#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_৫
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আমি হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। স্মরণের দিকে চোখ পরতেই সে কটমট করে তাকালো আমার দিকে। আমি তড়িঘড়ি করে চোখ সরিয়ে নিলাম। একটু হলেও বুঝলাম রাস্তা থেকে কিভাবে বিছানায় চলে এসেছি। কিন্তু বুঝে উঠতেই হৃদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে অস্বস্তিকর কারবার হলো। আমি যে তার পিছু নিয়েছিলাম এটা সে জেনে গেলো? আবার কি কি বলে ঝাড়বে আমাকে?
— এখন কি ঠিক আছেন আপনি? পানি খাবেন?
ভাবনার মাঝে অচেনা ডাক্তারের কথা কর্ণপাত হলো। আমি এক নজর দেখার জন্য মুখ তুলে চাইলাম তার দিকে। কিন্তু ভয়ে যেন মুখে কোনো বাঁকই ফুটাতে পারলাম না। মাথার আর ঘারের ওপর অত্যাচার করে বুঝিয়ে দিলাম আমার পানি খাওয়াটা চূরান্তরূপে জরুরি। সুদর্শন ডাক্তারটা আমার শব্দহীন ভাষা বুঝে পানি পূর্ণ একটা গ্লাস এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি ঢকঢক করে পান করে নিলাম। এমন সময়ই স্মরণ বলে উঠলো
— ওমন আলুর বস্তার মতো ঠাস করে পরার কারণটা কি?
আমার মুখ ভর্তি পানি ছিলো। এমন সময়ই স্মরণের এ প্রশ্ন। না চাইতেও আমার চোখ চড়ক গাছ হয়ে উঠলো যেন। মুখের পানিটুকু স্থিতি জড়তায় আটকে গেলো ভাবনার দরূণ। আমাকে কি আলুর বস্তুা বলা হলো? আকাশ পাতাল এক করে ভাবনায় মেতে উঠলাম। আমাকে কি সত্যিই আলুর বস্তা বলল? আমি না মাত্র এক মোন পাঁচ কেজি!
— অঙ্কন, বোবা হয়ে গেছে? অতিরিক্ত ভয় পেলে মানুষ কি বোবা হয়ে যায়?
স্মরণ গভীর চোখে আমাকে পরখ করতে করতে হঠাৎ বলল। ভাব খানা তার এমন যেন সে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছে। তার এমন কথা শুনে আমার চোখ যেন পারলে কোটর ছাড়া হয়ে যায়। অঙ্কন নামের ডাক্তারটা ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তার অভিমত হলো
— ভয় পেলে মানুষ হার্ট অ্যাটাক করে। কথা এড়িয়ে আসে। কিন্তু পার্মানেন্ট বোবা তো হয় না বন্ধু!
মনের সবটুকু হতাশা নিয়ে সে এ কথা বলতেই আমি এবার ভেতরে ভেতরে রাগ ক্ষোভ নিয়ে মুখের পানিটুকু গিলে ফেললাম। বাজখাঁই গলায় বলে উঠলাম
— আমি বোবা হইনি।
আমার পরিষ্কার কন্ঠস্বর তাদের কর্ণপাত হতেই তারা একযোগে তাকালো আমার দিকে। আমিও তাকিয়ে রইলাম উদ্দেশ্যহীন, ভাবশূন্য হয়ে। এরপর হঠাৎ স্মরণের প্রশ্ন ছুড়ে দেয়
— কি হয়েছিল?
— ভুত আমার কাঁধে হাত রেখেছিল।
ভীষণ ভীত হয়ে একথা বলে দিতেই স্মরণ যেন ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল
— কিহহহহহ?
আমি মিনমিন করে বললাম
— ভুত। ওর ঠান্ডা হাত দিয়ে আমাকে ধরেছিল।
স্মরণ আমার কথা শুনে ক্ষণিক ফোঁসফোঁস করে উঠলো। এরপর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে সে রাগ ভরা চেহারা নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো। অঙ্কের উদ্দেশ্যে বলে গেলো
— সরি ভাই, এতো রাতে তোকে বৃষ্টির মধ্যে ডেকে নিয়ে এসে পাগলের চিকিৎসা করানোর জন্য। আমার উচিত ছিলো তখনই এটাকে পাবনায় পাঠিয়ে দেওয়া।
আমি এমন কথার পিঠে শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলাম স্মরণের যাওয়ার পানে। পাশ থেকে অঙ্কন বলে উঠলো
— কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাই একটু এমনই। ওর মাথা বেশি বেশি গরম হয়। ভাবি মারা যাওয়ার পর…..
অঙ্কন আরো কিছু বলেছিল কিন্তু আমি তা মস্তিষ্কে যেন ধারণ করতে পারলাম না। এটা আবার বলে কি? কে কার ভাই?
— কে ভাই? কার ভাই?
আমি বড্ড নিষ্পাপ কণ্ঠে জানতে চাইলাম। উত্তরটা দেওয়ার আগে অঙ্কন কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। অতঃপর ধীর কন্ঠে বলল
— স্মরণ আপনার দুঃসম্পর্কের ভাই না?
আমি আশ্চর্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম অঙ্কনের দিকে। তবে কি পরিচয় পর্ব দেওয়া হয়ে গেছে অনেক আগে? সে দুঃসম্পর্কের ভাই হয়ে গেলো আমার? আমি ভাবনার মাঝে অঙ্কনকে বললাম
— হ্যা, ভাই হয়। আমার দাদির হাসবেন্ড। দাদা ভাই আমার।
অঙ্কন আমার কথা মজার ছলে নিলো। হঠাৎই হাসতে হাসতে তার শহিদ হয়ে যাওয়ার উপক্রম দেখতে পেলাম। আমি অজানা কারণেই মনের মাঝে রাগের অস্তিত্ব পরখ করলাম। অঙ্কন ছেলেটার হাসি এতটুকুও পছন্দ হচ্ছে না এমুহূর্তে । আমি তো ভেবে কুল পাচ্ছি না কি হবে আমার। কি বলা হবে আমাকে, আর কি করা হবে আমাকে স্মরণের পিছু নেওয়ার অপরাধে?
.
অঙ্কন ডাক্তার একটু পরই বেরিয়ে গেলো আমার ঘর থেকে। আমি ফ্রেশ হয়ে ভেজা শাড়ি ছেড়ে প্রায় এক ঘন্টা হলো ঘরবন্দী হয়ে বসে আছি। দু’টো টেবিল ল্যাম্প, দু’টো বৈদ্যুতিক বাতি সবই সচল রাখলাম। রাত দু’টো বাজতে চলল। ক্ষুধায় পেটে ইদুরের ছোটাছুটি। কিন্তু খেতে যাওয়ার সাহস টুকু করে উঠতে পারছি না। যদি স্মরণের সম্মুখে পরি? কৈফিয়ত দিতে হবে। কিন্তু কোনো প্রকার কৈফিয়ত আমার নিকট গোছানো নেই।
.
রাতটা পার করলাম বড্ড ভয়ে ভয়ে। বারংবার মনে হলো, এই বুঝি আবারও সেই ঠান্ডা হাতের সংস্পর্শ পেলাম, এই বুঝি অথৈ এসে আমার গলা চেপে ধরে বলবে,
” তোর সাহস হয় কিভাবে আমার স্মরণের বউ হওয়ার?”
আমি কল্পনায় এ প্রশ্নের জবাব গুছিয়ে রেখেছিলাম। আমি বলে দিতাম
” আপনার বরের বউ হওয়ার ইচ্ছে আমার একটুও ছিলো না। আমি জানতামই না সে বিবাহিত, বাচ্চাযুক্ত। সাথে এমন অসভ্য যে কিনা অন্যের কাছে বউকে দুঃসম্পর্কের বোন বলে পরিচয় দেয়।”
— আন্টি আর কতক্ষণ লাগবে? আমি স্কুলে যাবো না?
ছোঁয়া খাবার টেবিল হতে আমার উদ্দেশ্যে কথাটা বলতেই আমার হুঁশ হলো। আস্তে করে জিভ কেটে প্রত্যুত্তর করলাম
— আসছি। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আমার হয়ে গেছে।
তড়িঘড়ি করে প্লেটে ভাত বেরে নিলাম। ছোট মেয়েটা সকালের নাস্তা হিসেবে ভাতই খায়। স্মরণ খায় হালকা কিছু। তার খাবারটা গোছাতে গিয়েই ছোঁয়ার খাবার জোগাড় করতে দেরি হয়ে গেলো।
— জয়নব খালা, আপনি থাকতে অন্য কেউ কেন ছোঁয়ার খাবার নিয়ে যাবে? রান্নাও অন্য কেউ কেন করে?
হঠাৎই পেছন থেকে এমন উক্তি ছুড়ে মারলো কেউ। আমি ছোঁয়ার প্লেটে মাংস রাখছিলাম। পেছন ফিরে একবার দর্শন করলাম অনাকাঙ্ক্ষিত কথার মালিককে। সে শক্ত চোখ মুখ নিয়ে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক আগে থেকেই এ বাড়িতে রান্নার সব কাজ জয়নব খালা করে আসছেন। শুনেছি ষোল বছর হয়ে এলো। স্মরণের মা বেচে থাকা কালীন সময় থেকেই উনি আছেন। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে কখনো যেন তিনি এমন কথা শোনেননি। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সামান্য আতঙ্ক নিয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন স্মরণের দিকে। কিন্তু স্মরণের তাতে এক রত্তিও ভাবান্তর হলো না। সে এবার আমাকে উদ্দেশ্যে করে বলল
— তৈরি হয়ে থাকবেন। আজ বিকেলেই এই বাড়ি থেকে চলে যাবেন। ড্রাইভার রেখে আসবে অন্য বাড়িতে।
একথা কর্ণপাত হতেই আমি তড়িৎ গতিতে তাকালাম তার দিকে। সে পুরোদমে আমার চাহনি উপেক্ষা করে পেছন ঘুরে অগ্রসর হলো তার গন্তব্যের দিকে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, এই ঘর আমার পর করা ভীষণই অসম্ভব। আমি ভালো থাকতে পারবো না। আমার এই ভাবনাকে অজানায় প্রাধান্য দিয়ে হঠাৎ ছোঁয়া আমাকে ডেকে উঠলো
— আন্টি, খাইয়ে দাও তাড়াতাড়ি। স্কুলে যাবো আমি।
আমার তব্দা ভাব কাটবে কি আরো যেন বেড়ে গেলো তরতর করে। আমি হঠাৎ জয়নব খালাকে বললাম
— খালা, মেয়েদের স্বামীর ঘর এতো আপন হয় কেন?
খালা পাশ থেকে বলে উঠলেন
— কারণ মেয়ে মানুষের স্বপ্নই একটা সংসার। স্বামীর মায়া আর বাড়ির মায়ায় পরে যায় দেখেই তো যুগের পর যুগ অচেনা জায়গায়, অচেনা মানুষের সাথে সংসার করতে পারে।
আমি জয়নব খালার কথাটা সেকেন্ড দুয়েকের জন্য গভীর করে ভাবলাম। আমি কোনটার মায়ায় পরেছি? স্বামীর? নাকি বাড়ির?
চলবে….
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। )