#শতদলের_ভীরে
#পর্ব_৮
#মুসফিরাত_জান্নাত
ঘাড় ঘুরিয়ে জেবাকে দেখতে পায় সে।উশখুশ দৃষ্টি তার।জেবার হাতে একটা থা’প্পড় মেরে বলে,
“এমনে কেও ধরে হারামি?ভয় পেয়েছি আমি।”
চারিদিকে এক পলক চোখ বুলায় জেবা।চাপা স্বরে বলে,
“হাউ বইন!কেমনে সম্ভব এটা?”
বিষ্মিত ঐশী।জেবার কথার আগা গোড়া কোনোটাই বোধগম্য হয় না।ভ্যাবলাকান্তের মতো জিজ্ঞেস করে,
“কি কেমনে সম্ভব?”
“সকালে যাকে র্যাগ দিয়ে বেয়াদবি করলি,রাতের বেলা সেই তোকে বিয়ে করলো?কেমনে ভাই?”
হতভম্ব হয়ে যায় ঐশী।
“তুই এটা জানলি কেমনে?”
জেরপূর্বক কন্ঠ জেবার।
“শুধু আমি না।পুরো ভার্সিটি জেনে গিয়েছে খবরটা।”
“কিন্তু কিভাবে?”
“কে যেনো ভার্সিটির অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপে তোদের ম্যারিড লাইফের শুভকামনা জানিয়ে পোস্ট করেছে।সাথে তোদের বিয়ের ছবিও এড করেছে।”
ঘাম ছুটে যায় ঐশীর।চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে।
“বলিস কি!বিষয়টা তো ভাইরাল হয়ে যাবে।এখন ভার্সিটিতে আসব কেমনে আমি!”
“কেমনে আর আসবি?আগে প্রত্যেকদিন রিকশায় চড়ে আসতি।এখন থেকে স্যারের সাথে আসবি।”
পিঠের উপর ধুম করে কি’ল বসিয়ে দেয় ঐশী।
“মশকরা করিস আমার সাথে?সবাই বিষয়টা কেমনে নিবে চিন্তায় ম’রতেছি এমনি।”
“এতো চিন্তার কিছু নাই বইন।কয়েকদিন ভার্সিটি আসিস না।তাই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
উপস্থিত হয় তাসনিম।ঐশীকে দেখে হাসি বিনিময় করে।জেবার কথার পিঠে জবাব দেয় সে,
“ভার্সিটি আসবি না কেন?অবশ্যই আসবি।তোরা তো প্রেম করে বিয়ে করিস নি যে কটু কথা শুনবি।তাছাড়া স্যারও নতুন, কয়েক দিন হলো জয়েন করেছে।কেও ওনাকে সেভাবে চেনেও না।সো রিল্যাক্স।তাছাড়া তোদের বিয়েতে স্বয়ং ডিপার্টমেন্ট হেড স্যার উপস্থিত ছিলেন।কোনো সমস্যা হলে ব্যাপারটা তিনি সামলে নেবেন।”
“হুম।কিন্তু উনি যে আসতে না করলেন!”
আনমনে কথাটা বলে ঐশী।একসাথে হেসে ওঠে অপর দুইজন,
“বাব্বাহ!দুই রাতেই উনি!”
লজ্জা পায় ঐশী।আড়ষ্ঠভাব লুকাতে বলে,
“ভেতরে যাই চল।ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”
গটগট করে ভার্সিটির মুল দরজা পার হয় সে।পিছু নেয় ওপর দুইজন।ঐশীকে দেখে গুটি কয়েক জন চোখ মুখ টিপে হাসে।হাসিতে কোনো বিদ্রুপ নেই।অনেকে এসে দেখেও যায়।পুরো ব্যাপারটাই অনেকটা নতুন বউ দেখার মতো।এসবে অনেকটা বিব্রত হয় ঐশী।কিন্তু ক্লাস টাইম সহ অন্য সময়গুলো বেশ ভালোই কাটে।ঝামেলা ছাড়া পুরো দিন কাটে।বাড়ি ফেরার সময় হয়।সবার সামনেই ঐশীকে নিজের গাড়িতে বসিয়ে রওনা হয় সাদাত।কোথাও কেও উপহাস করে না।তবুও সকালে সাদাতের নিষেধাজ্ঞার কারণ ঠাহর করতে পারে না।কৌতুহল মেটাতে জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা আমরা বিবাহিত।এটা সবাই জানে।শিক্ষক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।তবুও কোথাও কোনো ঝামেলা দেখলাম না।ব্যাপারটা অবাক করার মতো না?”
স্মিত হাসে সাদাত।স্বগোতক্তি কন্ঠে জবাব দেয়,
“কোথাও যেন কোনো ঝামেলা না লাগে সে ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিলাম।”
বিস্মিত হয় ঐশী।
“তাহলে ভার্সিটি যেতে নিষেধ করেছিলেন কেনো?”
বাঁকা হাসে সাদাত।
“যদি নিষেধ না করতাম আপনি কি আদৌ ভার্সিটিতে সারাটা ক্লাস জুরে থাকতেন?”
ঠোঁটের কোণ আরও একটু প্রশস্ত হয় তার।বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রয় ঐশী।তার মানে তাকে ক্লাস করানোর নিঞ্জা টেকনিক ছিলো ওটা!মনে মনে বিড় বিড় করে ঐশী,
“বদমাশ লোক একটা।আমি ক্লাস করবো না ভেবে রেখেছিলাম তা বুঝে গিয়েছিলেন তবে।আর আমার ভাবনা ভন্ডুল করতেই এমন করা তাই না?আমিও দেখে নেব আপনাকে।অবশ্য ভালোই হয়েছে।পুরোটা সময় চিন্তা বিরাজ করায়, অস্বস্তি পালিয়ে গিয়েছিল।হি হি।”
নিরবতা গ্রাস করে তাদের।পিচ ঢালা রাস্তা মাড়িয়ে গাড়ি চলছে আপন গতিতে।কোথাও কোনো জ্যামের চিহ্ন নেই।পরিবেশও ঠান্ডা।বাতাস বইছে অনেক।উজ্জল রোদের তেজকেও হার মানাচ্ছে শীতল বাতাস।জানালার কাচ অর্ধেক নামিয়ে দেয় ঐশী।তার ফাঁক দিয়ে দমকা হাওয়া ছুঁইয়ে দিচ্ছেন তাকে।ঐশীর চোখ, মুখ, চুল সর্বোত্র বিচরন খেলছে উড়ো হাওয়ার দল।অবাধ্য চুলগুলো সে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।ছাড়া পেয়ে চুলগুলো উড়ে চলছে আপন নিয়মে। উড়ে উড়ে সাদাতের চোখে মুখে বার বার লেপ্টে যাচ্ছে। সেদিকে কোনো হুশ নেই ঐশীর।তার মন মস্তিষ্ক জুরে বাহিরের প্রকৃতি উপভোগে ব্যস্ত।এদিকে অপর পাশে বসা ব্যক্তির ভেতরের অবস্থা বোঝা দায়।সে যে তার চুলের গন্ধে মোহগ্রস্তের ন্যায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সেদিকে ধ্যান নেই কন্যার।নারীর এতো নিকট সঙ্গ হয়তো এলোমেলো করে দেয় সাদাতকে।নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে এক মনে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে সে।কন্যার দীঘল কালো চুল,ডাগর ডাগর দুটি চোখ,চকচকে চোখের মনি,মসৃন পাতলা ঠৌঁট সব নেশাগ্রস্তের ন্যায় টানে তাকে।আচ্ছা মেয়েটার চোখে মুখে কি চোরাবালি আছে নাকি?গভীরভাবে একবার তাকালেই আর বের হওয়া যায় না।সাদাতও ডুবে গিয়েছে সেখানে।যতই ওই মায়া মায়া মুখ থেকে দৃষ্টি সড়াতে চাচ্ছে,চোখের তৃষ্ণা আরও গভীর ভাবে গ্রথিত হচ্ছে।আচ্ছা কি আছে এই নারীর মাঝে?যা মুহুর্তে ওলট পালট করে দিল তাকে? উদাসীন কন্যাকে দেখে মনের অজান্তেই গলা খাকাড়ি দেয় সাদাত।মোহনীয় কন্ঠে ডাকে সে,
“বন্যপাখি!”
ক্ষুনাক্ষরেও বুঝে ওঠে না সাদাত,এটা কি বললো সে?পরক্ষনেই ডুবে যায় ওই মায়াবিনীর মাঝে।এসবের কোনোটাই মস্তিষ্কে ঢোকে না উদাসী কন্যার।আনমনেই জবাব দেয় সে,
“হুম।”
আবারও কন্ঠ জড়িয়ে আসে সাদাতের।মাতালের ন্যায় প্রশ্ন করে,
“এতো উদাস কেনো?বিবশ নয়নে কি দেখছেন?”
“প্রকৃতি।”
“প্রকৃতিকে খুব হিংসে হচ্ছে।ডাগর চোখে আটকায় সে।আমায় দেখলে কি খুব ক্ষতি হতো?”
চমকে ওঠে সাদাত।মনে মনে এসব কি বিড়বিড় করছে সে?হটাৎ গাড়িতে ব্রেক কষে।সম্বিৎ ফিরে ঐশীর।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পাশে বসা পুরুষটির পাণে।সাদাতের চোখের দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে ওঠে।কেমন মোহগ্রস্ত দৃষ্টি।এটা তার জন্য?হটাৎ সচেতন হতেই একটি প্রশ্ন জাগে তার মস্তিষ্কে।একটু আগে লোকটা কি বলে ডাকল তাকে?বন্যপাখি?
নিজেকে সামলে নেয় সাদাত।ধাতস্থ কন্ঠে বলে,
“গাড়ি থেকে নামুন।পৌঁছে গেছি।”
নেমে পড়ে ঐশী।সাদাতের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“একটু আগে কি বলে ডেকেছিলেন আমাকে?বন্যপাখি?”
হাঁসফাঁস করে সাদাত।স্মিত হেসে বলে,
“কই না তো!আপনি হয়তো একটু বেশিই উদাসীন ছিলেন।বন্যপশু বলেছি।”
কটমট করে তাকায় ঐশী।আবারও হাসে সাদাত।কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
“পাখিদের চঞ্চলতা থাকে।আর আপনার আছে হিংস্রতা।অল্পতেই কেমন রেগে যান।কথায় কথায় কটমট করে তাকাম।এই দেখুন না!কেমন বাঘিনীর মতো তাকিয়ে আছেন।ভয় পাচ্ছি তো!”
আরও একটু রেগে যায় ঐশী।ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায়।হাফ ছাড়ে সাদাত।কনট্রোল হারিয়ে ওভাবে তাকিয়ে থাকায় নিজেকে প্রচুর শাসায় সে।একটুর জন্য ধরা খায় নি আজ।যদি ঐশী উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে বসত, তবে কি হতো!পরক্ষণেই তাকায় কন্যার চলে যাওয়ার পাণে।রাগে কেমন ফোঁসফোঁস করছে সে।নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসে সাদাত।আনমনে বলে,
“রাগের সমুদ্র সে!”
_______
অন্তরীক্ষ জুরে রাতের আঁধার ছেঁয়েছে।ভরা পূর্নিমা হওয়ায় চাঁদের দ্যূতি ছড়াচ্ছে বেশ।পাগলা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মস্ত মস্ত গাছ-গাছালি।অথচ একটুও হেরফের হচ্ছে না কন্যার।ফকফকে চাঁদের আলোয় করিডোরে পাতা বেতের চেয়ারে মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছে সে।ডাইনিং প্লেসে একত্রে খেয়ে এসে এখানে চেপে বসেছে।সাদাতের সাথে এক বিছানায় ঘুমাবে না বলে জেদ চেপেছে।সাদাতও পড়েছে বেকায়দায়।অনেক বুঝিয়েও শান্ত করতে পারে নি তাকে।আবার রাগের কারণটাও বুঝে উঠতে পারছে না।শেষ চেষ্টা স্বরুপ আবারও সাধে সে,
“রাত তো অনেক বাড়লো।ঘুমাবেন চলুন।”
চেতে ওঠে ঐশী।
“রাত বাড়ছে,ঘুমান যান।আপনাকে কে আটকাইছে।কোনো পশুর কি ক্ষমতা আছে নাকি মানুষকে আটকানোর।”
বিষ্মিত হয় সাদাত।তার তখনের বলা কথার জের মেয়েটা এখনো ধরে রেখেছে।চটে যাওয়া টমেটোর ন্যায় লাল ঐশীকে দেখতে খারাপ লাগে না সাদাতের।ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
“কথায় কথায় আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।সাধে কি আর পশু বলি?”
“আম্মা!”
চিল্লিয়ে ওঠে ঐশী।এই কয়দিনেই শাশুড়িকে হাত করে ফেলেছে সে।হন্তদন্ত হয়ে প্রস্থান করে সাদাত।
“যাচ্ছি তো।মিয়া বিবির মাঝে আবার আম্মুকে ডাকেন কেন?অসভ্য মেয়ে।”
চলে যায় সাদাত।মুখ ফুলিয়ে করিডরেই ঘুমিয়ে পড়ে ঐশী।ঘুম থেকে উঠে বিছানায় আবিষ্কার করে নিজেকে।উপরে ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে।গায়ে পাতলা কাঁথা জড়ানো।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সাদাতের অস্তিত্ব পায় না।ঘরির কাটায় দৃষ্টি দিতেই বোঝে এতোক্ষণে ভার্সিটি চলে গেছে সে।উঠে পড়ে ঐশী।হটাৎ নজর যায় বেডের সাইড টেবিলে রাখা ছোট্ট চিরকুটের উপর।ভাজ খুলে দেখে সেখানে লেখা,
“কে বলেছে পশুদের মানুষকে আটকানোর ক্ষমতা নেই?হরিণও তো বন্যপশু।অথচ কি সুন্দর করে নিজের মায়ার জালে মানুষকে প্রায়শই আটকায়।”
চলবে
(দুইদিন গল্প দেই নি বলে আজ অনেক বড় পর্ব দিলাম।আশা করছি আর মন খারাপ করে থাকবেন না।ধন্যবাদ।)