প্রেম_প্রেম_পায় #স্বর্ণালী_সন্ধ্যা পর্ব ত্রিশ

0
605

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব ত্রিশ

৩০.
দুদিনের জ্বর কাটিয়ে নীতি আজ সুস্থ হলো৷ তাই সে অফিসে যাচ্ছে আজ ফারাজের সাথে৷ ফারাজ তার সাথে একদম স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে।সেদিন রাতে ফারাজ তার রুমে এসেছিল তার মনে আছে কিন্তু সে কি কি বলেছে তার পুরোপুরি মনে নেই৷ তবে কান্না করছিল এটা মাথায় আছে। এবং সেটা নিয়ে সে ভীষণ লজ্জিত।

ফারাজ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,
‘নীতি আজ আপনাকে অফিস শেষে আমার সাথে শপিংমল যেতে হবে।’

‘জি’

‘জিজ্ঞেস করবে না কেন? ‘

নীতি উত্তর দিল,
‘আমি জানি আপনি গিফ্ট কিনতে যাবেন অপরাজিতা আর ভাইয়ের জন্য।’

ফারাজ অবাকের সুরে বলল,
‘আরে কিভাবে বুঝলেন?’

‘আপনিই বলেছিলেন।’

ফারাজ খেয়াল করলো নীতি স্বাভাবিক এর চেয়ে চুপচাপ।হয়তো দুর্বলতা এখনো কিছুটা রয়ে গিয়েছে।

কাল অপরাজিতা আর ফায়াদের আকদ। তা নিয়ে মহা ব্যস্ত আখি বেগম। কাছের কিছু আত্নীয়দের দাওয়াত করেছে।তারা কাল আসবে৷ আর রাফিয়া,রিজু আর তাদের মা আগেই হাজির।রাফিয়ার বাবা ব্যবসায়ীক কাজে অন্য কোথাও থাকে তাই আসতে পারে নি।

বাসায় তো ফায়াদ আর ফারাজ নেই তাই আখি বেগম ফারদিন আহমেদ ও রিজুকে এইটা ওটা বলে ফরমায়েশ করতেই আছেন৷ শেষে রিজু আর না পেরে পড়ার বাহানা দিয়ে বাহিরে চলে এসেছে। বেচারা ফারদিন আহমেদ পড়ে গেছে বউয়ের চিপায়।তার বউয়ের নতুন করে বাড়ি সাজাতে মন চাচ্ছে।ছেলে বিয়ে করছে তাই।এতো করে বুঝালো ছেলের বউ তো এখন আসছে না। পরে আসবে।কিন্তু কে শুনে কার কথা!

‘এই তুমি কাজ করছো না কেন?’

‘বলছিলাম কি আমি একটু অফিস থেকে ঘুরে আসি?’

আখি বেগম দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
‘একদম না ‘

‘আচ্ছা’

রাফিয়া মিট মিট করে হাসছে এই দৃশ্য দেখে৷ হাসবেন্ড রা এভাবেই জনম জনম ধরে বউকে মান্য করে আসছে বুঝি!

রিজু বাসা থেকে বের হয়েই ফায়াদের কাছে গেল। গিয়ে দেখলো ফায়াদ বসে বসে মোবাইল স্ক্রল করছে।আজ হয়তো রোগী কম। ফায়াদকে ডাকতেই ফায়াদ মাথা তুলে তাকালো।

‘ তুই এখানে?’

রিজু হেসে বলল,
‘বাসায় ফুপি জালাচ্ছে সবাইকে। তাই বের হয়ে আসলাম।’

ফায়াদ হালকা হেসে বলল,
‘জানতাম।’

‘কাজ নেই?’

‘আপাতত নেই’

‘বের হবে ভাই?’

‘কোথায়?’

‘চলো ফারাজ ভাইয়ের অফিসে যাই’

ফায়াদ ভাবলো। যাওয়া যায়। আজ তার কাজও নেই হাসপাতালে তেমন।তাই সে আপত্তি করলো না।

রিজু আর ফায়াদ অফিসে এসে হাজির। ফারাজ তাদের দেখে চমকে গেলেও খুশি হলো।ফায়াদ সচরাচর অফিসে আসে না।

‘ডাক্তার ভাই আজকে অফিসে ব্যপার কি?’

ফায়াদ গিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
‘দেখতে এলাম অফিস কেমন চলে’

ফারাজ শব্দ করে হেসে দিল।বলল,
‘তোমার অফিস নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই আমি জানি। ‘

ফায়াদ হাসলো। আসলেই নেই। তার বিজনেস ভালো লাগে না। রিজু বসে বলল,
‘ভাই ডিস্টার্ব করলাম না তো এসে?’

ফারাজ বলল,
‘না। ভালো হয়েছে এসেছিস।আর এটাকে নিয়ে এসেছিস ভালো করেছিস৷ কাল থেকে তো বউয়ের হয়ে যাবে। আমাদের আর সময় দিতে পারবে নাকি?’

রিজু হাসলো।দাত কেলিয়ে বলল,
‘একদমি পারবেনা। অপরাজিতাকে তো চিনো না। তাকে সময় না দিলে মাথায় উঠে নাচবে।’

ফারাজ খোচা মেরে বলল,
‘কি ব্যাপার ভাই।আজ এখনো ফোন দিল না যে?’

ফায়াদ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
‘দিবে না’

‘ওহ দিবে দিবে’

ফায়াদ বলল,
‘দিবে না। ব্লক মেরে দিয়েছে।’

ফারাজ আর রিজু একসাথে বলল,
‘কি???’

ফায়াদ তখনও স্বাভাবিক। মাথা নেড়ে হ্যা বলল।
রিজু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ব্লক?তোমাকে? কেন?’

‘সে আরেক কাহিনী।’

ফারাজ বলল,
‘বল না ভাই?’

তখনি নীতি এলো সবার জন্য কিছু খাবার নিয়ে।রিজু নীতিকে বলল,
‘বসো আপু।ফায়াদ ভাইকে অপরাজিতা ব্লক করে দিয়েছে শুনবা না?’

নীতি অবাক হলো। ব্লক করে দিল। তাও ফায়াদকে। কিন্তু কেন?সে বসে পড়লো শোনার জন্য। সবার কৌতুহল দেখে ফায়াদ মাথায় হাত দিল। এখন এদের বলতেই হবে!
————
গতকাল অপরাজিতা এসেছিল হাসপাতালে ক্লাস শেষে।ফায়াদের কেবিনে ঢুকতেই দেখলো ফায়াদ নেই। সে অপেক্ষা করলো।কিছুক্ষণ পর এক মাঝবয়সী নার্স আসলো। মহিলা কে দেখে মনে হচ্ছে সে অপরাজিতাকে দেখে বিরক্ত। অপরাজিতা জিজ্ঞেস করলো,
‘উনি কোথায় গিয়েছেন?’

মহিলা ত্যাছড়াভাবে উত্তর দিল,
‘রাউন্ডে গিয়েছেন। আসবে।’

‘ওহ আচ্ছা।’

নার্সটি বের হতে গিয়েও আবার আসলো। এসে অপরাজিতাকে বলল,
‘তুমি মেয়েটা কেমন বলো তো। প্রতিদিন আসো ফায়াদ এর জন্য। ফায়াদ ছেলে টা নেহাত ভদ্র তাই কিছু বলে না। তোমাদের মতো মেয়ে গুলো সুন্দর ছেলে দেখলেই পিছে পিছে ঘুরে। যতসব ছ্যাছ’ড়ামি!’

‘কি?’
অপরাজিতা থম মেরে উনার কথা শুনে। তার রাগ ও লাগছে। কিন্তু মায়ের বয়সী ইনার সাথে অভদ্রতা করতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
‘আপনি জানেন আমি কে?’

মহিলা এবার বাকা ভাবে বললেন,
‘সে তুমি যাই হও বাবা ফায়াদের পিছে আর ঘুরোনা। ফায়াদকে আমি আমার মেয়ের জামাই বানাবো।মেয়ে মানুষ এভাবে ছেলেদের পিছে ঘুরো না। এখানে এসেছি ২ মাস হলো। প্রতিদিনই দেখি আমার ফায়াদ বাবার পিছে ঘুরো। কিসব কাণ্ড!’

এরই মধ্যে ফায়াদ প্রবেশ করলো।অপরাজিতার তো রাগে শরীর কাপছে।তাকে কি যা তা বলছে এই মহিলা৷ তাকে এভাবে কেউ বলে নি কখনো! সে নাকি ছেলেদের পিছনে ঘুরে! ভাবা যায়?
ফায়াদকে দেখে অপরাজিতা রাগে দাতে দাত চেপে বলল,
‘করেন উনার মেয়েকে বিয়ে!’

বলে হন হন করে বেরিয়ে গেল সে।তারপর আবার ফিরে ফায়াদকে একটা চিমটি কেটে গেল। ফায়াদ ব্যথায় আহ করে উঠলো। সে তো আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না। অপরাজিতা এভাবে বেরিয়ে গেল কেন?তাকে কেন চিমটি দিল।
নার্সটির দিকে তাকাতেই সে হেসে বলল,
‘চিন্তা করো না ফায়াদ।মেয়েটা তোমাকে আর জ্বালাতন করতে পারবে না।কতো বড় বেয়াদব তোমাকে চিমটি ও দিয়ে গেল।’

ফায়াদ অবাক হয়ে বলল,
‘মানে?’

নার্সটি তাকে সব বলল।সব শুনে ফায়াদের মাথায় হাত।ফায়াদ ভাবছে শুধু তো চিমটি দিয়েছে৷ চুল যে ছিড়ে নাই তাই তো তার কতো জন্মের ভাগ্য।পরে যখন ফায়াদ অপরাজিতা কে কল করে তার নাম্বার ততক্ষণে ব্লক লিস্টে চলে গিয়েছে।
————

সব শুনে রিজু বলল,
‘তুমি নার্সটিকে কিছু বলো নি?’

ফায়াদ বলল,
‘নার্সটা কে জিজ্ঞাসা কর!’

‘কে?’

‘সায়মা আন্টি!’

ফারাজ আর রিজু একসাথে বলে উঠলো,
‘ওয়াট!!’

‘হুম’

তাদের এই রিয়েকশন দেখে নীতি বুঝলো না কি হয়েছে।
তখন ফারাজ বলল,
‘আমি বলছি সায়মা আন্টি কে? আমার মায়ের অনেক দূর সম্পর্কের বোন। তিনি নার্স।কাহিনী হলো আমরা জন্ম হওয়ার পর তিনি আমাদের দেখেই সবার আগে যে কথা টা বলেন তা হলো আমার মেয়ের জামাই! অথচ তার মেয়ে তখন আমাদের থেকে ৩ বছরের বড়।’

রিজু পাশ থেকে নীতির কানে ফিসফিস করে বলল,
‘মহিলার মাথায় একটু সমস্যা আছে।’

ফায়াদ তা শুনে হালকা করে চোখ রাঙালো।
ফারাজ আবার বলা শুরু করলো,
‘তো ছোট বেলা থেকেই উনি যখন আমাদের বাসায় আসতেন আমাদের আশে পাশে কোনো মেয়ে দেখলেই তাকে এটা ওটা বলে দূরে সরিয়ে দিতেন৷ আমাদের মা তো এই কান্ডে মহা বিরক্ত ছিল৷একবার এমন হয়েছিল যে পাশের বাসার এক পিচ্চি মেয়ে আমাদের সাথে খেলতো।আন্টি এটা দেখে তাদের মায়ের কাছে বলে এসেছিল আমাদের নাকি তার মেয়ে ডিস্টার্ব করে। এটা শুনে আমাদের মায়ের সে কি রাগ! উনি আন্টিকে বুঝাতে আন্টি আবার মাকে উল্টো বুঝায়। সায়মা আন্টি রা তারপর অনেক দূরে বাসা নেওয়ায় তাদের আসা যাওয়া কমে যায়।’

তারপর ফায়াদ বলল,
‘এখন তিনি আবার এখানে শিফট করেছেন এবং আমার হাসপাতালে আছেন। অপরাজিতা কে চিনেন না তাই উল্টাবপাল্টা কি কি বলেছেন কে জানে!’

ফারাজ দুষ্টুমি করে বলল,
‘এখন এই পুচকি ফুল তোকে বিয়ে করবে তো?’

ফায়াদ বাকা হেসে বলল,
‘সে দুনিয়া উল্টে গেলেও আমাকেই বিয়ে করবে।’

রিজু বলল,
‘ব্লক তো খুলল না।’

ফারাজ এক চোখ টিপে বলল,
‘আরে বুঝিস না কেন? কাল আদর দিয়ে ব্লক খুলাবে।’

নীতি ফারাজের কথা শুনে লজ্জা পেল। তাই সে সেখানে আর থাকলো না। কাজের কথা বলে বেরিয়ে গেল। ফায়াদ নীতি আর ফারাজকে পর্যবেক্ষণ করছিল অনেকক্ষণ। সে জিজ্ঞেস করলো,
‘নীতির কি হয়েছে?’

ফারাজ বলল,
‘কই কি হয়েছে?’

ফায়াদ আর কিছু বলল না। নিরবে শুধু দেখে গেল।
তারপর তারা তিন ভাই বেশ কিছুক্ষন আডডা দিল। একটা সময় ফায়াদ আর রিজু বের হলো।দুজনে বাসায় এলো।

ফায়াদ বাসায় আসতেই বিচার দেয়া শুরু করলেন আখি বেগম।

‘তোর বাপ একটা কাজও ঠিকভাবে পারে না। কিভাবে কি করবো বল তো।’

ফায়াদ তার মা কে শান্ত করে বলল,
‘মা অপরাজিতা এখন এ বাড়িতে আসছে না। এতো আগে থেকে এগুলো করে কি লাভ।পরে তো থাকবে না।’

আখি বেগম ভাবলেশহীন ভাবে বললেন,
‘পরে আবার করবো। এখন তুই আমাকে সাহায্য কর। ওপাশের পর্দা গুলো চেঞ্জ করে দে যা।তারপর আরো কিছু আছে।’

ফায়াদ আর কি করবে৷ মায়ের খুশি বড় খুশি। এসব করে যদি সে শান্তি পায় তাহলে করুক।

অফিসের পর নীতি আর ফারাজ শপিংমল এ গিয়ে ফায়াদ আর অপরাজিতার জন্য গিফট কিনল।বাড়ি ফেরার পথে কেউ কোনো কথা বলছে না। অথচ তারা কতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো।
একটা পর্যায়ে ফারাজ বলল,

‘এভাবে আর কতোদিন চলবে নীতি?’

হঠাৎ এ প্রশ্নে নীতি অবাক হলো,
‘জ্বি?’

ফারাজ গাড়ি টাকে এক সাইডে পার্ক করে বলল,
‘আমরা তো ফ্রেন্ড তাই না?’

‘জ্বি’

‘তাহলে এতো অস্বস্তি এসেছে কেন আমাদের মধ্যে?’

নীতি মাথা নিচু করে বলল,
‘স্যরি স্যার।’

ফারাজ নীতির মাথা আলগোছে উচু করে দিল। বলল,
‘নো নো মাথা নিচু করবেন না। লিসেন নীতি আমি আপনার অনুভূতির সম্মান করি।কিন্তু আপনি তো জানেন যে—‘

কথা শেষ হওয়ার আগেই নীতি বলল,
‘আমি কোনো ইনটেনশন নিয়ে সেগুলো বলি না। আমি বলতাম না কখনো। আমি বলেছি তাই আমি লজ্জিত৷ আর কখনো এ ধরনের কথা আমি বলবো না৷আপনি আমাকে ক্ষমা করুন স্যার।’

কথা গুলো বলতে নীতির খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবুও সে নিজেকে নিজে ওয়াদা করলো আর কখনো নিজের অনুভুতি ফারাজের সামনে যাতে না আসে সে খেয়াল রাখবে। অনুভুতি গুলো না হয় মনের মাঝে চেপে র‍য়ে যাক।

ফারাজ বলল,
‘ক্ষমা করার কিছু নেই। আপনি সহজ হোন। হুম?’

নীতি হাসিমুখে বলল,
‘জ্বি স্যার’

গাড়ি স্টার্ট দিল। তারপর তারা টুকটাক নানা গল্প করছে যাওয়ার পথে।নীতি হাসিমুখে আবার আগের মতো কথা বলার চেষ্টা করছে।মুখে হাসি থাকলেও তার ভিতরে ভাঙচুর হচ্ছে। এতো সহজ অনুভূতি চেপে রাখা? লোকটা বুঝলো না। বুঝলো না সে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here