ফানাহ্ 🖤 #লেখিকা_হুমাইরা_হাসান #পর্বসংখ্যা_১৬

0
1110

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৬

– কি এতো গভীর চিন্তা করছেন?

রাশভারি গলার স্বভাব বিপরীত নরম কণ্ঠে ধ্যান ভাংলো মোহরের। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো কফি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষাবয়ব টার দিকে। মোহরের সাথে চোখাচোখি হতেই খানিক ঠোঁট এলালো, মোহর যেন স্তম্ভিত চিত্তেও মুখোভিব্যক্তি স্বাভাবিক রাখলো। এই মানুষ টাকে কখনো হাসতে দেখেছে বলে মনে হয়না, চেহারায় কর্কশতার ছাপ বিন্দুমাত্রও নেই, তবে হাসির উপস্তিতিও একেবারে নেই বললেই চলে। আজ প্রথম শুভ্র চেহারার ওই কড়া রঙের ঠোঁটের সামান্য বাঁকা হাসিটা রোমঞ্চিত করলো মোহরের নির্জীব চিত্তকে।

– কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?

মোহর না বোধক ঘাড় নাড়ালো। মেহরাজ কফির কাপ হাতে নিয়ে বসলো মোহরের চেয়ে এক হাতেক দূরত্বে অবস্থিত শৌখিন ধাঁচের বেতের চেয়ার গুলোতে। হাতের কাপ দুটো রাখলো সামনের ছোট গোলাকৃতির বেতের মোড়ার মতো টেবিলে, যার উপরাংশে গোলাকৃতিরই ডাইন গ্লাসের পারদ।

– আমার সাথে বসতে অসুবিধা হবে?

– এক ঘরে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে না তাহলে পাশাপাশি বসলে কিসের অসুবিধা?

মেহরাজ ঘাড় নাড়ালো বার দুয়েক, ভাবোভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। লম্বাটে শরীর টা খানিক ঝুঁকিয়ে হাঁটুর উপর দু’হাতের কনুইয়ের ভাঁজ রাখলো। ঘাড়টা কিঞ্চিৎ কাৎ করে মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল

– একই ঘরে বসবাস করলেও আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব যে ক্রোশাধিক, এটা কি সত্য নয়?

– সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আমাদের বিয়েটা অনিশ্চিত। এর আদেও কোনো ভবিষ্যত আছে কি না তারও কোনো ভরসা নেই। সত্য এটাই যে আমি আশ্রিতা হয়ে আছি, আপনি সাহায্য করছেন। অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও এতটা বিলাসিতা ভোগ করছি।

– এটাকে সাহায্য মনে হয় আপনার? আমার দ্বায়িত্ব নয়?

মোহর দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। এটা ব্যালকনি হলেও ছোট খাটো একটা ছাদই বলা চলে। রেলিঙের গা ঘেঁষে ছোটো লাইন মতো করা। সেখানে সারি সারি ফুলের গাছ। পরন্তু বিকেলের হলদেটে আলোতে ফুলগুলোতে মেদুর ঝিলিক স্পষ্ট চোখে বিঁধছে। মোহর সেদিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল

– যদি সত্যি জানতে চান তবে এ বাড়িতে থাকাটা আমার কাছে আশ্রয় ব্যাতিত অন্যকিছুই মনে হয় নাহ। আমাদের বিয়েটাকে আমি প্রতিকূল পরিবেশে ঘটে যাওয়া একটা দূর্ঘটনা বলেই মনে করি?

– বিয়েটা যদি দূর্ঘটনা হয় তবে আমি কি সেই দূর্ঘটনায় সৃষ্ট ক্ষত মোহ?

সচকিত হয়ে ঘাড় তুলে তাকালো মোহর। মেহরাজের সকৌতুক চেহারাতে চোখ ফেললেও মেহরাজ দৃষ্টি ফেরালো নাহ। মোহর ওর চোখে চোখ রেখেই বলল

– হ্যাঁ তাই। তবে আপনি আমার ক্ষত নন,আমিই আপনার ক্ষত। না আমার সাথে আপনার বিয়ে হতো আর নাইবা আপনাকে এতো ঝামেলা র্ঝঞ্ঝাটে পরতে হতো। আপনার পরিবার, বাগদত্তা ব্যক্তিজীবন সবকিছুতেই আমার জন্য বিপরীত প্রভাব ফেলেছে। দ্বায়িত্বের ভারে আমাকে আপনার ঘরে থাকতে দেওয়ার মতো কাজটাও করতে হচ্ছে।

কথা গুলো বলে, তড়িৎ নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিজের অজান্তেই মোহরের মনে হলো মেহরাজের ওই চাহনিতে চোখ রাখা টা তার পক্ষে আর সম্ভবপর হবে নাহ। নিজেকে কঠিন রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা টার ভিত্তিও কেমন নাড়া দেয় মেহরাজের চাহনিতে।

– আজ একটা কথা আমি ক্লিয়ার করতে চাই। বিয়েটা যে পরিস্থিতিতেই হোক বিয়েটা হয়েছে। তিয়াসাকে আমি কখনোই নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে দেখিনি। ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ যদি আপনি নিজের ঘাড়ে নেন সেটা সম্পূর্ণই ভুল হবে। আর পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কটা বরাবরই শান্ত,এক্ষেত্রেও আপনার নিজেকে দায়ী করার লজিক টা ননসেন্স। আর যদি কথা বলেন আমার ব্যক্তিজীবনের তবে আমাকে কিন্তু কেও বাধ্য করেনি আপনাকে নিজের বাড়ি বা নিজের ঘরে রাখতে। ব্যাপারটা সাহায্যের হলে সেক্ষেত্রে আপনাকে একটা ব্ল্যাংক চেক ধরিয়ে দেওয়াই কাফি ছিল মিসেস মোহর।

মোহর না চাইতেও চোখ ফিরিয়ে তাকালো বাম পাশে, চুম্বকের ন্যায় আটকে গেল জমাট বাঁধা রক্তের মতো স্থির চিত্তের চেহারার দিকে। মুহুর্তেই যেন কাঠিন্যের ছাপ দাপিয়ে উঠেছে মুখটাতে, লহমা খানেক বিরতির পর মেহরাজ আবারও বলল

– আমি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করিনা মোহর শিকদার। আপনাকে আমার বাড়ি আমার ঘরে থাকতে দেওয়া টা একান্তই আমার ইচ্ছে না এখানে সাহায্য আছে নাইবা দ্বায়িত্ব। আমার যা উচিত মনে হয় তাই করি। আর এখানে আমার এটাই উচিত মনে হয়েছে। আপনার যদি বিয়েটা মানতে খুব অসুবিধা হয় তবে আমি আপনাকে কোনো প্রকার পরামর্শ দেব না। যদি ডিভোর্স চান তার জন্যেও ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।
এই ছয়টা মাস কি সম্পর্কটাকে সুযোগ দেওয়া যায়না? বিয়েটা আপনার কাছেও যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত আমারও কিন্তু পূর্বপরিকল্পিত নয়। সম্পর্কের অর্থ তো শুধু দাম্পত্য জীবন নয়। আপনাকে এক ঘরে রেখে সম্পর্ককে সুযোগ দেওয়ার কথা বলতে চেয়েছি মানেই যে স্বামীর অধিকার চেয়েছি এমন কিছুই নয়। স্বামী স্ত্রী বাদেও একটা সম্পর্ক আছে, নাহয় সেটাতেই আমল করলেন।আমাকে স্বামী হিসেবে মানতে হবে নাহ। কারো শুভাকাঙ্ক্ষী বা বন্ধু হতে বয়সের এ্যাডযাস্টমেন্টটা কখনও মূখ্য হতে পারেনা।

বলেই হুট করেই দাড়ি বসিয়ে দিল নিজের বক্তব্যে। মোহর পুরোটা মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনলেও উত্তর করার শব্দ খুঁজে পেল না। মেহরাজ ভুল কিছু বলেনি কিন্তু তবুও মোহরের মনের ভেতর ভয়, অপ্রসন্নতা, অনিশ্চয়তার এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে যা ওকে সর্বদা বেচ্যাইন করে রাখছে। সম্পর্কটার কোনো ভবিষ্যৎ ভাবতে পারছে না।
কিন্তু আজ মেহরাজের বলা কথা গুলো যেন দেই দূর্ভেদ্য দেওয়ালের ভিত নাড়িয়ে দিল, সত্যিই তো! এই মানুষটাই তো তাকে বিভৎস অবস্থা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছে। তার ভরসায় তার দাপটে এই অজানা প্রাসাদে এতগুলো রাত পার করলো। অথচ তাকেই অবিশ্বাস করছে। এক্ষেত্রে ‘ নদীতে ভেসে ভেলাকেই ডুবন্ত পদার্থ ‘ বলে মনে করার মতোই যেন হয়ে গেছে অনেকটা

– কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মোহমায়া।

একটু আগে বলা মেহরাজের কথা আর এখনকার বলা কথায় আকাশ পাতাল তফাৎ ঠেকলো মোহরের নিকট। দাম্ভিকতার ধ্বনি তোলা কণ্ঠস্বর নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে গেল। মোহর দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চেহারায় তাকালে মেহরাজ মুখখানির আরও সহজ ভঙ্গিমায় বলল

– এতো ভাববেন নাহ, আপনার যেমনটা সুবিধা হয় তাই করবেন। আপাতত কফি খান। এটার জন্যেই কিন্তু এইখানটায় আসা

বলে মোজাইক পাথরের ন্যায় নকশার চিনামাটির কাপটা তুলে দিল মোহরের হাতে। পরিস্থিতি টাকে সামাল দিতে মেহরাজ অন্য মোড় ধরলো এটা সেও বুঝতে পেরেছে, তাতেই নীরব সম্মতি দিয়ে আর বাড়ালো না অস্বস্তি তোলা কথা গুলো।

এতক্ষনের সুমিষ্ট গন্ধটা আরও কাছ থেকে লাগলো মোহরের নাকে। কাপটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলো ঘ্রাণ টা কফির।

– কফিটা কিন্তু মন্দ বানাই না, ট্রাই ইট?

মোহর মৃদু হেসে কাপটা হাতে নিয়ে তা ঠোঁটে লাগিয়ে চুমুক দিল। আসলেও তাই, কফিটা খেতে অন্যরকম। দুর্দান্ত স্বাদের কফি। এমন টেস্ট অন্য কোনো কফিতেই পাইনি মোহর।

– সত্যিই দারুণ কফি বানাতে পারেন আপনি। এমন টেস্ট আগে কখনো পাইনি।

মেহরাজ নিজের কফির কাপ হাত্র নিতে নিতে বলল

– এই কফিটা বিশ্ববিখ্যাত, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি এটা। আমার এক ফ্রেন্ড কানাডা থেকে পাঠিয়েছে।

মোহর বিনিময়ে কিঞ্চিৎ গাল এলিয়ে আবারও সামনের দিকে তাকালো। হলদেটে আকাশ ভরা পুঞ্জীভূত সাদা মেঘ। লম্বা গাছগুলো শীষমুখ উঁচিয়ে উদ্ভাসে দাঁড়িয়ে। অনুষ্ণ বাতাসে অবাধ্য চুলগুলো অবিন্যস্ত চোখে মুখে আঁছড়ে পরলেও বিরক্ত হলো না মোহর, যেন মনে হলো অনেক দিন পর কোনো মনকে প্রশান্ত করার মতো একটা অবস্থান পেল।
মূলত মেহরাজ কফি খাওয়ার কথা বলে মোহরকে ব্যালকনিতে এনেছিল। বিশাল জায়গা জুড়ে ব্যালকনিটার রেলিং ভরা ঘাস আর নানান ফুলে। এবং তা খুব যত্নসহকারে পরিচর্যা করা হয় তা ফুলগুলো সুবিন্যস্ত সাজ আর প্রাণবন্ত পরিস্ফুটনেই স্পষ্ট।

– আমাকে ভরসা হয় না মোহমায়া?

হুট করেই মেহরাজের বলা কথাটা বিব্রতবোধে ডুবিয়ে তুললো মোহরকে। মেহরাজের চোখে একরাশ আগ্রহ উত্তরের, সেটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারলো না মোহর, খুব স্বাভাবিক গলায় বলল

– আপনাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য, এ ছাড়া আর কিই বা আছে আমার।

– বিশ্বাস আর ভরসা দুটো আলাদা নয় কি?

মেহরাজের সকৌতুক গলাতে মোহর জড়তাগ্রস্ত হয়ে উঠলো। কেমন বিব্রতে ভরা দৃষ্টিতে তাকালে মেহরাজ হাসলো খানিক, রম্য ভাবে বলল

– সবকিছুতে এতো সিরিয়াস কেন হয়ে যান আপনি। বয়স কতটুকু হবে? এইটুকু বয়সে এতটা গাম্ভীর্য মানায় নাহ। জীবনে চলার পথে অনেক কিছু হারাবেন,অনেক কিছু পাবেন। তা বলে নিজ ব্যক্তিত্বেকে দমিয়ে রাখা টা কোনো সমাধান নয়। আপনার চাঞ্চল্যে বা গাম্ভীর্যে জীবন তার গতির পরিবর্তন করবে না। সো এভোইড নেগেটিভিটিস, বি ইউরসেল্ফ,যাস্ট দ্যা ওয়ে ইউ আর।

– আসতে পারি?

মেয়েলী রিনিঝিনি কণ্ঠে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো। দরজায় মোহরকে দাঁড়িয়ে দেখে ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে এলো, মোহর এবার নিজ থেকেই ঘরের ভেতর ঢুকলো। হাতের খাবারের ট্রে টা বেড সাইড টেবিলে রেখে দাঁড়ালে তাথই তীর্যক গলায় বলল

– তোমাকে খাবার দিয়ে কে পাঠিয়েছে?

– আমাকে কোনো কাজের দ্বায়িত্ব দেবে এমন সম্পর্ক এ বাড়িতে দিদা ছাড়া অন্য কারো সাথেই নেই। তবে খাবার আনতে দিদা বলেনি আমায়

– তাহলে কে আনতে বলেছে?

– আমিই এনেছি আপা।

মোহরের আপা বলাটা যেন তাথইয়ের ভেতরটাই লাগলো। নিজের অজান্তেই সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার প্রতি নরম হতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু সে ইচ্ছাতে ধামা চাপা দিয়ে, বইয়ের পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে বলল

– আমার খাওয়ার চিন্তা তোমাকে করতে হবে নাহ, নিয়ে যাও এসব

বিছানার এক কোণায় বসেছিল মোহর। তাথইয়ের কথায় মোহর প্লেটে ভাত বারা থামিয়ে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

– এ বাড়িতে আমার সাথে যে কারো ভালো সম্পর্ক নেই এটা তো বললামই। দিদাও ঘুমিয়েছে। একা একা খেতে আমার একদম ভালো লাগে না আপা, তাই ভাবলাম দুই বোন একসাথে বসে খাই। তবে আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে চলে যাচ্ছি

বলে উঠে দাঁড়াতে নিলে তাথই হাতের বইটা ধপ করে বিছানাতে রেখে বলল

– দাঁড়াও বাড়া ভাত রেখে কোথাও যাবে না। বোসো

বলেই উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে এলো। ততক্ষণে মোহর দুই প্লেটে খাবার বেরেছে। তাথই এলে ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে প্লেট এগিয়ে দিল। মেয়েটার মুখে যেন রাশিভরা মায়া জড়ানো। তাথই চেয়েও কঠোর হতে পারেনা। মোহরের মুখ থেকে আপা ডাক শুনে হুট করেই তাথইয়ের ভীষণ ইচ্ছে হলো ওর কথা গুলো রাখার। তাই আর কোনো অমত না করে ওউ খাটে উঠে দুই পা ভাঁজ করে বসলো। মোহর খেতে খেতে বলল

– ইলিশ মাছ ভাঁজা নাকি আপনার খুব পছন্দ?

– আমার চেয়ে তোমার স্বামীর বেশি পছন্দ

খেতে খেতে ব্যস্ত গলায় শুষ্ক ভাবে বলল তাথই। ”তোমার স্বামী” এটুকু শব্দ যেন মোহরের বুকে ফালের মতো বিঁধে গেল। হুট করেই খাওয়া থেমে গেল ওর। তবে তাথই থেমে গেল না, ফিচেল গলায় বলল

– কি হলো? স্বামীর নাম শুনেই গলায় খাবার আটকে গেছে? পটরপটর বন্ধ হয়ে গেল?

মোহর কেমন অপরাধীর মতো মুখ করে তাকালো তাথইয়ের দিকে। ঢক গিলে আবারও খাওয়া শুরু করলে, খানিক বাদে বলল

– তেমন কিছুই না আপা

– এই মেয়ে, খবরদার আমার সাথে সেয়ানা গিরি দেখাবে না। মেহরাজের নাম শুনলেই তো আমাবস্যার চাঁদ হয়ে যাও কি সমস্যা তোমার?

মোহর খাওয়া থামিয়ে চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকালো, সে তো এসেছিল তাথইয়ের সাথে সময় কাটাতে যাতে ওর সাথে স্বাভাবিক হতে পারে,কিন্তু এখন ওকেই গেড়াকলে ফেলছে

– আমার ভাইকে কি তোমার হেলাফেলা মনে হয়? যেখানে ও নিজে পুরো বাড়ির সামনে নিজের বউ বলে জোর দেখায় আর তুমি পালিয়ে বেড়াও কেন। সারাদিন তো দিদার চামচার মতো লেগে থাকো ৷ কখনো তো বউ হওয়ার কোনো চেষ্টা তোমার মাঝে দেখলাম না

– ক্ কি চেষ্টা করবো আমি?

খানিক হতাশা মিশিয়ে নতমস্তকে বলল মোহর। তাথইয়ের থেকে এরূপ কথা এ কোনো কালেই আশা করেনি। তাথই না কখনো নিচে আসে না কখনো কোনো ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে তবে আজ!

– শোনো মেয়ে আগে কি ছিলে কি করেছো জানি না। তোমাকে আমার ভাই বিয়ে করেছে, যে পরিস্থিতিতে হোক যেভাবে হোক বিয়ে বিয়েই হয় কোনো ছেলেখেলা নয় যে তুমি কোনো গুরুত্ব দিবে না, নাকি আরেকটা বিয়ে করার ইচ্ছে আছে? আছে নাকি?

– হ্যাঁহ? না,,,না নেই

মোহর কেমন মন্তবুদ্ধির মতো করে বলল।তাথই যেন আজ ওকে যাতাবার জন্য আটঘাট বেঁধেই বসেছে

– তাহলে না চাইতেই যেটা পেয়েছো সেটার গুরুত্ব দিতে শেখো। এমন হাজারো আছে যারা পাগলের মতো ছুটেও পাইনি। মেহরাজকে চেনো।ওর সাথে এক ঘরে থেকেও যদি তুমি বুঝতে না শেখো তাহলে তোমার মতো বোকা আর কেও নয়। সময় থাকতে সম্পর্কের মূল্য দাও নয়তো এক সময় পস্তায়েও কিচ্ছু হবে নাহ

তাথইয়ের এতগুলো কথা বলার কারণ মোহর বুঝলো নাহ। তবে এটুকু স্পষ্ট যে মেহরাজ এমনি গম্ভীর যতই হোক বোনের সাথে সম্পর্কে তার কোনো হেরফের নেই। প্রায়ই তাথই এর ঘরে আসে, দীর্ঘ সময় ধরে বোনের সাথে গল্প করতে দেখেছে মোহর।
বাকিটা সময় আর কোনো কথা বলল না কেও-ই। খাওয়া শেষে মোহর উঠে দাঁড়ালে তাথই আবারও বইটা খুলে বসলো, হুমায়ুন আহমেদের বই ‘অপেক্ষা’। মোহর হুট করেই বলে বসলো

– সুরাইয়া আজীবনই অপেক্ষা করে যায় হাসানুজ্জামান তো ফেরেই না।

তাথই ধপ করে তাকালো মোহরের দিকে। নিজের বোকামি টা বুঝতে পেরে জিহ্ব কামড়ালো মোহর । ইশ এবার নিশ্চয় রেগে যাবে। এত আগ্রহ নিয়ে পড়ছিল আর ও কি না ধপ করে বলে দিল শেষটা। তবে মোহরের ভাবনাকে সম্পূর্ণ বিপরীত করে দিয়ে তাথই নিরেট দৃষ্টিতে আবারও বইয়ের পাতায় তাকিয়ে বলল

– সব অপেক্ষা ফিরে পাওয়ার হয়না৷ কিছু অপেক্ষাতে শুধু একবুক বেঁচে থাকার আশা আর ভালোবাসা থাকে, যা শেষ নেই যেনেও আমৃত্যু একটা মানুষকে অপেক্ষারত রাখতে বাধ্য করে

মোহরের কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল কথাটার মর্মার্থ বুঝতে। খানিক স্থির দাঁড়িয়ে থেকে বলল

– আপনি বইটা পড়েছেন?

বিনিময়ে শুরু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব এলো অপরপক্ষ থেকে। মোহর আর কোনো শব্দ
ব্যয় করলো নাহ। চুপচাপ খাবারের প্লেট গুলো নিয়ে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। আর মনে মনে বারংবার ভাবতে থাকলো

‘মানুষ তার বুকের ভেতর ছিন্নভিন্ন হয়ে র’ক্তাক্ত অবস্থায় প্রতিনিয়ত ম’রছে আর আমরা কত সহজেই না মানুষের বাহ্যিক রূপটা দেখে বিচার করে ফেলি ‘

সকাল বেলা করে ব্যস্ততা ডাইনিং রুমটা জুড়ে। আজহার, আরহাম দুজনে অফিসে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছে একবারে, তাদের খাবার তুলে দিচ্ছে আম্বি। শাহারা বেগম তাথইয়ের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মেহরাজ এখনো নিচে নামেনি মোহর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সিড়ি থেকে নামছিল তখনই কানে এলো

– সাঞ্জে আসবে আজ, ওকে কখন আনতে যাবে?

– অফিস থেকে বেরিয়েই যাবো।

কাকলি বেগমের কথায় আরহাম বলল। আম্বি রুটি তুলে দিচ্ছিলো প্লেটে, ব্যস্ত গলায় খানিক মমতা ঢেলে বললেন

– প্রায় দুমাস হলো মেয়েটা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, একটুখানি মেয়ে এতদিন বাড়ির বাইরে আছে মনে পড়লেই কেমন দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে।

ততক্ষণে মোহর নিচে নেমে এসেছে। মোহরকে দেখে আজহার মুর্তজা বললেন

– মোহর? এসো খেতে বসো

আম্বি বেগম ঘুরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। মোহর খানিক ইতস্তত গলায় বলল

– আমার লেইট হয়ে গেছে, আজ খাবো না আংকেল

– এটা আবার কেমন কথা। সকাল বেলা করে না খেয়ে কেন বেরোবি। একটু কিছু হলেও মুখে দিতে হবে।

শাহারক বেগমের জোরাজুরিতে অগত্যা বাধ্য হয়ে বসতে হলো টেবিলে। আরহাম মুর্তজা খাচ্ছিলেন মোহরের সাথে চোখাচোখি হলে তিনি সহবত সুলভ হাসলেন সামান্য। মোহর বসেছে একদম তাদের সামনা-সামনি। এভাবে ওদের সামনে বসতেও অস্বস্তি হচ্ছে, তবে মোহরের অস্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো নাহ। মোহরের জড়তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে মেহরাজ এসে বসলো একদম ওর পাশের চেয়ারটাতে, আম্বি বেগম এসে মেহরাজকে ওর ফ্রুট সালাদ আর অ্যাভোকাডো জুস দিলের। সাথে আরও একটা প্লেট এনে রাখলেন মোহরের সামনে। মোহর প্রচন্ড বিহ্বলিত হলেও প্রকাশ করলো না, আম্বি বেগম মোহরকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে রাখেন সেখানে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দেওয়া টা সত্যিই ভাবনাতীত।

খাবার শেষ করে মেহরাজের সাথেই উঠে দাঁড়ালো মোহর। শাহারা বেগম কে বলে বেরিয়ে এলো। মেহরাজ হাঁটছে আর তার পেছন পেছনে মোহর। আচানক ভীষণ অপ্রত্যাশিত এক ভাবনা ঘিরে ধরলো মোহরকে, ও বেশ তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে পারলো যে ইদানীং ওর সব জড়তা অস্বস্তি মেহরাজ এলেই কেমন উবে যায়, সকল নস্তিবাচক অবস্থাতেও অদ্ভুত এক নিশ্চিন্ততা ওর মনের ভেতর গেঁথে দেয় মেহরাজের উপস্থিতি।
অথচ এই মানুষ টাকে ঘিরেই আপাতত ওর যত অস্থিরতা, জড়তা, ব্যকুলতা।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#হীডিংঃ জানি লেইট করে পর্ব দেওয়ার জন্য অনেকেই মনোক্ষুণ্ণ, ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় কোনো কারণহীনা আমি গল্প মিস দেইনা। যারা এর আগেও আমার গল্প পড়েছে তারা যানেন আমি রেগুলারিটি মেইনটেইন খুব সিরিয়াসলি করি। তবে সবসময় তো সময়,পরিস্থিতি অনুকূলে থাকবে নাহ। আশা করি সবাই আমার সমস্যা টা বুঝতে পারবেন, তবুও দুঃখিত।
ভালোবাসা রইলো ❤️

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here