#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯।
মেহুল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাবীর এখন বেরুবে। সে জুতা পরছিল। জুতা পরা শেষে সে দরজার সামনে আসতেই মেহুল সাইড হয়ে দাঁড়ায়। রাবীর বাইরে বেরিয়ে আসে। পেছন ফিরে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘আসছি তাহলে, আল্লাহ হাফেজ।’
মেহুল ইতস্তত স্বরে বলে,
‘আজকে থেকে গেলেও তো পারেন।’
রাবীর ভ্রু উঁচু করে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
‘আপনি আমাকে থেকে যেতে বলছেন, স্ট্রেঞ্জ!’
‘জি, যদি মিটিং’টা বেশি জরুরি না হয়ে থাকে, তবে থেকে যেতে পারেন।’
এই কথা শুনে রাবীর তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে। মেহুল নিজের জায়গাতেই স্থির। রাবীরের দিকে এক খেয়ালে চেয়ে আছে। রাবীর আরো কিছুটা অগ্রসর হয়। মৃদু সুরে শুধায়,
‘প্রেমে পড়েছেন, মিসেস খান?’
মেহুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামায়। তীব্র ভাবে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘একদমই না।’
রাবীর হাসে। সে আরো এগিয়ে গিয়ে মেহুলের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। কোমল স্বরে বলে,
‘প্রেম কিন্তু ভয়ানক রোগ। এর থেকে বেঁচে থাকবেন। নয়তো এই রোগ কিন্তু মনকে একেবারে নিঃস্ব করে ছাড়ে, বুঝেছেন? আজ আসছি। অন্য একদিন নাহয় আপনার এই ইচ্ছে পূরণ করব। আল্লাহ হাফেজ।’
রাবীর ফিরতেই মেহুল আবার প্রশ্ন করে,
‘আপনি কখনো প্রেমে পড়েছেন, নেতা সাহেব?’
রাবীর ঘুরে তাকায়। কিছুক্ষণ মেহুলের দিকে চেয়ে থেকে জোরে নিশ্বাস ফেলে,
‘জি। আপনার নেতা সাহেব ও বোধ হয় এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো না। ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে বোধ হয়। চিকিৎসা ছাড়া তো বাঁচার আর কোনো উপায়ও দেখছি না।’
রাবীরের এই কথাগুলো শুনে মেহুলের কেন যেন লজ্জা লাগে। সে মাথা নিচু করে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,
‘আচ্ছা, ডাক্তার দেখিয়ে নিয়েন। এখন যান, আল্লাহ হাফেজ।’
মেহুল দরজা আটকে দেয়। রাবীর মৃদু হেসে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে রাবীরের যাওয়া দেখে। রাবীরের গাড়ি যতক্ষণ দেখা গিয়েছে সে বারান্দা থেকে ততক্ষণ’ই চেয়ে ছিল। রাবীরের গাড়ি দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর সে রুমের ভেতরে এসে বসে। তখন তাকে রিতা কল দেয়। মেহুল কল রিসিভ করে। রিতা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই সিয়ামকে কী বলেছিস, মেহুল।’
মেহুলের পুরোনো রাগ আবারও তাজা হয়ে উঠে। সে ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
‘তুই জানিস, ঐ সিয়াম’ই এইসব কিছু করেছে।’
‘তোর কি মাথা খারাপ, মেহুল? সিয়াম কেন এইসব করতে যাবে? এতে সিয়ামের কী লাভ? আর ও যদি এসব করতোই তাহলে তো সে সবকিছু স্বীকার’ই করতো, তাই না? অযথা ও কেন তোকে মিথ্যে বলতে যাবে?’
‘এই একটা ব্যাপার তো আমিও বুঝতে পারছি না। কিছু একটা তো কারণ আছে।’
‘হ্যাঁ, আগে তুই সেই কারণ খুঁজে বের কর। তারপর কারোর উপর দোষ চাপাস।’
‘আশ্চর্য! তুই এইভাবে বলছিস কেন? আমি কারোর উপর দোষ চাপাচ্ছি না। এই কথাগুলো রাবীর সংবাদপত্রের অফিস থেকে পেয়েছেন। উনারাই বলেছেন এইসব কিছু সিয়াম নামের একটা ছেলে করেছে যে আমার ভার্সিটিতেই পড়ে।’
‘সিয়াম নামের ছেলে কি আমাদের ভার্সিটিতে আর নেই? ওদের মধ্যেও তো কেউ একজন করতে পারে।’
রিতা হঠাৎ এত ওভাররিয়েক্ট কেন করছে সেটা মেহুল বুঝতে পারছে না। তাই সে বলল,
‘ঠিক আছে, তোর এখন কিছু বিশ্বাস করতে হবে না। রাবীর এখনও খোঁজাখুঁজি করছেন। কে সত্য কে মিথ্যা সবকিছুই একদিন বেরিয়ে আসবে। আপাতত, তুই তোর বিশ্বাস নিয়ে থাক আর আমি আমার বিশ্বাস নিয়ে থাকি। রাখছি।’
মেহুল কল কেটে দেয়। রিতার এমন ব্যবহার তার মোটেও পছন্দ হয়নি। সাপোর্ট না করুক, তাই বলে এভাবে কথা বলবে? সে তো তার বেস্ট ফ্রেন্ড। মেহুল মন খারাপ করে রান্নাঘরে যায় কফি বানাতে।
_______
রাবীর থানায় আসে। পুলিশ অফিসার বলেন,
‘মি. খান, আমরা সেই লোকটিকে পেয়েছি; যে এই আগুন লাগিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।’
রাবীর কপালে ভাঁজ ফেলে ফিচেল স্বরে বলে,
‘তাকে এক্ষুনি আমার সামনে এনে সব জিজ্ঞাসাবাদ করুন।’
‘আমরা জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্ব শেষ করেছি। কিন্তু, সে কিছুই স্বীকার করেনি।’
‘স্বীকার করেনি?’
‘না, সে কেবল একটা কথাই বলছে; সে কিছু জানে না। এছাড়া আর কিছুই তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না।’
রাবীর টেবিলের উপরে থাকা পেপার ওয়েট’টা ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়। আর কীভাবে বাঁকাতে হয় সেটা তো আপনারা খুব ভালো করেই জানেন। এই সত্যটা বের করা আমার জন্য খুব জরুরি। যেভাবেই পারেন, ওর মুখ খুলান। ওকে বলতে হবে। যেকোনো মূল্যে ওর মুখ থেকে সব সত্যি বের করতেই হবে।’
‘জি, আমরা আমাদের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাব। কতক্ষণ আর চুপ থাকবে, একবার না একবার তো সব স্বীকার করবেই।’
________
পরদিন সকালে ভার্সিটিতে একটা ছোটখাটো হৈ চৈ লেগে যায়। মেহুল আর সিয়ামের বিশাল ঝগড়া হয়েছে। যদিও সবকিছু প্রথমে সিয়াম’ই শুরু করেছিল। তবে পরে মেহুলও তাকে ছাড়েনি। রিতা না থাকলে এই ঝগড়া হয়তো আরো বড়ো আকার ধারণ করতে পারতো। তবে তার জন্যই বড়ো কোনো ঝামেলা হওয়ার আগে সব বেঁচে গিয়েছে।
মেহুল ছোট্ট গাছটা থেকে একটা পাতা টান দিয়ে ছিঁড়ে সেটা টুকরো টুকরো করতে করতে বলল,
‘তুই দেখেছিস ঐ অসভ্য ছেলেটা আজ কী কী করেছে? ও সবার সামনে এভাবে সিনক্রিয়েট করে আমাকে অপমানিত না করলেও পারতো। আমার এখন রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।’
‘তুইও তো কম বলিসনি।’
মেহুল ফোঁস ফোঁস করতে করতে রিতার দিকে তাকায়। ক্রোধ নিয়ে বলে,
‘এখনো তুই আমাকেই বলছিস? ঐ ছেলেকে তুই কিচ্ছু বলবি না? আজকে আমি ওকে কিছু বলেছিলাম? ও ইচ্ছে করে আমার সাথে এসে লেগেছে। একে তো চুরি, তার উপর আবার সিনাজুরি! আর এইসবের পরেও তুই ঐ ছেলের সাপোর্ট’ই করছিস? কী হয় ও তোর? আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই আমার সাপোর্ট করবি।’
রিতা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,
‘বেস্ট ফ্রেন্ড ভুল করলে তার সাপোর্ট করতে হয় না, তাকে বোঝাতে হয়।’
‘ওহ আচ্ছা, এখন তোর মনে হচ্ছে আমি ভুল করছি। আর ঐ সিয়াম তো দুধে ধুয়া তুলসী পাতা, তাই না? ঠিক আছে, আজ সব সরাসরি প্রমান হবে। আমি ঐ সিয়ামকে নিয়েই ঐ সংবাদপত্রের অফিসে যাব। গিয়ে ডিরেক্ট ঐ লোকের সাথে কথা বলব। তাহলেই তো সব সত্যি বেরিয়ে আসবে, তাই না। চল।’
মেহুল রিতাকে জোর করে টেনে নিয়ে ক্যান্টিনে গেল। সিয়াম তার বন্ধুদের সাথে সেখানেই আড্ডা দিচ্ছে। মেহুল তাদের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সিয়াম আবার ক্ষেপে যায়। ক্ষিপ্ত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি এখানে আবার কেন এসেছো? একবার ঝগড়া করে পেট ভরেনি? আবার এসেছো ঝগড়া করতে?’
মেহুল রেগে গেলেও কিছু বলে না। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে,
‘দেখো সিয়াম, তোমার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। হয়তো একটা বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, কথা কাটাকাটি হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই না। তবে আমরা এই ব্যাপারটাকে সলভ করতে পারি। এই যেমন তুমি বলছো, তুমি এইসব কিছু করোনি। কিন্তু, আমি বলছি; তুমিই সব করেছো। আর আমাদের এসব জানিয়েছেন ঐ সংবাদপত্রের রিপোর্টার। এখন আমরা যদি সেখানে গিয়ে সরাসরি তার সাথে কথা বলি তাহলেই তো সব সত্য বেরিয়ে আসবে। হতেও পারে আমার ভুল হয়েছে। আবার হতে পারে ঐ সংবাদকর্মী’ই আমাদের ভুল ইনফরমেশন দিয়েছেন। এই জন্যই আমাদের আগে সেখানে যেতে হবে। কথা না বললে আমরা কিছুই বুঝতে পারব না। এখন তুমি বলো, তুমি কী করবে?’
সিয়াম ভাবতে লাগল। মনে হলো, এটাই ঠিক। সরাসরি গিয়ে কথা বলাই ভালো। এতে সে যে কিছু করেনি সেটা সে সহজেই প্রমান করতে পারবে। তাই সে রাজি হয়ে গেল।
মেহুলও তখন সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আর রিতাকে নিয়ে চলে গেল সেই সংবাদপত্রের অফিসে।
চলবে…