ফানাহ্ 🖤 #লেখিকা_হুমাইরা_হাসান #পর্বসংখ্যা_১৮

0
990

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৮

হিলিয়ামের জলন্ত গ্যাসপিণ্ডটা দাপটের সহিত মাথা চারা দিয়ে উঠেছে বেশ অনেক্ষণ আগেই। আকাশের বুকে তার কমলা রশ্নীর তেজ ছড়াচ্ছে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। দেওয়াল ঘড়িতে সময় আটটা বেজে পনেরো মিনিট।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো মোহর। পরনে হালকা হলুদ রঙের সুতির জামা। তার উপর রঙিন সুতির এ্যামব্রয়ডারি করা। পাতলা লম্বাটে শরীর টার সাথে লতার মতো পেচিয়ে আছে জামাটা। ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নার সামনে দাঁড়ালো মোহর।

বার কয়েক পানির ঝাপটা চোখে মুখে পড়তেই ঘুম ছুটে গেল মেহরাজের। ঘুমের চোটে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দু’টো খুলে তাকালে সামনের দৃশ্যে দৃষ্টি আটকে গেল মেহরাজের। মুহূর্তেই সকল ঘুম অলসতা কর্পূরের মতো উবে গেল, সাথে ভীড় করলো একরাশ বিমহ। স্থিরচিত্তে তাকালো চোখ দু’টো সম্পূর্ণ প্রসারিত করে।
মোহরের কোমর ছড়ানো চুলগুলো টপকে বিন্দু বিন্দু করে পানি পড়ছে মেঝেতে, হলুদ রঙের জামাটা যেন মোহরের গড়নের সাথে মিশে গেছে। বাগানের সদ্য ফোঁটা হলদেটে গোলাপের চেয়েও আবেদনময়ী লাগছে মেহরাজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে।
চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত থাকার কারণে মোহর এতক্ষণেও খেয়াল করেনি মেহরাজের এহেন স্থৈর্যদৃষ্টি। অপলক নিষ্প্রভ ভাবে তাকিয়ে আছে মোহরের দিকে। মেহরাজ উঠে দাঁড়ালো। দীর্ঘাকার শরীরে লেপ্টে থাকা শুভ্র কাপড়ের টি-শার্ট টা হাত দিয়ে টেনে সোজা করলো। কোনোরূপ শব্দ বা প্রতিক্রিয়া ছাড়াই এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেল, দাঁড়ালো আয়নাটার সামনে, একদম মোহরের পেছনে এক হাতেক দূরত্বে।
হাত রেখে চিরুনি টা রেখে পেছনে ঘুরতেই মেহরাজকে দেখে তীব্রভাবে ভড়কে গেল মোহর। মৃদু চিৎকার করে উঠলো আতঙ্কে। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো, পরমুহূর্তেই মেহরাজকে দেখে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও জড়তা কাটলো নাহ। সকাল বেলা করে এভাবে ভয় দেখানো কোনো মানেই বুঝে উঠতে পারলো না মোহর, এভাবে মূর্তির মতো পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয়!

মেহরাজ অ্যাডিডাসের পিচ ব্ল্যাক রঙের ট্রাউজার টার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভীষণ পরিপাটি ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে এখনো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মোহরের সর্বাঙ্গে কাঁটা বিঁধলো যেন। ঘুম ঘুম লালাভ চোখের ধূসর বর্ণা চাহনিতে একরাশ তৎপরতা ঢেলে দিল মোহরের সমস্ত চিত্তে। শুকনো ঢোক গিলে বলল

– এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনি?

– দেখছি

– কি দেখছেন৷ যখন তখন এভাবে হুট করে পেছনে এসে দাঁড়ান কেন। এটা আবার কেমন স্বভাব

মেহরাজ ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ডলে আবারও পকেটে হাত ঢোকালো। মোহরের এবার বেশ রাগ হলো। সবসময় এভাবে ভয় পাইয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয়!

– আপনি কি একটু শব্দ করে চলাফেরা করতে পারেন নাহ। এভাবে চমকে দেওয়ার কি দরকার আজব, ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়

ফোস ফোস করে একদমে কথাগুলো বলল মোহর। মেহরাজ ওর এমন রণচণ্ডী রূপী কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেল। চোখ প্রসারিত করে তাকালো দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। বেশ চটে গেছে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মোহরের যে ভূতে একটু না অনেকটাই ভয় এটা ও মুখে স্বীকার না করলেও মেহরাজ খুব ভালো মতই বুঝতে পারে৷
মোহরের বিব্রতবোধ টাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে মেহরাজ বাঁকা হেসে তাকালো। এহেন রহস্যময়ী হাসি আর সূক্ষ্ম চাহনির অর্থোদ্ধার করতে পারলো না মোহর, জিজ্ঞাংসা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
মেহরাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে একদম মোহরের সামনে এসে দাঁড়ালো, মোহর ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল

– আ আপনি এগিয়ে আসছেন কেন।

মেহরাজ উত্তর করলো নাহ। মোহর ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠলো মেহরাজের নিকটত্বে, আবারও জড়ানো কণ্ঠে বলল

– সরে যান, আমার কাছে কেন আসছেন।আসবেন না।

ওর সমস্ত অপ্রীতিকর, বেখেয়ালি চিন্তাভাবনাকে মুহূর্তেই ভুল প্রমাণিত করে মেহরাজ বিছানার উপরে পরে থাকা জরজেটের হলুদ ওড়নাটা তুলে ওর দু’কাঁধের উপর বিছিয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে রোমহ্নন গলায় বলল

– আপনি বারবার কেন ভুলে যান যে এ ঘরে আরও একজন থাকে, একটু সামলে চলাফেরা করুন মোহ, না তো আপনার সাথে সাথে অন্য কারোর ও বারবার বুক কেঁপে উঠতে পারে, ভয়ে না হোক হয়তো কারণে!

বলেই সরে এলো। কাবার্ড খুলে একটা তোয়ালে বের করে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। এর মাঝে আর একবারও তাকালো না মোহরের দিকে। মোহর বিহ্বল ভাবে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার পানে, একটা টু শব্দ অব্দি করতে পারলো নাহ। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো যেন। দুরুদুরু বুকের কম্পন গায়ের লোমগুলোতেও শিরশিরানি ধরিয়ে দিল। তাই তো! এতটা বেখেয়ালি কি করে হলো! ঘরে যে আস্তো একটা পুরুষ মানুষ আছে সেটা কি করে ভুলে যায় ও বারবার। ছিছি, লজ্জা লজ্জা। নিজের এমন বিশ্রি কর্মকাণ্ডে নিজেরই নাক কা’টা যাচ্ছে মোহরের।

– ভাবী শোনো না, বলছি আজকে না গেলে হয়না?

মোহর অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সাঞ্জের দিকে। মেয়েটা এতো আদুরে যে এর একটা কথাকেও অগ্রাহ্য করা যায় না। কাল এসে থেকে ভাবী ভাবী করে অস্থির হয়ে উঠেছে। ওর ব্যবহার টা ঠিক এমন যেন আগে থেকেই ঠিক ছিল মোহ-রাজের বিয়েটা। ওকে দেখে মনেই হয়না ও এ বাড়িরই সদস্য। এতগুলো গম্ভীর মানুষ গুলোর মধ্যে একটা মাত্র চঞ্চল প্রাণোচ্ছল চেহারা।

– ভাবী বলোনা, আমি কাল মাত্র আসলাম।আর আজই তুমি আমাকে রেখে বেরোচ্ছো

– তো তোকে কি কোলে করে রাখতে হবে নাকি। ওর ক্লাসে ও যাবে না? তুই এসেছিস বলে কি ধেই ধেই করে নাচবে

– বড়পু তুই প্লিজ চুপ কর। তুই এখানে কেন এসেছিস বল তো। যা তো তুই তোর ঘরে গিয়ে খিল এঁটে বসে থাক।

তাথই ভ্রুকুটি করেই মুখ ফিরিয়ে নিল। সকাল বেলা করে এই মেয়েটার ন্যাকামি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে৷ শাহারা বেগম পান চিবাতে চিবাতে বলল

– আরে এই যাবে আর আসবে। দুপুরের আগ দিয়েই চলে আসবে ও

তবুও ক্ষান্ত হলো না সাঞ্জে। গোলগাল মুখটা আরও ফুলিয়ে বসলো। আম্বি খাতুন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাঞ্জের হাতে নুডলস এর বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলল

– কেন রে সাঞ্জে। আমাদের কি পছন্দ হচ্ছে না তোর? এসে থেকে ভাবী ভাবী করে তো মাথা টা নষ্ট করে দিচ্ছিস

সাঞ্জে মুখ ভরে নুডলস পুরে আড়চোখে তাকালো। খেতে খেতে বলল

– হ্যাঁ তো করবই। একটা মাত্র ভাবীকে পেয়েছি। ভাবী ভাবীই তো করবো

আম্বি খাতুন নির্লিপ্ত চোখ মেলে আবারও নিজের কাজে ধ্যান দিল। বড়রা এখনো নামেনি ঘর থেকে। মোহর শাহারা বেগমের পাশেই সোফাতে বসা। তাথই এর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে। এত আদুরে মিষ্টি বাচ্চাটা যে সারাদিনই কোলে করে রাখতে মন চাই। গায়ের রঙটা বেশ উজ্জ্বল, তাথই এতটা ফর্সা না, হয়তো ওর বাবার মতো গায়ের রঙ পেয়েছে।
মোহর বসে বসে খেলতে লাগলো ছোট্ট হাত দুটি ধরে । এর মাঝেই মেহরাজ একেবারে রেডি হয়ে নেমে এলো সিড়ি বেয়ে। সেদিকে একবার চোখ যেতেই অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল মোহর। মেহরাজ এসে বসলো একদম সাঞ্জের পাশের চেয়ারটাতে, ওকে দেখেই সাঞ্জে আহ্লাদী গলায় বলল

– দাভাই তুমি এসেছো। বেশ হয়েছে , তুমি একটু বোঝাও না।

মেহরাজ জিগাংসু চোখে তাকালে সাঞ্জে বিরতিহীন বলে

– ভাবীকে বলো না আজ বাড়িতেই থাকতে। আমি ভাবীকে নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বেরোবো

– বেরোবি তো বিকেলে,তাহলে এখন তো যেতেই পারে

মেহরাজের জবাবে মুখটা শুকিয়ে এলো সাঞ্জের। চুপ করে গেলে মেহরাজ ওর মাথায় হাত রেখে বলল

– আরে মন খারাপ করার কি আছে। আজ মোহর তাড়াতাড়ি চলে আসবে । এই দুই তিন ঘন্টার ভেতরেই। কি মোহর, আসবেন না?

মোহর কে উদ্দেশ্য করে বলে তাকালো মেহরাজ। মোহর শুরুতে থতমত খেলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে বলল

– হ্যাঁ। আসবো তো। তুমি মন খারাপ করো না। আমি দুপুরের আগেই চলে আসবো।

ধীরে ধীরে নাস্তার প্লেট গুলো সাজিয়ে দিলে মেহরাজ নাস্তা শুরু করলো। সাঞ্জেও আর কথা বাড়ালো নাহ।
মোহর ব্যগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। মেহরাজ নাস্তা সেরে উপরে গেছিল আবারও, এই ফাঁকে বেরিয়ে এসেছে ও। আজ একাই যাবে বলে ঠিক করেছে। ওই লোকটার সামনেও পরতে ইচ্ছে করছে না। অস্বস্তি ঘিরে ধরে খুব, তার উপর সকালের ঘটনাতে মোহর অনেক বেশিই লজ্জিত।
তড়িঘড়ি করে গেইট থেকে বের হতে নিলেই ওর সমস্ত পরিকল্পনাতে জল ঢেলে দিল পেছন থেকে আসা সুপরিচিত কণ্ঠস্বর

– দাঁড়ান

না চাইতেও পা দুটো থামালো মোহর। পেছনে না ঘুরেই বুঝতে পারলো দ্রুত পদক্ষেপ টা ওর দিকেই এগিয়ে আসছে

– কোথায় যাচ্ছেন?

মোহর শুকনো মুখে বলল

– মেডিক্যালেই যাচ্ছি,আবার কোথায়

– একা কেন বেরিয়েছেন? আপনাকে তো বলেছি একা আসা যাওয়া করবেন না!

– গাড়ি নেই। আরহাম আংকেল নিয়ে বেরিয়েছে সকালে

কোনো রকমে বাহানা দেখাতে এলোথেলো ভাবে বলল মোহর। মেহরাজ অবিলম্বেই কাঠ গলায় বলল

– আমাকে বারবার নিজের উপস্থিতি টা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে কেন হয় বলুন তো । এতো লম্বা চওড়া হয়েও কি আপনার চোখে পরিনা কখনো? আমাকে কি পছন্দ হচ্ছে না?

বলেই বিরক্তমুখে চশমাটা চোখে লাগিয়ে গ্যারাজের দিকে গেল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই চকচকে কালো গাড়িটা হাওয়া উড়িয়ে থামলো মোহরের সামনে৷ ভেতর থেকে আপনা আপনিই দরজা টা খুলে গেলে কোনো প্রশ্ন হীনা-ই উঠে বসলো মোহর। তৎক্ষনাৎ প্রচণ্ড বেগে গাড়িটা চলতে শুরু করলো।
আড়চোখে দু একবার মেহরাজের দিকে তাকালো মোহর। মেহরাজ ভীষণ গম্ভীর মুখ করে আছে। গায়ের ব্লেজার টা উরুর উপরে রেখেছে। আইভরি রঙের শার্টের হাতাটা কনুই অব্দি ফোল্ড করা। কালো রঙের প্যান্টের সাথে চোখের চশমাটা একদম একই লাগছে।

বাঁকা নজরে আপাদমস্তক দেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে নিল মোহর। নাহ এর দিকে তাকানোই যাবে না,
না জানি আবারও কখন কি বলে বসে। কিন্তু খুব অজানা কোনো কারণেই মেহরাজের সামনে আসলেই মোহরের ভেতর বাহির দুটোই বেহায়া হয়ে ওঠে। অবাধ্য নজর বারংবার নিষেধাজ্ঞাকে সকপটে বেপরোয়া করে চুম্বকের মতো একই দিকে তাকাতে চাই। এই যে এখন যেমন বারবার চোরা দৃষ্টিতে তাকাতে যাচ্ছে। প্রচন্ড বারণ সত্ত্বেও লোকটাকে আগাগোড়া পরখ করার বড্ড কৌতূহল জাগে, বাঁকা চোখেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মোহর। গায়ের গৌড়বর্ণের রঙটা যেন বেশিই উজ্জ্বল। এতটা ফর্সা কেন লোকটা!
ফর্সা হাতের লোমগুলো ও বেশি চোখে বিঁধছে । মাথার ঢেউ খেলানো কালো বাদামি মিশ্রিত চুল, খাড়া নাক। ঠোঁট দুটোও কেমন, দেখলে মনে হয় না কখনো নিকোটিনের স্পর্শ পেয়েছে । সবকিছুই যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। একটা মানুষকে এতটা সুদর্শন হতে হয়? ছেলে মানুষ এতটা নিখুঁত কেন হবে! ছেলে মানুষ তো একটু শ্যাম গড়নের, চোখ দু’টো দাবা, ঠোঁট দুটো কালচে হবে।

মোহরের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই গাড়িটা ব্রেক করলো। সচকিত হয়ে আশপাশ দেখে গাড়ির দরজা খুলে বেরোতে গেলেই মেহরাজ গুরুগম্ভীর গলায় বলল

– ক্লাস শেষে দাঁড়াবেন, আমি এসে নিয়ে যাবো

– আমি একাই ফিরতে পারবো

মেহরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কালো চশমাতে ঢাকা চোখের অভিব্যক্তি ঠাওর করতে পারলো না মোহর, তবে রাশভারি গলার স্বরটা স্পষ্ট কানে বাজলো

– আমার সাথে ফিরলে সমস্যা? ফায়াজ স্যার রাগ করবেন?

এখানে ফায়াজ স্যার কেন আসলো? মেহরাজের নিকট এহেন অপ্রত্যাশিত কথায় ললাটে ভাঁজ ফেলে বলল

– আপনি আমাকে খোটা দিচ্ছেন?

– মনে করিয়ে দিচ্ছি, ক্লাস শেষে দাঁড়াবেন আমি নিয়ে যাবো

বলেই গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে এস্কেলেটরে চাপ বৃদ্ধি করলো, শুধু অপেক্ষা টা স্টিয়ারিংটা ঘুরানোর। মেহরাজের গাড়ি স্টার্ট করাটা যে মোহরকে বেরিয়ে যেতে বলার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত এটা বুঝতে এক লহমাও দেরি হয়নি মোহরের। এতে অপমানিত হলো কি না জানা নেই,তবে ভীষণ বিভ্রান্ত সহ ক্ষুব্ধও হলো, মানুষটার এক এক সময় এক এক রকম আচরণটা একেবারেই পছন্দ হয়না মোহরের।

গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। শ্রীতমা এখনো আসেনি। কারণ ক্লাস শুরু হতে এখনো মিনিট বিশেক দেরি। মোহর আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছে। মূলত মেহরাজের নৈকট্য এড়াতে যথাসময়ের পূর্বেই বেরিয়েছিল। বেরোলেও তা এড়াতে আর পারলো কই।

– স্টপ, মোহর

বেশ চেনা মনে হলো কণ্ঠস্বরটা। তবে আশেপাশে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেলো নাহ। মনের ভুল ভেবে আবারও পা বাড়াতে নিলে হুট করেই কেও ছুটে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল

– তোমাকে দাঁড়াতে বলেছি না? কথা কি কানে যাই না?

জিন্সের প্যান্ট এর সাথে হাটু সমান লাল রঙের টপস পরা মেয়েটিকে দেখে বেশ বিব্রত হলো মোহর। ও এইখানে হঠাৎ?

– আপনি এখানে?

– কেন মেডিক্যাল কি তোমার একার? আমি আসতে পারিনা?

তিয়াসার হাতে একটা এ্যাপ্রোন ঝুলানো। তিয়াসাও কি ডক্টর? কই আগে তো দেখেনি, হয়তো খেয়াল হয়নি, যাই হোক ওর কর্কশ গলার মর্মার্থ বোধগম্য হলো নাহ মোহরের। শান্ত রূপেই জবাব করলো

– আমাকে ডাকছিলেন?

– এখানে তুমি ছাড়া আর কারো নাম মোহর বলে তো জানি না, এ্যানিওয়েস আমার সাথে এসো কথা আছে

– আমার ক্লাস আছে, এখন কোথাও যাওয়া সম্ভব না

মোহরের নাকচ করা শব্দে তিয়াসার মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। চড়া গলায় বলল

– তোমাকে আমি ডেকেছি আর তুমি আমার মুখের উপর না করছো। কি মনে করো নিজেকে মেহরাজকে বিয়ে করে খুব ডানা গজিয়েছে তাইনা?

– আপনি অহেতুক ঝগড়া করছেন, এটা আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সিন ক্রিয়েট করবেন না প্লিজ

– আমি সিন ক্রিয়েট করছি? আমার মুখে মুখে তর্ক করার সাহস হয় কি করে, হাউ ডেয়ার ইউ চিপ, ক্লাসলেস। কি মনে করো দেহ দিয়ে ভুলিয়ে রেখে মেহরাজের সব হাতিয়ে রাজত্ব করবে। তোমাদের মতো মেয়েকে সবাই খুব ভালো করেই চেনে বড়লোক দেখে ছেলে পটিয়ে বিছানায় মাতিয়ে নিজেদের সার্থসিদ্ধ করাই তোমাদের কাজ

সামান্য একটা কথার বিপরীতে এহেন উত্তর মোহর কখনও আশা করেনি। প্রচন্ড অপমানবোধ ঘৃণায় গা জ্বলে উঠলো। আশেপাশে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, তিয়াসাদ উচ্চ্যবাক্যে বলা কথা গুলো অনেকেরই কানে গেছে, মোহর ক্ষুব্ধ গলায় গর্জে বলল

– চিপ ক্লাসলেস শুধু টাকার হিসেবে না বাহ্যিক আচরণ আর উগ্র ব্যবহারেও বোঝা যায়। যেটা আপনার মাঝেই স্পষ্ট। এভাবে লোকসম্মুখে যে এরূপ বিশ্রি ভাষার ব্যবহার করতে পারে তাকে শুধু কুশ্রী স্বভাবেরই না মানসিক ভারসাম্যহীন ও বলা যায়

মোহরের তীক্ষ্ণ গলায় বলা অপমানসূচক কথায় মাথাটা যেন দপদপ করে জ্বলে উঠলো তিয়াসার। জেদ রাগ মাথায় চড়ে বসলে ও জলন্ত চোখে তাকিয়ে মোহরকে থা’প্পড় দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই পেছন থেকে একটা হাত খপ করে ওর কবজি চেপে ধরলো। মেডিক্যালের সামনে যদিও বেশি লোকজনের ভীড় নেই, তবুও গুটিকয়েক লোক জড়ো হয়েছে। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে দেখছে অপ্রীতিকর দৃশ্য।

নিজের কবজিতে অস্বাভাবিক শক্ত চাপ পড়তেই যন্ত্রণায় মুখ কুচকে এলো। তবুও ক্ষুব্ধ হয়ে পেছনে ঘুরে তাকালেই মোমবাতির ন্যায় ধপ করে নিভে গেল এক জোড়া হিংস্রাত্মক লালাভ চোখ দেখে। তিয়াসা কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করার আগেই হাড় হীম করা ভারি কণ্ঠটা বলে উঠলো

– ওর গায়ে একটা টোকা দিলেও ভবিষ্যতে এই হাত আর ব্যবহার করার মতো অবস্থায় থাকবে নাহ, এ্যন্ড আই উইল মেইক সিউর দ্যাট
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here