#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব ২৭

0
500

#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব ২৭
©জারিন তামান্না

জানুয়ারির কনকনে শীতের মিঠে রোদের দুপুর বেলা।স্কুল ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ।ছুটির পরে বাচ্চাদের কপি চেক করতে করতে ১ টা বেজে গেছে। যোহরের আজান দিচ্ছে এলাকার মসজিদে।সব গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো পলক।এবার বাড়ি ফেরার পালা। পলকের ব্যাগে রাখা ফোনটা বেজে চলেছে অনবরত। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতেই স্কুল গেট পার করে বাইরে এলো সে। ফোন বের করে দেখলো তিয়ান কল করেছে। আমজাদ আলীর অসুস্থতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আর পুরোনো বন্ধুত্বের জের ধরে আজকাল প্রায় কথা হয় তিয়ানের সাথে পলকের। এরমাঝে পলকদের বাড়িও গিয়েছিল সে।শাহনাজ বানু দাওয়াত করেছিল তাকে। পলককে দিয়ে ফোন করিয়ে নিজে দাওয়াত করেছিলেন ওকে লাঞ্চের জন্য।শাহনাজ বানুর এত করে বলায় তিয়ানও আর ফেলতে পারেনি তার কথা।ও বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে তিয়ানকে। তবে নিশাত পলাশ দুজনেই বেশ অবাক হয়েছিল যখন শুনেছিল তিয়ান পলকের কলেজ লাইফের বন্ধু। শুধু বন্ধু নয়। খুব ভালো আর কাছের বন্ধু। তাদের বোনের এমন কোন ছেলে বন্ধু ছিল কোন কালে অথচ তারা সেটা জানেইনি কখনো।এই ভেবেই খুব অবাক হয়েছিল তারা। পরে যখন সবটা জানলো তিয়ানের ব্যাপারে,, ওর বিদেশ চলে যাওয়া আর পলকের বিয়ের কারণে সব কিছু থেকে ব্যাক আউট করার পরে তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া,,,তখন তারা ভেবে নিয়েছে এই সব ঝামেলার কারণে হয় তো বলা হয়নি পলকের তিয়ানের কথাটা কখনো। তারপর থেকেই আরেকটু বেশি বেড়ে গেছে তিয়ান আর পলকের যোগাযোগ।মাঝে মাঝে বিথিকে সাথে নিয়ে গ্রুপ কলেও কথা চলে তিন বন্ধুর।ব্যাপারটা অনেকটা কলেজ লাইফের দিনগুলোর মত সাবলিল হয়ে গেছে তাদের কাছে। বিথি বেশ খুশি সব স্বাভাবিক হওয়ায়। তবে তিয়ানকে নিয়ে তার চিন্তা হয় কিছুটা। পলকেও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা মাঝে মাঝে। সব স্বাভাবিক হয়েও কেমন যেন স্পস্ট নয় পুরোপুরি।

ঘড়িতে সময় দেখলো পলক।দুপুর ১’১৫ বাজে। এই সময় তিয়ানের অফিসে থাকার কথা। তাই অসময় তার কল দেখে কিছুটা অবাক হলো পলক। কল রিসিভ করতে করতেই সামনে চোখ পড়লো তার। গাড়ির কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তিয়ান। কানে ফোন ঠেকিয়ে রেখেছে। পলকেই কল করছিল সে। তার পাশেই শাড়ি পড়িহীতা একজন মহিলা। চোখে সানগ্লাস। কোলে ছোট একটা বাচ্চা। কিছুটা দূর থেকে মহিলাটি কে সেটা বুঝতে পারলো না সে। পলককে দেখে ফোন রেখে আলতো হাসলো তিয়ান। পলকের চোখে বিচলতা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সে তিয়ানের আর ওই মহিলাটির দিকে। কাছাকাছি যেতেই তাকে দেখে একগাল হেসে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেললো মহিলাটা। সানগ্লাস খোলা মাত্রই বিস্ময়ে আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পলক। তার চোখ মুখে ঠিকড়ে পড়ছে খুশির ঝলক। গুণে গুণে ৫ বছরেরও বেশি সময় পরে সামনাসামনি দেখছে সে বিথিকে। বিথির কোলে ছোট্ট নোরা। বেশ ছটফট করছে সে মায়ের কোল থেকে নামবার জন্য। কিন্তু বিথি শক্ত হাতে আটকে রেখেছে তাকে। পলকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি হাসি মুখেই তিয়ান বললো, সারপ্রাইজ! কিন্তু পলকের কোন নড়চড় নেই।তা দেখে বিথি নিজেই এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। জড়িয়ে ধরেই জিজ্ঞেস করলো,
_কেমন আছিস রে বাঁশপাতা?

এতকাল পরে নিজের প্রিয় বান্ধুবীকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো পলক। তা দেখে ভড়কে গেল তিয়ান। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো পলকের কাছে। কিন্তু বিথি অবাক হলো না মোটেও। পলককে ছেড়ে দাঁড়াতেই তিয়ান খেয়াল করলো বিথিও কাঁদছে। চোখ ভেজা তারও। এবারে ব্যাপারটা বুঝলো তিয়ান।এতবছর পরে..এত কিছুর পরে ঘটা বিচ্ছিন্নতা থেকে আবার প্রিয় বান্ধুবীকে কাছে পেয়ে ইমোশনাল হয়ে গেছে দুজনেই। বিয়ের পর গড়নে,চালচলনে ব্যাপক বদলে গেছে বিথি।বয়কাট চুলের টমবয় টাইপের মেয়েটার এখন কোমড় সমান চুল।শার্ট প্যান্ট ছেড়ে যাকে কখনো সালোয়ার কামিজও পড়ানো যেতো না,,সে এখন শাড়ি পড়ে। পায়ে যার বেশিরভাগ স্নিক্যারস থাকতো সে এখন মেয়েদের হিল জুতো, স্লিপার পড়ে।মুখে যার সামান্য পাউডার দিতেও ঘোর আপত্তি থাকতো তার ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক। চোখে মোটা করে কাজল টানা। হালকা গয়নাগাটিতে টমবয় রুপ পাল্টে টিপিক্যাল উইমেন হয়ে গেছে। পলকও আর আগের মত বাঁশপাতা নেই। শরীরে, চেহারায় বেশ পরিবর্তন এসেছে তারও।এখন সে পূর্ণ যৌবনা নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ভিডিও কলে বহুবার একে অপরকে দেখেছে তারা,তবুও সামনাসামনি দেখাটাও অন্যরকম একটা অনুভূতি তাদের জন্য। তাদের এমন আবেগপ্লুত হতে দেখে তিয়ান বললো,
_মাঝ রাস্তায় কেঁদে ভাসাচ্ছিস কেন তোরা? আর এত বছর দুই বান্ধুবী নিজেদের পেয়ে আমাকে কি আউট সাইডার করে দিলি হ্যাঁ? কোন ভ্যালু নেই আমার!

তিয়ানের কথা শুনে হেসে দিল দুজনেই। তিয়ানের বাহুতে আলতো করে চাপড় মেরে বিথি বললো,
_মেয়েদের মধ্যে ছেলেদের ভ্যালু একটু কমই থাকে রে! তাই তোর ভ্যালু নাই না বললেও একটু কম বলা চলে।
_বাহ! বাহ! বন্ধুদের মধ্যে এখন ছেলে মেয়ে ভাগ হয়ে গেলো। এই শোন,,পলক যতটা তোর ততোটাই ও আমারও। আমি কোন কমপ্রমাইজ করতে রাজি নই এক্ষেত্রে। তিয়ানের কথাটা বিথি হেসে উড়িয়ে দিলেও পলকের কেমন যেন লাগলো। তিয়ানের সাথে স্বাভাবিক ব্যাবহার করলেও মাঝে মাঝে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। তাই শুকনো হেসে এড়িয়ে গেল তার কথাটা। তারপর, বিথিকে বললো,
_কবে আসছিস তুই? আর বাসায় না গিয়ে নোরাকে নিয়ে এখানে ক্যান আসছিস তুই?
_আরেএএ বোইন।স্টপ যা। একটা একটা প্রশ্ন কর। আমি চারদিন হইলো আসছি ঢাকায়। তিয়ানকে দেখা করার জন্য কল দিছিলাম,,তোর বাসায়ই যাইতে চাইছিলাম। কিন্তু,তিনু বললো,তোরে সারপ্রাইজ দিবে।আর আজকে নাকি জনাব ট্রিট দিবেন আমাদেরকে।তাই সরাসরি তোর স্কুলেই নিয়া আসলো।
_কবির ভাইয়া কই? আসেননাই উনি?
_না রে,,,আমি আসছি ২ মাসের জন্য। তোর বিয়ের পর পরই ফিরে যাবো। এতদিন তো আর তার পক্ষে ভার্সিটি গ্যাপ দেওয়া সম্ভব না। তাই তোর বিয়ের আগে আগে আসবে সে। তোদের বিয়ের পরেই আমাদের একটা রিসিপশন পার্টির প্ল্যান আছে।বিয়েটা তো আর এখানে হয়নাই। তাই একটা গেট টুগেদার করবো। আর তার পরে ওই সপ্তাহের শেষদিকে ব্যাক করবো ইন শাহ আল্লাহ।
_এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি তুই?একে তো বিদেশ গেলি পড়তে তারপর সেখানেই নিজের প্রফেসরের প্রেমে পড়ে বিয়েও করে ফেললি। ফিরলি বাচ্চার মা হয়ে।আর এখন মাত্র ২ মাস থাকবি? এইটা কোন কথা হলো!!
_আরেএ…সে যখন যাওয়ার যাবে বিথু,,এখন এসব চিন্তা করে ওর সময়টুকু কেন ওয়েস্ট করতেছো পলক। যতদিন কাছে আছে,enjoy her company. -পাশ থেকে তিয়ান বললো।
_হ্যাঁ,,,একদম ঠিক। এখন চল তো,,কোথাও গিয়ে বসি। বড্ড বিরক্ত করতেছে মেয়েটা। নোরাকে সামলাতে হিমশিম অবস্থা বিথির। তাই ওকে নিয়ে কোথাও স্থির হয়ে বসতে চাইছে সে।

_আচ্ছা,,চল।আমাদের বাসায়ই চল তাহলে। মা, নিশু তোরে দেখলে খুব খুশি হবে।

_উহু,,,আজকে কেউ কোথাও যাবে না। আজকে আমি ট্রিট দিবো তোমাদের। কোন রেস্টুরেন্টে যাবা, সেটা বলো এখন।
পলকের কথায় বাঁধা দিয়ে বললো তিয়ান।

_হ্যাঁ। আজ বাইরে ঘুরবো আমরা। আর আজকেও আমরা আমাদের ওই পুরানো আড্ডাখানাতেই যাবো। পুরোনো জায়গাগুলারে খুব মিস করছি এতদিন।বিথি বললো তিয়ানের কথায় সায় দিয়ে।
_আচ্ছা,,বেশ। চল। ওখানেই যাবো। তিয়ান বললো।

তারপর তিয়ানের গাড়িতে করেই তারা গেল তাদের কলেজ লাইফের পুরোনো রেস্টুরেন্টটায়।কলেজের এরিয়াতে হওয়ায় প্রায় সময় যেতো তারা ওখানে। আজও তাই ওখানেই গেল তারা।পুরোনো স্মৃতির টানে।

এতবছর পর তিন বন্ধু একসাথে হওয়ায় অনেক অনেক স্মৃতি, গল্প,কথায় অনেকটা সময় কাটালো তারা বাইরে। নোরাকে নিয়ে এই শীতের সন্ধ্যায় বাইরে থাকবে না বলে সেদিন বিকেলের পর পর বিথিকে বাসায় ড্রপ করে দিতে চলে গেল তিয়ান।পলককে ড্রপ করে দিতে চাইলেও মানা করে দিল পলক। সে একাই চলে এলো ওখান থেকে। যাওয়ার আগে বিথিকে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য বারবার করে বলে গেল সে। বিথিও সময় করে চলে আসবে বলে কথা দিল। তারপর, বেরিয়ে গেল যে যে যার যার গন্তব্যে।

___________________________________

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই বাসার গেটের সামনে এত এত মানুষের ভীড় দেখে অবাক হলো পলক। কিছু একটার গুঞ্জন চলছে সবার মধ্যে। ভীড় এড়িয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ালো সে। ফ্ল্যাটের দরজার মুখেও একই অবস্থা। বাসার ভেতর থেকে বেশ চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। পলক ঠিক বুঝতে পারলো না কি হয়েছে বাসায়। ভীড় এড়িয়ে বাসায় ঢুকতেই স্পষ্ট শুনতে পেল সে কেউ একজন বলছে,
_এত কথা শোনার টাইম নাই আমাদের। আপনি যদি ভালোয় ভালোয় না আসেন তাহলে কিভাবে নিয়ে যেতে হবে সেটা আমরা খুব ভালো করেই জানি। একে তো বউ পিটাবেন আবার তাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য জোর করবেন।তারওপর আবার মেয়ে নিয়ে চলে আসছেন।এত কিছুর পরেও আপনি বলতেছে আপনাকে মিথ্যা আরোপে ফাঁসানো হচ্ছে?
_আপনি কেন বুঝতে পারছেন না! আমি কোন জোরজবরদস্তি করিনি ওর সাথে। আর ডিভোর্স আমি দিচ্ছি ওকে। এর যথেষ্ট কারণও আছে। এখন ডিভোর্স পেপার পাওয়ার পরে সে গিয়ে যদি নারী নির্যাতনের মামলা করে সেখানে আমার কি দোষ? আর একজন মামলা করলে কোন প্রমাণ ছাড়াই আপনারা কাউকে এরেস্ট করতে পারেন না। এমন আইন কোথাও নেই।
_আমাকে আইন শিখানোর তুই কে হ্যা? ব্যাটা বউ পিটাবি, ডিভোর্স দিবি আবার বড় বড় কথা। এতক্ষণ ভালোভাবে কথা বলতেছিলাম, ভাল্লাগেনাই।আসলে তোদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতেই নাই। এই বারিক হ্যান্ডকাফ পড়াও শালা রে। থানায় নিয়া দুই ঘা দিলেই সব জাউরামি বেরোয়া যাইবো এর। জদলি করো। আর বাকিগুলা কই ঘাপটি মারছে দেখো।সার্চ করো যাও।

এতক্ষণ শান্তিনগর থানার এস.আই আর পলাশের মধ্যে কথা হচ্ছিল। গত সপ্তাহে ডিভোর্স লেটার সাইন করে পাঠিয়েছিল পলাশ। আমজাদ আলী বা নিশাত কেউ বাসায় নেই। পলাশ সবে মাত্রই ফিরেছিল অফিস থেকে। যোশরের যে ব্রাঞ্চে চাকরি করতো সে সেখান থেকে ইমার্জেন্সি লিভ নিয়ে ঢাকায় এসেছিল সেদিন।এরপর এখানে এসে ঢাকার ব্রাঞ্চে ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছিল সে। ম্যানেজার হিসেবে প্রমোশন হওয়ার কথা ছিল তার এ বছর ।কিন্তু এবছর প্রমোশন ছেড়ে দিয়ে এখানে ট্রান্সফার নিয়েছে সে। এত বছরের পুরোনো কর্মী হওয়ায় আর পাস্ট রেকর্ডও ভালো থাকায় কোম্পানি তার আবেদন এক্সেপ্ট করেছে। গত সপ্তাহেই জয়েন করেছিল সে। তার পর পরই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছিল সে শেফাকে। আর আজ শেফা থানায় নারী নির্যাতনের মামলা করেছে পলাশ আর তার পরিবারের নামে। পলাশ বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পুলিশ কিছুই মানতে নারাজ। সাথে আসা দুজন কন্সটেবল সারাবাসায় সার্চ করেও শাহনাজ বানু, প্রাপ্তি আর পলাশকে ছাড়া কাউকে পেল না। তাই তাদেরকেই নিয়ে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিল।

এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হতভম্ব নয়নে সবটা দেখছিল পলক। আশেপাশে মানুষের নানান গুঞ্জন চলছে। কিন্তু কেউ আগ বাড়িয়ে এসে প্রতিবাদ করছেনা। যে পরিবারটা এত বছর তাদের এলাকায়, তাদের বিল্ডিং এ আছে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই, তাদের বিপদেই কেউ পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না।দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে কেবল। বারিক নামের কন্সটেবল পলাশকে হাত কড়া পড়াতেই,শাহনাজ বানু হাহাকার করে উঠলেন। সেটা অগ্রাহ্য করেই তার হাতেও হাতকরা পড়াতে গেলে পেছন থেকে বাঁধা দিল পলক।দ্রুত পায়ে এসে এস.আই লোকটার কাছে গিয়ে বললো,
_আপনি আইনের কথা বলছিলেন না? আপনার আইন যে কোন মহিলা কন্সটেবল ছাড়া কোন মহিলাকে এরেস্ট করার পারমিশন দেয় না সেটা জানেননা আপনি? তারপর চোখ রাঙ্গিয়ে কন্সটেবলের উদ্দেশ্যে বললো, আপনার মায়ের বয়সী উনি। ভদ্রতা জ্ঞান নেই বলে কিছু নেই আপনার? আর পুরুষ কন্সটেবল হয়ে কোন সাহসে হাত দিচ্ছেন আপনি উনার গায়ে?
_এইই, কে আপনি, হ্যা?পুলিশের কাজ পুলিশ জানে। এখানে আপনাকে কে কথা বলতে বলছে!
_এই বাড়ির মেয়ে আমি। তাই কথা বলার অধিকার আমার আছে।আর পুলিশ তার কাজ কতটা জানে সেটার নমুনা বেশ ভালোই দেখতে পাচ্ছি আমি। তাছাড়া, কে কি মামলা করলো সেটার সত্য মিথ্যা যাচাই না করে এরেস্ট করতে পারেন না আপনি।
_এই যে ম্যাডাম। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে যথেষ্ট শিক্ষিত আপনি। আর একজন মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের প্রতি যে নির্যাতন আপনি, আপনার ভাই আর পরিবার করেছে তারপরে আর ভদ্র সভ্যতার জ্ঞান করা সাজে না আপনাদের সাথে। মহিলা কন্সটেবল নাই সাথে তাই আপনাদের দুজনকে এখন ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু আপনার ভাইকে সাথে নিয়ে যাবো। পারলে আপনাদের উলিক নিয়ে এসে ছাড়ায় নিয়ে যাইয়েন আপনার ভাইকে। এই বারিক নিয়ে চলো এরে। -বলেই টানতে টানতে পলাশকে।নিয়ে গেল তারা। প্রাপ্তি প্রচুর ভয় পেয়েছে।কাঁদছে প্রচুর। শাহনাজ বেগম বাঁধা দিয়েও আটকাতে পারেননি ছেলেকে।তিনিও কাঁদছেন। বড্ড দিশেহারা লাগছে পলকের।

পুলিশ পলাশকে নিয়ে যেতেই পাড়া প্রতিবেশীরাও যার যার বাড়ি ফিরে গেল।কেউ কেউ ঘরে ঢুকে দু চারটা কথা,পরামর্শরও শুনিয়ে গেল। একটু পরে নিশাত আর আমজাদ আলীও ফিরে এলো।সব শুনে হতভম্ব তারা।এই মূহুর্তে কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারলেন না আমজাদ আলী।ক’দিন আগেই হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল তার। ডাক্তার খুব সাবধানে থাকতে বলেছেন তাকে। আর এরই মাঝে এমন একটা অবস্থায় পড়ে বিপি বেড়ে গেল তার। অসুস্থ হয়ে গেলেন আবারও। শাহনাজ বানু সমানে কেঁদে চলেছেন। নিশাত বোঝাচ্ছে তাকে। প্রাপ্তিকে কোন মতে ঘুম পাড়িয়ে ভেতর ঘরে রেখে এসেছে পলক। কিন্তু,,,এত কিছুর মাঝেও পলাশকে কি করে ছাড়িয়ে আনবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না পলক। আমজাদ আলীকে প্রেশারের মেডিসিন দিয়েছে। কিন্তু,তিনি কিছুতেই শান্ত হতে পারছেন না।তার ভাইকে ফোন করেছিলেন কিন্তু,নারায়ণগঞ্জ থেকে এত রাতে তিনি কিভাবে আসবেন! তাই সকাল হতেই চলে আসবেন বলে আস্বস্ত করলেন আমজাদ আলীকে। শাহনাজ বানুর ভাইও শহরে নেই। ব্যাবসার কাজে খুলনা গেছেন।এই অবস্থায়, ছেলেকে কিভাবে ছাড়িয়ে আনবেন সে চিন্তা তাকে অস্থির করে তুলছে। এত রাতে উকিল কোথায় পাবে সেটাও ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। বিপদে মাথা কাজ করে না,,খুব সত্যি কথাটা।তাই তারাও কেউ কিছুই ভেবে পাচ্ছে না কি করবে।

রাত ৮:৩০ টা। হঠাৎ পলক নিশাতকে ডেকে বললো,,প্রাপ্তির কাছে থাকতে। ব্যাগ নিয়ে কোথাও একটা যেতে দেখে নিশাত জিজ্ঞেস করলো তাকে,
_এত রাতে কই যাইতেছিস তুই,বুবু?
_থানায় যাই।
_কিহ? এতরাতে তুই একা থানায় যাবি? মাথা খারাপ হইছে তোর?
_কিছু করার নাই নিশু। ভাইয়াকে তো আর জেলে থাকতে দিতে পারি না। আর তাছাড়া বাসায় বসে থেকে কিছু করাও যাবে না। ওখানে গিয়েই কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বাবাকে কিছু বলিস না এ ব্যাপারে। চিন্তা করবে আরও।আমি আসছি। -বলেই ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল পলক।

নিশাত আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। একদিকে ভাইকে পুলিশ নিয়ে গেছে,,বাবার বিপি হাই,,মা কেঁদে কেটে অস্থির আর অন্যদিকে এতরাতে বোন তার থানায় ছুটলো একা একা। এত কিছুর চিন্তায় অসহ্য লাগছে তার এখন। ক’দিন আগেই এক বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েছে আর আজ আবার..! কিন্তু কি করবে সে এখন। আগের বার তো তিয়ান হেল্প করেছিল কিন্তু এবার? তিয়ানের কথা মনে পড়তেই তাকে ফোন করার কথা ভাবলো নিশাত।আবার, পরমূহুর্তেই তার মনে হলো,তিয়ানের নাম্বার তার কাছে নেই।কিন্তু,সিফাতের নাম্বার তো আছে।সিফাতের কথা মনে হতেই আর দেরি করলো না নিশাত। দ্রুত হাতে ডায়াল করলো সিফাতের নাম্বারে।

সিফাত কেবলই অফিস থেকে বাসায় ফিরছিল। গাড়িতে থাকা অবস্থাতেই নিশাতের ফোন পেল সে। নিশাতের থেকে সব শুনে তাকে শান্ত্বনা দিয়ে বললো, নিশাত যেন টেনশন না করে,,সে যাচ্ছে থানায়।
নিশাতের সাথে কথা শেষ করেই পলককে ফোন করলো সিফাত। কিন্তু,পরপর কয়েকবার কল করার পরেও যখন পলক রিসিভ করলো না টেনশনে পড়ে গেল সে। মেয়েটা কোথায় আছে,,কি অবস্থায় আছে জানে না সে। তবুও,নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে তাদের ফ্যামিলি লইয়ারের নাম্বারে ডায়াল করলো সিফাত। যা ব্যবস্থা করার এখন তাকেই করতে হবে।

রাত ১০ টা। সিফাতের গাড়ি এসে থামলো শান্তিনগর থানার সামনে।থানায় পৌঁছেই গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে ভেতরে গেল সে। ভেতরে ঢুকতেই কোণার একটা বেঞ্চে বসে থাকতে দেখলো পলককে।দুহাতে মুখ চোখ ঢেকে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে আছে সে।তাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখেই বুকের ভেতরটায় ছ্যাৎ করে উঠলো সিফাতের। ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। শান্তকন্ঠে ডাকলো পলককে।
_মৃন্ময়ী? আচমকা সিফাতের কন্ঠ শুনে চমকে তাকালো সে। মুখ তুলে চাইতেই সিফাতকে দেখতে পেল সামনে। পলকের মুখ চোখ ফুলে আছে।কান্নায় দমকে হাল্কা কেঁপে কেঁপে উঠছে সে তখনো।পলককে এই অবস্থায় দেখে অস্থির হয়ে উঠলো সিফাত। পলক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সিফাতের মুখপানে। এই মূহুর্তে তাকে এখানে মোটেও আশা করেনি পলক। সিফাত সেটা বেশ বুঝতে পারলো। কিন্তু,পলককে কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার আগেই পেছন থেকে একজন কন্সটেবল পলককে বললো,
_আপনি এখনো এখানে বসে আছেন কেন ম্যাডাম? আপনাকে তো চলে যেতে বললাম। স্যার তো বলেছেন কালকে কোর্টে নেওয়ার আগে দেখা হবে না আপনার ভাইয়ের সাথে। তাই বসে না থেকে চলে যান। কাল কোর্টে উকিল নিয়ে আইসেন। তাছাড়া,থানায় কোন মহিলা কন্সটেবল কিন্তু নাই আজকে ডিউটিতে। একা মেয়েমানুষ হয়ে এভাবে রাতবিরাতে থানায় বসে থাকাটা খুব ভালো কিছু না। বাড়ি চলে যান।
_উকিল আসছে আমাদের। সে না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবো আমরা। কন্সটেবলের কথার বিপরীতে বললো সিফাত।
পাশ ফিরে সিফাতকে একনজর দেখলো কনস্টেবল। তারপর বললো,
_অ…আপনার সাথে তো লোক আছে দেখতেছি। তারপর, সিফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো, কিন্তু স্যার আজকে আর কিছুই করা যাবে না। কেস কাল কোর্টে উঠবে। নারী নির্যাতনের মামলা এইটা। এত সহজে জামিন হয় না এই কেসে। আপনি ম্যাডামকে নিয়া চলে যান। কাল কোর্টে আইসেন উকিল নিয়া।
_সেটা আমরা দেখে নেব। আপনি আপনার ডিউটি করুন।গম্ভীর কন্ঠে বললো সিফাত। তা শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে কন্সটেবল বললো,
_ভালো কথা আজকাল লোকে কানে তোলে না। যাক গে,,আপনাদের ব্যাপার আপনারই বোঝেন। আমার আর কি! বলেই ওখান থেকে চলে গেল লোকটা। কন্সটেবল লোকটা চলে যেতেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে পলকের দিকে তাকালো সে।মাথা নিচু করে আগের মতই বসে আছে পলক। সেটা দেখে তার পাশে গিয়ে বসলো সিফাত। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
_কল করেছি অনেকবার,রিসিভ কেন করেননি?
_ফোন বাসায় রেখে এসেছি ভুলে।
_আর তারপরেও এখানে এভাবে বসে ছিলেন কেন?আপনার খোঁজ না পেয়ে যে সবার চিন্তা হবে সেটা একবার মাথায় আসেনি আপনার?
_ভাইয়ার সাথে দেখা করবো বলে বসে ছিলাম। কিন্তু,তারা দেখা করতে দিচ্ছে না। ভাইয়াকে ফেলে যেতেও ইচ্ছে করছে না। এতবছর পরে নিজের পরিবারে ফিরেও আজ তাকে….আর কিছু বলতে পারলো না পলক। কান্নার দমকে কথা আটকে গেছে তার। পলকের এ অবস্থা সহ্য হচ্ছে না সিফাতের। কি করবে সেটাও বুঝতে পারছে না। উকিল না আসা পর্যন্ত কিছু করাও সম্ভব না।তাই কেবল আরেকটু কাছে গিয়ে পলকের কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে নিল তাকে। পলককের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আস্বস্ত করতে বললো, লয়ারের সাথে কথা হয়ে আমার। আসেছে সে। সে এলেই ভাইয়ার সাথে কথা বলার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। Don’t worry.ঠিক হয়ে যাবে সব।
সিফাতের কথাও পলককে শান্ত করতে পারলো না। এক হাতে সিফাতের ব্লেজারের একটা পাশ শক্ত করে আকড়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজেই ঝরঝর করে কেঁদে দিল সে।সিফাতও আর বাঁধা দিল না তাকে। মৃন্ময়ীর কষ্ট হচ্ছে,ভীষণ রকম কষ্ট হচ্ছে, এটুকু ঠিক অনুভব করতে পারছে সে। তাই আর কিছুই বললো না তাকে। কেবল তার এক হাতে পলকের অন্য হাতের আঙুলে আঙুল গুঁজে নিজের মুঠোয় পুরে নিল সেটা।সিফাতের আর পলকের আংটি পড়া আঙুল দুটো একসাথে হয়ে মিশে রইলো পাশাপাশি। আংটিটা দেখে পলাশের মুখটা মনে পড়ে গেল সিফাতেরও। সেদিন যখন সিফাতের সাথে পরিচয় হয়েছিল পলাশের,হোয়াট গোল্ডের মাঝে ছোট ছোট কয়েকটা হীরা বসানো একটা আংটি দিয়েছিল সে সিফাতকে।ছেলেদের সোনা পড়া নিষেধ।তাই পলকের বিয়ে ঠিক হবার পরপরই মায়ের থেকে সিফাতের হাতের মাপ জেনে এটা সে কিনেছিল সিফাতের জন্য।কিন্তু,বিয়েটা পিছিয়ে যাওয়ায় আর পাঠানো হয়নি তখন এটা।এরপর যখন ঢাকায় চলে এলো সে,,,এটাও সাথে করে নিয়ে এসেছিল। এঙ্গেজমেন্ট রিং বলা চলে একপ্রকার। পলকের হাতেও হীরের একটা আংটি।দুটোকে পাশাপাশি খুব মানিয়েছে বলেই সবাই বলেছিল সেদিন। সেটা দেখে বিষন্ন মনে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো সিফাত। তারপর অন্য হাতে পলকের মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো নিজের বুকে।
___________________________________

উকিল এসেও তেমন কোন কাজ হলো না। নারী নির্যাতনের মামলায় সহজে জামিন পাওয়া যায় না। কেস কোর্টে উঠবেই। তাই পলাশকে জামিনে ছাড়ানো গেল না সেরাতে। তবে,পলাশের উকিল হিসেবে তার সাথে কথা বলার একটা সুযোগ পেল মি.জুনাইদ। পলাশের সাথে কথা বলতে গেলে,পলাশ সব খুলে বললো তাকে। শেফার সাথে তার সম্পর্ক, পারিবারিক ঝামেলা, প্রাপ্তির জন্মদান নিয়ে শেফার হুমকি আর যশোর ছেড়ে আসার ঘটনা।আর তারপর ডিভোর্স পেপার সাইন করে পাঠানোর কথাটাও বললো। এতসব কিছু শুনে এসে মি.জুনাইদ সিফাত আর পলককে বললেন, পলাশের ডিভোর্সের কেস যিনি হ্যান্ডেল করছেন এই কেসটাও তাকেই হ্যান্ডওভার করতে। কারণ, সে জানে পলাশের ব্যাপারে সবটা।তিনি ফোনে কথা বলেছেন পলাশের লয়ারের সাথে। তাই কাল কোর্টেও তিনিই যাবেন এই কেস নিয়ে। তারপর,সিফাতের সাথে কথা শেষ করে তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে তিনিও চলে গেলেন ওখান থেকে।

সে রাতটা পলক থানাতেই রইলো। অগ্যতা সিফাতকেও থাকতে হলো ওখানেই। দুই বাড়িতে ফোন করে সব জানিয়েছে সিফাত। কাল পলাশকে নিয়ে কোর্টে যাবে একেবারে। কনকনে শীতের রাত। ঢাকায় খুব একটা শীত না থাকলেও দরজা খোলা থাকায় বেশ ঠান্ডা বাতাস আসছিল ভেতরে।পলকের গায়ে একটা চাদর কেবল। সারাদিনের ধকলে বেশ ক্লান্ত পলক। ক্লান্ত সিফাতও। গতকাল ইটালি থেকে ফিরেছে সে। আজ অফিসে কেটেছে সারাটাদিন।মিটিং শেষ করে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরছিল। কিন্তু,মাঝ পথেই নিশাতের ফোন পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে থানায় এসেছে। আর বিগত ৪ ঘন্টা যাবৎ থানার বাইরে গাড়িতে বসে আছে পলককে নিয়ে। রাতে কিছুই খাওয়া হয়নি কারও। রশিদকে গাড়ি নিয়ে ফিরে যেতে বলেছিল কিন্তু,সে সিফাতকে রেখে যাবে না। তাই সেও বসে আছে গাড়ির দরজা খুলে। আবার একটু পর পর গাড়ি থেকে নেমে পায়চারি করছে থানার সামনে।

রাত ২:১০ মিনিট।

একটু আগে রশিদ দু কাপ চা নিয়ে এসেছে। থানার কাছে একটা টং দোকান খোলা ছিল।সেখান থেকেই ম্যানেজ করেছে। এক কাপ চা পলকের দিকে বাড়িয়ে দিল সিফাত।ক্লান্তিতে আর দীর্ঘসময় কান্নার ফলে মাথা ধরেছে পলকের। তাই চা’টুকু পেয়ে বেশ উপকারই হলো তার। কিন্তু,মনের অশান্তিতে তার এখন কিছুই মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। তাই চায়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। পাশ ফিরে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো।সিফাতও তাই রেখে দিল নিজের কাপটা।একটু পরে হঠাৎ করে মাথায় আলতো স্পর্শে বিলি কাটার অনুভূতি হতেই কেঁপে উঠলো পলক।ঝট করে চোখ খুলে পাশ ফিরে চাইতেই দেখলো সিফাত তার মাথায় বিলি কাটছে। অবাক নয়নে তার দিকে চেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল পলক তার আগেই খুব আদুরে স্বরে সিফাত বললো,
_এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হলে চলবে কি করে মৃন্ময়ী!কাল আরও বড় একটা তুফানের সম্মুখিন হতে হবে আমাদের। তার জন্য তো নিজেকে শক্তপোক্তভাবে ধরে রাখতে হবে।নইলে লড়াই করবো কি করে? আর আমি জানি, আমার মৃন্ময়ী এটুকু ঠিক বুঝবে,তাই না?

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সিফাতের কথাগুলো শুনলো পলক।সিফাতের শেষ কথায় রোবটের মত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো কেবল। কিছুটা দূরে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রশিদ। সিফাত ইশারা করতেই কাপ দুটো নিয়ে সিফাতকে দিল সে। মৃদু হেসে এককাপ চা পলকের হাতে দিয়ে বললো, এটা খান। ক্লান্তি কমে যাবে। ভালো লাগবে আপনার।
পলক এবারে ঠিকই নিল কাপটা। সিফাত চোখের ইশারায় সেটায় চুমুক দিতে বলায় রোবটের মত তাতে একটা চুমুক দিল পলক। তারপর, সিফাতের দিকে তাকিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,
_এত ভালো কেন আপনি?
সিফাত আলতো হাসলো পলকের এহেন কথায়। তারপর, নরম স্বরে বললো,আমি এতটাও ভালো নই মৃন্ময়ী।
_কিন্তু,,তাও আপনি অনেক ভালো।
তার প্রতি পলকের এমন ধারণা দেখে আবারো হাসলো সিফাত। তারপর বললো,
_ তাহলে বলবো,সেটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে আমাকে মৃন্ময়ীর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে বলেই।ভালো তো ভালোটাই ডিজার্ভ করে,তাই না? এটা শুনে চট করেই আপত্তি জানিয়ে পলক বললো,
_উঁহু,আপনাকে নয়।আমাকে আপনার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে হয়তো।স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাঁড় থেকেই স্ত্রীকে সৃষ্টি করা হয়। বলেই বাইরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চায়ে চুমুক দিল পলক।
তার এই কথায় ভ্রু কুচকে গেল সিফাতের। “হয় তো” কথাটা পছন্দ হয়নি তার।তাই চকিতেই পলককে প্রশ্ন করলো,
_হয় তো কেন? বিয়ে তো আপনার আমার সাথেই হচ্ছে।সুতরাং আপনিও নিশ্চিতভাবে আমারই। এখানে” হয় তো ” কিসের?

সিফাতের এহেন প্রশ্নে তার দিকে ফিরে চাইলো পলক। তারপর সিফাতের বিভ্রান্ত চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে খাদে নামানো গলায় বললো,
_বিয়েটা হবার কথা।হয়নি এখনো।ভাগ্যটা বড্ড বেসামাল বিষয়। শেষ মূহুর্তে গিয়েও বদলে যেতে পারে।তাই,দুজনের তরফ থেকেই কবুল না বলা পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত নয়। কে বলতে পারে,,শেষ পর্যন্ত কে কার হয়..কার থেকে কার সৃষ্টি আর কার জন্যই বা কার জন্ম!

সিফাত চমকালো পলকের ওই দৃষ্টির দিকে চেয়ে।পলকের চোখে রহস্য খেলা করছে।আর সিফাতের দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি,রহস্য ভেদ করতে না পারার বিচলতা। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো পলক।সে হাসিতেও যেন রাজ্যের রহস্য নিহিত। চোখ সরিয়ে নিল পলক সিফাতের থেকে।পলকের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেই ঘোর কাটলো সিফাতের।তারপর, অস্থির গলায় বাচ্চাদের মত করে বললো,
_এইই…কিসের কবুল কিসের কি! এই নিন আমি এখনই কবুল বলছি, কবুল..কবুল..কবুল।এবার আপনিও বলে ফেলুন ঝটপট।তাহলেই হবে। নিশ্চিত ভাবেই আপনি আমার হয়ে যাবেন। নিন…বলুন তাড়াতাড়ি!

গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে ছিল পলক।আর সেই মূহুর্তে সিফাতের এমন বাচ্চামো দেখে এই ঘোর ক্লান্তি, কষ্টের মাঝেই হেসে ফেললো পলক। তাকে হাসতে দেখে সিফাত আরও অস্থির হয়ে উঠলো। ব্যাকুল সুরে বললো,
_কি হলো বলুন,কবুল!
সিফাতের এমন বাচ্চামো দেখে এবার মুচকি হেসে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চাইলো পলক।তারপর, চায়ের কাপের শেষ চুমুকটুকু দিয়ে বললো,
_চা-টা খুব একটা খারাপ ছিল না। ধন্যবাদ!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here