#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_৩
শাশুড়ির সাথে এক মুহূর্তের ঝাপসা কলহে ফাইজার মন বিষিয়ে উঠেছে। হাত পা গোপনে অবশ হওয়ার ভাব ধরেছে। আজ তাসরিফ সুকৌশলে এড়িয়ে গেলো। কাল কি করবে? একই প্রসঙ্গ যখন তাসরিফের মা পরশু তুলবে তখনই বা কি করবে, কি বলে চাপা দেবে তাসরিফ এই বিষয়? ফাইজার মন তড়পিয়ে উঠলো। মনে বসে রইলো এক ঝাঁক চিন্তা, শঙ্কা, আর আফসোস। আলস্যে প্রশ্ন ওঠে, অফুরন্ত ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখা সংসার কি শুধু মাত্র একটা সন্তানের অভাবে ভেঙে যেতে পারে? সন্তানই কি জীবনের সব? ফাইজার ভেতর হতে প্রত্যুত্তর আসে, ঘরের মানুষ খাঁটি হলে চৌকাঠের ওপাশে থাকা মানুষের কথায় কি যায় আসে? এমনও অনেক দম্পতি আছে যারা নিসন্তান! সন্তানহীনা জীবন পার করে দিয়েছে তারা বেমালুম।
.
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সূর্য যেন ঘুরে অস্তের পথ ধরেছে। দুপুর ছেড়ে বেলা এখন বিকেলের প্রহরে। ছায়াছবির দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ হয়েছে। বেলা দেখে কোনো পন্ডিত ব্যাক্তি বলে দেবে আছরের ওয়াক্তের সময় হলো বলে। ফাইজা ঘুমিয়েছিল। দুপুরের খাওয়া বাকি পরে আছে। তাসরিফ এলে খাবে বলে করে করে বকেয়া পরে গেছে ওবেলার খাবার। আজকাল তাসরিফ বড্ড অনিয়ম করছে বাড়ি ফেরায়। সার কথা ইদানীং সে পাল্টে গেছে। ফাইজার ঘুমের সময় খুব দূর অব্দি গড়াতে পারলো না। ক্ষুধার জ্বালা টেনে ধরে রইলো যেন। অগত্যা চোখের পল্লব খুলে গেলো। বিছানায় বসে মিনিট দুয়েক ঝিমঝিম করা মাথা পরখ করে ফাইজা চলে গেলো ওয়াশরুমে। ফিরে এসে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে অনেক খানি অবাক সে। এমনটা মনঃক্ষুণ্ন করে দেওয়ার মতো ব্যাপার। তাসরিফ একা বসে খাবার খাচ্ছে। বেশ মনোযোগ সহযোগে। ফাইজার পদশব্দ অব্দি তার কর্ণে পৌঁছায়নি। ভারী মন অস্পষ্ট অভিমান মনে ধারণ করলো। ফাইজা গলা খাকড়ি দিয়ে টেবিলের শূন্য গ্লাস পানি পূর্ণ করে দেয়ার মুহূর্তে নিজের অবস্থান জানান দিতে তাসরিফের উদ্দেশ্যে বলল
— কখন এসেছেন?
বাঁধ ভাঙা অভিমান। ফলস্বরূপ সম্বোধনটা আপনিতে পদার্পণ করেছে। তবে হয়! কে জানে কি এমন কালো ছায়ার হাতছানি পরেছে। তাসরিফ অভিমানীর অভিমান বুঝেও স্বাভাবিক আছে। সে খাবারের প্লেটে দৃষ্টি রেখে কুঁচকানো কপালে বলতে ব্যাস্ত
— একটু আগে।
ফাইজা পুনরায় প্রশ্ন করলো
— আমাকে ডাকলে না যে?
— কতবার ডেকে তুলে বলবো খাবার দাও? তুমি তো জানো আমি আসবো। আমাকে তোমার খাবার দিতে হবে।
গলার স্বরটা খর্বই। তবে বিরক্তির মাত্রা অতি উচ্চ। ফাইজা চমকে উঠেছে। এভাবে কেন বলছে তাসরিফ?
— আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম।
— গত রাতেও ঘুমিয়ে গেছিলে। কি করো তুমি ইদানীং? ঘরে বসে থাকো তারপরও কাজকর্ম ঠিকঠাক করো না।
ফাইজা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল। এক আনা, দু আনা করে আজ তাসরিফ দশ আনার পরিবর্তন দেখিয়ে দিলো। ফাইজার বুকের ব্যাথা থার্মোমিটারের ধুপ করে বেড়ে যাওয়া পারদের মতো বেড়ে গেলো। ভাবনায় কতই না ভ্রান্তি ছিলো ফাইজার। সে ভেবেছিল গতরাতে সে না খাওয়ার দরুণ তাসরিফ খায়নি। কিন্তু ব্যাপারখানা তো খাবার প্লেটে দেওয়র মতো কেউ ছিলো না বলে খাবার খেতে পারেনি তাসরিফ। ফাইজার চোখ চিকচিক করে উঠলো। তাসরিফ খাবার শেষ করে উঠে দাড়িয়ে গেছে। পা বাড়িয়ে চলতেও শুরু করেছে। ফাইজা ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো। তাসরিফের প্রতিটি কর্ম যেন প্রমাণ করলো চাপা বিরক্তি, ফিকে হয়ে আসা ভালোবাসা। ফাইজার অগাধ বিশ্বসের মহল ভাঙতে শুরু করেছে। প্রিয় মানুষের এমন পরিবর্তন অসহ্য রকমের পীড়া দিচ্ছে তাকে। পেটের ক্ষুধা নাই হয়ে গেলো ফাইজার। ঘরে ফিরলো ভাঙা মন নিয়ে। তাসরিফ বেলকনিতে চেয়ার পেতে বসেছে। গ্রিলের ফাঁকে গুমোট আকাশ দেখা যায়। বৃষ্টি নামার সংকেত। ফাইজা বেলকনিমুখো জানালা ধরে দাড়ালো। তাসরিফ তার অস্ত্বিত্ব অনুভব করতে পারলো কিনা কে জানে? তবে ফাইজা অনুভব করলো পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো। এমন মেঘ দেখলে, বৃষ্টি হলে প্রায়ই ভেজা হতো। তাসরিফ কে পাশে দার করিয়ে রেখে লাফিয়ে, ঝাপিয়ে বৃষ্টি বিলাশ করতো ফাইজা। তাসরিফ কেবল ফাইজার অবুঝ কান্ড দেখে হাসতো। কখনো বা ফাইজাকে অজান্তে উৎসাহ দিতে হাত বাড়িয়ে ঘুরিয়ে নাচাতো। বড্ড মনোমুগ্ধকর ছিলো সেই স্মৃতিগুলো। ফাইজা হঠাৎ এক পা দুপা করে এগিয়ে গেলো তাসরিফের নিকট। পাশে দাড়িয়ে আচমকাই শুধালো
— তুমি কি আমার ওপর অনেক বিরক্ত? তোমারও কি মনে হয় সন্তান ছাড়া জীবন চলে না?
তাসরিফ এক পলক দেখলো ফাইজাকে৷ ফাইজার হুট করে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন সে কুড়িয়ে নিয়ে বলল
— জীবন হয়তোবা চলে। তবে পরিবার সুখী হয় না।
আরো একটা বড়সড় ক্ষত তৈরি হলো তাসরিফের বাঁকে ফাইজার হৃদয়ে। থমকে গেলেও সময় নিয়ে নিজেকে সামলে তুলল। অতঃপর তীব্র অনিচ্ছা থেকে, অভিমানে ভেসে গিয়ে বলল
— তাহলে বিয়ে করো আরেকটা। আমার ডিভোর্স কি দরকার? ডিভোর্স নিবা?
দু’আঙ্গুলে মাথার ভর নিহিত করে বসে ছিলো তাসরিফ। ফাইজার কথায় তার একবিন্দু যেন ভাবান্তর হলো না। একচুল পরিমাণ বিচলিত হয়ে অবস্থানের পরিবর্তন করলো না। সরল বাক্যে জবাব দিলো
— পরে বলবো। ভেবে বলবো।
ফাইজা উত্তপ্ত মেজাজ মন নিয়ে তাসরিফের কথা ছো মেরে নিয়ে বলল
— পরিবার সুখী করা দরকার। তুমি করেই ফেলো বিয়ে।
— আচ্ছা।
শীতল কন্ঠের স্বীকারোক্তি তাসরিফের। এ পর্যায়ে ফাইজার রাগ ছিটকে যেন বহিঃপ্রকাশ পেলো। অশান্ত হয়ে তাসরিফের সম্মুখে দাড়িয়ে বলল
— এতো স্বার্থপরই যখন হবে তখন আমার অপারেশনের পর আমাকে সাহস কেন দিতে? কেন বলতে একটা সন্তানই সব না। স্বামী স্ত্রী মানেই সন্তান জন্ম দেওয়া না। এই নীতিবাক্য গুলো কেন শোনাতে আমাকে? অপারেশনের পর দিনই ডিভোর্স দিয়ে দিতে। ভাঙা মন যত্ন করে জোরা লাগিয়ে আবার কেন ভেঙে দিচ্ছো? সমস্যা কি তোমার? কি চাও তুমি?
— ফাইজা, চিৎকার কোরো না। ভালো লাগছে না আমার।
ফাইজা ফুঁসে উঠলো। চোখ অশ্রুর ভীরে উপচে দিলো জল। আবারও আবেগের তাড়নায় ছুটে এলো কিছু কথা
— আমি চলে গেলে তুমি খুশি হবে?
ফাইজার কথায় তাসরিফ এবার উঠে দাড়িয়ে গেলো। তবে বেচারা তাড়াক করে উঠে বসলেও ক্ষুদ্ধ হতে পারলো না। হাজার চেয়েও ঠিক আঘাত করে কথা বলতে পারছে না ফাইজার সাথে।
— আমি তো চাই তুমি চলে যাও। মন থেকে চাই তুমি চলে যাও।
ফাইজার চোখে চোখ নিবন্ধ করে গাঢ় কন্ঠে তাসরিফ বলে উঠলো এ কথা। ফাইজা জল গড়িয়ে পরা আঁখি নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো তাসরিফের দিকে। আচমকা তাসরিফ মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে দিলো ফাইজাকে। আলগোছে দু কদম দূরে সরে গেলো ফাইজা। তাসরিফ পা বাড়ালো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বুকের খাঁচায় যেন প্রাণপাখি ছটফট ছটফট করতে শুরু করলো। একবুক আফসোস থেকে হাত চলে গেলো বুকের বা পাশে। বড্ড করুণ হৃদপিণ্ডের অবস্থা। ঠিক এমনই করুন দশা তার টি শার্টের বুক পকেটে থাকা একটা বেলি ফুলের মালার। ফাইজার জন্য কেনা হয়েছিল। কিন্তু দেওয়া হয়নি। দিতে দেয়নি আফসোস!
.
তাসরিফের ওমন ব্যাবহার ফাইজা হজম করতে পারলো না। ডুকরে কাঁদল তাসরিফ ঘর ছেড়ে চলে যেতেই। পৃথিবী বড্ড নিষ্ঠুর না! স্বার্থ ছাড়া কেউ ভালোবাসে না। স্বার্থতেই যেন ভালোবাসা নিহিত। হয়তো জিতে যাবে তাসরিফের মা। হয়তো ফাইজার শাশুড়ির নিকট গিয়ে বুকে দগদগে ক্ষত রেখে হাত পেতে চাইতে হবে ডিভোর্স পেপার। নয়তো খুব গোপনে সবার আগোচড়ে আড়ালে চলে যেতে হবে ফাইজার। তার ঘরের মানুষ আর সে মানুষ নেই। খাঁটিতে খাদ পরেছে। চৌকাঠের ওপাশের মানুষগুলো তাই জিতে যাওয়ার পথে।
চলবে….
( গল্প কেমন যে হচ্ছে আর কেমন যে হবে পরবর্তীতে কে জানে 🥲 আমার তো লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে লেখালেখি সব ভুলে গেছি। হ য ব র ল টাইপ বাক্য লিখছি শুধু)