরুত্ব আছে।’
আজিজুর সাহেব হেসে মাথা নাড়ালেন।তারপর অথৈকে বলেন,
‘ অথৈ আম্মু যাও রদ্রিককে নিয়ে তোমার রুমে যাও।’
না চাইতেও অথৈকে উঠতে হলো।তারপর সামনের দিকে পা বাড়ালো।রুদ্রিক অথৈর পিছনে পিছনে চলল।
__________
অথৈ আর রুদ্রিক অথৈয়ের রুমে আসলে।অথৈ নিজে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।তারপর রাগি চোখে তাকায় রুদ্রিকের দিকে।ওকে এইভাবে রেগে তাকাতে দেখে রুদ্রিক বাঁকা হাসল।রসিকতার স্বরে বলে,
‘ আরে কি করছ?এখনি দরজা আটকাচ্ছ কেন?আমাদের বিয়ে এখনও হয়নি।’
অথৈ যেন রুদ্রিকের এমন রসিকতায় আরোও রেগে গেল।দাঁত কিরমির করে বলে,
‘ এটা কেমন ফাইজলামি?আর কিসের বিয়ের কথা বলছেন?আমি আপনাকে বিয়ে কোনোদিন করব নাহ।’
‘ কেন করবে নাহ?’
বেশ ঠান্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করল রুদ্রিক।অথৈ জবাবে বলে,
‘ এমনি আপনাকে আমার ভালোলাগে নাহ।’
রুদ্রিক গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ কেন ভালো লাগে নাহ?কি করেছি আমি?আমার চেহারা খারাপ?নাকি আমি কোনোদিক দিয়ে প্রতিবন্ধি?মেয়েবাজি করি?না জুয়া খেলি?না তোমার সাথে কোনোদিন অসভ্যতামো করেছি?বা অন্য মেয়েদের সাথে করেছি?কোনটা?’
রুদ্রিকের একের পর এক প্রশ্নে অথৈ দমে গেল।ঠিক কি উত্তর দিবে জানা নেই অথৈর।রুদ্রিক দেখতে কেন সুন্দর।শ্যামবর্ণের গায়ের রঙ,লম্বাচওড়া, পেটানো, শক্তপোক্ত,সুঠামদেহির রুদ্রিককে যে কোনো মেয়ে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলবে।আর রুদ্রিকের মাঝে কোনো বাজে স্বভাব দেখেনি অথৈ।শুধু সিগারেট খাওয়া ছাড়া।অথৈকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্রিক নিজেই বলল,
‘ কি হলো? চুপ করে আছ কেন?উত্তর দেও।যদি আমার কোনো একটা দোষ তুমি দিতে পারো তবে আমি নিজে বিয়ে ভেঙে দিব।’
‘ না এর কোনোটাই নাহ।’
‘ তাহলে?’
‘ জানি না।শুধু আপনাকে বিয়ে করতে পারব নাহ।’
রুদ্রিক কদম বাড়িয়ে অথৈর সামনে চলে আসল।অথৈ ওর থেকে অনেকখানি খাটো।তাই রুদ্রিক ওর দিকে ঝুকে ওর চোখে চোখ রেখে বলে,
‘ আমাকে রিজেক্ট করছ।ফলাফল কিন্তু ভালো হবে নাহ।আর জানো তো যেটা কেউ রুদ্রিককে করতে বারন করে।সেটা রুদ্রিক আরও আগ্রহ নিয়ে করে।আমি নিচে গেলাম।উত্তরটা যেন হ্যা হয়।নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে নাহ।’
রুদ্রিক ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।অথৈ রুদ্রিকের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রাগে বিরবির করে ওকে কয়েকটা গা’লি দিল।লোকটা এমন ত্যাড়া।তবে ও নিজেও কারো থেকে কম না।ও রুদ্রিককে বিয়ে করবে না।
#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।মন ভালো না থাকায় কি লিখেছি নিজেও জানি না।একটু মানিয়ে নিবেন।