#শতদলের_ভীরে
#পর্ব_১০
#মুসফিরাত_জান্নাত
“কি হলো নিশ্চুপ কেনো?কাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো তখন?”
কিছু সময় আমতা আমতা করে ঐশী।কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে সাদাত।ঐশী যখন বুঝতে পারে উত্তর না দিয়ে উপায় নেই তখন সে কোনো বিবেচনা ছাড়াই হড়বড় করে বলে,
“ওই একজন মানুষ জীবনে বংশের বাত্তি জ্বালাতে পারবে না তো!তাকেই টিউব লাইট বলছিলাম।”
সন্দিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে সাদাত।দৃষ্টি সরু করে বলে,
“তা সেই একজন মানুষটা কে?”
হাঁসফাঁস করে ঐশী জবাবে বলে,
“তা জানা আপনার কাজ নাকি?”
কাঠ কাঠ গলায় প্রতিউত্তর করে সাদাত।
“অবশ্যই আমার কাজ।”
“আপনার ফালতু প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”
কঠোর গলায় জবাব দেয় ঐশী।পরক্ষণেই কন্ঠে তেজ মিশিয়ে বলে,
“আপনি তো দেখছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বংশধর।আমাকে ভাতে মা’রতে চাচ্ছেন,পানিতে মা’রতে চাচ্ছেন।”
“মানে!”
“এইযে সুদুল বুদুল দিয়ে খাওয়াইয়া এখন জাইতা ধরছেন।”
সরু চোখে তাকিয়ে থাকে সাদাত।কন্ঠ খাদে নামিয়ে প্রতিউত্তর করে সে।
“আমার কেনো যেন মনে হয়,তখন আমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিলো আপনাদের।কোথাও আমাকে টিউব লাইট বলেন নি তো?”
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ঐশী।চোর ধরা খাওয়ার মতো দৃষ্টি তার।চোরের মায়ের বড় গলা, বলতে একটা প্রবাদ আছে।ঐশীর অবস্থাও তাই।এলোমেলো কন্ঠে তেতে উঠে সে।
“যদি বলে থাকি তো কি করবেন?”
সরু চোখে তাকায় সাদাত।ঠোঁটের কোণে বদমাইশি হাসি।ঐশীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে কন্ঠ খাদে নামিয়ে জবাব দেয়,
“যদি বলেই থাকেন তবে…আমি টিউব লাইট নাকি এলইডি লাইট তা প্র্যাক্টিক্যালি দেখিয়ে দিবো আপনাকে।”
“উঁ!”
“হু।”
বিষম খায় ঐশী।চোখ তার চড়কগাছ।লোকটা এতোটা অসভ্যের মতো কথা বলবে ভাবতে পারে নি সে।লজ্জায় নাক কান দিয়ে ঝাঁঝ বের হয় তার।
“নিজের ছাত্রীকে এমন অসভ্য কথা বলতে বিবেকে বাঁধলো না আপনার?”
“নিজের টিচারকে নিয়েও এমন এলোমেলো মন্তব্য করতে আপনাদের বিবেকে নাড়া দেয় নি?”
ইতস্তত করে ঐশী।নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই আটকা পড়েছে। আড়চোখে তাকে একবার পরখ করে বাঁকা হাসি দেয় সাদাত।শাণিত কন্ঠে বলে,
“কথা বলার আগে একটু ভেবে নিবেন ঐশী।এতোটাও অবুঝ হবেন না।আপনার অবুঝপনাকে যদি আমি সিরিয়াসলি নিয়ে নেই কি হবে বুঝতে পারছেন?”
লজ্জায় লাল হয়ে যায় ঐশী।অস্বস্তিতে,ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়।তপ্ত শ্বাস ফেলে সাদাত।মেয়েটা চঞ্চল হলেও বড় অবুঝ স্বভাবের।
_____
পরের সময়টা এক ধাপেই চলে যায়।চোখের পলকেই এক মাস কেটে যায়।সাথী তার শশুর বাড়ি গিয়েছে বিয়ের কয়েক দিন পরে।সাদাত ও ঐশীকে দাওয়াত করেছিলো আজ।বিয়ের পর প্রথম বারের জন্য ভাই বউকে নিজের বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে দিতে চায় সে।সজীবেরও পূর্ণ সমর্থন আছে এতে।তাই আর দেরি করে নি।সব গোছগাছ করে দাওয়াত দিয়ে গিয়েছে।সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দাওয়াত দেওয়ায় সাদাতও নাকচ করেনি।ওদের সাথে সিন্থিয়াকে নিয়ে সকাল সকাল এসে পড়েছে ওরা।মামা খালাকে কাছে পেয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে সায়ান ও স্নিগ্ধা।সাথীর দুই জমজ ছেলেমেয়ে।এবার ক্লাস ওয়ানে পড়ে ওরা।লেখাপড়া বাদ দিয়ে সবকিছুতেই পূর্ণ প্রতিযোগিতা চলে দুইজনের।তার পরেই লাগে মা’রামা’রি,ঝ’গড়া ঝামেলা।এই যেমন এখন লেগে পড়ে আছে নতুন মামির কাছে ঘেসতে।সব জায়গায়ই ঐশীর কাছে লেপ্টে আছে তারা।খাওয়ার টেবিলে বসার আগে ঐশীর কাছে বসা নিয়ে ঝ’গড়া বাধায় দুইজনে।কিন।তু কেউই ছাড়ার পাত্র না।সায়ান দাবি করে,
“নতুন মামি আমার।”
স্নিগ্ধা প্রতিবাদ করে দ্বিগুন জোরের সহিত বলছে,
“বললেই হলো!নতুন মামি আমার।”
সায়ান তেতে উঠে বলছে,
“কোন যুক্তিতে নতুন মামি তোর?তুই সড় এখান থেকে।আমি মামির কাছে বসব।”
স্নিগ্ধাও গর্বের সহিত জবাব দেয়,
“অবশ্যই নতুন মামি আমার।তুই দেখ,আমিও মেয়ে,মামিও মেয়ে।এইজন্য নতুন মামি আমার।”
যুক্তিতে হেরে যায় সায়ান।এদিক ওদিক তাকিয়ে ধুপ করে স্নিগ্ধার গায়ে চ’ড় লাগিয়ে দেয়।এটা তাদের বরাবরের অভ্যাস।পাল্টা আক্রমণ করে স্নিগ্ধা।লেগে যায় মা’রামা’রি।হুলস্থুল কান্ড।অনেক চেষ্টা করেও তাদের থামাতে পারে না কেও।এক পর্যায়ে জোর করে স্নিগ্ধাকে সড়িয়ে নেয় ঐশী।সাদাতও কোলে তোলে সায়ানকে।তখন দাঁত কেলিয়ে স্নিগ্ধা বলে,
“চিল্লায়া কি মার্কেট পাওয়া যায় পা’গলা।দেখেছিস নতুন মামি আমাকে টেনে নিয়েছে।নতুন মামি আমার।”
কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় সায়ান।মামার গলা জড়িয়ে ধরে নিচু কন্ঠে বলে,
“আমার এই পঁচা বোন চাই না মামা।এই পঁচা মামিও চাই না।আমাকে একটা ভালো ভাইয়া এনে দাও।”
বাকরুদ্ধ সাদাত।লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে।খুক খুক করে কেশে ওঠে।ছেলেটা আদৌ জানে সে কি বলছে?আড়চোখে একবার ঐশীর দিকে তাকায় সে।উৎসুক নয়নে কান খাঁড়া করে এদিকটায় চেয়ে আছে মেয়েটা।উদ্দেশ্য সায়ানের বলা কথাগুলো শোনা।মনে মনে হাসে সাদাত।যদি সে এই কথাগুলো শুনতো তবে কানে লাগাম লাগিয়ে রাখতো।ভাগ্যিস শুনতে পাচ্ছে না।কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে বিস্ফোরণ ঘটায় অবুঝ বাচ্চাটি।শব্দ তুলে কেঁদে বলে,
“আমাকে একটা ভালো ভাই এনে দিবে না মামা?আব্বুর পকেট মে’রে তোমাকে অনেক টাকা দিব আমি।নতুন ভালো ভাইয়ের সাথে ব্যাট বল খেলব আমি।এই পঁচা বোন তখন লাগবে না আমার।দাও না মামা।”
কথা গুলো কর্ণ গোচর হতেই এক লাফে সড়ে যা ঐশী।ভয়ার্ত কাঁপা গলায় বলে,
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লা…।”
হতভম্ব সাদাত। প্রতিক্রিয়া দিতে ভুলে গিয়েছে যেন।সায়ানের কথায় লজ্জা পাবে নাকি ঐশীর প্রতিক্রিয়া দেখে হাসবে বুঝে উঠতে পারছে না।এ দিকে সায়ানেরও কান্নার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।একে একে বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য জড়ো হয়।সায়ানের কান্না থামছেই না।যতক্ষন না সাদাত তাকে ভাইয়া এনে দেওয়ার আশ্বাস দিবে ততক্ষন সে কান্না থামাবে না।এমনকি খাবারও পাতে তুলবে না জেদ ধরে বসে।বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় সাদাত।ফিক করে হেসে দেয় সিন্থিয়া।তার বাঘের ন্যায় ভাইয়ে খাঁচায় বন্দী বেড়ালের ন্যায় হাঁসফাঁস করতে দেখে মজা পায় সাথীও।বাসর রাতে জোর করে তাকে দুধ খাইয়েছিলো না?সুযোগের সৎব্যবহার করতে ভুলে না সে।কুটিল হেসে বলে,
“দেও না ভাইয়া।সায়ানকে একটা ভালো ভাইয়া এনে দেও।এই প্রথম আমার ছেলে একটা জিনিসের আবদার করেছে তোমার কাছে।ফেললে কিন্তু ভালো হবে না।”
লজ্জায়, অস্বস্তিতে গাল লাল হয়ে যায় দুজনের।নত মুখে জোরে জোরে শ্বাস নেয় তারা।লজ্জায় যেন পরাণ পাখি উড়ে যাবে।এর মাঝে রসিকতা জুড়ে দেয় সিন্থিয়া।সাদাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বেশি কিছু তো চায় নাই ভাইয়া।একটা মাত্র বাচ্চা চাইছে।এতে তোমার টাকাও লাগবে না পয়সাও লাগবে না।বাচ্চাটা এনে ওকে খুশি করে দাও।”
ফিক ফিক করে হাসে সকলে।লজ্জায় মিইয়ে যায় সাদাত ও ঐশী।দুজনেরই পায়ের তলা শূন্য হয়ে যায়।ছোট বোনের বর হিসেবে বিষয়টাকে আর এগোতে দেয় না সজীব।সাদাতের সম্মান রক্ষার্থে সায়ানকে কোলে তুলে নেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে বলে,
“ব্যাট বল খেলার মতো ভালো ভাইয়া একদিনে পাওয়া যায় না আব্বা।এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়।সময় এলে তোমার মামা অবশ্যই তোমাকে ভালো ভাইয়া এনে দিবে।এবার তুমি শান্ত হও।”
কিছু সময় কেঁদে শান্ত হয়ে যায় সায়ান।হাঁফ ছাড়ে ঐশী ও সাদাত।তবুও লজ্জারা পিছু ছাড়ে না।অস্বস্তিতে কেও কারো দিকে চোখ মেলায় না আর।
খাবার শেষে নিরিবিলি জায়গায় চলে যায় ঐশী।হটাৎ কি একটা ভেবে মৃদু হাসে সে।একা একাই ভীষণ লজ্জা পায়।দূর থেকে সরু চোখে এসব পরখ করে সাদাত।লজ্জারাঙা ঐশীকে পরীর ন্যায় সুন্দর লাগে।হটাৎ ঘোরের মধ্যে চলে যায় সে।ঐশীর একা একা লজ্জা পাওয়া এক অন্য জগতে নিয়ে যায় তাকে।কল্পনার রাজ্যে শত রঙা প্রজাপতির আনাগোনা অনুভব করে।সেখানে শুধুমাত্র দুটি প্রাণ।সে ও ঐশী।হটাৎ অনুভব করে সে তার কল্পনার রাজ্যের রাজা আর ঐশী তার সুদর্শনা রানী।একই রাজ্যে দুজনের বসবাস।রানী তার রুপ খুলে মেলে ধরে আপন মনে।দূর থেকে তা উপভোগ করে সে।দেখতে দেখতে অনুভব করে এইতো তার ভালোলাগা,তার সুখ,তার আনন্দ।এক নতুন অনুভূতির সঞ্চার হয় হৃদয়ে।মনের অজান্তেই বিড়বিড় করে,
“লজ্জাপরী,আপনার সাথে আমার বাচ্চা হলে কিন্তু মন্দ হতো না।”
চলবে