#শতদলের_ভীরে
#পর্ব_১১
#মুসফিরাত_জান্নাত
কয়েক কদম এগিয়ে যায় সাদাত।ঐশীর একদম সন্নিকটে চলে আসে।চোখ তুলে তাকায় মেয়েটি।চোখে মুখের লজ্জারা হুট করেই বেড়ে যায়।মাথা নিচু করে ফেলে সে।মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে শুধায়,
“কি হয়েছে আপনার?এমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
সাদাতের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা যায় না।তখনো সে নেশাক্ত নয়নে চেয়ে আছে।ঐশীর অপ্রস্তুত চেহারাটাও কাছে টানে তাকে।হালকা ঝুঁকে ঐশীর কপালে লেপ্টে থাকা এলো চুলগুলো এক হাতে সড়িয়ে দেয়।কেঁপে ওঠে ঐশী।লালাভ আভা জমে মেদুর গালে।স্মিত হাসে সাদাত।ঐশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“অদ্ভুদ তো আপনি।অদ্ভুদ আপনার রুপ।আপনার চলাফেরা, কথা বলা, তাকানো সবকিছু অদ্ভুত।
একেক সময় একেক রুপে ধরা দেন আপনি।
কখনো বন্যপাখির কলকলানি, তো কখনো বন্যহরিণের মায়া।এখন নিজের মাঝে ফুটিয়ে তুলেছেন লজ্জাবতীর ছায়া।
সত্যি বড় অদ্ভুত আপনি!”
লজ্জায় মিইয়ে যায় ঐশী।লোকটার আজ হয়েছেটা কি?এমন করে তাকিয়ে আছে কেন?বেশ কিছুদিন হলোই সাদাতের আচরণে এমন অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত করছে ঐশী।সাথে নিজের আচরণে,অনুভুতিতেও ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছে।তা না হলে কি আর সাদাতের এমন উস্কানিমূলক আচরণে সায় দেয় সে!
বরফের ন্যায় জমে থাকে ঐশী।আরও ঘনিষ্ট হয় সাদাত।প্রশ্রয় পেয়ে অনুভুতিরা সীমাবদ্ধতা হারায়।অল্প একটু ছুঁইয়ে দেয়।তিরতির করে কেঁপে ওঠে ঐশী।আড়ষ্ঠতায় গুটিয়ে নেয় নিজেকে।মুখে কেনো রা করে না।কয়েক কদম পিছিয়ে যায় শুধু।বুকের মাঝে ঢিপ ঢিপ আওয়াজ তুলছে।শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দ্বিগুন বেগে।ঐশীকে এমন রুপে দেখে উস্কানি দেয় মস্তিষ্ক।আবারও নেশালো কন্ঠে আওয়াজ তোলে সাদাত।
“লজ্জাপরী,কেনো এ রুপ বদল?আমাকে এলোমেলো করে দেওয়ার জন্যই কি এই প্রচেষ্টা?আমি যে মাতাল হয়ে যাচ্ছি।আপনার মোহ আমাকে উন্মাদ করে তুলছে।দয়া করে আর ক্ষণে ক্ষণে বদলাবেন না।ভুল চুক হয়ে যাবে।”
“হোক না কিছু ভুলচুক।তবুও যদি কিছু মধুর সময় আসে।”
মনের অজান্তেই বলে ফেলে ঐশী।এক হাতে তাকে কাছে টেনে নেয় সাদাত।আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগেই সম্বিত ফিরে সাদাতের মুঠোফোনের ঝংকার শুনে।অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ঐশী।নিজের বলা কথায় নিজেই আড়ষ্ট হয়।শত চেয়েও নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না।লজ্জায় মুখ লুকাতে এক দৌড় দেয়।আবারও বদলে যায় তার রুপ।মনে মনে বিড়বিড় করে,
“এটা তুই কেমনে বললি ঐশী?আদৌ বুঝে বলেছিস এই কথার ব্যাখ্যা কতোদূর!”
লজ্জাবতীর চলার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাদাত।মুঠোফোন একবার বেজে বন্ধ হয়ে আবারও আওয়াজ তোলে।বিরক্ত হয় সাদাত।মনে মনে গালির ডালা থেকে ছুঁড়ে মারে একটা শালীন বাক্য।
“ফোন করার আর সময় পেল না!”
নাম্বারটা দেখতেই বিরক্তি মিলিয়ে গেলো।জেঁকে ধড়ল উৎকন্ঠা।কল রিসিভ করতেই করুন কন্ঠে কেউ জানালো,
“সময় তার ফুরিয়ে এসেছে সাদাত।শেষ বারের জন্য সে তোমার দর্শন চায়।সাথে তোমার বউকেও এক পলক দেখে যেতে চায়।এবার না হয় নিয়ে এসো ওকে।”
“হুম।”
ছোট্ট করে জবাব দেয় সাদাত।চোখের কার্ণিশ ভিজে যায়।জমে আসা ক্ষুদ্র জল কনার দল চিকচিক করে।বৃদ্ধাঙুলির দ্বারা আটকায় তাদের।কতো অদ্ভুত এই দুনিয়া।ঐশীর মাঝে এতোই ডুবে ছিলো যে অন্য কারো প্রতি হুট করেই নজর তুলে নিয়েছিলো সে।অথচ তার জন্যই ঐশীকে নিজের জীবনে পাওয়া।দ্রুত পা ফেলে ঐশীর কাছে যায় সে।লজ্জারাঙা ঐশীর হাতটা জাপ্টে ধরে।কাওকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে।বিষ্মিত ঐশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।কি হয়েছে লোকটার?একটু আগেও কেমন অন্যরকম ছিলো।এখন আবার মন ভার।ঘটনার মূল বুঝে উঠতে পারে না সে।আসল কাহিনি জানতে হলে তাকে যে পদ্ম বিল পেরিয়ে ওই ছোট্ট কুঠরিতে যেতে হবে।
_______
বড় নৌকার এক কোনে উদাস হয়ে বসে আছে সাদাত।দৃষ্টি তার কলকল ধ্বনিতে আন্দোলনরত পানির ঢেউয়ে।মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে নিয়েছে ঐশী।ঘোমটার ফাক গলিয়ে মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে সাদাতকে।কত স্বাভাবিক ভঙিতে বসে আছে লোকটি।অথচ তার মনে উত্থাল ঢেউ।হয়তো কিছু একটা আঁচ করে ঐশী।ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার।বেশ কয়েক দিন হলই সাদাতকে আনমনে লাগে।মনে হয় কাওকে নিয়ে চিন্তামগ্ন সে।অথচ ঘুরেফিরে ঐশীর কাছেই ঘেষতে থাকে।সাদাতের এই দ্বিমুখী অনুভূতির নাম জানা নেই ঐশীর।সে কখনো জানার চেষ্টাও করেনি।অথবা কে জানে করতে চায় নি।এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত সে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়।নদীতে কতো পদ্ম ফুটে রয়েছে।আহ্লাদ করে কয়েকটা নিজের দখলে নিয়ে নিতে ইচ্ছে করে তার।কিন্তু জীবনের প্রথম নৌকায় চড়ায় সাহস করে উঠতে পারে না।প্রায় চল্লিশ মিনিটের ব্যবধানে বিল পাড়ি দেয় তারা।ভাড়া মিটিয়ে পায়ে হেঁটে চলে। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে একটা ছোট্ট কুঠরি দেখতে পায় ঐশী।
ঐশীর হাত ধরে কুঠরিতে প্রবেশ করে সাদাত।ভেতরে একটা আটপৌরে পালঙ্ক পাতা।তার উপর শুয়ে রয়েছে শীর্ণ একটি দেহ।পাশে বসে গগন ফাটিয়ে কাঁদছে আরেকটি মেয়ে।সাদাতকে দেখে কান্নার বেগ বাড়িয়ে বলে,
“তুমি এতোক্ষণে এলে বাবা।সে যে একটু আগেই চলে গেলো।”
চোখ ছাপিয়ে অশ্রু নামে সাদাতের।শেষ সাক্ষাৎ ও হলো না মেয়েটির সাথে।শেষ কয়েক মাসে একটি বারও চোখের দেখা পায় নি তার।অথচ এক কালে পা’গলের মতো পছন্দ করতো তাকে।তার দেখা না পেলে কাটতো না একটি দিনও।কিন্তু এখনের পরিস্থিতি ভিন্ন।এতোগুলো দিন ঠিকমতো খোঁজ ও নেওয়া হয় নি।বর্তমান সংসার নিয়ে সে যে বড়ো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো।
পৃথিবী বড় অদ্ভুত এক জায়গা।শূন্যস্থান কখনো স্থায়ী হয় না।কেও না কেও এসে ফাঁকা জায়গাটা নিমিষেই দখল করে ফেলে।তেমনি কারো প্রতি ভালোলাগাও স্থায়ী হয় না।জীবনের লীলাখেলায় বার বার ভালোলাগা বদল হয়।সাদাতের প্রথম ভালোলাগা ছিলো অথৈ।পারিবারিকভাবেই বিয়ে ঠিক ছিলো তাদের।তারপর আস্তে আস্তে ভালোলাগা বৃদ্ধি পায়।একে অপরকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে।সবকিছু ঠিকই চলছিলো।কিন্তু যখন সময় ঘনিয়ে এলো তাদের একত্রে মিলিত হওয়ার।ঠিক তখনই প্রাণঘাতী এক রোগ এইডস্ এ আক্রান্ত হয় অথৈ।তারপর বাধে বিপত্তি।পরিবার সমাজ কেও মেনে নেয় না অথৈকে।নস্টা মেয়ে উপাধি দিয়ে গ্রাম তাড়া করে।অথচ সাদাত বাদে অন্য কোনো ছেলে তার জীবনে ছিলো না।এটা সাদাতও জানতো।অথৈয়ের এক পতিতার সাথে সখ্যতা হয়।তার দুঃখের কাহিনি শুনে মন গলে যায় অথৈয়ের।তার সাথে ওঠাবসা, একই জিনিসপত্র মাঝে মধ্যে ব্যবহারও করতো।কেই বা জানতো সেই পতিতার শরীরে কেও এইডস এর সংক্রমণ ছড়িয়ে গিয়েছে।যার সূত্র ধরে অথৈ ও এই প্রানঘাতী রোগের ভয়ংকর থাবার মুখে পড়ে।সমাজচ্যুত অথৈ পাড়ি জমায় এই পদ্মবিলে।জন্মদাত্রী মা ফেলতে পারে নি অথৈকে।সাদাতকে বিয়ের জন্য অনুরোধ করে অথৈ।নিজের জীবন গোছানোর নিমিত্তে সে ও বিনা বাক্যে ঐশীকে বিয়ে করে।পদ্মবিলে তাদের একমাত্র সাপোর্ট ছিলো সাদাত।প্রয়োজনীয় জিনিস শহর থেকে এখানে পাঠিয়ে দিত।বিয়ের পরও তা অব্যহত থাকে।কিন্তু এখন থেকে তার আর প্রয়োজন হবে না।আজ যে তাদের মুক্তি হলো।
মৃ’ত ব্যক্তিকে ওই চড়েই একটা জায়গায় মাটি চাপা দেওয়া হয়।ব্যবহার্য সব জিনিস পুড়িয়ে ফেলা হয়।একদম একাকিনী হয়ে এক নৌকায় পথ ধরে অথৈ এর মা।কান্নারত অবস্থায় বাস্তবতার পরীক্ষা দিতে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে।
_______
পদ্ম বিলের পাড়ে উদাস হয়ে বসে রয়েছে সাদাত।মনের অবস্থা বোঝা দায়।এসব কাহিনি শুনে ঝিম মে’রে ছিলো ঐশী।মন ভার তার।স্বামীর ক্ষেত্রে মেয়ে সত্বা একটু স্বার্থপর হয়।ঐশীও তার ব্যতিক্রম নয়।মেয়েটির মৃ ‘ত্যু তাকে যতটা না শোকার্ত করেছে তার চেয়ে বেশি শোকাহত হচ্ছে অন্য কিছুতে।তার স্বামী অন্য নারীকে ভালোবাসে ভাবতেই বুকটা জ্বলে যাচ্ছে।দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।গুটি গুটি পা ফেলে সাদাতের কাছে যায় সে।লোকটার নিষ্পাপ মুখে চেয়ে সকালের ঘটনা মনে পড়ে।কতোটা রোম্যাঞ্চকর মুহুর্তে ছিলো তারা।অথচ তখনও সে জানতো না তার স্বামীর মনে অন্য রমনীর বাস।আচমকা উ’ন্মাদের ন্যায় করে ঐশী।উদভ্রান্তের মতো সাদাতকে প্রশ্ন করে,
“আমার ওই মেয়েকে হিংসা হচ্ছে স্যার।আপনার প্রথম প্রেম ওই মেয়ে কেনো হলো?আপনার সকল অনুভুতি তো সে।ও ম’রে গিয়েও আমার হিংসার কারণ হয়ে বেঁচে রইলো স্যার।আফসোস!”
চোখ তুলে ঐশীর দিকে তাকায় সাদাত।চোখে তার গভীর ক্ষত।ভেতরটা কেঁপে ওঠে ঐশীর।টুপ করে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।আবেগের বশে সে কি ভুল কিছু বলে ফেললো?
“অথৈ আমার প্রথম ভালোলাগা মাত্র।ওকে হিংসা করার কিছু নেই।আমার অনুভূতির কেন্দ্রস্থল আপনি।”
দৃঢ় কন্ঠে জবাব দেয় সাদাত।প্রতিউত্তরে ঐশী শুধায়,
“তাহলে আমাকে পর করে এখনো আপনি ডাকেন কেন?”
“আপনিও তো আমাকে আপনি ডাকেন।তাই আমিও ডাকি।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তো।তাই সর্বত্র ইকুয়াল রাখছি।”
“কতো স্ত্রী তো তার স্বামীকে আপনি ডাকে, তাই বলে কি স্বামীদেরও ডাকতে হবে নাকি?”
“আমি হয়তো ওদের মতো না।ওরা তো বিয়ের প্রথম রাতেই নিজের অধিকার সচেতন হয়ে পড়ে।অথচ আমি প্রথম রাত থেকে দ্বায়িত্ব সচেতন ছিলাম।ওদের অনেকে তো ভালো না বেসেও সন্তানের বাবা হয়েছে।অথচ আমি ভালোবেসেও প্রকাশ করতে পারিনি।আমি বলতে পারিনি আমি আপনাকে ভালোবাসি ঐশী।”
ঐশীর চোখ চিকচিক করে ওঠে।নদীতে শত শত পদ্ম।মৃদু হাওয়ায় দুলছে তারা।প্রকৃতির সুমিষ্ট ঘ্রাণ সে শুষে নিচ্ছে।বিলের পানির ঢেউয়ের সাথে মনের ভিতর উত্তাল ঢেউ খেলে যায়। আচমকা জড়িয়ে ধরে সে সাদাতকে।সাদাতও বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় প্রেমপ্রেয়সীকে।এটা তাদের প্রথম ঘনিষ্ট স্পর্শ।নির্জন প্রকৃতির খোলা হাওয়ার মাঝে দুজন দুজনকে অনুভব করে তারা।সন্ধ্যার নির্লজ্জ হাওয়া বার বার ছুঁয়ে সাক্ষী হয় তাদের।একজোড়া কপোত-কপোতীর প্রথম প্রেমের সুচনা হয় এই শতদলের ভীরে।হয়তো এভাবেই চলবে যুগ থেকে যুগান্তর।এখান থেকে চলে যাবে ওরা।অন্যত্র সারাজীবন একত্রে থাকবে।তবুও প্রথম প্রেমের সূচনার গন্ধ নিয়ে ওরা আজীবন বেঁচে থাকবে এই শতদলের ভীরে।
সমাপ্ত
(গল্পটা দীর্ঘযাত্রার হওয়ার ছিলো।অথচ আমি একটুও লেখার অবস্থায় নেই।তাই এখনই সমাপ্তি টানতে হলো।যদি আপনারা চান তবে সাদাত ও ঐশী আবারও ফিরে আসবে নতুন কোনো অধ্যায় হয়ে।ততদিনে ভালো থাকবেন।এতোদিন পাশে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।)