#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_১৩
সন্ধ্যার দিকে মেহেন্দী অনুষ্ঠান শুরু হয়। বাড়ির সব মেয়েরা হাত ভর্তি করে মেহেদি দিয়েছে। তীরও বসেছে হাতে মেহেদি দেওয়ার জন্য। তীর যখন হাতে মেহেদি দিচ্ছিলো তখন ওর নজর যায় অদুরে বসে থাকা সিঙ্গেল সোফাতে। পায়ের উপর পা তুলে ইশান বসে আছে আর ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শান্ত চোখে। তীর সাথে সাথে ইশানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ইশানের চোখের দিকে তাকালেই নিজেকে কেমন জানি পাগল পাগল লাগে, বুকের ধুকপুকানিটা বেড়ে যায় দ্বিগুন। কিন্তু মন চাইছে আবার ইশানকে দেখতে কি সুন্দর পিত্ত কালারের পাঞ্জাবি পড়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। তীর একটা শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করেই আড় চোখে আবার তাকায় ইশানের দিকে। ইশান এখনও তাকিয়েই আছে ওর দিকে তীর বিরবির করে উঠে।
–এভাবে তাকিয়ে তাকায় মানে কি? আমি কি একটু দেখতে পারবো না ওনাকে। সবসময় কি ওনিই চেয়ে থাকবে আমার দিকে। আচ্ছা ইশা যা বলছে সেটা কি সত্যি। কই কখনো তো এসে বলে নি ওনি যে আমাকে পছন্দ করে বা ভালোবাসে।
আবার আড় চোখে তাকায় তীর ইশানের দিকে। ইশান তীরের আড় চোখের চাওনি ধরতে পেরে সাথে সাথে ভ্রু নাচায়। তীর থতমত খেয়ে নজর সাথে সাথে ফিরিয়ে নেয়ে। ইশান ওর আড় চোখের চাওনি ধরে ফেলেছে ইস কি লজ্জাটাই না পেলো ইশানের কাছে তীর। তাই তীর মনে মনে প্রতিক্ষা করে আর তাকাবে না ইশানের দিকে। ইশানও মুচকি হেসে চলে যায় এখানে থেকে। ইশানের আর বুঝতে বাকি নেই তীরের মনের কথা লাজুক দৃষ্টি আর আড় চোখের চাওনি বার বার বলে দিছে তীরের মনে প্রনয়ের ফুল ফুটছে বলে।
_______
তীর ছাদ থেকে নামছে। এমন সময় ইশানও দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। ইশানকে দেখা মাএই তীরের আবার শুরু হয়ে গেল বুকের ধুকপুকানি। নিজেকে শান্ত করে কাচুমাচু হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে আস্তে ধীরে। অন্য দিকে ইশানও তীরকে দেখার সাথে সাথে থমকে দাড়ায়। তীর সিঁড়ির খালি জায়গায় আসতেই ইশান হুড়মুড়িয়ে তীরের সামনে এসে দাড়ায়। হঠাৎ ইশানের এভাবে সামনে এসে দাঁড়াতে হচকিয়ে যায় তীর। ঢোক গিলে ইশানের পাশ দিয়ে চলে যেতে নিলে ইশান আবারও তীরের পথ আটকে দাড়ায়। অন্য পাশ দিয়ে যেতে চাইলে আবারও পথ আটকে দাড়ায় ইশান। এবার তীর কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না লোকটা কেন এভাবে তার পথ আটকাছে বার বার। কেউ দেখলে কি ভাববে। ভয়ে ভয়ে আশ পাশ চোখ বুলিয়ে কাপাকাপা গলায় বলে।
–প… পথ ছাড়ুন।
ইশান নিশব্দে হাসে তীরকে জ্বালাতে ভালোই লাগছে। গলা খাকরি দিয়ে বলে।
–একটু আগে আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলি কেন?
কথাটা শুনার সাথে সাথে তীর চোখ তুলে ইশানের দিকে তাকায়। মানে লোকটা তীরের পথ এর জন্য আটকে রেখেছে। তীর এক পলক ইশানের দিকে তাকিয়ে আবার নজর নিচু করে নেয়। তটস্থ গলায় বলে।
–কখন?
–মেহেদি দেওয়া সময়।
তীর কোনো কথা খুজে পাচ্ছে না তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইশান নিজের কোমড় বাকিঁয়ে তীরের মুখোমুখি হয় কিন্তু তীর নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে সাহস পাচ্ছে না ইশানের দিকে তাকাতে। ইশান তীরকে কোমল কন্ঠে ডাকে।
–তীর!
আবারও সেই ডাক। যেই ডাক শুনে তীরের সারা অঙ্গপতঙ্গ কেঁপে উঠে। শ্বাস ঘন হয়ে আসছে, বুকের কাপঁনও বেড়ে যাচ্ছে, সারা শরীরের অদ্ভুদ এক শিহরন বয়ে যাচ্ছে। কথা না বলতে চাওয়া শর্তেও অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে।
–হু!
–তাকা আমার দিকে।
তীর তাকায় না চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এ কোন পাগলের পালায় পড়লো আগে তো এমন করতো তাহলে আজকে কেন এই লোক এমন করছে। তবে কি ইশার কথাই সত্যি। না আর ভাবতে পারছে না তীর পালাতে হবে এই লোকের কাছ থেকে না হলে একটা অঘটন ঘটে যাবে কিন্তু পালাবে কি করে ইশান যেভাবে সামনে দাড়িয়ে আছে। ইশানের কন্ঠ পুনরায় শুনা যায়।
–কি হলো? তাকা আমার দিকে।
তীর মিনমিন করে বলে।
–কেন?
–একটু আগে তো আড়ঁ চোখে আমাকে দেখছিলে। তাই এখন সরাসরি দেখ তর চোখের কষ্ট কম হবে। তুই আমার দিকে না তাকানো পর্যন্ত কিন্তু এখান থেকে এক পাও নড়তে পারবি না।
তীর হাসঁফাস করছে। দু হাত সমান তালে কচলিয়ে যাচ্ছে। নাহ এখানে আর বেশিক্ষন থাকা যাবে না তাই তীর যেই দৌড় দিতে যাবে ওমনি খপ করে হাত ধরে ফেলে ইশান।
–আগে আমার দিকে তাকাবি তার পর যাবি এখানে থেকে নে তাকা আমার দিকে আমার চোখের দিকে তাকা। যত তাড়াতাড়ি তাকাবি আমার দিকে তত তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে পারবি।
তীর চোখ বন্ধ করে রেখেছে কি করবে ভেবে উঠতে পারছে না। ইশান ধৈর্য হারা হয়ে নিজেই তীরের চিবুক ধরে মুখটা উচু করে মাতাল চোখে তাকিয়ে নেশালো কন্ঠে বলে।
–তাকা তীর একবার তাকা শুধু একবার তাকা আমার দিকে।
তীর এবার নিজের চোখের পাতা মেলে তাকায়। মেলে তাকাতেই দুজনের চোখ এক সাথে মিলিত হয়। ইশানের চোখে মুখে ফুটে আছে একরাশ মুগ্ধতা, চোখে মুখে অন্যরকম এক মাদকতাও প্রকাশ পাচ্ছে ইশানের। তীরের ছোট মনটা কেপে উঠলো, অন্তরে দোলা দেয় প্রনয়ের হওয়া, তীর নিচের ঠোট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয়। আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না ইশানের এই চোখের দিকে। ইশানের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
ইশানের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। এবার হয়তো তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে এটা ভাবতেই বুকের মাঝে অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করছে।
______
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ এখন হবে গান-বাজনার আসর। তার জন্য ছাদে বড় পাটি পাতা হয়েছে, ছাদের চারিদিকে লাইটিং করা। সব কাজিনরা আর বন্ধুরা পাটিতে বসেছে কিন্তু ইহান আর ইশান মিসিং। ইশা রাগে গজগজ করতে বলে।
–যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়াপড়শির হুস নাই। বরের এখনাে আসার নামেই নাই।
রিফাত বলে।
–ইশা তুই গিয়ে ইহান ভাইয়াকে নিয়ে আয় আর আমি ইশানকে নিয়ে আসি চল।
ইশা লাজুক দৃষ্টিতে তাকায় রিফাতের দিকে। ইশা তাকাতেই রিফাত চোখ টিপ মারে। ইশা বড় বড় চোখ করে তাকায় আর রিফাত মুচকি মুচকি হাসছে। রিফাত আবারও বলে।
–কি হলো চল?
ইশা কাপাকাপা গলায় বলে।
–হু….ম চলুন।
ইশা আর রিফাত ছাদের দরজা পার হতেই রিফাত ইশার বা হাত চেপে ধরে। ইশা ছটপট করে সিঁড়ির নিচের দিকে তাকিয়ে বলে।
–কি করছেন? হাতটা ছাড়ুঁন কেউ দেখে ফেলবে তো।
–দেখবে না চলো তো।
রিফাত ইশার হাত ধরেই সিঁড়ি বেয়ে নামে। শেষের সিঁড়িতে আসতেই রিফাত ইশার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে।
–যাও।
ইশা মাথা নাড়িয়ে ইহানের ঘরে চলে যায়। ইশা ইহানের ঘরে ডুকতেই দেখে ইহান কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলছে ফোনে। ইশার আর বুঝতে বাকি রইলো না কার সাথে ইহান কথা বলছে। ইশা মুচকি হেসে বলে।
–ভাইয়য়য়া! কার সাথে কথা বলছো তুমি?
ইহান ইশার আওয়াজ শুনে চমকে উঠে। সামনে ফিরে ইশাকে দেখে কলটা কেটে বলে।
–একি তুই কখন এলি?
–মাএই আসলাম আর এসে দেখি তুমি কেয়া ভাবির সাথে প্রেমলাপ করছো।
ইহান মাথা চুলকিয়ে বলে।
–তেমন কিছু না।
–সে যেমন কিছুই হোক তুমি এখন চলো তো।
–কোথায়?
–কোথায় মানে? ছাদে যাবে ওখানে গান বাজনা হবে তোমার কি মনে নাই।
–ইসরে ভুলে গেছিলাম। তুই যা আমি এখনেই আসছি।
–তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু না হলে কিন্তু ভালো হবে না।
–আচ্ছা বাবা যা আসছি।
_____
রিফাত ইশানের ঘরে ডুকে দেখে ইশান রকিং চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে কপালে দু আঙ্গুল চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
–কিরে ব্যাটা এভাবে বসে আছিস কেন?
রিফাতের কন্ঠস্বর শুনে ইশান চোখ মেলে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে বলে।
–এমনি!
রিফাত বেডে বসতে বসতে বলে।
–এমনি মানে কি? কিছু কি হয়েছে?
ইশান চুল গুলা নিজের হাত দ্বারা বেকব্রাশ করে বলে।
–কিছু হয় নি আমি ঠিক আছে।
–কিছু একটা তো হয়েছে তর আমি নিশ্চিত।
–কিছু হয় নি! চল তো।
ইশান আর রিফাত ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। ছাদে আসার সাথে সাথে ইশানের নজর যায় তীরের দিকে। কেমন হেসে হেসে কথা বলছে সাবার সাথে আর মাঝে মাঝে বাতাসে দোল খাওয়া ছোট চুল গুলো কানে গুজে দিচ্ছে। খুব মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে আজকে। চাঁদের আলো আর ছাদের লাইটিং করা আলো মুখের উপর পড়াতে খুব আবেদনময়ী লাগছে। ইশানের হাত নিশপিশ করছে তীরকে ছোঁয়ার জন্য, বুকের গতি বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেছে। জোরে শ্বাস নিয়ে মনে মনে বিরবির করে উঠে।
–এভাবে কেন নিজেকে আমার সামনে প্রেজেন্ট করছিস তীর? আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। তোকে খুব ছোঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা তকে গভীর ভাবে ছোঁয়ে দিলে কি রাগ করবি।
এর মাঝে ইশার নজর যায় ইশানের দিকে ইশানকে দেখার সাথে সাথে বলে।
–এইতো ভাইয়া চলে এসেছে। ভাইয়া এসো তাড়াতাড়ি এসে বসো তোমার জন্য এতক্ষন অপেক্ষা করছিলাম।
ইশান নিজের কল্পনা জগত থেকে ফিরে আসে। তীর ইশানের দিকে এক নজর তাকিয়ে অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কিছুক্ষন আগের ঘটনাটা মনে পড়তেই লজ্জা গাল দুটো লাল হয়ে আসছে। বারবার ইশানের মাদকতায় ভরা চোখ দুটো ভেসে উঠছে।
ইশা বসা থেকে উঠে এসে ইশানের হাত ধরে এনে তীরের মুখোমুখি বসিয়ে দিয়ে বলে।
–এবার ইশান ভাইয়া গান গাইবে?
সবাই ইশার গলায় তাল মিলিয়ে বলে।
–হে হে এবার ইশান ভাইয়া গান গাইবে।
ইশান তীরের দিকে তাকায় দেখার জন্য তীর কি বলে। কিন্তু তীর নিচ দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত ইশানের কোলে গিটারটা দিয়ে বলে।
–নে তাড়াতাড়ি শুরু কর আর চাইলে কাউকে ডেডিকেট করেও গাইতে পারিস।
ইশান পক্ষান্তরে একটা মুচকি হাসি দেয়। সেই হাসিটা তীর আড় চোখে দেখে। কিন্তু মাথায় ঘুড়ছে এখন রিফাতের বলা কথাটা এখানে কাকে ডেডিকেট করার কথা বলছে।
ইশান গিটার হাতে নিয়ে মাথা নত করে বাজানো শুরু করলো। গিটারের টুং টুং শব্দ ভেসে আসছে। তীর এবার চোখ তুলে তাকায় ইশানের দিকে মনে মনে অনেক এক্সাইটেড হয়ে আছে। এই প্রথম ইশানের গলায় গান শুনতে পাবে ভেবে বুকের ভেতরের ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। মুহুর্তের মাঝেই পরিবেশ নিস্তদ্ধে পরিনত হয়েছে। সেই নিস্তদ্ধেতার পরিবেশর মাঝ থেকে ভেসে আসে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ।
“তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন
দু’চোখে আঁকছে শীত
বাহারি ডাকটিকিট
দু’চোখে আঁকলো শীত
বাহারি ডাকটিকিট
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন”
#চলবে________