#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪২
নিজের বাড়ির প্রধান দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ফারাহ। পাশে সযত্নে দাঁড়িয়ে থাকা শৌভিকের দিকে ইতস্তত হয়ে চাইল সে। শৌভিক দৃষ্টি নামিয়ে ছাতা ফারাহর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভেতর অবধি ছাতা নিয়ে যেতে পারেন। সমস্যা নেই।”
“তার কোনো প্রয়োজন হবে না।”
শৌভিক আরো কিছু বলতে উদ্যত হলো। সঙ্গে সঙ্গে দরজার ওপাশ দিয়ে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো তিনটা ছেলে। যাদের মধ্যে একজনকে শৌভিক চেনে। মাথায় ক্যাপ পড়া এবং কাটা ভ্রু দেখে শৌভিক নিশ্চিত হলো এটা সেই ছেলেই যাকে সে একদিক বাস থেকে নামিয়ে শায়েস্তা করেছিল। রাফিন তার বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়ার পথে ফারাহ এবং শৌভিকের সামনে পড়ল। নিজের বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল রাফিন। আচানক শৌভিকের সামনা-সামনি হওয়ায় তার মুহূর্তে মনে পড়ে সেদিনের দিনটা। ফারাহর পাশাপাশি দেখায় অতিরিক্ত রাগে থরথর করে কেঁপে ওঠে রাফিন। আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে ওঠে,
“তুই এখানে কোন সাহসে আসিস? তাও আবার মন্ত্রী সাহেবের মেয়ের সাথে? তোর তো সাহসের প্রশংসা করতে হয়! মন্ত্রীর মেয়েকে হাত করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চাস?”
শৌভিক একবার আঁড়চোখে ফারাহকে দেখে নিলো। মেয়েটি হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। শৌভিক মেয়ের সামনে ঝামেলা করতে চায় না। তাই সে ফারাহর হাতে নিজের ছাতা ধরিয়ে গম্ভীর সুরে বলে,
“আমি আসি তাহলে।”
শৌভিক যাওয়ার জন্য ফারাহর পাশ কাটায়। তৎক্ষনাৎ রাফিন ছাতা ছেড়ে দৌড়ে এসে হঠাৎ শৌভিকের এক গালে ঘু/ষি মে/রে বসে। আকস্মিক ঘটনায় শৌভিক কিছুটা দূরে ছিটকে যায়। রাফিন সাহস পায় নিজের দুজন বন্ধুর জন্য। আজ সে একা নয়। সে শাসিয়ে বলে,
“সেদিনই তোরে সাবধান করছিলাম। আজকে যখন তোরে নিজের বাগে পাইছি। ছাড়ব?”
রাফিনের দুই বন্ধু এগিয়ে আসে। ফারাহ স্তম্ভিত। নিজের গালে হাত বুলাতে গিয়ে রাফিন ধা/ক্কা দেয় শৌভিককে। বৃষ্টিভেজা সড়কে পড়ে যায় শৌভিক। হাতে ব্যথা পায়। ফারাহ ছাতা ফেলে ছুটে আসে আগপাছ না ভেবে। শৌভিক উঠে এবার রাফিনকে চেপে ধরতে চায়। কিন্তু রাফিনের দুই বন্ধু তা দেয় না। ফারাহ এগিয়ে এসেই রাফিনকে হাত দিয়ে ধা/ক্কা মে/রে সরিয়ে দিয়ে হাঁটু মুড়িয়ে বসে শৌভিকের নিটকে। রাফিনের দুই বন্ধুকে ধমক দিয়ে বলে,
“এই সরে যাও তোমরা। নয়ত সব কয়টার খবর করতে আমার মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে।”
দুটো ছেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সরে যায়। রাফিন তড়িঘড়ি করে বলে,
“ম্যাডাম আমি বুঝতে পারছেন না। এ আপনার সঙ্গে সম্পর্ক মধুর করতে চাইছে। ওরে চেনেন না আপনি। ভালে হয় এসব থেকে দূরে থাকেন। ওরে আমরা দেখে নিচ্ছি।”
ফারাহ উঠে যেন তেড়ে এলো রাফিনের দিকে। নিজের হাত উঠিয়ে বলল,
“এই ছেলে, এই! থা/প্পড় চিনো? এক চ/ড়ে সব দাঁতকপাটি ফেলে দেব। আমাকে দেখে কি ছোটো বাচ্চা মনে হয় তোমার? যে আমি কিছু বুঝি না? এমনি তোমাদের ঝামেলার জন্য আমার প্রিয় ডিজাইনিং ড্রেসটা নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছি। এখন যদি তোমরা আরো ঝামেলা করো তাহলে নিজের মুখের কথা সত্যিতে পরিণত করব।”
ফারাহর কথায় ভড়কালো সকলেই। কারণ সে কার মেয়ে সেটা সকলেরই জানা। ফারাহ পিছু ফিরে তাকাল। শৌভিক উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাত নাড়ানোর চেষ্টা করছে। ব্য/থায় কুঁকড়ে গেছে মুখ। চশমা রাস্তায় লুটোপুটি খাচ্ছে। ভিজে গিয়েছে শৌভিকের প্রশস্ত শরীর। চশমার আড়ালে রাখা ছোটো চোখ দুটো দৃশ্যমান হতেই ফারাহর মনে হলো লোকটাকে আলাদা লাগছে এখন। খেয়াল করল ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্ত। যাতে একটু একটু করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ফারাহ দূরন্ত পায়ে ছুটে শৌভিকের সংলগ্নে দাঁড়াল। অনুশোচনা বোধে তাড়াহুড়ো করে নিজের ভেজা ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে শৌভিকের ঠোঁট মুছে দিয়ে মিনমিন করে বলে,
“আই এম সরি। আমার জন্য সত্যিই আপনাকে ক/ষ্ট পেতে হলো। বাবা পি/স্তল না ধরলেও তার সেক্রেটারির ছেলে…”
“তেমন কিছুই না। আপনার বাবার ওই সেক্রেটারির ছেলের সাথে আমার পুরোনো একটা শত্রুতা আছে। তার এই কাণ্ড ওই শত্রুতার জন্যই। আমিও দুঃখিত। আমার জন্য আপনার ডিজাইনার ড্রেস খারাপ হয়ে গেল।”
“উচ্ছন্নে যাক ড্রেস। আপনার ব্লি;ডিং হচ্ছে। আমার বাড়ি চলুন না হয়। আমি ফার্স্ট এইড করে দেব!”
শৌভিক হেসে উঠতে চাইল। কিন্তু ঠোঁট প্রসারিত করতে গিয়েই পেল ব্য;থা। তবুও হাসি মুখ করে বলল,
“আ/হত তো হয়েই গিয়েছি। নি/হত করতে চান? আপনার বাড়ির দরজার সামনেই আমার যা অবস্থা! বাড়িতে গেলে আমার ডে/ড বডি খুঁজে পাওয়া যাবে তো?”
কথা বলতে বলতে শৌভিকের ঠোঁটের কোণ দিয়ে আরো র/ক্তের দেখা পাওয়া গেল। ফারাহ সরল মনে এগিয়ে দিলো নিজের রুমাল।
“র:ক্ত পড়ছে মুছে নিন।”
শৌভিক হাত বাড়াতে গেলেই তার হাতে অসম্ভব যন্ত্র/ণা করল। বলল,
“বৃষ্টির পানিতে এমনিতেও ধুয়ে যাবে।”
ফারাহ সন্তুষ্ট হলো না। নিজেই রুমাল নিয়ে পায়ের গোড়ালি উঁচু করে উদ্যত হয়ে একহাতে আলতো করে শৌভিকের ভিজে দাড়ি স্পর্শ করল। অন্যহাতে সযত্নে মুছে দিলো র;ক্তখানি। শৌভিক বুঝল না এতে লাভ কী পেল মেয়েটি! বৃষ্টিতে এমনিতেই সব ধুয়ে যাচ্ছে। তবে প্রথম অচেনা মেয়ের এই স্পর্শ তার হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। কেমন যেন করে কাঁপতে থাকল তার কণ্ঠস্বর। নিজের এই দুর্বলতা আড়াল করতে সে বলল,
“আমি আসি। বাড়ি গিয়ে নিজের ফার্স্ট এইড করে নেব। আমিও বাড়ি যান। মন্ত্রীর তুলতুলে মেয়ে। ঠাণ্ডা লেগে যাবে আবার।”
শৌভিক ঝুঁকে নিজের চশমা তুলে নিলো। দ্রুত পায়ে চলল মেইন রাস্তার দিকে। ফারাহ ভেতরে গেল না। তাকিয়ে রইল সেই ভিজতে ভিজতে হেঁটে যাওয়া সেই অমায়িক পুরুষটির দিকে।
সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে মোহ। বাহিরে প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়েছে। বাহিরে মাঝে মধ্যে বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা গেলেও তার বাড়িতে একেবারেই নিস্তব্ধতা। মিসেস সুফিয়া রেগেমেগে চোখমুখ লাল করে ফেলেছেন। নীরবতা ভেঙে তিনি কিছু বলতে গেলে হাতের ইশারায় উনাকে থামিয়ে আজহার সাহেব বলেন,
“আমার মেয়ের সাথে আমি কথা বলব।”
মিসেস সুফিয়া চুপ রইলেন। আজহার সাহেব মাথা নুইয়ে রাখা মেয়ের দিকে তাকান। বোঝায় যাচ্ছে সে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে এত মানুষের সামনে। তবুও তিনি শুধালেন,
“তোমার মামী যা বলছে তা সত্যি? তুমি মন্ত্রী সাহেবের ছেলের সাথে দেখা করতে বাহিরে বেরিয়েছিলে?”
“জি, বাবা। কিন্তু তার কিছু কারণ…”
মোহকে পুরো কথা বলতেই দেওয়া হলো না। মিসেস আফিয়া বলে ওঠেন,
“দেখেছেন আপনারা? আমি বলেছিলাম। আজহার ভাই, আমি এখনো বলছি আপনি নিজের মেয়েকে সামলান। এমনিতে কিন্তু কম অঘটন ঘটায় নি আপনার মেয়ে। যার একটার ফল ইথান।”
ইথানের প্রসঙ্গ আসতেই যেন আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠল মোহ৷ না চাইতেও রূঢ় কণ্ঠে বলে ফেলল,
“মামী! কথাটা আমাকে নিয়ে হচ্ছিল। ইথানের প্রসঙ্গ তুলবেন না। আমি ইথানকে নিয়ে কোনো অভিযোগ সহ্য করব না।”
আফিয়া এবার হতাশ কণ্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ, তুমি দোষ করবে আর কেউ বললেই সমস্যা! সবার প্রশ্রয় পেয়েই এমন হয়েছ তুমি।”
আজহার সাহেব এবার আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,
“আমি আমার মেয়ের সাথে একা কথা বলব। মোহ, আমার ঘরে এসো।”
আজহার সাহেব উঠে গেলেন ঘরের দিকে। মোহও গেল পিছু পিছু। তার বাবা ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসলেন আস্তে করে। মোহ গুটি গুটি পায়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল একমনে। আজহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলতে চাইছিলে তুমি। বলো এখন। এখানে কেউ বাঁধা দেবে না তোমায়।”
মোহ কৃতজ্ঞতার সাথে বলল,
“আমাকে বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ বাবা।”
“আমি তোমাকে ভালো করে চিনি মোহ। তোমার সকল পদক্ষেপের কোনো না কোনো কারণ থাকে। জানি আমি। বলো আমায়।”
মোহ স্বচ্ছের পুরো ব্যাপারটা বলে দিলো ধীরে ধীরে। সবটা শুনে ভাবুক হয়ে উঠলেন আজহার সাহেব।মোহ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আজহার সাহেব ভার কণ্ঠে বলেন,
“ছেলেটা উদ্দেশ্য খারাপ নয়। ও প্রথম থেকেই সবসময় ওর বাবার কাজের জন্য লজ্জিত হয়েছে। এখন আমাদের জন্য ও নিজে কষ্ট পাচ্ছে। এটা যেমন ওর জন্যও ঠিক নয়। তোমার জন্যও ঠিক নয়। এমনিতেই মন্ত্রী সাহেবের রাগ তোমার উপর উপচে পড়ছে। এখন যদি তোমার জন্য উনার ছেলে উনার সাথে ঝামেলা করে থাকে তবে সেই রাগটাও যদি তোমার উপরই ঝাড়তে চান। তাহলে কী হবে বুঝতে পারছ?”
মোহ চুপ করে রইল। একধ্যানে তার নজর বাহিরের দিকে। একটা সময় তার মনে হলো বাহিরে কিছুটা দূরে সরু রাস্তার ওপাশে এই তীব্র বর্ষণে নিজেকে ইচ্ছেমতো সিক্ত করছে। মোহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা যখন মানুষটিকে চেনার চেষ্টা করল তখনি তার গায়ের লোম শিউরে উঠল। কারণ মানুষটি স্বচ্ছ। তার অবচেতন, উদাসীন মন ব্যকুলতায় ছেয়ে গেল। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“বাবা, বাবা! স্বচ্ছ এখনো যায়নি। রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজছেন। উনার গায়ে জ্বর। আমার একটা অনুরোধ…”
আজহার সাহেব মেয়ের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বললেন,
“সে অসুস্থ হলে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারো।”
এই অনুমতির যেন অধীর আগ্রহে ছিল মোহ। তার বাবার মুখের কথা শেষ হতেই সে যেন বিদ্যুতের বেগে ছুটল বাহিরের দিকে। তার গোল গোল দুটো চোখের অস্থিরতা ধরা দিলো আজহার সাহেবের চোখে। কারোর প্রতি মেয়ের এত উচাটন কখনো দেখেন নি তিনি। তবে কি মেয়ের মনের অজান্তে সৃষ্টি হলো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি? যা বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব?
রাস্তার একপাশে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ। তার এলোমেলো জীবন উপলব্ধি করছে সে। বৃষ্টির একেকটা ফোঁটায় নিজের সময়ের সাথে আউলিয়ে যাওয়া জীবনটা নিয়ে ভাবছে সে। মনে করছে, আগে তো তার জীবন এমন ছিল না! আড্ডা, ঘোরাঘুরি, লেট নাইট পার্টি, ঘুম এসব মিলিয়েই কেটে গিয়েছিল দিন। হঠাৎ কী হলো? এত পরিবর্তন কী করে হলো তার? নিজেকে প্রশ্ন করতেই উত্তরটা সে নিজেই পেল। এর পেছনে এক নারীর অবদান রয়েছে। এমনই তো বর্ষণ ছিল সেদিনও। যেদিন মোহ আনবীর নামক এক রমণী এসে তার সবকিছু উলোটপালোট করে দিয়ে গেছে!
এত ভাবনার মাঝে একসময় স্বচ্ছের অনুভূত হয় তার গায়ে আর বৃষ্টি পড়ছে না। নিজের দুর্বল চোখ দুটি খুলতেই সে তার সামনে তার দুনিয়া উলোটপালোট করে দেওয়া নারীটিকে খুঁজে পায়। ছাতা ধরে কপাল কুঞ্চিত করে বিচলিত নয়নে তাকিয়ে রমনী। সে ভাবে হয়ত এই মোহ তার নিছকই কল্পনা। কিন্তু মোহ যখন কড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“এভাবে বৃষ্টিতে কেন ভিজছেন?”
স্বচ্ছ নড়েচড়ে উঠল। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকানোর চেষ্টা করল। অস্ফুটস্বরে বলল,
“এমনিই। ইচ্ছে করল হঠাৎ!”
“ভালোবাসেন আমায়?”
মোহের আচমকা এক প্রশ্নে স্বচ্ছের ভেতরের প্রতিটা স্নায়ু সজাগ হয় যেন। দুর্বল নেত্রপল্লবে ভেসে ওঠে তার অব্যক্ত অনুভূতি। কান গরম হয়ে আসে। অনুভূতি ব্যক্ত করে সে কি নিজের জয় পাবে? প্রণয়ের জয়?
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকের পর্বে চমক থাকার কথা ছিল। তবে সেই অংশ লিখতে পারিনি এখনো। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]