#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৩
মেঘালয় রাজ্যে এসেছে।ঘোরাঘুরি কি থামে এতো সহজে?গতকাল ওরা বিকেল থেকে সন্ধ্যার অনেক পর পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করেছে।তারপর কটেজের বাহিরে বোন ফায়ারের আয়োজন করে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছে।এবং হ্যা রাতের ডিনারটাও নিজেরাই রান্না করে খেয়েছে।এতে অবশ্য কটেজের ম্যানেজারকে কিছু টাকা দিতে হয়েছে।ম্যানেজারকে এটাও জানালো যে কয়দিন ওরা এখানে আছে।মাঝে মাঝে বোনফায়ারের আয়োজন করবে।এতে যেন সমস্যা না হয়।টাকা যতো লাগবে দেওয়া হবে।আজ সকাল সকাল উঠেছে ওরা।বেশ শীত পরেছে এখানে।অথৈ ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারে না।মেয়েটা উঠতেই চাইছিলো না।তার কথা অনুযায়ী এই ঠান্ডার মধ্যে কোন পাগল কম্বলের উষ্ণতা বাদ দিয়ে ঘোরাঘুরি করবে।রুদ্রিক জোড়াজুড়ি করে এনেছে।তার জন্যে মেয়েটা এখন মুখ ফুলিয়ে আছে।অথৈয়ের এমন অবস্থা দেখে পিহু ওর কাছে আসল।জিজ্ঞেস করে,’ কিরে তোর আবার কি হয়েছে?সকাল সকাল মুখটাকে এমন মিষ্টি কুমড়ার মতো করে রেখেছিস কেন?’
অথৈ রাগি চোখে তাকালো।
‘ তোর আমাকে দেখে মিষ্টি কুমড়ার মতো মনে হচ্ছে?’
‘ ওই মুখটা ফুলিয়ে রেখেছিস।এইজন্যেই তো বললাম।’
‘ তো তুই এটা বলতে পারিস।কিন্তু তাই বলে মিষ্টি কুমড়া বলবি?’
অথৈয়ের সাথে না পেরে পিহু বলে,’ হয়েছে আমার মা।ক্ষমা দে আমাকে।আমি তোকে মিষ্টি কুমড়া বলব নাহ।’
‘ হু!’
‘ তা এখন বল এমন করে আছিস কেন?’
পিহুর প্রশ্নে অথৈ আঁড়চোখে রুদ্রিকের দিকে তাকালো।লোকটা সাফাত আর অনিকের সাথে কি যেন কথা বলছে।অথৈ মুখ ভেঙিয়ে নজর সরিয়ে নিলো।বলল,’ ওই বজ্জাত লোকটা।আমাকে এই ঠান্ডার মাঝে সাত সকালে টেনে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে।তুই তো জানিস আমার ঠান্ডা একদম সহ্য হয় না।আমার কথা লোকটা শুনলই নাহ।’
পিহু হা করে শুনল অথৈয়ের কথা।ফের অবাক হয়ে বলে,’ শীত পরেছে এই কারনে তুই ঘুরতে যাবি না। লাইক সিরিয়াসলি?’
অথৈ মাথা দুলালো।পিহু নাক মুখ কুচকে ফেলে বলল,’ তো এখানে এসেছিস কেন তাহলে?যদি ঘুরতেই না যেতে চাস? এখানে আসার আইডিয়া কিন্তু তুই নিজেই দিয়েছিস।’
অথৈ বিরবির করল,’ হ্যা আইডিয়া দিয়ে বড্ড অপরাধ করে ফেলেছি।’
পিহু বুঝতে পারল না অথৈয়ের কথা।কিন্তু কিছু বলতে যাবে।তার আগেই সেখানে প্রিয়ান আসল।এসেই বলে,’ চল যাওয়া যাক।’
‘ কিন্তু আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?’ প্রশ্ন করল পিহু।
জবাবে প্রিয়ান বলে,’ আপাতত লিভিং রুট ব্রিজ দেখতে যাবো।এরপর কোথায় যাবো তার লিস্ট সাফাত ভাইয়ার কাছে।’
সবাই ওরা গিয়ে দাঁড়ালো ভাড়া করা গাড়ির সামনে।একজন একজন করে গাড়িতে উঠছে।রুদ্রিক আর সাফাত গাড়িতে উঠতে যাবে।এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ায় আরহা সাথে আরও ওর পাঁচজন বন্ধু।মোট ছয়জন তারা।আরহাকে দেখেই সাফাতের কপাল কুচকে আসে।এই মেয়ে আবার এখানে কেন এসেছে?আরহা ড্যাবড্যাব করে সাফাতের দিকে তাকিয়ে আছে।তা দেখে সাফাতের বিরক্তি যেন আরও দ্বিগুন বেড়ে গেলো।প্রায় একপ্রকার ধমকের সুরে বলে,’ এই মেয়ে তুমি এখানে এসেছ কেন?’
আরহা দাঁত বের করে হাসি দেয় সাফাতের কথায়।তার বেশ লাগে সাফাতকে রাগাতে।আরহা বলে,’ ভাইয়া আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ সেটা তুমি জেনে কি করবে?’
সাফাতকে একটা মেয়েকে এমন ধমকাধমকি করতে দেখে।রুদ্রিক বলে উঠল,’ সাফাত কে এই মেয়ে?আর তুই-ই বা এর সাথে এমন করে কথা বলছিস কেন?’
সাফাত নাক মুখ কুচকে বলে,’ আরে আর বলিস না দোস্ত।কাল তো তোরা সব ঘুমোচ্ছিলি।আমার ঘুম আসছিলো না তাই বাহিরে এসে ওইযে একটা বড় গাছ আছে না আমার কটেজ বরাবর সেখানে বসেছিলাম।কোথা থেকে যেন এই মেয়ে আসল।এসেই বলে তাকে হ্যাল্প করতে।আর হ্যাল্প টা জানিস?বলে কিনা তার একটা ছবি তুলে দিতে।ওইযে বেগুনি রঙের ফুল ফুটেছে গাছটায় সেখানে।আমিও সরল মনে রাজি হলাম।কিন্তু ছবি তুলার জন্যে ফোন চাইলে এই মেয়ে বলে ফোন আনেনি।পরে বলে আমার ফোন দিয়ে ছবি তুলে দিতে।আমি রাজি হতে চায়নি।কিন্তু এই মেয়ে নাছোরবান্দা ছবি তুলবেই তুলবে।শেষে দিলাম ছবি তুলে।এরপর আমার হোয়াইটসএ্যাপে এড হয়ে একে ছবিগুলো পাঠিয়ে দেই।’
সব শুনে রুদ্রিক বলল,’ তো কি হয়েছে?এখানে এমন করার কি আছে?ছবিই তো তুলে দিয়েছিস।’
সাফাত বিরক্ত কণ্ঠে বলে,’ তুই বুঝবি না।গতকালকের থেকে এই মেয়ে আমার পিছু ছাড়ছেই না।’
আরহার এইবার রাগ লাগলো।লোকটা ভাবে কি নিজেকে।কখন থেকে ওকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলছে।আরহা রাগি গলায় বলে,’ থামুন আপনি।এইযে আপনি শুনেন ভাইয়া।আপনি কি আমায় দেখেছেন উনাকে বিরক্ত করতে?’
রুদ্রিক মাথা দুলিয়ে না বোঝালো।আরহা তা দেখে বলে,’ তাহলে প্রমান হয়েই যায় এই লোক মিথ্যে বলছে।আমি কখন আপনাকে বিরক্ত করেছি,হ্যা?’
সাফাত এইবার কি বলবে ভেবে পেলো না।এই মেয়ে তাকে কাল ইশারা দিয়ে দিয়ে কি কি করেছে তা আর কিভাবে বলবে?এমনিতেও এসব বলা ঠিক মনে করল না।মেয়েটা কষ্ট পেতে পারে।তাই সাফাত ওই প্রসঙ্গ পালটে বলে,’ আচ্ছা সেসব বাদ।এখন বলো এখানে কেনো এসেছ?’
আরহার রাগি কণ্ঠ,’ আপনাকে কেন বলব?আমি এই ভাইয়াটাকে বলব।এই ভাইয়াটা ভালো আছে।আপনার মতো খারুস না।যে কথায় কথায় ধমকায়।’
সাফাত আশ্চর্য হয়ে গেলো।এই মেয়ের সাহস কতো বড়ো ওর বন্ধুদের সামনে ওর নামেই উল্টাপাল্টা বকছে।’
সাফাত ধমক দেয়,’ এই মেয়ে?তুমি কাকে কি বলছ মাথা ঠিক আছে?’
আরহা দুঃখী দুঃখী করে নিলো।কাঁদো গলায় বলে,’ দেখেছেন ভাইয়া?দেখেছেন আপনি?আপনার বন্ধু আমার সাথে কিরকম বেহেইব করছে?’
রুদ্রিক সাফাতের দিকে তাকিয়ে বলে,’ এই সাফাত?তুই ওকে ধমকাচ্ছিস কেন?’
‘ উফ! আমি যাচ্ছি।তোর যা করার কর।’
এই বলে সাফাত গাড়িতে উঠে বসল।এদিকে গাড়ির ভীতরে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে বাহিরের দিকেই তাকিয়ে আছে।ইহান নেমে আসল গাড়ি থেকে। এসেই আরহাকে জিজ্ঞেস করে,’ তোমার কি কোনো হ্যাল্প লাগবে?সরি তুমি করেই বললাম।তুমি বয়সে আমার অনেক ছোটোই হবে। দেখে বোঝা যাচ্ছে।’
আরহা হেসে বলে,’ না না ভাইয়া।সমস্যা নেই।আপনি তুমি করেই বলুন।ইনফেক্ট আপনারা সবাই আমাকে তুমি করেই ডাকুন।’
রুদ্রিক বলে,’ এখন বিষয়টা আমাদের বলো?কোনো সমস্যায় পরেছ কি তুমি?’
আরহা আমতা আমতা করতে লাগল।মুখ উঠিয়ে এখানে চলে তো এসেছে।এখন কথাটা বলতে কেন যেন লজ্জা লাগছে।এভাবে বন্ধুদের মাঝে অন্য মানুষরা এসে জয়েন হলে সবারই বিরক্ত লাগবে।আরহাকে আমতা আমতা করতে দেখে ইহান ওকে আসস্থ করতে বলে,’ তুমি নির্দ্বিধায় আমাদের বলো?ওতো ইতস্ততবোধ করার কিছু হয়নি।’
আরহা যেন ভড়সা পেলো।তাই মনের কথাটাই বলল,’ আসলে ভাইয়া আমরা এখানে ছয়জন ফ্রেন্ডরা এখানে এসেছি একসাথে।এখানে এসে একজন গাইড ভাড়া করেছিলাম।এখন সে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পরেছে।অন্য গাইড ভাড়া করতে চেয়েছিলাম।তাও পায়নি।এখন একা একা এভাবে ঘুরতে পারছি না।আসলে কিছু চিনি না তো?আপনাদের দেখে ভালো মনে হলো।আবার আমরা একই দেশের মানুষ।আপনার ফ্রেন্ডদের সাথে তো কাল কথা হয়েছিলো।তাই বলতে চেয়েছিলাম আপনারা আমাদের এই ছয়জন কে কি আপনারা আপনাদের গ্রুপে নিবেন?মানে আপনাদের সাথে আমরা ঘুরতে চাই।তাহলে একটা ভড়সা পাবো আর কি।’
রুদ্রিক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।আসলে এখানে সে কি বলবে?তার একার মতামতে তো আর হবে না।এখানে আরও বাকিরাও আছে।রুদ্রিক এইবার গাড়ির ভীতরে সবার দিকে তাকালো।প্রশ্ন করল,’ আমার একার কথায় তো আর হবে না।তোমরা কি বলো?’
অথৈ ভাবল।এখানে তো আর তারা তাদের ঘাড়ে উঠে বসবে না।ব্যস শুধু ওদের সাথে সাথে থাকবে।ওরা যেখানে যাবে এই মেয়ে আর তার বন্ধুরাও সেখানে যাবে।তাছাড়া রুদ্রিক,ইহান,সাফাত,অনিক,নীল,প্রিয়ান আর আহিদ এতোগুলো ভড়সাযোগ্য ছেলে আছে ওদের সাথে।সমস্যা হবে না।আর মেয়েটার সাথে মাত্র দুটো ছেলে।তাই অথৈ বলে,’ আমার কোনো সমস্যা নেই।কিরে তোরা কি বলিস?চলুক আমাদের সাথে।তারা তো নিজেদের মতোই হাটবে।শুধু আমাদের সাথে থাকবে এই।’
সবাই রাজি হয়ে গেলো।ওরা এইবার আরেকটা গাড়ি ভাড়া করল।মোট তিনটে গাড়ি নিয়েছে ওরা।গাড়িগুলো রওনা হলো গন্তব্যের দিকে।
এদিকে গাড়িতে ইহান রিধির পাশেই বসেছে।রিধি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।তার মোটেও ভালোলাগেনি।ইহান মেয়েটার সাথে সেধেসেধে কথা বলেছে এইজন্যে।কেন যাবে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে?রুদ্রিক ভাই তো কথা বলছিলই।সে কেন গেলো গাড়ি থেকে নেমে?
কই তার সাথে তো কোনোদিন আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি।রিধির রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।হাতের মুঠোয় ওড়না নিয়ে তা দুমড়েমুচড়ে নিজের রাগ মেটাতে চাইছে।এদিকে ইহান সবটাই খেয়াল করছে।কিন্তু বুঝতে পারছে না।হঠাৎ মেয়েটার হলোটা কি?কেন এমন রাগে লাল হয়ে আছে।ইহান ধীর কণ্ঠে এইবার বলে উঠল,’ রিধি?এনি প্রবলেম?এমন রেগে আছ কেন?’
রিধি এমন দৃষ্টি ছুড়ে মারল ইহানের দিকে।যেন এই চোখের দৃষ্টির আগুনেই ইহানকে ঝলসে দিবে সে।ইহান আমতা আমতা করে বলল,’ আরে?এভাবে তাকাচ্ছ কেন?সমস্যাটা কি বলবে তো?’
রিধি এইবার মুখ খুললে।অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলে,’ আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না একদম বলবেন না।কথা বললেই ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিবো আপনার।আর আমার সাথে এইভাবে চিপকে বসেছেন কেন?দূরে সরুন।একমিনিট আপনি আমার পাশেই বা বসেছেন কেন?ওই মেয়েটার পাশে গিয়ে বসেননি কেন?খুব তো গাড়ি থেকে নেমে একেবারে আগ বাড়িয়ে হ্যাল্প করার জন্যে চলে গিয়েছিলেন।তো ফিরে আসলেন কেন?মেয়েটার সাথে একই গাড়িতে একসাথে বসতেন।আমার পাশে কি হ্যা?’
রিধি রাগের মাথায় একনাগাড়ে হরবর করে মনের কথা বলে দিলো।তারপর রাগে ফুসতে ফুসতে জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকলো। ইহান রিধির প্রতিটা কথা শুনে অবাক হলো।পর পর ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার?তার প্রিয়তমা হিংসে করছে।আর সেই কারনেই এমন মুখ ফুলিয়ে আছে। ইহান মাথা নুইয়ে রিধির কানে ফিসফিস করল,’ রিধি?আর ইউ ফিলিং জেলাস?’
রিধি থতমত খেয়ে যায়।সে কি এখন ধরা পরে গেলো?রিধি আমতা আমতা করে বলে,’ আমি জেলাস কেন ফিল করব?আশ্চর্য কথাবার্তা।’
ইহান হাত দিয়ে বাতাস করার মতো অভিনয় করল।মুখ টিপে হেসে বলে,’ ইশ,চারপাশ এমন পোড়া পোড়া গন্ধ্যে ভড়ে গিয়েছে কেন?’
রিধি বলে,’ কোথায় পোড়া গন্ধ?আমি তো পাচ্ছি না।’
‘ এই গন্ধ শুধু আমিই পাবো।আর কেউ পায় না।বুঝেছ?ভীষণ স্পেশাল এটা আমার জন্যে।’
‘ পোড়া গন্ধ আবার স্পেশাল হয় কিভাবে আজব?’
ইহান মাথা দুলিয়ে বলে,’ হ্যা হয় হয়। ও তুমি বুঝবে না।’
রিধি মুখ ভেঙিয়ে বলে,’ আমার ওতো বোঝা লাগবে না।আর আপনি আমারও আমার দিকে চেপে আসছেন।দূরে সরুন।’
ইহান সরে যাবে তো দূরের কথা।ও আরও চেপে বসল রিধির সাথে।তারপর সবার অগোচরে হাতটা অথৈয়ের পিঠের পিছন দিয়ে নিয়ে ওর কোমড়ে আঁকড়ে ধরল।আকস্মিক ইহানের অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়ায় সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল।খামছে ধরল পরিহিত ওড়নার অংশ।এ কি করছে লোকটা?লোকটার একটুখানি স্পর্শ যে ওকে কতোটা পাগল করে তোলে তা কি লোকটা জানে না?রিধি বুকটা উত্তেজনায় ধরফর করছে। ইহান রিধি শরীরের কম্পন স্পষ্ট টের পেলো।কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,’ এভাবে কাঁপছ কেন?এতো কাঁপাকাঁপি করার মতো তো এখনও আমি কিছুই করিনি।’
রিধি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। গতকাল থেকে ইহান হুটহাট এমন সব কথা বলছে। যা শুনে লজ্জায় নুইয়ে যায় রিধি।এখনও তা হলো।মেয়েটা লজ্জায় একেবারে জড়সড় হয়ে বসে আছে।ইহান মুচঁকি হাসল।বলল,’ লজ্জা পেলে অনেক সুন্দর লাগে তোমাকে রিধি।’
ব্যস,রিধির জন্যে এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিলো ওর সব রাগ,অভিমান দূর করে দেওয়ার জন্যে।অভিমানগুলো যেন হাওয়াই মিঠাই মুখে দিলেই যেমনভাবে গলে যায়।ঠিক তেমনভাবেই গলে গেলো।লোকটার কি হলো?এমন কেন করছে?তবে কি লোকটা ওকে ভালোবাসে?ও যে লোকটাকে ভালোবাসে তা কি বুঝতে পেরেছে?ওর অনুভুতিগুলো অনুভব করতে পেরেছে?ভাবতেই সারাশরীর শীতলতায় ছেঁয়ে গেলো।অদ্ভূত প্রশান্তিতে চোখ বুঝে আসল রিধির।চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সিটে হেলান দিয়ে দিলো।চোখের কার্ণশ ঘেষে একফোঁটা তপ্ত জল গড়িয়ে পরল।যা ইহান অতি যত্নে নিজ হাতে মুছে দিলো।তবে কিছু বলল না। সে জানে এই চোখের জল দুঃখের না।এই চোখের জল সুখের।
_______________
ওরা গাড়ি থেকে নেমে পরেছে।এখন সেই রুট ব্রিজের উদ্দেশ্যে হাটছে।লিভিং রুট ব্রিজ নামটাই কেমন অদ্ভূত তাই নাহ?এর কারন হলো।মূলত এই সেতু আলাদা করে গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি হয়নি। গাছেদের মোটামোটা শিকড় একে অপরকে জড়িয়ে জাপ্টে ধরে তৈরি করেছে আশ্চর্য ঝুলন্ত সেতু। তলায় বয়ে চলেছে নদী। উপরে গাছের শিকড়ে শিকড়ে পা দিয়ে দিব্যি যাতায়াত করছে মানুষ। একজন-দুজন নয়, কম করে ৫০ জনকে একই সঙ্গে বহন করার ক্ষমতা রয়েছে এই রুটব্রিজের।
তবে রুট ব্রিজের আয়ু বাঁচাতে এখন চলাচলের জন্য লোক সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
মেঘালয়ে এমন ব্রিজ রয়েছে মোট দুটি। একটি সিঙ্গেল রুট ব্রিজ, দ্বিতীয়টি ডবল ডেকার রুট ব্রিজ।
সিঙ্গেল রুট ব্রিজটি রয়েছে শিলংয়ের মাওলিলং-এ। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম বলা হয় এই খাসি গ্রামটিকে। সেখানেই রয়েছে এই সিঙ্গেল রুট ব্রিজ। কয়েকশো সিঁড়ি পেরিয়ে নামতে হয় সেখানে। তলা দিয়ে পাথর কাটিয়ে বয়ে চলেছে ছটফটে নদী। তার উপরেই রয়েছে প্রাকৃতিক এই সেতু।আর সেই উদ্দেশ্যেই যাচ্ছে ওরা।রুদ্রিক এই গ্রাম থেকে একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক ভাড়া করে নিলো।তবে রুদ্রিকের ভয় হচ্ছে।মেয়েরা কিভাবে এমন পিচ্ছিল সিড়ি দিয়ে নামবে।এখন আফসোস করছে ও এখানে আসা ঠিক হয়নি।এদিকে ভাড়া করা লোকটি ওদের নিয়ে জঙলের মাঝ দিয়ে হেটে চলেছে।অথৈ বেশ আনন্দে আছে।ওর সমুদ্র থেকে পাহাড় পর্বত বেশি ভালোলাগে।অথৈয়ের আনন্দ দেখে রুদ্রিকের আর ইচ্ছে করছে না বলতে যে চলো আমরা ফিরে যাই।রাস্তাটা যে অনেক বিপদ্দজনক।রুদ্রিককে চুপচাপ দেখে অথৈ এইবার রুদ্রিকের দিকে তাকালো।তাকাতেই ওর কপালে ভাজ পরল।রুদ্রিককে চিন্তিত দেখাচ্ছে।কিন্তু লোকটা এতো চিন্তা করছে কেন?একটু আগেও তো সব ঠিকঠাক ছিলো।অথৈ রুদ্রিকের হাতের মাঝে হাত গুজে দিলো।অথৈয়ের স্পর্শ টের পেতেই পাশ ফিরে অথৈয়ের দিকে তাকায় রুদ্রিক।অথৈ মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,’ কি হয়েছে আপনার? আপনাকে এতো চিন্তিত লাগছে কেন?’
রুদ্রিক না নাড়িয়ে না বোঝালো।মানে কিছু হয়নি।অথৈ গোমড়ামুখো হয়ে বলে,’ মিথ্যে বলছেন কেন?আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনি কোনো বিষয়ে খুব চিন্তিত।’
রুদ্রিক হতাশার শ্বাস ফেলল।এই মেয়েটা এখন তাকে আপাদমস্তক পুরোটাই বুঝতে পারে।তার থেকে কিছুই লুকোতে পারে না।রুদ্রিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’ আমাদের এখানে আসাটা বোধহয় ভালো হয়নি।কেমন যে লাগছে আমার।মন বার বার বাধা দিচ্ছে আর যেতে না করছে।’
অথৈ দুহাতে রুদ্রিকের বাহু আঁকড়ে ধরে বলে,’ আরে শুধু শুধু চিন্তা করছেন আপনি।কিছু হবে না।আপনি আছেন তো।আর তাছাড়া আমরা কতোগুলো মানুষ আছি একসাথে।একজন বিপদে পরলে সবাই একসাথে ঝাপিয়ে পরব।’
‘ অথৈ তুমি বিষয়টা যেভাবে সহজভাবে নিচ্ছো পরিস্থিতি সেরকম নাও থাকতে পারে।’
‘ উফ,চুপ করুন তো আপনি। বেশি বেশি ভাবছেন।আমি আপনার পাশে আছি।আপনি আমার পাশে আছেন।এর থেকে আর বেশি কি চাই আপনার?সব চিন্তা ভাবনা বাদ বুঝেছেন।শুধু প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যগুলো মন ভড়ে উপভোগ করুন! দিনশেষে এইগুলোই স্মৃতি পাতায় জমা হয়ে থাকবে।’
অথৈয়ের কথা শুনে রুদ্রিক আলতো হাসলো।তবে ওর চিন্তার পরিমানটা বিন্দু মাত্র কমলো না।কিন্তু তা আর অথৈকে বুঝতে দিলো না।অথৈয়ের হাসিমাখা মুখটা দেখেই সবটা নিজের মধ্যে চেপে নিলো রুদ্রিক।অথৈয়ের ঠোঁটের একটুকরো হাসির জন্যে রুদ্রিক সব করতে পারবে।
____________
পিহু লাফিয়ে লাফিয়ে হাটছে। প্রিয়ান বার বার মানা করছে ওকে এমনভাবে হাটতে না।দেখে শুনে হাটতে।এই মেয়ে শুনলে তো।এমনিতেই বনজঙল জায়গা।তার উপর এখানে প্রায় বারো মাসকালই নাকি বৃষ্টি।সাপ টাপের কথা কি আর বলা যায়?এইযে কতো শতো পাতা পরে আছে এগুলোর মধ্যেই তো লুকিয়ে থাকতে পারে তাই নাহ?
প্রিয়ান এইবার তেড়েমেড়ে গেলো পিহুর কাছে।গিয়েই ওর হাত নিজের হাতের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরল।আকস্মিক প্রিয়ানের এহেন কাজে ভড়কে যায় পিহু।পর পর বিষয়টা বুঝতে পেরেই রাগি গলায় বলে,’ কিরে এইভাবে আমাকে ধরে রেখেছিস কেন?’
প্রিয়ান দাঁতেদাঁত চিপে বলে,’ বান্দর যদি কথা না শুনে তাহলে তাহলে তাকে দরি দিয়ে বেধে রাখতে হয়।আর আমি তাই করছি।আমার কাছে তো দরি নেই।তাই আপাততো হাতের সাহায্যেই তাকে আটকে রেখেছি।’
পিহু চোখ রাঙিয়ে বলে,’ তুই আমাকে বান্দর বললি?’
‘ যেভাবে লাফাচ্ছিস হনুমান বা উল্লুক বলিনি এটাতেই শুকরিয়া আদায় কর।’ তাচ্ছিল্য করে বলল প্রিয়ান।
পিহু সব শুনে প্রিয়ানের হাতের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল।কিন্তু পারছে না।তা দেখে প্রিয়ান হেসে বলে,’ হনুমান বলেছি বলে কি হবে?হনুমানের মতো ওতো শক্তি তোর গায়ে নেই।সো যেটুকু শক্তিই আছে তা অযথা অপচয় করছিস।আমি না চাইলে এই হাত তুই কখনই ছাড়াতে পারবি না।কোনোদিন না।আজীবন আমার সাথে এইভাবে জুড়ে থাকতে হবে তোকে।’
” আজীবন আমার সাথেই এইভাবে জুড়ে থাকতে হবে তোক!” প্রিয়ানের শেষের কথাটায় কি যেন ছিলো।পিহুর ঝটফট করা কমে যায় তৎক্ষনাত।এই একটা বাক্য কি এমন ছিলো?যে পিহুর হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলো।আর বার বার এই বাক্যটাই ওর চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।শরীরে আলাদা ঠান্ডা স্রোতের শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।পিহুকে এমন ধীরে ধীরে হাটতে দেখে কপালকুচকে ফেলে প্রিয়ান।এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না।এই একটু আগেও গ্যাঙ্গারুর মতো লাফাচ্ছিলো আর এখন?এখন কচ্ছপের গতিতে হাটছে।প্রিয়ান ওকে আবার টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসল।এতে হকচকিয়ে উঠে পিহু।জিজ্ঞাসাসূচক চোখে প্রিয়ানের দিকে তাকালে প্রিয়ান বলে উঠে,’ কি এখন আবার কি হলো তোর?এমন ধীরে ধীরে হাটছিস কেন?সমস্যাটা কি তো?’
পিহু নাক মুখ কুচকে বলে,’ আমি জোড়ে হাটলেও দোষ?আস্তে হাটলেও দোষ।আমি করবটা কি শুনি?’
প্রিয়ান হাটা থামিয়ে দেয়।এমনিতেও ওরা সবার পিছনে ছিলো।বাকিরা ওদের আগে আগে।প্রিয়ানকে থামতে দেখে পিহু বলে,’ আরে থামলি কেন?চল! দেখ ওরা আগে চলে যাচ্ছে।আরে তোর সমস্যা কি?’
পিহু এইবার প্রিয়ানের চোখের দিকে তাকালো।তাকেতেই ওর বুকটা কেঁপে উঠল।এ কোন প্রিয়ান?এটা ওর বেষ্টফ্রেন্ড প্রিয়ান না।প্রিয়ানের চোখে আজ অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছে পিহু।কিন্তু ও যেটা ভাবছে সেটা কিভাবে সম্ভব? না, না এটা ওর ভুল ধারনা।এটা হতে পারে না।কিন্তু ওর ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে প্রিয়ান হুস্কি স্বরে বলে উঠল,’ আমার সমস্যা একটাই।আমি তোকে ভালোবাসি পিহু।আর তুই সেটা বুঝেও বুঝতে পারছিস না।কেন বুঝিস না পিহু?আমি তোকে অনেক ভালোবাসি পিহু।সত্যি! একবার আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ করেই দেখ।প্রমিস করছি নিজের সবটা দিয়ে তোকে আগলে রাখব।এইযে এই হাতটা ধরেছি না তোর?এই হাত কখনই ছেড়ে দিবো না।আজীবন তোকে আমার বক্ষপিঞ্জারায় অতি যত্নে রেখে দিবো।তুই শুধু একবার আমার বাড়িয়ে দেওয়া ভালোবাসার হাতটা আঁকড়ে ধরে দেখ পিহু।’
পিহু কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে।ও কখনও কল্পনাও করেনি প্রিয়ান ওকে ভালোবাসবে।এটা ওর মাথাতেও আসেনি।পিহু শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো প্রিয়ানের দিকে।প্রিয়ান ব্যাকুল নয়কে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে পিহুর দিকে। এদিকে পিহু ভাবছে প্রিয়ান যেহেতু ওকে বলছে প্রিয়ান ওকে অনেক ভালোবাসে।তাহলে পিহু কি একবার সেই ভালোবাসাটা গ্রহণ করে দেখবে?প্রিয়ান বন্ধু হিসেবে বেস্ট এতে কোনো সন্দেহ নেই।লোকে বলে প্রেমিক অথবা স্বামী হওয়ার আগে ভালো বন্ধু হওয়া উত্তম।ওদের মাঝে বন্ধুত্ব তো আছেই।আর প্রিয়ানও ওকে ভালোবাসে।আর পিহুও প্রিয়ানকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো রিজন দেখছে না।যেহেতু পিহুর কাউকে ভালোও লাগে না।আর ও কাউকে ভালোও বাসে না।তাই প্রিয়ানের ওই হাতটা একবার ভড়সা করে ধরেই দেখুক না।প্রিয়ান তো বলছে এই হাত কখনও ও ছাড়বে না।ওকে সারাজীবন আগলে রাখবে।পিহু লম্বা শ্বাস ফেলল।ধীর আওয়াজে বলে উঠল,’ দেখ প্রিয়ান আমি বুঝতে পেরেছি তুই আমায় অনেক ভালোবাসিস।আমাকে সারাজীবন আগলে রাখবি।কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসি না।আর ভবিষ্যতে ভালোবাসবো কি না তাও জানি না।হয়তোবা ভালোবেসেও ফেলতে পারি।যদি এই সত্যিটা মেনে নিতে পারিস।আমি তোর এই ভালোবেসে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আগলে ধরতে পারি ভড়সা সহকারে।’
প্রিয়ান কি বলবে? ও তো আনন্দে বাক্যহারা।সে জানে পিহু ওকে ভালোবাসে না।তবে মেয়েটা যে ওর ভালোবাসা গ্রহণ করে নিয়েছে এই অনেক।প্রিয়ান একঝটকায় পিহুকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো।পিহু শরীরে অন্যরকম শীহরণ বয়ে গেলো।প্রিয়ান প্রফুল্লচিত্তে বলে,’ তুই আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিসনি এটাই অনেক।আর হ্যা তোকে ভালোবাসতে হবে না।আমার একার ভালোবাসাই যথেষ্ট।তবে আমি জানি আমার এই তীব্র ভালোবাসার প্রকপে পরে তুই নিজেও আমায় একসময় ভালোবেসে ফেলবি।আমি এখন শুধু এই দিনটারই অপেক্ষা করবো।’
পিহু মুচঁকি হাসলো।ওর ভালোলাগছে কেন যেন প্রিয়ানের বুকে মাথা রাখতে।এইযে প্রিয়ান ওকে এইভাবে জড়িয়ে ধরে আছে।এতে যেন মনের মাঝে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করছে ওর মধ্যে।পিহুও দুহাতে জড়িয়ে ধরল প্রিয়ানকে।মনে মনে বলল,’ আমিও চাই প্রিয়ান আমি যেন তোকে ভালোবেসে ফেলি।আর ভালোবাসা যেন আমাকে বাধ্য করে তোকে ভালোবাসতে।আমি এটাই চাই।’
#চলবে______________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন। অনেক বড়ো পর্ব লিখেছি।তাই হয়তো অনেক ভুল থাকতে পারে।ক্ষমা করবেন তাহলে।