#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব ২১
©জারিন তামান্না
তুমি যদি যেতে না চাও তাহলে এসো না। কিন্তু,এইবার আর আমাকে বাঁধা দেওয়ার কোন চেষ্টাও তুমি করবা না।
_তুমি বললেই হলো?তোমাকে তো ত্যাজ্যপুত্র করে বাড়ি থেকে বের করে দিছিল ওই লোক। এখন নিজে বিপদে পড়ছে বলে ডাকতেছে তোমারে।আর তোমারেও বলি হারি! বাবা একবার বলছে, আর ওম্নি ড্যাং ড্যাং করে ছুটতেছো তার কাছে।
_মুখ সামলায়া কথা বলো শেফা। উনি আমার বাবা আর তোমারও। তাকে বাবা বলে সম্বোধন করো। আর সে নিজে থেকে কিছুই করে নাই,আমার ব্যবহারে রাগে দুঃখে বাধ্য হয়ে ওমন করছিল। আর আমাকে ওই রকম ব্যবহার করতে বাধ্য করছিলা তুমি। আমিও নিরুপায় ছিলাম তখন। কিন্তু এখন নাই। তুমি থাকো তোমার মত,আমি আর আমার মেয়ে একাই যাবো।
_তোমার মেয়ে মানে? এই তোমার মেয়ে মানে কি হ্যাঁ? ওরে তো জন্ম দিছি আমি।তোমার একার মেয়ে ক্যাম্নে হইলো ও!
_জন্ম দিছো! সেটাও শুধু আমি তোমার হাতের পুতুল হইছিলাম বলে। নয়তো পেটেই মেরে ফেলতে চাইছিলা ওরে। আর খালি জন্ম দিছো বলেই ওর ওপর তুমি কোন অধিকার দাবি করতে পারো না,কোর্ট অন্তত সেই অধিকার তোমাকে দিবে না।
_মানেএএ? কি বলতে চাইতেছো তুমি?
_মানেটা খুব সহজ শেফা। তুমি যদি আমার সাথে সংসার করতে চাও তাহলে আমার সাথে ও বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে তোমাকে।সেটাও ভদ্রভাবে। কোন অশান্তি করবা না তুমি। আর যদি সেটা না চাও তাহলে তোমার সাথে আমার সোজা কোর্টে দেখা হবে। ডিভোর্সের দিন। আর তোমার যা অবস্থা তাতে প্রাপ্তির কাস্টাডিও তুমি পাবা না। আর পাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকলেও আমি সেটা হইতে দিবো না। বোঝা গেল? সরো এখন…প্রাপ্তির ব্যাগ গোছাইতে দাও।
_এএএ…এইই…কি বলতেছো তুমি এসব? ডিভোর্স..কোর্ট! তুমি কি আমাকে ভয় দেখাইতেছো? তুমি বলবা আর আমি ডিভোর্স মাইনা নিবো? ফাইজলামি পাইছো তুমি?
_আমি চাইনা এমন কিছু হোক। তোমার সাথে সংসার করার যদিও কোন ইচ্ছা আমার নাই,৩ বছর আগেই সেটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শুধুমাত্র আমার মেয়েটা যেন একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবার পায় তাই তোমার সাথে আছি এখনো। কিন্তু তুমি যদি এখন কোন ঝামেলা করো তাহলে এ সংসার ভাঙতেও দু বার ভাববো না আমি। আমার মেয়েটাও এডজাস্ট করে নিবে।ও পরিবারে সে ভালো থাকবে খুব। অন্তত তোমার কাছে থাকার থেকে ভালো থাকবে সে।
শেফা হতভম্ব হয়ে গেল পলাশের কথা শুনে। এ কোন নতুন মানুষকে দেখছে সে! তার হাতের কাঠপুতুল করে রাখা মানুষটার হঠাৎ কি হলো? সুতো কি ছিঁড়ে গেল তবে? এখন কি হবে তার! এত কষ্ট করে সংসার আলাদা করলো, এবার কি সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে শেষমেশ ! সব গুলিয়ে যাচ্ছে তার। এদিকে দ্রুত হাতে নিজের আর মেয়ে প্রাপ্তির জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে ভরছে পলাশ। রাতের ফ্লাইটেই ঢাকা যাবে সে। বাবার ওমন অবস্থা শুনে আর একমূহুর্তও দেরি করতে চাইছে না সে। প্রাপ্তি এখনো অনেক ছোট। তাকে নিয়ে যশোর থেকে ঢাকা অনেকটা পথ বাসে করে যাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই ফ্লাইটেই যাবে। কিন্তু শেফা জেদ করছে যাবে না। তাই তাকে না নিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পলাশ।
★
৫৩ ঘন্টা পরে আজ সকালে জ্ঞান ফিরেছে আমজাদ আলীর। আই.সি.ইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে তাকে। রাতে পলক আর তার চাচা ছিল হাসপাতালে। খবর পেয়ে পরের দিনই চলে এসেছিলেন তিনি। সারাদিন নিশাত আর শাহনাজ বানু ছিলেন। আর রাতে তারা ছিল। তিয়ান সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আর অফিস শেষে সন্ধ্যায় এসে দেখে গেছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে। জ্ঞান ফিরার পর তিয়ানের সাথেও আলাপ হয়েছে আমজাদ আলীর। শাহনাজ বানুর কাছে শুনেছে তার কথা।ছেলেটার দায়িত্বজ্ঞান দেখে বেশ অভিভূত আমজাদ আলী। সেই শুরুর দিন থেকে কতভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে ছেলেটা তাদেরকে। পলাশ থাকলেও হয় তো এভাবেই সব করতো।আলাদা হবার ৩ বছর পর এই প্রথম নিজের ছেলের কমতি এভাবে অনুভব করছেন তিনি।জীবনের এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে সব থেকেও না থাকার কথা ভেবে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার।
জ্ঞান ফিরার পর পলকের সাথেই প্রথম দেখা হয় আমজাদ আলীর। মেয়ের এমন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, মলিন মুখ দেখে বড্ড কষ্ট হয় তার।আজ তার কিছু হয়ে গেলে সব দায় দায়িত্বের ভার এই মেয়েটার ওপর এসে পড়বে। অথচ ক’দিন বাদেই এই মেয়েটার বিয়ে। নিজের পরিবার ছেড়ে শশুড় বাড়িতে নতুন পরিবারে চলে যাবে সে। তখন কে দেখবে তার স্ত্রী আর আরেক মেয়েকে। ওই মেয়েটাও বেশ ছোট এখনো। উনি না থাকলে তো অকূল পাথারে পড়তে হবে তাদের দুজনকে। অথচ আজ যদি তার ছেলেটা তার কাছে থাকতো তবে এসব কিছুই ভাবতে হতো না তাকে। তার এই দুঃসময়ে পলকেও একা হাতে সব সামলাতে হতো না। সেদিন রাতেও এসব নিয়ে অনেক ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু আজ তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। জীবন বারবার সুযোগ দেয় না। এই ঘটনার পরেও তিনি যদি সঠিক কোন সিদ্ধান্ত না নেন তবে পরিবর্তীতে হয় তো ভীষণভাবে আফসোস করতে হবে তাকে। তাই যখন স্ত্রীর সাথে দেখা হলো তিনি বললেন,
_পলাশের মা..
পলাশকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করার পর থেকে তিনি শাহনাজ বানুকে কখনো এই নামে ডাকেননি আর। বেশিরভাগ সময় সাজির মা নয় তো শানু বলেই ডাকতেন। কিন্তু আজ হঠাৎই এই পরিস্থিতিতে স্বামীর মুখে পুরোনো ডাক শুনে চমকে উঠলেন তিনি। ভয়ও পেলেন কিছুটা। না জানি আবার কি বলে আর অসুস্থ হয়ে যায় মানুষটা। ভয়ে চিন্তায় কিছু বলতে পারলেন না তিনি। মুখে অক্সিজেন মাস্ক নিয়েই আমজাদ আলী আবার বললেন,
_অবাক হচ্ছো কেন? ২৭ বছর তো এই নামেই বেশি ডেকেছি তোমায়।
_হ্যাঁ,কিন্তু তারপর তো…
_পলাশকে ফোন করো। ফিরে আসতে বলো।
_আ..আ..আমি? ফোন করবো? ভয়ার্তক কন্ঠে চোরাচোরা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। স্ত্রীর এহেন প্রতিক্রিয়ায় মুচকি হাসলেন আমজাদ আলী। তারপর বললেন,
_তুমি আমার স্ত্রী শানু। কিন্তু তার সাথে একজন মা! স্ত্রী হিসেবে তুমি তোমার স্বামীর সম্মানার্থে ছেলের কথা বলোনি,তাকে ফিরিয়ে আনার আবদার করোনি কখনো। কিন্তু,আমার অগোচরে একজন মা হিসেবে ছেলেকে ছাড়তেও পারোনি কখনো। ওর সাথে তোমার যোগাযোগ আছে। আমি জানি সেটা। কিন্তু এই নিয়ে তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। তুমি আসতে বলো ওকে। রাগ করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম ছেলেটাকে। আমার অবর্তমানে কাল সেই তো সব হবে এই পরিবারের। তার জায়গায় তাকে ফিরে আসতে বলো শানু।
স্বামীর এহেন কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না শাহনাজ বানু। আনন্দে স্বামীর এক হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন তিনি। পলক মেডিসিন নিয়ে মাত্রই এসেছে কেবিনে। কেবিনে ঢুকে মাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে মূহুর্তেই ভয় পেয়ে গেল সে। মনে মনে সঙ্কা জাগলো,”বাবার কিছু হলো না তো?” ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। আমজাদ আলী চোখ বুজে শুয়েছিলেন।তা দেখে মনের ভয়টা আরও বেড়ে গেল পলকের। মায়ের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_ম..আ..আ…মা! কি হইছে..এভাবে কাঁদতেছো কেন? আর বাবা..
_তোর বাবা পলাশ রে ফিরা আসতে বলছে রে সাজি। তুই বস্ এইখানে। তোর বাবার কাছে থাক।আমি পলাশ রে ফোন কইরা আসি।আসতে বলি ওরে। কতদিন দেখিনা আমার ছেলেটারে।কাঁদতে কাঁদতেই কথাগুলো বলে পলককে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না তিনি। চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে। পলক বিস্মিত। সেই সাথে খুশিও ভীষণ। খুব বেশি অপ্রত্যাশিত কিন্তু আনন্দের বিষয় এটা তার জন্য। তার পরিবারটা আবার আগের মত এক হয়ে যাবে। যদিও অন্তরার জায়গাটা ফাঁকা থেকে যাবে..তবুও অনেকটাই ঠিক হয়ে যাবে সব। অন্তরা কেন যে এমন করলো!মনে মনে এই নিয়ে আফসোস করলো পলক। বুক চিরে বেরিয়ে এলো হতাশা আর কষ্টের সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস। মেডিসিনগুলো ক্যাবিনেটের ড্রয়ারে রেখে বেডের পাশে রাখা চেয়ারে বসলো পলক। আমজাদ আলীর মুখের দিকে চাইতেই খেয়াল করলো অক্সিজেন মাস্ক পড়া মুখটায় সুখ দুঃখের ছায়া বোঝা না গেলেও চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল ঠিক জানান দিচ্ছে মানুষটার মনের ভাব। অন্তরে জমানো কথা,কষ্টগুলো এভাবেই নিরবে প্রকাশ করছেন তিনি। হাত বাড়িয়ে চোখের পানিটুকু মুছে দিল পলক। তারপর বাবার একহাত নিয়ে তার গালে ঠেকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। চোখ বুজে থাকলেও মেয়ের উপস্থিতি আর এসব কান্ডকারখানা সবই অনুভব করতে পারছিলেন আমজাদ আলী। এই মেয়েটাকে তিনি খুব বেশি স্নেহ ভালোবাসা দিতে পারেননি। কিন্তু মেয়েটা তার ঠিকই নিজের সবটা উজার করে ভালোবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে তাকে ।তার সম্মান বজায় রেখে চলেছে। আর যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসলো সেই মেয়েটাই তাকে সমাজের কাছে অসম্মানিত করে পালিয়ে গেলো বাড়ি ছেড়ে। এই জন্যই বোধয় লোকে বলে,ভালোবাসা কখনো মাপঝোক করে হয় না। সামনের মানুষটা কতটা ভালোবাসে তা দেখে অপর পক্ষের মানুষটা কখনো ভালোবাসে না। সে ভালোবাসে নিজের জোরে,নিজের মত করে। আরও একবার চোখের কার্ণিশ বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা। তবে এবারে এই অশ্রুধারার নাম ছিল সুখজল!
____________________________________
ব্যাগপত্র গুছিয়ে প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নিল পলাশ। এতক্ষণ পাশের ঘরে বসে পলাশ আর শেফার কথোপকথন
…চেঁচামেচির সবটাই শুনেছেন শেফার মা শিউলি বেগম। মেয়ের এহেন বোকামিতে বেশ রাগ হচ্ছে এখন তার। কিন্তু,এখন তিনি গিয়ে যদি না সামলান তবে হয় তো সবটাই বেরিয়ে যাবে তাদের হাত থেকে। কিছুই করার থাকবে না আর। তাই পলাশ চলে যাওয়ার জন্য বেরোতেই হন্তদন্ত ছুটে এলেন তিনি। বললেন,
_এভাবে কোথায় যাচ্ছো বাবা?শেফাকে না নিলে মেয়েটাকে ক্যাম্নে সামলাবা তুমি?
_আমি অনেক বলছি আপনার মেয়েকে। সে যাবে না বলছে।আমিও জোর করিনি তাকে।তাকেও আর প্রয়োজন নাই আমাদের।
_আরেএএএ বাবা,,,বোকা মেয়েটা না বুঝে কি বলছে না বলছে ওইটা নিয়ে রাগ করলে চলে বলোতো বাবা! আমি বুঝাই বলতেছি ওরে…ও যাবে তো তোমার সাথে। আমিও যাবো দরকার পড়লে।তাও তুমি এম্নে রাগ কইরা চইলা যাইয়ো না।
_আমি ওর সাথে যাবো না আম্মা। আর ও ডিভোর্স দিবে বললেই ভাবছে আমি ভয় পাইয়া যাবো। সুড়সুড় কইরা ফিরা যাবো ওই সংসারে? জীবনেও না। ওই লোক আমারে কম অপমান করে নাই। আরেএএএএ ওই কালী অপয়া মেয়েটারে উদ্ধার কইরা দিতেই আমার ওমন সোনার টুকরা ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলাম। কে না কে কি বললো,পুলিশ আইসা মিথ্যা কেসে ফাঁসাই দিল আর ওম্নি আমার ভাই খারাপ হইয়া গেল।
পলাশ আর শিউলি বেগমের কথার মাঝে তেঁড়ে এসে তেঁতানো গলায় কথাগুলো বললো শেফা। মেয়ের এহেন কাণ্ডজ্ঞানহীনতা দেখে রাগে ফুঁসে উঠলো তার মা। মেয়েকে ধমকে দিয়ে বললেন,
_আহ শেফা চুপ কর তুই। আমি কথা বলতেছিত জামাই বাবাজির সাথে। আর তুই কোন জেদ করবি না।তুইও যাবি ওই বাড়িতে।
_ আমি যাবো না ওই বাড়িতে। ওর যেখানে ইচ্ছা যাক।মেয়েও লাগবে না আমার।নিয়ে যাক ওই আপদটাকেও। ও ডিভোর্স দিবে আমারে..না? ও কি ভাবছে আমি এত সহজে ছাইড়া দিবো ওরে? নারী নির্যাতনের মামলা কইরা ওরে আর ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীর লোকেরে যদি জেলের ভাত না খাওয়াইছি তো আমার নামও শেফা না।
আচমকা শেফার এহেন আচরণ আর মামলা করার কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন শিউলি বেগম। সাথে প্রচন্ড রাগও হলো তার।মেয়ে তার নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার বন্দোবস্ত করছে। নিজ হাতে নিজের সর্বনাশ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ওদিকে তার ছেলেটাও জেলে। কবে নাগাদ জামিন হবে জানা নেই। আর এদিকে যদি মেয়ের সংসার ভাঙে তাহলে তার কি গতি হবে? গ্রামের ভিটে মাটিও তো হাতছাড়া হয়ে গেছে ছেলের কেস লড়তে গিয়ে। তাই মেয়ের সংসারে এসে উঠেছেন। এখন যদি এটাও না থাকে কই যাবে সে মেয়ে নিয়ে! হতচ্ছাড়ি বোকা মেয়েটা কি একবারও ভাবে নাই এ কথা?! -এসব কথা ভাবতেই মাথার ভেতর ভনভনিয়ে উঠলো শিউলি বেগমের। পলাশ প্রচন্ড বিরক্ত হলো শেফার এহেন আজেবাজে কথায় ।কিন্তু প্রকাশ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু বললো,
_এসবের পর আপনার মেয়ের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখা সম্ভব না আমার, মা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ডিভোর্স লেটার পাঠায় দিবো।সাইন করে দিতে বলবেন ওরে।
_আরেএ বাবা…কি সব বলতেছো এইগুলা। শেফা বোকার মত কি বললো আর তুমি রাগ করে বলতেছো সম্পর্ক রাখবানা। সম্পর্ক ভাঙা কি এতই সহজ বাবা? তাছাড়া মা ছাড়া ক্যাম্নে থাকবে এই মেয়েটা, ওর কথাটা তো ভাবো অন্তত।
_এখন আর নতুন করে ভাবার কিছু নাই মা।মেয়েটার জন্যই এতদিন ওর সাথে ছিলাম। কিন্তু,এর সাথে থাকলে আমার মেয়েটা কোনদিন ভালো শিক্ষা পাবে না। আর বাবা হয়ে এইটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। তাছাড়া আপনার মেয়ে তো গর্ভেই মেরে ফেলতে চাইছিল ওরে। শুধু আমার জন্য পারে নাই।এখনো চাচ্ছে না সে থাকুক।আর যদি ও মামলা করতে চায় তো করুক। আমিও কোর্টে গিয়েই মুখোমুখি হবো ওর।ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ। -বলেই মেয়েকে কোলে নিয়ে ব্যাগপত্র সমেত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল পলাশ।
পলাশ যেতেই মেয়ের ওপর রাগে ফেটে পড়লেন শিউলি বেগম। মুখে যা এলো তাই বলে গালাগাল করলেন মেয়েকে। কিন্তু,শেফাও কম কি! সে তার জেদ আর সিদ্ধান্তে অটল। মায়ের কোন কথাই এই মূহুর্তে তার মাথায় ধরলো না। কিন্তু, মায়ের এহেন চেঁচামেচিও সহ্য হলো না তার।মায়ের সাথে কতক্ষণ তর্ক বিতর্ক চললো তার। তারপর না পেরে গটগট নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল সে। এদিকে শিউলি বেগমও চেঁচামেচি করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। কিন্তু শেফাকে ও বাড়িতে পাঠানোর জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করার চিন্তাও তার মাথা থেকে গেল না।
____________________________________
রুকু আর মিসেস.রেহনুমা এসেছে হাসপাতালে। আমজাদ আলীকে দেখতে। ইয়ানাও এসেছে সাথে।পলকের সাথে দেখা হবে জেনে সেও বায়না করেছিল আসার জন্য। অগ্যতা তাকেও সাথে করে আনতে হয়েছে। আজ সকালে পলককে ফোন করেছিল রুকু। বৌভাতে পলক কি ধরণের শাড়ি পরতে চায় সেটা জানতে চেয়ে। তখনই কথায় কথায় জেনেছে আমজাদ আলীর অসুস্থতার কথা। শুনে প্রথমে কিছুটা রাগারাগি করেছে সে পলকের সাথে। কেন তাকে একবার ফোন করে জানানো হয়নি। সেও তো ডাক্তার। ঢাকা মেডিকালে কত ডাক্তার তার পরিচিত। আগে জানালে এত কষ্ট করে আবার বার্ডেমে আনতে হতো না। কিন্তু,পলক এর জন্য স্যরি বলেছে। কারণ,সে সময় সত্যিই তাদের কারও মাথায় আসেনি রুকুর কথা। এমনকি পরবর্তীতে ও বাড়িতে জানানোর কথাও কারও খেয়ালে আসেনি একবারও। তাছাড়া তিয়ান যেভাবে সবটা সামলেছে খুব একটা অসুবিধা হয়নি বলেই হয় তো তারাও আর কিছু ভাবেনি ট্রিটমেন্ট নিয়ে।ট্রেনিং এ যাওয়ার পর থেকে সিফাতের সাথেও খুব একটা যোগাযোগ নেই পলকের। তাই তাকেও জানানো হয়নি এসবের কিছুই। তাই ও বাড়িতেও কেউ কিছুই জানতে পারেনি আমজাদ আলীর অসুস্থতার ব্যাপারে।
★
আমজাদ আলীর সাথে দেখা করার পর কেবিনে বসেই তার ব্যাপারে কথা বলছিল রুকু পলকের সাথে। কোন ডাক্তারের আন্ডারে আছেন,কি অবস্থা, কোন সমস্যা আছে কি না এসব নিয়ে। মিসেস.রেহনুমা আর শাহনাজ বেগমও কথা বলছিলেন নিজেদের মাঝে। ইয়ানা নিশাতের সাথে গেছে কোথায় জানি। এমন সময় কেবিনে এলো তিয়ান।হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ছেলেকে দেখে অবাক হলো রুকু আর রেহনুমা।তবে, তাকে দেখেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন শাহনাজ বানু। কুশলাদি বিনিময়ের পর পরিচয় করিয়ে দিলেন রুকু আর রেহনুমার সাথেও। তিয়ানের সাথে পরিচিত হয়ে বেশ খুশি হলো তারা। পলককে এভাবে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদও জানালো। নতুন করে আরেকদফা নিমন্ত্রণ জানালো তাকে বিয়েতে আসার জন্য। তিয়ানও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই গ্রহণ করলো সেটা। তিয়ান বরাবরই মিশুক টাইপের ছেলে। তাই বেশ ভাব হয়ে গেল তাদের সাথেও। তিয়ানের কোন বোন নেই। তাই মিশুক আর স্নেহময়ী রুকুকে তার নিজের বড় বোনের মতই মনে হলো তার। এরই মাঝে ইয়ানাও এলো। হাতে আইসক্রিম নিয়ে। তাকে দেখেই চিনতে পারলো তিয়ান। সিফাতের আইডিতে বেশ কিছু ছবি দেখেছে তাদের দুজনের।কেবিনে ঢুকে অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখে ভ্রু কুচকে গেল তার। কৌতুহলী মনে প্রশ্ন জাগতেই সরাসরি পলককে প্রশ্ন করলো সে।
_মামণি,এই আংকেলটা কে?
ইয়ানার মুখে মামণি ডাক শুনে তিয়ান প্রথমে ভেবেছিল রুকুকে জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু, পাশ থেকে পলককে জবাব দিতে দেখে অবাক হয়ে গেল সে।
_এটা তোমার মামণির ফ্রেন্ড হয় সোনা। পলকের মুখে নিজের পূর্বপরিচয় শুনতে পেয়ে বড্ড স্বস্তি পেল তিয়ান।তারমানে পলক স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে। আলতো হাসলো সে। তারপরেই,ইয়ানাকে কাছে টেনে নিল তিয়ান। কোলে নিয়ে বললো,
_হ্যাঁ,,,আম্মু। আমি তোমার মামণির ফ্রেন্ড হই।কিন্তু এখন তো আমার তোমারও ফ্রেন্ড হতে ইচ্ছে করছে। তুমি কি আমার ফ্রেন্ড হবে?? বাচ্চা বাচ্চা মুখ করে বললো তিয়ান।
তিয়ানের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে দিল ইয়ানা। হাসতে হাসতে বললো,
_আমি তো এখনো অনেক ছোট,আর তুমি কত্ত বড়! তাহলে আমি তোমার ফ্রেন্ড হই কি করে?
_উউউউমমম…আমার অনেক বড় বড় ফ্রেন্ড আছে,কিন্তু কোন তোমার মত ছোট্ট কিউট ফ্রেন্ড নাই। তাই আমি তোমার ফ্রেন্ড হতে চাই। প্লিজ, প্লিজ.. প্লিইইইইজজজ!! করুণ মুখ করে বললো তিয়ান।
_আচ্ছা,ঠিক আছে। আজকে থেকে তুমিও আমার ফ্রেন্ড।
_থ্যাংকইউ আম্মুটাহ। বলেই ইয়ানার ছোট্ট গালে আলতো করে চুমু দিল তিয়ান। এরপর বললো,
_উউউউমমম, আমার নতুন ফ্রেন্ডকে তো তাহলে একটা ফ্রেন্ডশিপ গিফট দিতে হয়! তো কি চাই আপনার বলেন তো আম্মু?
_আমার কিচ্ছু লাগবে না ফ্রেন্ড। পাপাই আর বাবাই তো এত্ত এত্ত ডল..টয়েস আর চকলেটস দিয়ে আমার ঘর ভর্তি করে দিয়েছে। আম্মু তো বাবাই আর পাপাইকে হুমকি দিয়েছে অলরেডি।বলেছে এরপর আর কোন খেলনা আনলে ওগুলো আর জায়গা দেবে না। ইনুমণির ঘরে জায়গা নেই একটুও। তাই যখন জায়গা খালি হবে তখন তুমি গিফট দিও, ওকে?
ইয়ানার এমন কথায় কেবিনে উপস্থিত কেউ আর না হেসে পারলো না। হাসলেন আমজাদ আলীও। এতক্ষণ ঘুমে ছিলেন তিনি। তার ঘুম ভাংতেই তিয়ান দেখা করে কথা বার্তা বললো তার সাথে। এরপর, সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিল যাওয়ার জন্য। শাহনাজ বানু পলককে বললেন তিয়ানকে এগিয়ে দিয়ে আসার জন্য। অগ্যতা পলককে তার সাথে লিফটের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যেতে হলো।
পথে যেতে যেতে তিয়ান পলককে বললো,
_ভারী মিষ্টি মেয়ে ইয়ানা।
_হ্যাঁ।
_তা তোমার বিয়েতে কি আসবো আমি?
_ইনভাইট যখন করা হয়েছে তখন আসা না আসা তোমার ব্যাপার। আমি কি বললো এতে?
_কই না তো! তোমার বিয়েতে তো কেউ ইনভাইট করেনি আমাকে। বিথুকে তো তুমি নিজেই ইনভাইট করেছো বললো।কিন্তু আমাকে তো…. বলেই পাশ ফিরে পলকের দিকে চাইলো তিয়ান।
হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল তারা। তিয়ানের এহেন কথায় টনক নড়লো পলকের। দাঁড়িয়ে পড়লো ওখানেই। তিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলো মিটিমিটি হাসছে সে। চোখেমুখেও দুষ্টুমির আভাস। হতভম্ব চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো সে ওভাবেই। ব্যাপারটা ঠিক কি সেটা বুঝতেই হাসি পেয়ে গেল পলকের।তিয়ান আজও একই রকম রয়ে গেছে। কথার মারপ্যাঁচে ফেলে দুষ্টুমি করার অভ্যাস আজও একই আছে তার।এটা ভাবতেই মুচকি হাসলো সে মনে মনে। কিন্তু বাইরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
_ইনভাইট করলে আসবে তুমি বিয়েতে?
_অবশ্যই আসবো। কিন্তু তুমি খুশি হবে তো আমি এলে?সহ্য করতে পারবে আমাকে ওখানে?
তিয়ানের এমন প্রশ্নে মূহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল পলক। গম্ভীর নয়নে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে রইলো তিয়ানের মুখের দিকে। তিয়ানের মুখের ভাব নির্বিকার। কিন্তু,পলকের চোখে ছিল অন্যকিছু যেটা তিয়ানের দৃষ্টি এড়ালো না। পলককে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিয়ান আবারও জিজ্ঞেস করলো,
_কি হলো বলো….সহ্য করতে পারবে আমার উপস্থিতি?
তিয়ানের কথায় এবারে মুচকি হাসলো পলক। বড্ড রহস্যময় ঠেকলো এ হাসি তিয়ানের কাছে। তারপর, তিয়ানের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সামনে হাঁটতে শুরু করলো পলক। যেতে যেতে বললো,
_সব কিছুর আগে পরে আমরা আজীবন বন্ধু থাকবো। এ কথা তুমিই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলে। বলেই আরেকবার তাকালো তিয়ানের দিকে। তিয়ানের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি।পলকও হাসলো খানিক।এরপর লিফটের দরজা খুলে যেতেই তিয়ানকে ইশারা করলো যাওয়ার জন্য।
Take care.. বলেই লিফটে ঢুকে দরজা বন্ধ হওয়ার বাটন চেপে অপেক্ষা করতে লাগলো তিয়ান।দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ওভাবেই একে অন্যের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। দুজনের মনেই অনেক প্রশ্ন,অনেক দ্বিধা দ্বন্দ, অনেক অনেক অব্যক্ত কথা। কিন্তু,সরাসরি সেসব জানতে চাওয়ার বা বলার ক্ষমতাটা খুঁইয়েছে দুজনেই।একদা একজন নিজের অনুভূতিকে সত্যি বলে অস্বীকার করে ফিরিয়ে দিয়েছিল বলে আর অন্যজন সেই অস্বীকার করা অনুভূতিটা সত্যিই মিথ্যা ছিল বলে মেনে নিয়েছিল বলে। অথচ, অগোচরে তারা দুজনেই বিশ্বাস করতো অনুভূতিটা সত্যি ছিল।হয় তো এখনো করে……হয় তো করে না। তবে,সময় তার আপন স্রোতে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে।কেউ পায় নতুন ঠিকানা আর কেউ ডুবে যায় অতলের আবাসনে।ঠিক যেমন আজ পলক আর তিয়ান এসে পৌঁছেছে নিজেদের নতুন জীবনে।
চলবে…