#বিবর্ণ_বসন্ত
৮ম_পর্ব
~মিহি
‘আরে, ঐটা দুলাভাই না? সাথে মেয়েটা কে?’ বান্ধবী রত্নার কথায় কোণার টেবিলটার দিকে তাকালো অনামিকা। টেবিলটাতে সোহরাব বসে আছে রাইসার সাথে। গা ঘিনঘিন করে উঠলো অনামিকার। সোহরাবের উপর রাগটা যেন ক্রমশ বাড়তে লাগল, বুক ফেটে কান্না আসছে তার।
-‘এই অনু, কী হলো তোর?’
-‘কিছুনা রে।’
-‘যা দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে আয়।’
-‘আরে না। ও অফিসের কাজে এসেছে, অযথা বিরক্ত করবো না। তুই খা তো।’
রত্না চুপচাপ খেতে লাগল। না চাইতেও অনামিকার চোখ বারবার সোহরাবের দিকে যাচ্ছে। এত কী কথা বলছে ওরা! নারীসুলভ হিংসাটা দিব্যি কাজ করছে তার।
-‘সোহরাব, কফিটা শেষ করো। তারপর বের হই একসাথে।’
-‘হ্যাঁ, থ্যাংকস বাই দ্য ওয়ে। এনআইডিটা হারিয়ে ফেললে মারাত্মক বিপদে পড়তাম।’
-‘ওয়েল..’
আর কিছু বলার আগেই রাইসা কাশতে শুরু করলো। সোহরাব প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও রাইসার ক্রমাগত কাশি তার ধ্যান কাড়লো। সে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। আচমকা রাইসা কাশতে কাশতে চেয়ার ছেড়ে পড়ে গেল। উৎসুক জনতার দৃষ্টি সেদিকে স্থির হলো। সোহরাব নিজের জায়গা ছেড়ে রাইসাকে ধরলো। রাইসা কোনোরকম নিজেকে সামলে বললো,’ক..কফিতে কি বাদাম দিয়েছে? আ..আম..আমার..এ..এলার্জি..আ..আছে।’ সোহরাব কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। অনামিকা দ্রুত এসে পাশে দাঁড়ালো।
-‘সোহরাব আপনি এখানে কেন আর আপুর…’
-‘এই মুহূর্তে আমাকে জেরা করা বাদ দাও। রাইসার অবস্থা দেখেছো?’
-‘আমি তো সেটাই জিজ্ঞাসা ..’
-‘জাস্ট শাট আপ! ওয়েটার..ওয়েটার, ডক্টরকে কল করুন কেউ।’
সোহরাবের কীর্তিকলাপে অনামিকার নিজেকে প্লেটে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্টের মতো লাগতে লাগল। সৌভাগ্যক্রমে ক্যাফেতে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিল। সে রাইসাকে চেক করো মেডিসিন প্রেসক্রাইব করলো। রাইসা কিছুটা সুস্থ হলে সোহরাব তাকে বাড়িতে রেখে আসতে গেল। এ অবস্থায় ঢাকায় ফেরা তার উচিত নয়। সবকিছুর মাঝে অবহেলিত হয়ে পড়ে রইল অনামিকা। রত্নাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
বাড়িতে পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল অনামিকা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। সোহরাব কেন একটুও বুঝলো না তাকে? কেন-ই বা আল্লাহ অনামিকার কপালে এমন অশান্তির দাম্পত্য জীবন লিখে দিলেন? মা কি পারতো না আরেকটু অপেক্ষা করতে? মায়ের কথা মনে পড়তেই বুকটা হু হু করে উঠে তার। ফোন হাতে নিয়ে মাকে কল দেয় সে। দুবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হয়।
-‘আসসালামু আলাইকুম মা, কেমন আছো?’
-‘ওয়ালাইকুম সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো রে মা, তুই কেমন আছিস? জামাই কেমন আছে? শ্বশুরবাড়িতে সবাই ভালো?’
-‘সবাই ভালো মা।’
-‘তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?’
-‘আর বলো না মা, তোমার জামাইয়ের সাথে জেদ করেছিলাম আইসক্রিম খাবো। ও মানা করলো শুনিনি। শেষে বেচারা বাধ্য হয়ে কিনে দিল, এখন সেটা খেয়ে আমার ঠাণ্ডা লেগে গেছে। তোমার জামাই তো খুব রেগে গেছে।’
-‘তুই কি কোনোদিন শোধরাবি না অনু? জামাইয়ের কথা শুনে চলবি। আমি ব্যাংকে এসেছি। পরে কথা বলবো।’
-‘ব্যাংকে কেন?’
-‘তোর বাবার পেনশনের টাকাটা তুলতে।’
-‘ওরা তো বিকাশেই পাঠিয়ে দিত।’
-‘কী যে হয়েছে এবার।’
-‘এই গরমে তুমি ওখানে গেছো। সাবধানে ফিরো।’
-‘আচ্ছা মা।’
মায়ের সাথে কথা শেষ করে ফোন রাখতেই সাজিয়া ডাক দেন অনামিকাকে। অনামিকা চোখের জল মুছে ভালোভাবে চোখমুখ ধুয়ে তারপর সাজিয়ার কাছে যায়। সাজিয়া জোহরের নামায শেষ করে মাত্র উঠেছেন।
-‘অনু, এদিকে বোস।’
-‘ডাকছিলে মা?’
-‘কান্নাকাটি ফুরোয়নি?’
সাজিয়ার কথায় অনামিকার মনে জমে থাকা কষ্টগুলো আবারো দলা পাকাতে লাগল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না অনামিকা। সাজিয়ার কথায় চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ালো অবিরত। সাজিয়া পরম স্নেহে তাকে বুকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন।
-‘মা রে, সুখী সংসার কী অতই সোজা? বোস, কিছু কথা বলি। সোহরাব কাল একটা অন্যায় করেছে যার জন্য তুই ওকে থাপ্পড় মেরেছিস। তুই চাইলে এর চেয়ে বড় একটা শাস্তি দিতে পারতি। কী জানিস? অপমান করে জর্জরিত করে ছেড়ে দেওয়া যাতে সোহরাব অনুতাপে পোড়ে কিন্তু তোর থাপ্পড়ে সোহরাবের মধ্যে ইগো জন্মেছে। অনুতাপ জন্মানো হয়ে উঠেনি আর। আমি বলছিনা তুই ভুল করেছিস। এর চেয়েও কঠোর শাস্তি ওর প্রাপ্য কিন্তু শাস্তির ফলাফল যেন অনুতাপ হয় তা বুঝতে হবে। বুঝলি?’
-‘জ্বী মা।’
-‘সংসার আয়নার মতো রে মা। আয়নার সামনে হাসলে আয়নাতেও হাসির প্রতিবিম্বই ফুটে উঠে। তাই বলে আয়নার কাঁচে হাত কাটলে তখনো হাসবি তা হবে না। মানুষ গিরগিটিকে নেতিবাচকভাবে দেখলেও সংসারে তুই গিরগিটি হতে পারলেই ভালো। পরিস্থিতির সাথে যতরঙ বদলাতে শিখবি ততই সংসারটা গোছাতে পারবি।’
অনামিকার মনটা ভালো হয়ে গেল। সোহরাবের প্রতি জমা ক্রোধটা মিইয়ে গেল। আসলেই অনামিকার শাস্তির ধরণটা ভুল ছিল। পরবর্তীতে এ বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে তার কিন্তু মা যে বললো সংসার আয়নার মতো। সে হাসলে অপরপক্ষও হাসবে? একবার কি চেষ্টা করে দেখবে অনামিকা?
______________________
সোহরাব অফিস থেকে ফিরলো সন্ধ্যা সাতটায়। ঘরে ঢোকার পূর্বেই দেখলো সুমি মলিনমুখে দুয়ারে বসে।
-‘কীরে সুমি? এমন মুখ করে সন্ধ্যায় দরজায় বসে আছিস কেন?’
-‘আর বলো না ভাইয়া। তন্বীর তো শরীর খারাপ কিন্তু ভাবীর যে কী বলো, দুপুর থেকে বিকাল অবধি খুব মন খারাপ করে ছিল। ঠিকমতো কথাই হয়নি। এখন আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত। তাই একা ভালো লাগছেনা।’
-‘ওহ। আচ্ছা ঘরে আয়।’
সোহরাবের মাথায় রাহেলা বানুর কথা ঘুরতে লাগল। সে আশেপাশে খুঁজতে লাগল তাকে। সাজিয়া শেখকে দেখেই প্রশ্ন করলো,’মা ফুফু কোথায়?’ সাজিয়া বিষয়টা আঁচ করতে পেরে সোহরাবকে ঘরে ডাকলেন। সোহরাব দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে মায়ের সাথে চলে গেল।
-‘সোহরাব বোস, তোর সাথে কিছু কথা বলবো।’
-‘বলো আম্মা।’
-‘অনামিকা যে তোর স্ত্রী এটা কি তুই ভুলে যাস?’
-‘আম্মা, ঐ মেয়েটার সাথে আমি সংসার করতে পারবো না। ও একটা খারাপ মেয়ে। ইসলামে স্বামীর গায়ে হাত তোলা জঘন্য পাপ। ও কতটা খারাপ তুমি ভাবো।’
-‘ও খারাপ হলে তুই সাধু? ইসলামে স্বামীর গায়ে হাত তোলা পাপ আর স্ত্রীকে মারা পুণ্য তাইনা? অনামিকা জেদী তবে খারাপ মেয়ে নয়। তুই ভালো ব্যবহার করা সত্ত্বেও ও কখনো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে? তোকে অপমান করেছে?’
-‘……….’
-‘কথা বলছিস না কেন? জানিস না তাই না? জানবি কী করে তুই তো ওর সাথে কখনো ভালো ব্যবহার করিসইনি। একবার ওকে বুঝে দেখ, ও বাহির থেকে যতটা কঠিন ভেতরটা ততটাই কোমল। নিজের সংসার নিজে সামলাতে শেখ। মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষের মতো অন্যের কথায় উঠ-বস করিস না। আর যার পরামর্শে অনামিকাকে অবহেলা করছিস তার কীর্তিকলাপ শুনবি?’
-‘মানে?’
-‘তোর গুণধর ফুফু আর কী! ছেলেকে বিয়ে করালো না সুন্দরী গরিব মেয়ে দেখে যাতে মেয়েকে পায়ের তলায় রাখতে পারে। দিনভর এই আদেশ, সেই ফরমাশ, ছেলেকে এই সেই পরামর্শ দিয়ে ছেলে এখন তার বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। তোর ফুফুর তাতেও আক্কেল হয়েছে? সংসারে আগুন লাগানোটা তার অভ্যেস হয়ে গেছে।’
-‘কী বলছো আম্মা!’
-‘ছোটবেলায় তোর বাবা যখন আমাকে মারতো তুই বলতি বড় হয়ে আমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবি। অথচ আমার হওয়া সিংহভাগ অত্যাচারের কারণ ছিল তোর ফুফু। যে বাবাকে তুই ছোটোতে অপছন্দ করতি, বড় হয়ে তুই ঠিক তার মতোই হয়ে উঠলি। আমার শিক্ষায় এতটা গলদ ছিল? অনামিকার জীবনটা বোধহয় আমি নিজ হাতে নষ্ট করে দিলাম। যদি পারিস, ওর সাথে একটু ভালো ব্যবহার করে দেখ ও তোকে ফিরতি উপহার কী দেয়।’
চলবে…