#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫৩
তূর্ণ’কে বিদায় জানিয়ে বরাদ্দকৃত কক্ষে প্রবেশ করলো দুয়া। প্রবেশ করেই হতবিহ্বল! ধক করে উঠলো অন্তর আত্মা। কতটা সময় ওভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। আচানক সম্বিৎ ফিরে পেতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বিছানার ধারে ছুটে গেল মেয়েটি। এলোমেলো ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে শুয়ে তৃষা। তাকে অবলোকন করে অজানা ভীতিতে আড়ষ্ট হলো দুয়া। দু পা ধীরে সুস্থে বিছানায় উঠিয়ে নিলো। বসলো তৃষা’র শিয়রে। নিদ্রায় আচ্ছন্ন মানবীর মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে আদর মাখা স্বরে ডাকতে লাগলো,
” তৃষা। অ্যাই তৃষা। ”
দু ডাকেই নেত্রপল্লব মেলে তাকালো তৃষা। নিদ্রা অগভীর ছিল কিনা। দুয়া আঁতকে উঠলো ননদিনীর অবস্থা দেখে। এলোমেলো ভঙ্গিমায় শুয়ে তৃষা। লালাভ আভা ছড়িয়ে চক্ষু জোড়ার সফেদ অংশে। চোখমুখ শুকিয়ে ম্লান। কেশের হাল করুণ। এক রাতেই ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী লাগছে। এমন দেখাচ্ছে কেন ওকে? কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে দুয়া তৎক্ষণাৎ শুধালো,
” বোন। কি হয়েছে তোর? এভাবে ঘুমিয়ে ছিলি কেন? শরীর খারাপ করছে? ”
কি জানি কি হলো। তৃষা কিচ্ছুটি বললো না। বরং ভাবির কোলে মুখ গুঁজে দিলো। লুকানোর চেষ্টা করলো ভেতরকার সবটুকু গ্লানি, যাতনা। চুপটি করে শুয়ে রইলো সেভাবে। ওর হাল অবলোকন করে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো দুয়া। কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মনের মধ্যে ভালোমন্দ বহু চিন্তা উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে। বড় ভয় করছে। সুস্থ সবল হাসিখুশি মেয়েটির এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো? তার অনুপস্থিতিতে খারাপ কিছু…! না না। ছিঃ! এসব কু চিন্তা কি করে সে প্রশ্রয় দিচ্ছে? আল্লাহ্ সহায় আছেন। নিশ্চয়ই সব ঠিক আছে। তবে কি হয়েছে ওর? কিছু বলছেও না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভীত মনটি আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। শেষমেষ নিরুপায় হয়ে নীরবতা ই বেছে নিলো দুয়া। নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়লো কক্ষটি। দুয়া কোমল হাতে বিরহে কাতর মেয়েটির মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগলো। কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। নানাবিধ চিন্তায় দুয়া’র অবস্থা বেগতিক। কিছু সময় বাদে সে অনুভব করতে পারলো ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের স্পর্শ। তৃষা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করলো দুয়া। সমস্ত কু চিন্তা দূরীকরণ করতে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস নিলো। ঘুমন্ত মানবীর মাথার নিচে এক হাত এবং ঘাড়ে আরেক হাত গলিয়ে দিলো। সাবধানতা অবলম্বন করে আস্তে ধীরে বালিশে শুয়ে দিলো। অতঃপর ওর অগোছালো কেশ, এলোমেলো পোশাক ঠিক করে মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিলো। দেহে জড়িয়ে দিলো পাতলা কাঁথা। দেয়ালঘড়িতে চোখ পড়তে আঁতকে উঠলো দুয়া। ওহ্ হো! নামাজের ওয়াক্ত শেষের পথে। তড়িঘড়ি করে মেঝেতে পদযুগল নামিয়ে বিছানা ত্যাগ করলো মেয়েটি। ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে।
•
উন্মুক্ত বাতায়নের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। কানে ঠেকানো ক্ষুদ্র যোগাযোগের মাধ্যম। আদিত্য’র মিঠি কিরণ মেখে যাচ্ছে সুঠাম গাত্রে। হালকা হাওয়ায় মসৃণ লালচে চুলগুলো মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ছুটছে। ফোনালাপে মগ্ন মানুষটি। ওপাশে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপণে ব্যস্ত। দিচ্ছে কোনো নির্দেশনা। অধরে লেপ্টে দুর্বোধ্য হাসির রেখা। ফোনালাপ শেষে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো তূর্ণ। মোবাইল হাতে পিছু ঘুরে কিঞ্চিৎ চমকালো। বিছানায় বসে মিহাদ। দু পা ঝুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে।
” হোয়াট হ্যাপেন? এমন খা!টাশের মতো হাসছিস কেন? ”
খা.টাশ! এত পঁচা সম্বোধন শুনে মিহাদ অসন্তুষ্ট হলো না। বরং আরো দাঁত কেলিয়ে হাসলো। হাসি হাসি মুখে শুধালো,
” কি ভাইয়া? গতরাত কোথায় ছিলে? প্রেমনগরে? ”
তূর্ণ হাঁটি হাঁটি পায়ে সমতল আরশির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। এলোমেলো কেশ দু হাতে সেট করতে করতে বললো,
” বউয়ের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে প্রেমনগর যেতে হবে কেন? বউ সাথে থাকলে অলি থেকে গলি যেকোনো জায়গাতেই প্রেমের পবন বয়ে যায়। কোনো বিশেষ জায়গার দরকার হয় না। বুঝলি? ”
মিহাদ দুঃখী বদনে বললো, ” কি করে বুঝবো? আজ অবধি একান্ত একজন পেয়েছি কি? সিঙ্গেল হয়ে মিঙ্গেলের ফিলিংস মাখা কথা বোঝা কতটা কঠিন, তুমি জানো? ”
তূর্ণ ওর দিকে আফশোসের চাহনিতে তাকিয়ে মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ রকমের শব্দ করলো।
” আফশোস! তুই আমার ভাই। আস্ত এক গ*বেট। বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের অভাব পড়েছে নাকি? দুয়া’র ফ্রেন্ড আছে। আমার ফ্রেন্ড আছে। আরো কত গেস্ট আছে। একটাও পটাতে পারলি না? তুই তো সিঙ্গেল নামক জাতির ক*লঙ্ক। ”
মিহাদ অবাক চাহনিতে তাকালো! এত বড় অপবাদ! সহে না গাত্রে। করুণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
” কি বলছো এসব ভাইয়া? শেষমেষ তোমার বন্ধু! ওই মনিকা আপু তো ম্যারিড। বাকি আছে শুধু দিবা আপু। আমি নাদান ছেলে হয়ে শেষে কিনা সিনিয়র পটাবো? ”
তূর্ণ হেসে বললো, ” চাইলে ট্রাই করতে পারিস। সিনিয়র আপুর সাথে ডেট করার মজাই আলাদা। ইউ নো না? ”
চোখ টিপে কক্ষ হতে প্রস্থান করলো তূর্ণ। আর নাদান ছেলেটি? তার তো অনবরত হিচকি উঠছে। কোনোমতে উঠে বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা জগের ওপর
হা;মলে পড়লো।
.
মধ্যাহ্ন ভোজের সময় ডাইনিং এরিয়ায় একত্রিত হলো তরুণ প্রজন্ম। খাওয়ার ফাঁকে চলছে কথোপকথন, খুনসুটি। মিহাদ ওর বিপরীত দিকে বসে থাকা ছোট বোনকে উদ্দেশ্য করে খাবার চিবুতে চিবুতে বললো,
” এই মু;টকি? আর কত খাবি? বিয়েশাদী হয়ে গেছে। এখনো অন্যের অন্ন ধ্বং*স করবি? একটু তো রয়ে সয়ে খা। ”
সিনথিয়া এমন কটূক্তি গায়ে মাখলো না। প্লেটে হাত চালনা করতে করতে বললো,
” ভাই আমার। অন্যের প্লেটে কালি নজর না দিয়ে নিজের প্লেটে নজর দে। গরুর মাংস কয় পিস নিয়েছিস সে খেয়াল আছে? অন্যকে আবার পেটুক বলে! হুহ্! ”
মিহাদ বোকা বনে গেল। সশব্দে হেসে উঠলো বাকিরা। কবির সকলের অলক্ষ্যে বউয়ের দিকে ঠোঁট চোখা করে চু মু ইশারা করলো। ফাটাফাটি বলেছে তার বউটা। সিনথিয়া স্বামীর পানে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তাতে বক্র হাসলো কবির। দুয়া পানির গ্লাসে এক চুমুক বসিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিলো,
” ভাইয়া। একটু রয়ে সয়ে। আমরাও আছি কিন্তু। ”
কবির ঠিক বুঝতে পারলো কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। যদিওবা বাকিরা বুঝতে পারলো না একমাত্র তূর্ণ ব্যতিত। সে একমনে খেয়ে চলেছে। উপস্থিত অন্য সকলে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চলেছে। বুঝতে পারছে না দুয়া কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললো। কবির দুষ্টু হেসে দুয়া’র প্রত্যুত্তরে বললো,
” সমস্যা নেই বোন। বড়রাই তো ছোটদের গুরু। মাঝেমধ্যে এমন টুকটাক ছোটোখাটো টিপস্ দেয়া দরকার। নাহলে তারা শিখবে কি করে? তাই না? ”
হতবিহ্বল দুয়া! তপ্ত হলো তার কপোলদ্বয়। সিনথিয়া তো লাজে মরি মরি। তূর্ণ তো খুব সুন্দর মতো বোন জামাইয়ের সাথে সম্মত হলো।
” একদম ঠিক বলেছো কবির। টোটালি অ্যাগ্ৰি উইথ ইয়্যু। ”
কবির সমর্থক পেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। বিজয়ের সে হাসি। সিনথিয়া তো লাজে জড়োসড়ো। ছোট-বড় ভাইবোনদের সামনে এসব কি করছে এরা? এতকিছুর ভিড়ে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক তৃষা। তার চোখজোড়া স্বল্প সিক্ত। ম্লান মায়াবী মুখখানি। তৃষ্ণা জেগেছে চক্ষে। সকলের ভিড়ে অনুপস্থিত আকাঙ্ক্ষিত মানব। নিশাদ। সে এখানে নেই। কোন দরকারি কাজ আছে নাকি। তাই আগেই খেয়ে নিয়েছে। সকলের সাথে যোগদান করেনি। তবে এ কথাটি যে সত্য নয়, মিথ্যা। তা তৃষা ঠিক অনুধাবন করতে পারলো। তার জন্যই তো নিশাদ এমন করছে। এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। দেখেও নাদেখা করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এতে করে তার কোমল হৃদয় যে ভ!ঙ্গুর অবস্থায় ছটফট করে চলেছে! সে খবর কি জানে ভাবলেশহীন মানবটি? সকলের অলক্ষ্যে তর্জনী ছুঁয়ে নেত্রকোণে জমায়িত অশ্রু মুছে নিলো তৃষা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেল। সে মুহূর্তে কর্ণ কুহরে পৌঁছালো তূর্ণ’র কণ্ঠ,
” তৃষা। তোর প্লেট তো খালি। কিছু নে। ”
.
রিসোর্টের একাংশে সরু পথ। পথের দু ধারে সারি সারি দৈ-ত্যকায় বৃক্ষ সমারোহ। কর্ণ কুহরে ভেসে আসছে পাখপাখালির মৃদু গুঞ্জন। নিরিবিলি নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত এমন পরিবেশে একাকী উপস্থিত মানব। লম্বাকার গাছের সনে হেলান দিয়ে বসে সে। বাঁ পা জমিন ছুঁয়ে তো ডান পা ভাঁজ করে উঁচু ভাবে দাঁড় করা। হাতে তার ক্ষুদ্র এক যন্ত্র। নাম সে যন্ত্রের স্মার্টফোন। তাতে দৃশ্যমান হৃদয়ে লুকানো রমণীর অবয়ব। হাসিখুশি মুখখানি সে যতবার দেখে ততবারই শীতলতম অনুভূতি জেঁকে ধরে অন্তঃস্থলে। রমণীটিকে আরেকটু খানি ভালোবাসার, নিজের সনে আগলে নেয়ার, পবিত্রতম বাঁধনে বেঁধে রাখার ইচ্ছেরা উড়াল দেয় হৃদ দিগন্তে। ছোটখাটো এই মেয়েটিকে সে যে খুব করে ভালোবাসে। দু’টো বছর ধরে লালন করে আসছে হৃদ মাঝারে। কম সময় নয়। দিনপঞ্জির হিসেব মতে লম্বা সময়। সর্বদা সে আড়ালে আবডালে থেকে হৃদয়ে লুকানো রমণীকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে। প্রয়াস চালিয়েছে সমস্ত দুঃখকষ্ট- ভয় থেকে দূরে রাখার। আল্লাহ্’র রহমতে সফল হয়েছে বটে। এই দু’টো বছরে একটু একটু করে তার অনুভূতি গাঢ় হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে হৃদয়ের অলিগলি সর্বত্র। বক্ষস্থলে একান্ত রমণী রূপে তাকে মিশিয়ে নেবার ইচ্ছে বারংবার জাগ্রত হয়েছে। তবে সে তাড়াহুড়ো করেনি কখনো। বরং তার লুকানো অনুভূতি লুকায়িত রেখেছে। অপেক্ষা করেছে সঠিক সময়ের। তবে তার অপেক্ষার প্রহর যে যাতনায় সমাপ্ত হবে জানা ছিল না। শেষে এই ছিল তার তাকদীরে? তার হৃদয়ে লুকানো প্রেম এভাবেই অসমাপ্ত, অপূর্ণ রইবে! কভু মিলবে না সে রমণী! তার ছোঁয়ায় আবেশিত হবে না পৌরুষ চিত্ত! হয়ে যাবে দু’জনার দু’টি পথ আলাদা! কেন? কি অন্যায় করেছে সে? প্রেমিক হতে গিয়ে শা*সক হয়ে গিয়েছিল? বেশি ত্রাশ সৃষ্টি করে ফেলেছে! হৃদয়ে লুকানো রমণীর নিকট সে এখন এতটাই অপছন্দনীয়? ঘৃণ্য? ঘৃণা শব্দটি মস্তিষ্কে কড়া নাড়তেই স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়লো। গাছের সঙ্গে লেপ্টে গেল মানুষটির দেহ। অসহনীয় যন্ত্রণা সৃষ্টি হলো বক্ষ মাঝারে। বদ্ধ হলো অক্ষি জোড়া। সে অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়লো ক ফোঁটা তপ্ত কণা। পুরুষ মানুষের হৃদয় নাকি পাথরের মতো কঠিন। তাদের কাঁদতে মানা। চিরচেনা সে রীতি ভঙ্গ করে আজ ক্রন্দনে লিপ্ত হলো নিশাদ। তার প্রেমী চিত্ত ভেঙেচুরে আজ অগণিত টুকরো। কভু লাগবে না আর জোড়া!
.
নিশুতি রাত। পুরুষালি হাতের মাঝে বন্দী পেলব হাতটি। সতর্কতা অবলম্বন করে দুজনে বেরিয়ে এলো রিসোর্টের ভবন হতে। মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে মৃদু স্বরে শুধালো,
” এভাবে রাতদুপুরে আমরা চোরের মতো কোথায় যাচ্ছি? বলো না। ”
” আরে ভাই একটু ধৈর্য ধর। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। জানিস না? ”
” আমি ভাই হই? ” ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দুয়া।
তূর্ণ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো, ” কথার কথা বললাম। এটাও বুঝিস না? ”
” তুমি কিন্তু কথা এড়িয়ে যাচ্ছো। সত্যিটা বলবে না? ”
” হ্যাভ প্যাশেন্স। ”
অধৈর্য হয়ে মুখ ফুলালো দুয়া। নীরবে হাঁটতে লাগলো সঙ্গীর সনে।
.
আঁধারিয়া রজনী চিঁড়ে এগিয়ে চলেছে সে কপোত- কপোতী। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। আঁধারের মাঝে তূর্ণ হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলো চমক। সেথায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হলো দুয়া! অজান্তেই ডান হাতে ঢেকে গেল ওষ্ঠাধর। অবাক নয়নে স্বামীর পানে তাকালো মেয়েটি। তূর্ণ মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দুয়া পুলকিত, স্তম্ভিত! নীরবে সঙ্গিনীর পানে হাত বাড়িয়ে দিলো প্রেমিক রূপী স্বামীটি। ইশারায় হাতে হাত রাখার আহ্বান জানালো। সম্মোহিতের ন্যায় পুরুষালি হাতের মাঝে নিজের হাতটি স্থাপন করলো দুয়া। তূর্ণ’র বাঁ হাতে বন্দী দুয়া’র কোমল হাতখানি। ডান হাতে মোবাইল তুলে ধরা। ফ্লাশ লাইটের আলোয় পথ ধরে তারা এগিয়ে গেল। সাবধানতা অবলম্বন করে সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়ে নিচে নেমে গেল। প্রথমে তূর্ণ উঠলো কায়াক এ ( kayak ). সে কায়াকে উঠে সঙ্গিনীর পানে হাত বাড়িয়ে দিলো। সাবধানতা অবলম্বন করে স্বামীর হাত ধরে কায়াকে উঠলো উত্তেজনায় কম্পিত দুয়া। তূর্ণ’র ইশারা মতো সে সাবধানে বসলো।
মাঝারি আকৃতির নীলাভ শুভ্র মিশেলের কায়াক’টি। মধ্যখানে একটি লণ্ঠন রাখা। লণ্ঠন হতে হলদে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে কায়াকের অন্দরে। মাথার ওপরে কৃষ্ণবর্ণ নভস্থল। গাত্রে ছুঁয়ে যাচ্ছে হিমেল পবন। চারিদিকে আঁধারের মাঝে এক টুকরো হলদে আভা। সঙ্গী হিসেবে রয়েছে একান্ত জন। সে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ! ভালোলাগার আবেশে সিক্ত হলো তনুমন। আচমকা ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটির। লেকের বুকে আঁধার রাতে চলতে শুরু করেছে কায়াক’টি। কায়াকের নিয়ন্ত্রণ তূর্ণ’র হাতে। চিকন বৈঠা মতো লাঠিটি জলজ বুক চিঁড়ে এগিয়ে চলেছে। দুয়ার অধরে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। যে খুশিতে সয়ংক্রিয়ভাবে সংক্রমিত হলো প্রেমিক পুরুষটি। মনোমুগ্ধকর এ পরিবেশে হঠাৎ মোহনীয় সুর ভেসে উঠলো,
‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
চমকিত নেত্রে স্বামীর পানে তাকালো দুয়া! তার চোখেমুখে অবাকতার পাশাপাশি উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হলো। তাতেই সন্তুষ্ট হলো হৃদয়। তার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বুঝি এক ফালি হাসিতেই সফলতা অর্জন করলো। স্বামীর চোখের ইশারায় দুয়াও এবার সুরেলা সঙ্গ দিলো। আঁধারের মাঝে মেয়েলী কণ্ঠে ভেসে উঠলো,
‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
তূর্ণ’র অধর কোণে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা। হৃদয় ছুঁয়ে গেল শব্দমালা গুলো। তার হৃদয়ে লালিত রমণীর কণ্ঠ বড্ড সুমধুর! হৃদয়, কর্ণ, মস্তিষ্ক সর্বত্র মা*দকতা ছড়িয়ে দেয়। মাইরা’র চোখের গভীরতায় ভেসে বেড়ানোর মাঝে সে-ও এবার নিজস্ব মনোভাব সুরে সুরে ব্যক্ত করতে লাগলো,
‘ দু’চোখে আঁকছে শীত
বাহারি ডাকটিকিট
দু’চোখে আঁকলো শীত
বাহারি ডাকটিকিট
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন ‘
দুয়া বিমোহিত নয়নে চেয়ে স্বামীর পানে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে একান্ত জনকে। মিটিয়ে চলেছে চক্ষু তৃষ্ণা। হৃদয়ের তৃষ্ণা। এক হাতে বৈঠা আগলে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলো তূর্ণ। ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটির। কপোলে ছেয়ে গেল আর’ক্ত আভা। লাজুক রমণী অর্ধাঙ্গের হাতে হাত রাখলো। সুরে সুরে ব্যক্ত করে গেল,
‘ তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
অমোঘ আকর্ষণে বশীকরণ হয়ে অর্ধাঙ্গের পানে এগিয়ে গেল দুয়া। বসলো সুঠাম বক্ষপটে পৃষ্ঠ এলিয়ে। তাকে আঁকড়ে ধরলো স্বামী রূপী প্রেমিক পুরুষটি। আবেশে বুজে এলো মেয়েটির আঁখি পল্লব। একান্ত জনকে অনুভব করতে করতে ভীন দুনিয়ায় হারিয়ে গেল। পেলব হাতটি রাখলো উদরে স্থাপিত অর্ধাঙ্গের হাতের ওপর। থেমে থেমে কণ্ঠ নিঃসৃত হতে লাগলো,
‘ ইতিউতি কার্নিশে
আলো-ছায়া যায় মিশে
চলো না কুড়োবো আবার
এলোমেলো চেনা রুট-এ
বসন্ত যায় যায় যায় জুটে
ভালোবেসে জীবন কাবার ‘
লেকের বুকে থেমে গেল কায়াক। বৈঠা সতর্ক ভঙ্গিতে আগলে রেখে অর্ধাঙ্গীকে নিজের সনে মিশিয়ে নিলো তূর্ণ। ললাট কার্নিশে অধর ছুঁয়ে দিলো। জাগতিক হুঁশ ফিরে এলো মেয়েটির। তপ্ত হলো কপোল। তূর্ণ সম্মোহনী স্বরে গাইতে লাগলো,
‘ গুঁড়ো গুঁড়ো করিডোরে
চুপিসারে পাতা উড়ে
আজ বাতাসও মা!তাল
বেপরোয়া হাফ ছুটি
মাখাচ্ছে খুনসুটি, খুনসুটি
ভালোবেসে উথালপাথাল ‘
মাইরা’কে দু হাতে সযতনে আগলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। চোখে চোখে আলাপণ সেরে কপালে ঠেকে গেল কপাল। বদ্ধ হলো দু’জনার আঁখি। পুরুষালি স্বরে ভেসে এলো,
‘ এত কথা বলি যাকে
চিনি আমি চিনি তাকে
এত কথা বলি যাকে
চিনি আমি চিনি তাকে ‘
দুয়া মন্থর গতিতে কপাল হতে কপাল সরিয়ে নিলো। আঁখি মেলে তাকালো দু’জনে। স্বামীর নয়নে নয়ন মিলিয়ে দুয়া গেয়ে উঠলো,
‘ চোখে চোখে কথোপকথন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
প্রিয়তমার কোমল ওষ্ঠে আলতো পরশ বুলিয়ে তূর্ণ গাইতে লাগলো,
‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
লজ্জালু আভা ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির মায়াবী বদনে। দুজনের একত্রিত সুরের কলতানে মুখরিত হলো চারিপাশ,
‘ দু’চোখে আঁকছে শীত
বাহারি ডাকটিকিট
দু’চোখে আঁকলো শীত
বাহারি ডাকটিকিট
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন ‘
সমাপ্ত হলো প্রেমময় গানের শব্দমালা। আবেশে সিক্ত কপোত কপোতী গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো। মাঝ লেকের বুকে থমকে কায়াক। তাতে প্রেমাসক্ত এক জোড়া কপোত-কপোতী। মগ্ন নিজেদের মধ্যে। বাতাসেও যেন আজ প্রণয়ের অনুভূতি।
চলবে.
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। কেমন লাগলো আজকের বিশাল বড় পর্বটি? শব্দসংখ্যা ২১০০+. কাহিনীর স্বার্থে আজ পুরো লিরিক্স ব্যবহৃত হলো। আশা করি পাঠকবৃন্দ বিব্রত বোধ না করে মুহুর্তটুকু উপভোগ করবে। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ]