#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব ৩২

0
502

#ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব ৩২
©জারিন তামান্না

সন্ধ্যা ৭:০৩ মিনিট।

কাবিননামায় বরের সই নেওয়া হয়ে গেছে। কবুলও বলা হয়ে গেছে তার পক্ষ থেকে।এবার শুধু কনের সম্মতি নেওয়া বাকি। সে সই করে কবুল বললেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে।

এদিকে বাড়িতে বিয়ে তবুও পরিস্থিতি কিছুটা গোমট। আমজাদ আলী মুখভার করে রেখেছেন। নিশাত, পলাশও নারাজ। শাহনাজ বানু পড়েছেন বিপাকে।স্বামী আর সন্তানের মধ্যে।কোন একজনের পক্ষ তিনি নিতে পারছেন না। তার তো পুরো জগৎটাই এই স্বামী সন্তানদেরকে নিয়ে।তাদের মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে বেছে নেবেন এটা তার জন্যও অনেক কঠিন ব্যাপার। আর যদি সেখানে দুজনেই দুজনের জায়গায় সঠিক হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তাই দ্বিধাদ্বন্দে, মন খারাপ,কষ্ট, হতাশা সব মিলিয়ে তিনিও খুব একটা ভালো মানসিক অবস্থায় নেই। পলকের উপর প্রচন্ড রেগে আছেন আমজাদ আলী। তার এই মেয়েটা এমন কিছু করতে পারে, আজ দুপুর অবদি সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। মেয়েটা যেমন তেমন সিফাতও পলককে এইভাবে সাপোর্ট করবে সেটাও তিনি ভাবতে পারেননি। কিন্তু,,সিফাতকে তিনি খুব স্নেহ করেন। নিজের ছেলের মত ভালোবেসে ফেলেছেন এই কয়েকদিনেই। ছেলেটাও তাকে কেমন বাবা বলে ডাকে।সব মিলিয়ে তার কথাটাই মূলত ফেলতে পারেননি তিনি। তাই পলকের এহেন কাজকেও মেনে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু,,মেনে নিলেও সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র খুশি নন তিনি। তবুও, সামাজিকতার খাতিরে আর বাবার দায়িত্ব হিসেবে সব নিয়মনীতি পালন করছেন তিনি।

পলকের থেকে বিয়ের সম্মতিসরূপ ৭ লক্ষ টাকা দেনমোহরে কবুল বলিয়ে নিয়েছেন কাজী সাহেবে। যার মধ্যে ৩ লক্ষ টাকা গয়না বাবদ আর বাকি ৪ লক্ষ টাকা নগদে পরিশোধ করা হয়েছে। পলক কবুল বলার পর পরই কাজী সাহেব নিজ হাতে সেই দেনমোহরের টাকা পলকের হাতে তুলে দিয়েছেন।বলেছেন, বরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যেন কবুল বলার সাথে সাথেই শরীয়ত মতে বরের ফরজ আদায় হিসেবে যেন এটা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু,কাজী সাহেব দেনমহরের পরিমাণ ঘোষণা করার পরপরই বেশ গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে।সবার মুখে একই কথা! এত ধনী পরিবারের বিয়ে হয়েছে, এত বড় ব্যবসায়, এত সম্পত্তি, বর নিজেই এত প্রতিষ্ঠিত , এত এত টাকা আয় করে, এত অর্থবিত্ত যাদের তারাই কিনা মাত্র ৭ লক্ষ টাকা দিলো দেনমোহরে? বিয়েটাও করছে কি সাদামাটাভাবে। একজন তো বলেই দিল,
_আরেএএএ এই মেয়ের জন্য এত টাকা কে দিবে বলো তো?

_হ্যাঁ,ঠিক বলছেন।তাছাড়া আর মেয়ের বাড়ির লোক তো কোন মতে মেয়েকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে তাই এত অল্প টাকায় দিয়ে দিল মেয়েকে। প্রথম ব্যক্তির কথায় সায় দিয়ে বললেন তার পাশের জন।
_শুনেছি মেয়ের আগে বিয়ে ভেঙেছিল।যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, সেই ছেলে এখনও জেলে। তারউপর মেয়ে দেখতে শ্যামলা। বরকে তো দেখলাম বেশ সুন্দর,,ফর্সা লম্বা।তার তুলনায় মেয়ে ভালোই খাটো। কি বুঝে এই মেয়েকে পছন্দ করলো কে জানে!

_আমার মনে হয় ছেলের কোন সমস্যা আছে। তাই এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করছে। নয় তো এত ধনী পরিবারের এত সুন্দর ছেলে মধ্যবিত্ত পরিবারের এমন একটা শ্যামলা মেয়ে বিয়ে করে কখনো?

কবুল বলার আগে খুব কেঁদেছে পলক।কিন্তু, কেউ তাকে থামানোর চেষ্টা করেনি। তার কান্না একদিকে যেমন খুশির তেমনি কষ্টেরও। পলক খুশি কারণ সে যা চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে। সে পেরেছে সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে মানুষটাকে নিজের করতে। আর এই মানুষটা পাশে ছিল বলেই, তাকে সাহস দিয়েছিল বলেই সে নতুন করে সবটা আগের মত সাজিয়ে দিতে পেরেছে। সে জানে পুরোনো জিনিস নিজের জায়গায় ফিরে এলে কিছুটা জড়তা,সংকীর্ণতা,দূরত্ব, মান অভিমান থাকেই।কিন্তু,,সময়ের সাথে ধীরে ধীরে সবটাই ঠিক হয়ে যায়। সবাই একসময় ঠিকই মেনে নিবে সবটা। স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু,,এই খুশির চাইতেও বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। এত বছরের পরিবার,,আপন মানুষ, সম্পর্ক সব কিছুকে ছেড়ে অন্য একজনের হয়ে,অন্য এক পরিবারে চলে যেতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু,যাওয়ার আগে সবাইকে এভাবে নারাজ করে যেতে হচ্ছে তার। তবে,,সে জানে যে যতই রাগ করুক…একদিন সবাই বুঝবে তাকেও। বুঝবে যে কেনো সে সব কিছু জেনে বুঝেও এমন একটা কাজ করেছে।

কিন্তু,,এত সব মানুষের এত সব বাজে কথা আর সহ্য হলো না পলকের। তাকে নিয়ে বলছে তো বলছেই,,এখন আবার বরকে নিয়েও এসব আজে বাজে কথা বলছে? অথচ এসবের প্রতিবাদে কেউ কিছুই বলছে না। এরা অন্যের বাড়ি এসে তাদের কথা শুনিয়ে যায় অথচ বাড়ির লোক কিছুই না বলে তাদের ভুলভাল কথাকেই পরোক্ষভাবে সায় দেয়। কি সমাজ আমাদের! নাহ,পলক আর চুপ করে থাকতে পারলো না। যে মানুষটার সাথে তার বাকি জীবনটা কাটাবে,,যে মানুষটা আজ থেকে তার হলো তাকে অন্য কেউ এভাবে ভুলভাল বলে অপমান করবে সে পলক কিছুতেই মানতে পারলো না। চোখ মুছে, কাবিননামায় সই না করেই নেমে গেল বিছানা থেকে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

_আসসালামু আলাইকুম।আমার জীবনের এমন একটা মূহুর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের। তবে একটা কথা, আজকে আমার বিয়ে পড়ানো হয়েছে। আমাকে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়নি। আর যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বিয়েটাও তিনিই করেছেন আমাকে। তার পরিবার নয়। তার জের ধরেই ওই পরিবারের অংশ হচ্ছি আমি।তাই দেনমোহরটাও একান্তই তার সামর্থ্য আর সুন্নতি নিয়ম অনুসারে ধার্য করা হয়েছে। সেটাও আমার কথায়। ইসলামে দেনমোহরকে স্ত্রীর অধিকার হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু,অধিকার কি জোরজুলুম বা কারও সামর্থ্যের বাইরে আদায় করা যায়? নাকি আদায় করা উচিৎ?

আপনারা তার অর্থ সম্পদ দেখছেন , সেই তুলনায় এই দেনমোহর খুবই সামান্য আমি জানি। এই অধিকার যার আদায় করার কথা তার সামার্থও এর থেকে বেশি। কিন্তু,এত বেশি দেনমোহর দিয়ে আমি কি করবো যেখানে একটা মানুষ তার গোটা জীবনের অংশীদার হিসেবে আমাকে অধিকার দিচ্ছে?স্ত্রী হওয়ার সম্মান দিচ্ছে,মর্যাদা দিচ্ছে। সামাজিকতার কথা ছাড়ুন,,ধর্মমতে লোক দেখানো কাজ হিসেবে অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করাও নিষেধ করা হয়েছে। স্বামী যতটুকু দিতে সামর্থবান ততটুকুই দিতে বলা হয়েছে। আর সেটা আদায় করা আবশ্যকও বলা হয়েছে। আমার স্বামী নিজের ব্যক্তিগত সঞ্চয় সামর্থ থেকে আমার দেনমোহর পরিশোধ করেছে। তার পরিবারের অর্থ সম্পদ থেকে নয় । অর্থাৎ আমাদের বিয়ে, এই সম্পর্ক হালাল এখন থেকে।

আর তাছাড়া,বিয়েটা দুটো মানুষের মানসিক চাহিদা,সন্তুষ্টির একটা সম্পর্ক। আমরা দুজনই দুজনকে জেনেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। আমাকে আপনারা তার যোগ্য নাই বলতে পারেন,,কিন্তু উনি আমাকে আমার সবটা জেনেই গ্রহণ করেছেন, আর আমিও! তাই এই সম্পর্ক আর ওই মানুষটা যেমনই হোক, সবটাই আলহামদুলিল্লাহ।

আশা করি এখন এই নিয়ে আর কিছু বলার নেই আপনাদের। আমাদের সুখী সুন্দর জীবনের জন্য দো’য়া করবেন প্লিজ। আর এভাবে বলার জন্যও দুঃখিত।

_আআআআহ….এই মেয়ের তো দেখি খুব দেমাগ! ক্যামন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতেছে দেখো। আর আজকালকার মেয়েদের লাজ লজ্জা বলে কিছু আছে নাকি! আমরা হলে লজ্জায় মাথা তুলেই তাকাতে পারতাম না আর এ দেখো নতুন বউ হয়ে লাজ লজ্জা ভুলে কেমন কথা শোনাতে চলে এসেছে সবাইকে। পলকের কথা শেষ হতেই ঘরে উপস্থিত একজন প্রবীন মহিলা বললেন।

_নিজের জন্য বলার অধিকার তো সবারই আছে আন্টি। আর মেয়ে বলেই সব মিথ্যা অপবাদ, অপমান মুখ বুজে সহ্য করবে এমন ভাবার তো কিছু নেই। আপনারা তার বাড়ি এসে তাকেই অপমান করছেন,,তার হাজবেন্ডকে নিয়ে কথা বলছেন এভাবে.. সেটাই বা সে কেন শুনবে চুপচাপ?

আর কি যেন বলেছিলেন আপনি! সে আমার তুলনায় খাটো,শ্যামলা, বিয়ে ভেঙে গেছিল একবার..ব্লা ব্লা ব্লা..আজ ওর জায়গায় আপনার মেয়ে হলেও কি একই ভাবে ভাবতেন ব্যাপারটা? নাকি আপনিও চাইতেন আপনার মেয়েও সুন্দর,,ভালো কাউকে পাক জীবন সঙ্গী হিসেবে।শুনতে ভালো না লাগলেও এটাই সত্যি,, আপনি তেমনটাই চাইতেন। তাহলে সে কি দোষ করেছে? রূপ রঙ সবটাই আল্লাহর দান,,,কিন্তু স্বভাব চরিত্র আর মানসিকতা সবটাই মানুষের নিজের। আর আমিও তাকে এসব দেখেই আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে তাকে আমার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।

তাই যে কোন কিছু বলার বা ভাবার আগে,,সেই অবস্থানে নিজেকে বিচার করে দেখবেন একবার। তাহলে,,নেতিবাচকভাবটা কমে যাবে অনেকটাই।

বিয়ে বাড়িতে কিছু একটা নিয়ে বেশ গুঞ্জন চলছিল বুঝে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সদ্য নতুন বিবাহিত বরও।ঘরের কাছে এসে বাকি সব কথাও কানে গেছে তার।রাগ তারও হয়েছিল।তবে,পলককে ওভাবে বলতে দেখে নিজে থেকে আর কিছুই বলেনি তখন। কিন্তু, শেষ এপর্যন্ত পলককে নিয়ে এভাবে বলায় আর চুপ থাকতে পারেনি সে।তাই ঘরে ঢুকে উক্ত কথাগুলো বলেছে। পলকের কথা পরে সবাই মোটামুটি চুপ হয়ে গেলেও বরের বলা কথার শেষে এসব নিয়ে আর কারও কিছু বলার রইলো না।

_তুমি একদম ঠিক বলছো বাবা। বিয়ে তো রিজিকের ব্যাপার। আর আল্লাহ তোমাদের মন মানসিকতাও এক রকম কইরাই মিলায় দিছে। তোমরা নিজেরা খুশি থাকলেই হইলো। একজন বয়স্ক লোক বললো।
_জ্বী চাচা, দো’য়া করবেন। বলেই মিষ্টি করে হাসলো সে।

___________________________________

কাবিননামায় পলকের সই নেওয়া হলো। সই শেষে মোনাজাত করে ওদের নতুন জীবনের জন্য দো’য়াও করা হলো। মেয়ের উপর রাগ করে থাকলেও দোয়া করতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন আমজাদ আলী। কাঁদলো বাকি সবাইও। তবে তাদের এই কান্নার পুরোটাই ছিল আনন্দের।আবার কিঞ্চিৎ কষ্টেরও।

বিয়ে শেষে খুরমা খেজুর দেওয়া হলো সবাইকে। তারপর সবাই নতুন বর কনেকে নিয়ে গেল নীচতলার বিশাল হল রুমে। দুজনকে পাশাপাশি বসানো হলো বাদবাকি আচার অনুষ্টানের জন্য। প্রথমে বর বউয়ের মুখ দেখার পালা। তাই, নিশাত বড় একটা আয়না এনে বর কনের মাঝে সামনাসামনি রাখলো। বরকে উদ্দেশ্য করে পলকের মামী বললেন,
_শোনো বাবা! সামনে আয়না ধরার পরে তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে আয়নায় কি দেখো! তুমিও বলবা যা দেখতে পাবা,,কেমন?
_জ্বী,মামী।

তারপর সবাই একরকম ঘেরাও করে ধরলো নতুন বর কনেকে। নিশাত আয়না সামনে ধরতেই বরকে জিজ্ঞেস করা হলো,
_আয়নায় কি দেখা যায়? আসমানের চাঁন নাকি হুরপরী?
ঘোমটার ফাঁক গেলিয়ে উঁকি দেওয়া পলকের মুখটা ভেসে উঠেছে আয়নায়।লাজুক হাসি এসে জুড়ে বসেছে পলকের চোখ মুখের কোণায় কোণায়। লাল বেনারসীতে প্রথমবার দেখেই কয়েকটা হার্টবিট নির্দ্বিধায় মিস করে গেছিল সে।আর এখন লাল ওড়নার আচঁলের ফাঁকে উকি দেওয়া লাজুক মুখখানি একেবারে ঘায়েল করে দিয়েছে তাকে। নববধূ সাজে বড্ড মোহনীয় লাগছে পলককে। সেদিকে কিছুসময় মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলো সে।তারপর, ঘোর লাগা কন্ঠে সে বললো, _আমার মায়াবতী মৃন্ময়ী!

সিফাতের এই কথার সাথে আনন্দে হই হই রই রই রব পড়ে গেল চারিদিকে। পলককেও জিজ্ঞেস করা হলো,
_সাজি!! আয়নায় কি দেখা যায়?
আয়নায় সিফাতের ঘোর লাগা চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে পলক বললো,
_মৃন্ময়ীর অপেক্ষার অবসান! বলেই মুচকি হাসলো সে।সেই মৃদু হাসিতেই তার মনের সন্তুষ্টি, আনন্দ আর একনিষ্ঠ ভরসাটুকুও ঠিক দেখতে পেল সিফাত। সন্তুষ্টচিত্তে সেও হাসলো তার ভুবনভুলানো হাসিখানা।

____________________________________

ফ্ল্যাশব্যাক,

_আর যদি ভাইয়া নিজেই চায় তুমি আমার হও, তখন?

থমকে গেল পলক। চমকে তাকালো সে তিয়ানের দিকে। তিয়ানের মুখে বিজয়ের হাসি।আর, পলকের চোখে বিস্ময় আর বিভ্রান্তি।

_বলো না পলক…যার জন্য তুমি আমার হতে পারছো না,,সেই যদি তোমাকে আমার হতে দেয়,তবুও ফিরিয়ে দেবে তুমি আমায়?

তিয়ানের কথা শুনে পলক কিছু বললো না। হাতের তোয়ালেটা নিয়ে বেলকোনিতে গিয়ে মেলে দিল তারে। তারপর, ঘরে এসে সোজা গিয়ে লক করে দিল ঘরের দরজাটা। তিয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে সব।পলকের কি করতে চাইছে বুঝতে পারছে না সে। তাই সে পলককে জিজ্ঞেস করলো,
_পলক….কি করছো তুমি এসব?

পলক এবারেও কিছু বললো না, কেবল তিয়ানের কাছে এসে তার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল বিছানার দিকে। তারপর,চোখের ইশারায় তাকে বসার জন্য বললো। তিয়ান পলককে বুঝতে না পারলেও তার কথা মেনে বাধ্য ছেলের মত বসলো বিছানার উপর। তিয়ান বসতেই তার সামনে হাটু গেঁড়ে বসলো পলকও। তিয়ান চমকালো তার এহেন কাজে। এই নিয়ে পলককে কিছু বলতে যাচ্ছিল,,তার আগেই পলক তিয়ানের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। তারপর ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
_উনি চাইলেও হবে না।কারণ, আমি নিজেই চাইনা এমন হোক।
_তুমি ভালোবাসোনা আমাকে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তিয়ান।
_বাসি! খুব ভালোবাসি।
_তাহলে? কেন চাইছো না তুমি আমার হতে? তুমি এখনো অভিমান করে আছো আমার উপর? তাই জন্য ফিরিয়ে দিচ্ছো আমাকে? অস্থির কন্ঠে বললো তিয়ান।
_উহু,,এমন কিছুই না, তিয়ান। তুমি শোনো আমার কথাটা।
_বলো..
_আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি তিয়ান। কিন্তু,সেই ভালোবাসাটুকু এখন কেবলই বন্ধুত্বের। বিথি আর তুমি দুজনেই এক আমার জন্য। সেদিন রাতে ছাদেও বলতে চেয়েছিলাম কথাটা কিন্তু তুমি শুনলেই না কিছু।আর গতকাল তুমি যখন আমাকে ওভাবে ধরে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিলে,,জানো কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম আমি?
_পলক আমি..

_তোমাকে আমি শুরু থেকে যেভাবে দেখেছি,,এখানে এত বছর পরেও যেভাবে পেয়েছি,,সেই তিয়ানের সাথে কোন মিলই ছিল না বিগত কয়েকদিনের আমার দেখা তিয়ানের। এই তিয়ানকে তো আমি চিনিই না একমদই। বড্ড অপরিচিত সে আমার। কিন্তু আমি জানতাম এই তিয়ান শুধুমাত্র একটা সময়ের ব্যবধান।সময়টা পার হয়ে গেলেই আমার বন্ধু,,ভালোবাসার মানুষ..যে তিয়ান,সেও ফিরে আসবে তার আগের রূপে। আর আজ সেই সময়ের ব্যবধানটা পার করার সময় হয়েছে তিয়ান। তাই আজ তোমাকে শুনতে হবে, বুঝতে হবে আমার কথাটা।

_পলক তুমি ভুল বুঝতেছো আমাকে! আমি সত্যিই ভালোবাসি তোমাকে।আর আমি তোমার আগের তিয়ানই আছি। বিশ্বাস করো।তোমার সাথে ব্রেকআপের পরেও আমি কোন রিলেশনশিপে ইনভলভ হইনি। আমি অন্যকাউকে তোমার জায়গা দেইনি।- অস্থির কন্ঠে তিয়ান বললো।

_আমি সেটা জানি তিয়ান। কিন্তু,,এত দিন পরে এত কিছুর পরে অনেক কিছুই অদল বদল হয়ে গেছে। তোমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে যেমন ছিলে তুমি আমার কাছে আজও তেমনই আছো। হ্যাঁ,,এটা সত্যি যে একটা সময় এই ভালোবাসাটা অন্য এক পথে অগ্রসর হয়েছিল। আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম দুজনের হতে। যতদিন তোমার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল,,ওই সম্পর্কটা ছিল আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি,,তোমার ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল না তিয়ান। একজন প্রেমিকা হিসেবে নয় বরং ভালোবাসার মানুষ হিসেবে তুমি আমাকে সম্মান করেছো, আগলে রেখেছো,সাপোর্ট করেছো।আমিও খুব করে চেয়েছিলাম তখন যেন আমি তোমাকেই পাই নিজের করে। আমার সবটা জুড়ে তুমি থাকো।কিন্তু,ভাগ্য..পরিস্থিতি সেটা হতে দেয়নি। তুমিও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। কোন সুযোগ দাওনি আমাদের এই সম্পর্কটাকে। ফলাফল আমাদের বিচ্ছেদ হলো! কিন্তু,,সেই তুমি আমাকে পরোক্ষভাবে সাপোর্ট করার জন্য আমাকে মিথ্যামিথ্যি অবজ্ঞা করলে। নিজেকে আমার কাছে খারাপ দেখিয়ে ব্রেকআপ করলে। তারপরে,,আমাদের আর কোন যোগাযোগ কিন্তু ছিল না। তুমি জানতে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। নিজেকে সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলে তুমি।তোমার ভালোবাসাটাও কোথাও একটা চাপা পড়ে গেছিল। কিন্তু, পরে সব জানার পরে ভুলেও একটাবার খোঁজ করোনি আমার। সম্পূর্ণ ব্যাক আউট করে গেছিলে তুমি।আর তার ৩ বছর পর যখন তুমি আবার আমাকে দেখলে, আমার সাথে মেলামেশা শুরু হলো, পুরোনো স্মৃতি উল্টেপাল্টে দেখা হলো তুমি আমাদের অতীতকে মিস করতে শুরু করেছিলে।আবার ক্যাপ্টেনের সাথে যখন আমায় দেখলে তোমার খারাপ লাগলো।কারণ,তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলে আর আজও ভালোবাসো।আমি জানি সেটা। এটুকু বলেই খানিক থামলো পলক। তিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো।

_ভালোবাসি জানো তাহলে কেন ফিরিয়ে দিচ্ছো পলক? কাতর কন্ঠে বললো তিয়ান।

_ভালো তো উনিও বাসেন আমায়। মৃদু হেসে বললো পলক।

_তুমি ভালোবাসো তাকে?

তিয়ানের এহেন প্রশ্নে স্তব্ধ হয়ে কয়েকসেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো পলক। তারপর ঝরঝরে গলায় বললো,

_নাহ। তবে ভালো লাগে তাকে আমার। আর বিয়ের পর একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসাটাও হয়ে যাবে একসময়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাই তো এমন!

_তাহলে আমি নই কেন পলক? তুমিও ভালোবাসো আমায়।

_তোমার সাথে বিচ্ছেদের পরে আমার বিয়েটাও ভেঙে গেল।ভেঙে পড়েছিলাম আমিও। সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। প্রায় দেড় দু বছর সময় লেগেছে আমার নিজেকে স্বাভাবিক করতে। এরমাঝেই আমার আরও ৮ টা সম্বোধন ভেঙেছে আমার। আমি ভেবেছিলাম এটাও ভেঙে যাবে। কিন্তু,আমাকে অবাক করে দিয়ে এই মানুষটাই আমাকে ভালোবেসেছে।বিয়ে করতে চেয়েছে। পরিবারকে রাজি করিয়েছে। একবার তো আমি তাকে ভুল বুঝে বিয়েটাই ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি! কারও কাছে আমাকে ছোট না করেই কি সুন্দর সবটা সামলে নিয়েছিল সেদিন। এই ৩ টা মাসে উনি মুখে কিছু না বলেও পদে পদে বুঝিয়ে গেছেন,,কতটা ভালোবাসেন উনি আমাকে। আমার সবটা জেনেও আমাকেই চেয়েছেন নিজের জন্য।

কিন্তু তুমি বুঝতে পারছো না তিয়ান ,এত বছর পর আমাকে পেয়ে যে ভালোবাসার দাবি তুমি করছো সেটা এখন শুধুমাত্র আমাকে পাওয়ার জেদ হয়ে উঠেছে তোমার। আসলে, প্রিয় কোন কিছু একবার হারানোর পর সেটা ফিরে পেলে আমরা তাকে খুব করে আগলে রাখতে চাই। আবেগী হয়ে বর্তমান ভুলে আঁকড়ে ধরতে যাই সেটাকে। কিন্তু,,সেই জিনিসটা আদৌও ধরে রাখার মত আছে কিনা সেটা ভেবে দেখিনা। তাই জন্য তুমি চাইছো যে কোন মূল্যে আমি তোমার হই।আমি কি চাই সেটা কিন্তু একবারও জানতে চাওনি তুমি। যখন তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল,,তুমি ছিলে না। স্বেচ্ছায় দূরে করে দিয়েছিলে আমায়।মাঝে আরও ৩ টা বছর কেটে গেছে। তোমাকে প্রথম দেখার পর আমি ভেবেছিলাম আমি আজও ভালোবাসি তোমাকে। কিন্তু,উনি আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছেন, তোমাকে আমি এখন আর ভালোবাসি না সেভাবে। আমার খারাপ লাগার কারণ তুমি নও বরং তোমায় ভুল বুঝে পুষে রাখা কষ্টগুলো ছিল। আর সত্যি জানার পর আমিও ভেবে দেখেছি সবটাই।আমি সত্যিই মুভ অন করে গেছি তিয়ান। তোমার জন্য ওমন আর কোন অনুভূতি আমার নেই। আর সত্যি বলতে, সেসময় তুমি প্র্যাক্টিকাল হয়ে আমাকে ছেড়েছিলে আর আজ আমি প্র্যাক্টিকাল হয়ে তোমায় গ্রহণ করতে পারছিনা।

_অহ! তাহলে আমার জায়গাটা রিপ্লেস করে গেছে উনার আগমনে! তাই জন্য আমার সামনে এলেই আমাকে দেখানোর জন্যই এমন বিহেভ করেন উনি। আমাকে দেখায় কত ভালোবাসে উনি তোমায়।

_ভুল! ভুল ভাবছো তুমি। উনি তোমার জায়গাটা রিপ্লেস করেননি। বরং উনি স্বয়ং নিজের একটা জায়গা তৈরী করে নিয়েছেন। আর আমি চাই তার সেই জায়গাটাতেই তাকে সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে। ইনফ্যাক্ট, সেদিন আমি তোমায় মিথ্যা বলেছিলাম। উনি কিছুই জানেন না তোমার আমার ব্যাপারে।উনি জানার পরে কি করবেন সেটাও জানি না আমি। তবে আমি চাইনা উনি কষ্ট পাক।তাই আজও বলার সাহস করে উঠতে পারিনি আমি। তাই উনার তোমার সাথে কম্পিটিশন বা তোমাকে রিপ্লেস করার কোন প্রশ্নই আসে না।

_উনি জানে না মানে? বিস্ফোরিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো তিয়ান।
_তাকে বলা হয়নি আমাদের সম্পর্কের কথা। অপরাধী কন্ঠে বললো পলক।
_উনি জানেন না তাহলে যে কাল রাতে…এটুকু বলতেই চুপ হয়ে গেল তিয়ান। তার মনে পড়ে গেল গতরাতে তার সাথে সিফাতের কথোপকথন। তিয়ান জানতো যে সিফাত সবটা জানে।তাই সে ওভাবে কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু,,সে তো কিছুই জানে না! তারমানে পলক কিছু না বললেও সে সবটা জানে কোনভাবে। আর এরপরেও সে না পলককে কিছু বলেছে আর না তিয়ানের সাথে কোন মিস বিহেভ করেছে। ঠিক কতটা ভরসা কেউ কাউকে করলে এভাবে সব জেনেও কোন প্রশ্ন করে না, সেটা তিয়ানও বুঝে গেল এবার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পলকের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আমি তোমাকে ভালোবাসি পলক।
_ভালো আমিও বাসি তোমাকে। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ তুমি। তোমার থেকেই এভাবে ভালোবাসতে শেখা।তোমার থেকে যে ভালোবাসা,,সম্মান আমি পেয়েছি সেটা কখনোই ভুলে যাওয়ার মতো নয়। আমৃত্যু সেটা আমার মনে থাকবে। কিন্তু, আমাদের বিচ্ছেদের পর আমি বেরিয়ে এসেছি সবটা থেকে। তুমিও শক্ত করো নিজেকে। বেরিয়ে এসো অসম্পূর্ণ অতীতটা থেকে।
_কিন্তু, তাও আমি তোমাকেই ভালোবাসবো আজীবন।
_তা বেসো.. আপত্তি নেই আমার।কিন্তু দেবদাস না হলেই হলো। এটুকু বলেই ফিক করে হেসে দিল পলক। হাসলো তিয়ানও। তারপর তিয়ান বললো,
_তুমি সুখী হবে ইন শাহ আল্লাহ। ভাইয়া ভালো রাখবেন তোমায়।
_ ইন শাহ আল্লাহ। পলক বললো সন্তুষ্টচিত্তে। তিয়ানকে সে বোঝাতে পেরেছে। এখন বেশ শান্তি লাগছে তার।

_রেডি হয়ে নাও তুমি।আসছি আমি।
_আচ্ছা।

এটুকু বলেই তিয়ান উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। সে দরজার কাছে যেতে যেতেই একটা কল এলো পলকের ফোনে। সেটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে কি বলা হলো বুঝলো না তিয়ান। কেবল পলককে বলতে শুনলো,
_ ওকে নিয়ে যাও হসপিটালে। আসতেছি আমি। বলেই দ্রুত পায়ে গিয়ে আলমারি থেকে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে দরজা খুলতে শুরু করলো সে। তা দেখে তিয়ান বললো,
_কোথায় যাচ্ছো এখন এভাবে?
_হসপিটালে।
_মানে?
_এখন কিছু বলার সময় নাই তিয়ান। বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল পলক। তিয়ান কিছু বুঝলো না,,কেবল পলকের পিছু পিছু যেতে যেতে বললো, ওয়েট..আমিও আসছি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here