#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
১৭.
রেজাল্ট শিট হাতে নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে মেঘালয়া সেদিকে। কিছুক্ষণ আগে ইরাজ মার্কশিট তুলে এনে হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকেছে হাত-মুখ ধুতে। মেঘালয়াকে দেখতে কেমন প্রাণহীন, জড়ো পদার্থের মতো লাগছে। যেন ভেতরে অনুভূতির বড়ো অভাব। মাথাটা ঝুঁকিয়ে চেয়ে আছে রেজাল্ট শিটটির দিকে। ইরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মেঘালয়াকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ডাকল, “মেঘ!ʼʼ
মেঘালয়ার পক্ষ থেকে জবাব নেই। অনিমেষ চেয়ে আছে সেই কাগজটির পানে। ইরাজ পা ফেলে বেরিয়ে যেতে অগ্রসর হয়ে আবার পা ঘুরিয়ে বিরক্ত হয়ে এসে বসল সোফার সামনে থাকা কাউচের ওপর। তখনই মেঘালয়ার চোখ থেকে টুপ করে একফোটা পানি সেই কাগজে পড়ে। ইরাজের ভেতরে আচমকা যেন এই দৃশ্য এক অদ্ভুত ধাক্কা মারল। মুচরে উঠল ভেতরে। কেঁড়ে নেওয়ার মতো কাগজটি হাত থেকে নিয়ে নিলো। মেঘালয়া ছেড়ে দেয় আস্তে করে। ইরাজ দেখেই এসেছে রেজাল্ট, আবারও কৃত্রিম ব্যস্ততা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কাগজটি। অতঃপর নিজের স্বভাবসুলভ কঠিন ভাব ধরে রাখতে মৃদূ ধমক দেওয়ার মতো করে বলল,
“মেয়ে মানুষ ঢং ছাড়া আর কিছু জানেনা? এমন ভাব করছিস যেন, সাড়ে চার সাবজেক্টে ফেইল। ৪.৯৪ জিপিএ তে পাশ করেছিস। এভাবে শোক পালনের কি আছে?ʼʼ
মেঘালয়া এবার মুখ তুলে চাইল। ইরাজের বুকটা আবারও ধুক করে ওঠে। মেঘালয়ার চির পরিচিত চঞ্চল চোখদুটো আজ বিষাদের জলে টলমলে। গাল গড়িয়ে পানি বেয়ে পড়ল এবার। ভাঙা গলায় বাচ্ছাদের মতো অভিযোগ করে নিজের বিরুদ্ধেই মেঘালয়া, “A+ তো আসেনি। আব্বুর সামনে এবার দাড়াব কি করে?ʼʼ
কান্নায় ভেঙে পড়ল মেঘালয়া। ইরাজের কেমন অস্থির লাগছে। চেয়েও আজ আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না মেঘালয়ার থেকে। ইরাজের কি যেন হয়ে গেল। হুট করে উঠে এসে মেঘালয়ার পাশে বসল। নরম স্বরে বলল, “পাগলি! তুই তো গুচ্ছতে পড়তে চাস। আর এস এস সি এর জিপিএ ফাইভ আছে তো। অনায়েসে চান্স হয়ে যাবে।ʼʼ
মেঘালয়ার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। ইরাজের এমন কণ্ঠস্বর তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল। চোখ মেলে তাকাল ইরাজের দিকে। থুতনির কাছে প্রতিক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। ইরাজ সেদিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসল মৃদূ। অতঃপর বলল, “আঙ্কেল আসছে। বাপের সামনে এভাবে যাবি? আর তোর বাপ তোর অবস্থা দেখে আমাকে কেলিয়ে যাবে।ʼʼ
মেঘালয়া চমকে উঠে, আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ল। আব্বু আসছে, না জানি রেজাল্ট দেখে কত কষ্ট পাবে! আব্বুর সামনে যাবে কি করে মেঘালয়া! তা বুঝে ইরাজ আশ্বস্ত করে বলে, “রিল্যাক্স! তোর বাপ জানে। আমি তাকে সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলাম মার্কশিট তুলতে। চরম খুশি সে, মিষ্টি নিয়ে যখন তখন এসে পৌঁছাবে। তাড়াতাড়ি মুখে-চোখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেস হ।ʼʼ
মেঘালয়া উঠল না। থম মেরে বসে রইল। ইরাজ মার্কশিটের দিকে চেয়ে বলল, “কি ভাবছিস?ʼʼ
মেঘালয়া শুনতে পায়নি বোধহয়। ইরাজ আবারও কিছু বলতে যাবে, তখনই মেঘালয়া জবাব দেয়, “আমি বড়ো ভুল করে ফেলেছি জীবনে। নিজের কাছে নিজের ক্ষমা নেই। সকলে কি করে মেনে নেবে আমায়?ʼʼ— ব্যর্থতা প্রকাশ পায় মেঘালয়ার কথায়।
ইরাজ বুক ফুলিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। নিচের দিকে একটু ঝুঁকে বসে, হাতের কাগজটি সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল, নিজের হাতঘড়ি চাপা দিয়ে। এরপর বলল,
“এরকম ভুল তোর বয়সে সকলেই করে। তবে তুই ঠিক ভুল করিসনি, করেছিস বোকামি। যেখানে কোন অনুভূতি নেই, সেখানে রিলেশনশিপে চলে গেলি? শখ করে? নিতান্তই নির্বোধ তুই, যে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারে না। শুধুমাত্র নিজেকে প্রমান করতে, জটিল কোন মায়া, অনুভূতি ছাড়াই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলি?ʼʼ— ইরাজের কথায় অস্পষ্ট তাচ্ছিল্য।
মেঘালয়া আজ আবারও অবাক হয় ইরাজের পাল্টি খাওয়া আচরণে। এভাবে তো কোনদিন বুঝিয়ে বলেনি, করেছে শুধু তিরস্কার। হঠাৎ-ই কিছু মনে পড়তেই এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে মলিন হাসল, “আর আপনি সবটা জানা সত্ত্বেও তা চলতে দিলেন!ʼʼ
ইরাজ কোন জবাব দিল না। আচমকা এ কথায় তার মুখটা কেমন কঠিন হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল। মেঘালয়াকে আবারও তাড়া দিল, “নিজেকে সামলে ফ্রেস হয়ে আয়।ʼʼ
—
হেলাল সাহেব এলেন দুপুরের দিকে। তার দুহাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট। আজ তিনি ইমতিয়াজ সাহেবের বাড়ি বন্ধু হিসেবে নয়, এসেছেন বেয়ান হিসেবে । এটা ভেবে যেমন উত্তেজনা কাজ করছে, তেমন একটু অপ্রস্তুত বোধও ঘিরে ধরছে তাকে। আর তা প্রায় সম্পূর্ণটাই আনতারা খানমকে ঘিরেই বোধহয়। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময় একটু সংকোচ কাজ করল। আবার আজব অনুভূতিও হচ্ছে, তিনি তার ছোট্রো পরীর শশুরবাড়ি এসেছেন। এই তো কিছুদিন আগেও মেঘালয়া আব্বুর হাত ধরে শুক্রবার হলেই সন্ধ্যার পর ফুসকা খেতে যেত। রাত-বিরাত আবদার করত, “চলো কোথাও বসে আইসক্রিম খেয়ে আসি, আব্বু! এবার আবার না কোরো না যেন! চলো যাই।ʼʼ
তিনি নিয়ে যেতে না পারলে, ইরাজকে কল করতেন। ইরাজকে রাজী করাতে আবার আরেক খাটুনি হতো। ইরাজ তো জন্মের ঘাঁড় ত্যাড়া।
এসব ভাবতে ভাবতে ঢুকলেন ভেতরে। প্রথমেই দেখা হলো আনতারা খামনের সঙ্গে। ওখানেই বুকটা একটু ধুক করে উঠল, হেলাল সাহেবের। তবুও সাহস করে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আসসালামুআলাইকুম, ভাবীজান! কেমন আছেন?ʼʼ
আনতারা খানম নিরস মুখে কেবল সালামের জবাবই দিলেন, এরপর নিজেকে কাজে মস্ত ব্যস্ত দেখানোর চেষ্টা করলেন। মেঘালয়া বোধহয় শুনেছে আব্বুর কণ্ঠস্বর। লাফিয়ে নেমে আসল সিঁড়ি বেয়ে। একদৌড়ে এসে আব্বুর বুকে। হেলাল সাহেব কোনমতো মিষ্টির প্যাকেট নামিয়ে রেখে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। এতক্ষণ মেঘালয়ার আব্বুকে নিয়ে বহু সংকোচ থাকলেও, এতদিন পর আব্বুকে এত কাছে পেয়ে সেসব ভুলে বসল একদম। ইমতিয়াজ সাহেব অফিসে এখন। মেঘালয়া টেনে নিয়ে গিয়ে আব্বুকে বসার ঘরের সোফাতে বসাল। হেলাল সাহেব মেয়ের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছেন কিছু। এক পর্যায়ে মনে হলো, মেঘালয়া খারাপ নেই। তবে বাবার চোখ তো, মেঘালয়ার চোখের নিচের বসে যাওয়া অংশ বহু কথা বলে যায় বাবার কানে কানে।
বেশ কিছুক্ষণ পর কথায় কথায় মেঘালয়া আব্বুর কাছে আক্ষেপ প্রকাশ করে, “আব্বু! আমি ভুল করেছি, প্রতিনিয়ত তার শাস্তিও পাচ্ছি। আজ দেখো না আমার রেজাল্টের হাল। তবুও বলো তো, ভুলটা কি এতটাও বড়ো ছিল, যতটা মাশুল আমি দিয়েছি?ʼʼ
হেলাল সাহেব তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে। আজকাল সেই ছোট্রো মেঘালয়া বেশ ভারী ভারী কথা বলতে শিখেছে। হেলাল সাহেব ছোট্রো একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “ভুল কম, বোকামি বেশি করেছ তুমি।ʼʼ
মেঘালয়া ঘাঁড় নাড়ল, “হুম, আজ উনিও তাই বলল।ʼʼ
মেয়ের কথায় হাসলেন হেলাল সাহেব। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে, “বোকামিটা কি ছিল আব্বু!ʼʼ
“তুই নিজেই বুঝবি, মেঘা! বোঝার চেষ্টা করলে।ʼʼ
আব্বুর গলাটা বড়ো আদুরে লাগল এবার। মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল আব্বুর হাসি হাসি মুখের দিকে।
—
রাত এগারোটার দিকে রুমে আসল মেঘালয়া। আব্বুকে বিদায় দিয়ে তবে ফিরেছে রুমে। সারাটাদিন আব্বুকে কাছে পেয়ে যতটা ফুরফুরে লাগছিল মেজাজটা, এখন ঠিক ততটাই বিষন্নতা আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরছে ওকে। সন্ধ্যার দিকে ইমতিয়াজ সাহেব বাড়ি ফিরেছেন, তখন থেকে আলোচনা চলেছে, সবার মাঝে। একান্তে আর আলাপ করার সুযোগ পায়নি মেঘালয়া। আনতারা খানম পুরোটা দিন কেবল নিজের দ্বায়ভার পালন করেছেন, বেশি একটুও কিছু না। রাতের খাবার সকলে মিলে একসঙ্গে খেয়ে, তারপর হেলাল সাহেবকে পৌছে দিতে গেছে ইরাজ। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে বাইরে। আজ মেঘালয়া ভেতরটা হালকা হয়েছে এটা বুঝে, যে আব্বুর আর কোন ক্ষোভ নেই তার প্রতি।
সে মুখ-চোখে হালকা পানি ছিটিয়ে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। মস্তিষ্ক ভাবার জন্য একান্ত সময় পেয়ে, প্রথমেই ভাবনায় নিয়ে এলো, রেজাল্টের কথা। ভারী নিঃশ্বাস ফেলল মেঘালয়া। দিন শেষে মানতেই হবে, বাপ তো বাপই। বাপ-মায়ের বাঁধা নিষেধ সাময়িকভাবে খারাপ লাগার হলেও, তা একদিন এটা প্রমান করে ছাড়ে, বা-মা কখনও সন্তানের খারাপের জন্য কিছু করে না। তারা গুরুজন, তাদের চিন্তা-ভাবনা সর্বদা অগ্রগামী। তারা অবশ্যই সন্তানের চেয়ে ভালো বোঝেন জীবন সম্বন্ধে! মেঘালয়াও আজ বোঝে, সে যতদিন আব্বুর ছায়াতলে ছিল, সে জীবনের সেরা সময় কাটিয়েছে। যখনই নিজে সিদ্ধান্ত নিতে সচেষ্ট হয়েছে, জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরু ঠিক ওখান থেকেই।
আচমকা ইরাজের কথা মাথায় এলো। অতীতের ভাবনায় মজে গেল সে।
ইরাজ কখনও তাকে সেভাবে বুঝতে দেয়নি তার ভেতরে লুকানো অনুভূতি। তবে আব্বুর পরেই মেঘালয়াকে আগলে রাখার জায়গা ইরাজের শাসনই তো ছিল! তখন ইরাজকে বড়ো বিরক্ত লাগত মেঘালয়ার। সবকিছুতে বাঁধা! এটা করবি না, সেটা করতে পারবি না, ওখানে যাবি না, এভাবে চলতে হবে। ইরাজকে নিজের চারপাশে কারাগারের শিকলের মতো লাগত।
ইরাজ মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফিরে আসল বাড়িতে। এসে, টুকটাক বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দিল। তার কোনকালেই ইন্টারেস্ট নেই চাকরির প্রতি। যেখানে নিজের বাপের ব্যবসা আছে, চাকরির প্রয়োজন মোটেই নেই। তখন মেঘালয়া সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এসময় ইরাজ নিয়ম করে, মেঘালয়ার কলেজে যাতায়াত করত। চোখে-চোখে রাখা, বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, পরিচিত গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া, কখনও কখনও নিজে না উপস্থিত হতে পারলে লোক পাঠাত। এই ব্যাপারগুলো চরম বিরক্ত লাগলেও মেঘালয়া আব্বুর জন্য, আর ইরাজকে ভয় পাওয়ার কারনে চুপচাপ মেনে নিত।
কিন্ত মেনে নেয় নি আর এক পর্যায়ে। যখন তাবিরের প্রপোজাল সে এক্সেপ্ট করল, তারপর থেকে ইরাজের এই চোখে চোখে রাখার ব্যাপারটা মেঘালয়ার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। একদিন সাহস করে ইরাজকে বলেই দিয়েছিল,
“আপনি আর আসবেন না আমার কলেজে। আমি অনাথ নই। আমার আব্বু স্বয়ং জীবিত। আপনি এভাবে আমার পেছনে বডিগার্ডের মতো লেগে থাকেন, তা নিয়ে পুরো কলেজে আমাকে বেবী গার্ল, ম্যানিকুইন, বার্বিডল বিভিন্ন নামে ক্ষেপানো হয়। আমি ছোটো বাচ্ছা নই আর, চলতে পারি একা।ʼʼ
আসলে তাকে কেউ ক্ষেপাতো না, বরং তাবির এরকম বিভিন্নভাবে মেঘালয়াকে ভড়কেছে। ইরাজকে স্বপ্নেও আর এরপর থেকে কোনদিন কলেজের আশেপাশে দেখতে পাওয়া যায়নি। এমনকি তারপর একেবারে দেখাও হয়েছিল সেই চট্রগ্রামে। এর মাঝে আর ইরাজ কোনদিন মেঘালয়ার সম্মুখে আসেনি।
মেঘালয়া আব্বুর কাছেও এসে অভিযোগ করেছিল ঠিক একইভাবে। মেঘালয়ার আদুরে মুখের কথা হেলাল সাহেব ফেলতে পারেন নি। তিনি কল্পনাতেও আনেন নি তার অগোচরে এমন কিছু ঘটিয়ে চলেছে মেঘালয়া। এরপর থেকে মেঘালয়া একাই যাতায়াত করত। তাবিরের কাছে নিজেকে স্বাধীন প্রমান করতে, সমাজের আর সব মেয়েদের মতো চাল-চলন আয়ত্ব করে ফেলেছিল প্রায়।
চলবে..