#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৯)
এক সপ্তাহ হলো উষশী’র সাথে দেখা হয় নি। মেয়েটি ঘর থেকে বের হচ্ছে না। অন্য কোনো ভাবে যোগাযোগের ও সুযোগ নেই। সেই জন্যেই রোজ বাড়ির সামনে এসে ঘুরঘুর করে অভিরাজ। ওর ভেতরটা কেমন করে উঠল। মেয়েটির কি শরীর খারাপ? হুট করেই চিন্তাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। অসহ্য হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল অভিরাজ। চোরের মতো লুকিয়ে। বিষয়টা অনুভব হতেই বত্রিশ বছর বয়সী অভিরাজ ভীষণ লজ্জিত বোধ করছে। পরমুহূর্তেই ভাবল ভালোবাসার জন্য চাঁদকে জয় করাও কঠিন না। আর সে তো শুধুমাত্র চোরের মতো বাড়িতে প্রবেশ করেছে। সুন্দর শুভ্র সাদা রঙের বাড়িটার এক পাশ জুড়ে রয়েছে বাহারি ঝর্ণা। সেই ফোয়ারার ঠিক পাশেই টেবিল চেয়ার রাখা। আর অপর পাশে কিছু পেন্টিং। অভি আগ্রহ নিয়ে এগোল। পেন্টিং গুলো উলোটপালোট করে দেখতে লাগল। অনেক গুলো পেন্টিং এর মাঝে একটা বিশেষ পেন্টিং নজরে এল। এতে একটুও অবাক হলো না সে। বরং মৃদু হেসে যত্ন নিয়ে পেন্টিং টায় হাত বুলাল। উষশী’র সাথে তার প্রথম চু ম্ব নের দৃশ্য এটি। মেয়েটা তখন একদমই ধ্যানহীন হয়ে পড়েছিল। গাড়িতে এসে প্রশ্ন করেছিল তারা সম্পর্কে আছে কি না। কি অদ্ভুত সুন্দর ছিল দিন গুলো। কথা গুলো মনে হতেই ভালো লাগা এসে স্পর্শ করে গেল অভিরাজের সমস্ত শরীরে। চার পাশ থেকে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে।
“হো ইজ হেয়ার?”
চমকে উঠল অভিরাজ। ধীর হাতে পেন্টিং টা রেখে দিল। ততক্ষণে ব্যক্তিটা ওর সামনে চলে এসেছে।
“হো আর ইউ?”
“মাই সেল্ফ অভিরাজ সিনহা।”
“হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?”
“আই হেভ কাম টু মিট উষশী।”
“সরি। দেয়ার ইজ নো ওয়ান উইথ দিস নেইম। ইউ হেভ কাম টু দ্য রং এড্রেস।”
ব্যক্তিটা মিথ্যে বলায় অভিরাজের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তারপর হুট করেই মনে পড়ল উষশী নিজেকে সান নামে ডাকতে বলেছিল। বারের মেয়ে গুলোও সান নামে সম্বোধন করছিল। ব্যক্তিটা অনেক দূর চলে গিয়েছে। অভিরাজ দূর থেকেই চেচাল।
“আই কাম টু মিট সান। প্লিজ কল হার।”
সান নামটি শুনে মেঘের মতো কালো হয়ে এল ব্যক্তিটার মুখশ্রী। অভিরাজ সামনে এগিয়ে এল।
“কল হার।”
“সরি। ম্যাম ইজ স্লিপিং। ইউ কাম লেটার।”
অভিরাজ কে চলে যেতে হলো। যাওয়ার পূর্বে কয়েকবার পেছনে তাকাল। মেয়েটির দেখা নেই। অভিরাজ চোখের আড়াল হতেই উষশী’র হৃদয় ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে এল উষ্ণ শ্বাস। মেয়েটির চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছে। কেন এত মায়া হয় এ হৃদয়ে?
উষশী ইদানীং বারে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরের মধ্যেই থাকছে সে। এমনকি ভার্সিটিও যাচ্ছে না। মেয়েটির এই স্তব্ধতা অভিরাজের উপর ভীষণ প্রভাব ফেলল। তার কাছে এক একটা সেকেন্ড দীঘল মনে হচ্ছে। কাজে মন বসছে না। লাবণ্যই সব দেখা শোনা করছে। ঈশানের কোনো খোঁজ নেই। ছেলেটা এখনো ফিরে নি। কবে ফিরবে জানা নেই। সব কেমন আবার উলোট পালোট হতে শুরু করেছে। এর মাঝে কয়েকবার বাবার সাথে কথা হলো। ভদ্রলোক ব্যবসাটা নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। সত্যি বলতে এবার আর ব্যবসাটা নষ্ট করতে চায় না সে। ওর মন বার বার সব গুছিয়ে নিয়েও কেমন করে যেন খেই হারিয়ে ফেলছে। উষশী’র সাথে পরবর্তী দুই সপ্তাহ দেখা হলো না। কতটা কষ্ট হলো ওর তা ভাষায় ব্যক্ত সম্ভব না। এক মেঘলা বিকেলে মেয়েটির সাথে দেখা হয়েই গেল। মেয়েটি ত্রস্ত পায়ে হেটে চলেছে। শরীর শক্তি হারিয়েছে। তবু তার পালানোর চেষ্টা। ওর এই অবস্থা দেখে অভি’র ভেতরটা কেমন করে উঠল। ছুটে এসে জাপটে ধরল। কত দিন কত মাস কত বছর পর প্রিয় মানুষের শরীরের শুভ্রতা মিলল। এত সময় ধরে পালাতে চাওয়া উষশী এবার জাপটে ধরেছে। ওর এই আচরণে অভি’র ঠোঁটের কোণে হাসির উদয় ঘটল।
“এখনো অস্বীকার করবে আমায় ভালোবাসো না? উষশী,পাঁচ বছর আগে কি হয়েছে কেন হয়েছে আমি কিচ্ছু জানতে চাইব না। দূরে যেও না প্লিজ। তোমাকে ভোলা এ জনমে সম্ভব না। আই লাভ ইউ মোর দ্যান মাইসেলফ।”
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। চারপাশে আঁধার নেমে এসেছে। সেই সাথে বেড়েছে বাতাসের গতি। ঠান্ডা শীতল হয়ে উঠেছে শরীর। উষশী’র শরীরে পাতলা ফিনফিনে পোশাক। তাও হাঁটুসম। মেয়েটির ভীষণ শীত অনুভব হচ্ছে। অভি একটু ব্যস্ততা অনুভব করল। ওমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টিতে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা যুগল ভেসে যাচ্ছে। তাদের দুজনের তপ্ততা মিলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। অন্যরকম ভালোলাগায় সিক্ত হচ্ছে প্রহর। আর সেই সুন্দর সময়টুকু শুষে নিতে ভুল করল না অভিরাজ।
অভিরাজের কাঁধে মাথা এলিয়ে আছে উষশী। মেয়েটির চোখ সামনের রাস্তাতে। সেখানে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। তারা দুজনেই ভিজে একাকার। অভিরাজ কত দিন পর এমন শান্তি অনুভব করছে। উষশী তার পাশে বসে। শুধু পাশেই বসে নয় বরং খুব নিকটে অবস্থান করেছে। তাদের দুজনের ঠোঁটেই সেই স্বাদ লেগে আছে। প্রিয়তমার বাদামি রঙা চুলে হাত গলিয়ে দিল অভিরাজ। ছেলেটার হাতের মাদকে উষশী’র দু চোখে ঘুম নেমে এল। সে দু হাতে চেপে ধরল অভিরাজের বাহু। সেই সাথে উচ্চারণ করল।
“এভাবেও ভালোবাসা যায় অভিরাজ?”
“যায় তো।”
“পাঁচ বছর পর এসেও তুমি একই ভাবে আমায় ভালোবেসে যাচ্ছ। অথচ আমি তার যোগ্য নই।”
“এভাবে বলে না উষশী।”
“আমি খুব খারাপ অভিরাজ। আমার ছলনায় ডুবে নিজের জীবনটা শেষ করবেন না।”
“জীবন তো তোমার নামেই উৎসর্গ করেছি উষশী।”
“এভাবে ভালোবাসতে হয় না অভিরাজ।”
“কেন হয় না?”
“কারণ দুঃখ পেতে হয়।”
“তোমার দেওয়া সব দুঃখও আমার নিকট সুখ হয়ে ধরা দেয় উষশী।”
উষশী দু চোখের জল মুছে নিয়ে বলল,”যেতে হবে আমায়।”
“আবার কবে দেখা হবে?”
“যেদিন বৃষ্টি নামবে।”
“যদি বৃষ্টি না হয়?”
“তবে মরু উদ্যানে এক চিলতে রোদ হয়ে প্রহর রাঙাবে উষশী। আর শুরু হবে আমাদের প্রহর রাঙা বৃষ্টিহীনা আলাপন।”
লাবণ্য বিরস দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে। অনেক সময় ধরে অভি’র জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলেটা বলেছিল ডিনার এক সাথে করবে। অথচ ডিনারের সময় পেরিয়ে এখন মধ্যরাত। অর্ধভেজা হয়ে ফিরেছে অভিরাজ। লাবণ্য এগিয়ে এল।
“বৃষ্টিতে ভিজলি যে?”
“অনেকদিন ভেজা হয় না তাই।”
“উষশী’র কি খবর?”
“দেখা হয়েছিল আজ।”
“তারপর?”
“কথা হলো।”
“কি বলল?”
“বিশেষ কিছু নয়। বড়ো জেদি মেয়ে।”
“খাবার বাড়ছি আমি। ফ্রেস হয়ে আয়।”
“না। আজ আর খাব না।”
অভিরাজ ভেতরে চলে গেল। লাবণ্য’র মনে বিশেষ কোনো প্রভাব পড়ল না। এসবে সে অভ্যস্ত। অভি’র ভালো থাকাটাই ওর নিকট এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সমুদ্রের তীরে এসে বসেছে ঈশান। সাগরের গর্জনে চারপাশ মুখরিত হয়ে আছে। মৃদু হাওয়ায় উড়ছে তার চুল। দৃষ্টিতে রিক্ততা। বুকে তৃষ্ণা। অথচ এর কোনো সমাধান নেই। মাত্র কিছু প্রহর আগে নিজ মা বাবার প্রতি ভীষণ ঘৃণা বোধ শুরু হলো। সেই ঘৃণা থেকেই নিজেকে হারিয়ে ফেলার ইচ্ছে হচ্ছে। অথচ কোনো এক অজানা টানে সেটা হয়ে উঠল না। পাশে থাকা মুঠো ফোন বেজে চলেছে। অভিরাজের নাম্বার। ইচ্ছা না থাকলেও রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্নতা ভেসে এল।
“ঈশান,কোথায় তুই? বাসায় ফিরছিস না কেন? কি হয়েছে? কথা বল। এই ঈশান।”
“আমি সবটা জেনে গিয়েছি ভাইয়া।”
“ঈশান আমার কথা শোন।”
“কিছু শোনার নেই ভাইয়া। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। সেই সাথে নিজের মা বাবার উপর।”
“পুরনো কথা টেনে আনার কোনো মানে নেই। তুই বাড়ি ফিরে যা ভাই।”
“কোথায় ফিরব? অমন নিচু মনের মানুষ গুলোর সাথে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমি ভাবতাম শুধু আমিই কষ্টে আছি। অথচ ছোঁয়া কতটা সহ্য করেছে। উপায় না পেয়ে সম্পর্কটা করেছে। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে ভাই। তবু ম র তেও পারছি না।”
ঈশান কল কেটে দিয়েছে। অভিরাজ ভীষণ অসহায় বোধ করছে। ঘটনাটা কিছু বছর পূর্বে জেনেছিল সে। ঈশানকে বড়ো আদরে মানুষ করা। ছেলেটার চলন বদল সবটুকুই বুঝে আসত ওর। তবে ছোঁয়া’র অনুভূতিতা জানা ছিল না। মেয়েটা এত চাপা স্বভাবের। অন্যদিকে মায়ের মন ভিন্ন। লতিফা ঠিকই বুঝেছিলেন। ঈশানের অনুভূতি গুলো বুঝতে গিয়ে ছোঁয়া’র অনুভূতি গুলোও ধরে ফেলেছিলেন। এক সন্ধ্যায় বাড়িতে কেউ নেই। শুধু ছোঁয়া আর লতিফা। সেদিন খুব ঝড় ছিল। প্রকৃতির সেই ঝড়টা ছোঁয়া’র জীবনেও উঠেছিল। ছোঁয়া’র শারীরিক কিছু সমস্যা রয়েছে। বাচ্চা জন্ম দেওয়াটা রিস্কের। তাই তিনি চান নি নিজের ছেলের জন্য এমন এক মেয়েকে ঘরে আনতে। ছোঁয়া’র সমস্ত অনুভূতিকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন তিনি। ছোট্ট ছোঁয়া কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছিল ‘আমি কখনো ঈশান ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক জড়াব না মেঝো আম্মু।’
মেয়েটা নিজ প্রতিজ্ঞা রেখেছে। জ বা ই করেছে নিজ অনুভূতিকে। আর এসব কোনো ভাবে জেনে গিয়েছিল অলক। ছোঁয়া’র প্রতি ওর ভালো লাগা ছিল। সেই সুযোগে মেয়েটির সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। ঈশান কথা গুলো জেনে গেলে ঝামেলা হত। ওর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হত। আর সেই জন্যেই পরিবার পরিজনের কথা ভেবে নিজ জীবনের এত বড়ো ক্ষতি করে ফেলল ছোঁয়া।
|আমি গল্প এমন ভাবে সাজাই যাতে করে পরের পর্বে কি হতে চলেছে পাঠক ধরতে না পারে। যদি পাঠক ধরতেই পারে। কল্পণা করেই ফেলে তবে লেখক কি লিখবে? যাদের বিরক্তি লাগছে। গল্প শেষ হলে পড়ুন।|
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি