#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৭।
খালা আর কিছু বলার আগেই বাড়ির ল্যান্ড লাইনে কল আসে। খালা তখন ভয়ে পেয়ে যায়। রিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘এই ফোনে তো খালি সাহেব’ই কল করেন। সাহেব কি তাইলে বুইঝা গেছেন?’
রিতা আর মেহুলও দুশ্চিন্তায় পড়ে। রিতা বলে,
‘খালা, আপনি ভয় না পেয়ে কলটা রিসিভ করুন। দেখুন, কী বলে?’
খালা ভয়ে ভয়ে ফোনটা তুলে কানে লাগায়। ওপাশ থেকে সাদরাজ তখন জিজ্ঞেস করে,
‘খালা, আমাদের বাসায় কেউ কি এসেছে?’
খালা ভয়ে ভয়ে রিতা আর মেহুলের দিকে তাকায়। কী বলবে বুঝতে পারছে না। মিথ্যে বলার পর ধরা পড়লে আরো বিপদ। এইদিকে সত্য বলারও উপায় নেই। সাদরাজ আবার জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, খালা? কিছু বলছো না কেন? আমি ক্যামেরাতে দেখেছি। কে এসেছে?’
‘আসলে সাহেব, একটা নতুন মহিলারে আমি খবর দিছিলাম। ঐ যে আমাদের ম্যাডাম বাসায় একা একা থাহেন। এহন তো আপনিও নাই। তাই ভাবছি এই মহিলা আইলে আমাদের ম্যাডামরে একটু সঙ্গ দিতে পারব। আমিই ওরে আনছি। আমাদের গ্রামের।’
সাদরাজ বলল,
‘খালা, যাকে তুমি এনেছো তাকে চলে যেতে বলো। আমার অবর্তমানে, আমাকে না জানিয়ে তুমি বাইরের মানুষ কী করে আনলে? উনাকে এক্ষুনি যেতে বলো। আমি যেন বাসায় এসে কাউকে না দেখি।’
‘মাফ করবেন, সাহেব। আমি এক্ষুনি ওরে বাইর কইরা দিতাছি।’
‘ঠিক আছে। রাখছি।’
সাদরাজ ফোন রাখার পর খালা মেহুলকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘খালা, আপনি এক্ষুনি যান। সাহেব আপনারে দেখছে। সাহেব আইতাছে, আপনারে আইসা দেইখা ফেললে কেলেঙ্কারি হইব। তাড়াতাড়ি বাইর হোন, খালা।’
মেহুল বলল,
‘আচ্ছা। চলে যাচ্ছি।’
সে তখন তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট বাটন ফোন বের করে রিতার হাতে দেয়। তাকে বলে,
‘এই ফোনটা লুকিয়ে রাখিস। আর, প্রয়োজন মতো কল দিস আমাকে। এখন আমি যাই। আমারও অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে।’
‘আচ্ছা। সাবধানে যাস, দোস্ত।’
‘ঠিক আছে। তুইও সাবধানে থাকিস। কোনো অসুবিধা হলে কল দিয়ে জানাবি। সিমও আছে। চিন্তা করিস না, আমরা আছি তোর পাশে।’
রিতাকে বিদায় জানিয়ে মেহুল ছুটল। গেইট পেরিয়ে তার গাড়ির কাছে গেল। গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে।
__________
বাসায় পৌঁছে ড্রয়িং রুমে রাবীরকে দেখে মেহুল থমকে দাঁড়ায়। রাবীর মেহুলকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায় ছিলেন, মেহুল। আপনার ফোনও এতক্ষণ বন্ধ বলছিল। আর ড্রাইভারকেও কল দিচ্ছিলাম, সেও তো কল রিসিভ করেনি।’
মেহুল মনে মনে কথা সাজাল, কী বলবে। পরে সে হেসে রাবীরের দিকে এগিয়ে যায়। রাবীরের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘বাবা, নেতা সাহেব দেখছি তার বউয়ের দুশ্চিনায় একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে।’
‘তা তো হতেই হবে। সামনে নির্বাচন। আমার শত্রুরা এখন আরো বেশি জেগে উঠবে। আমাকে হারাতে ওরা যেকোনো কিছু করতে পারে। তাই আপনাকে এখন আরো বেশি সাবধানে থাকতে হবে। একদম একা কোথাও যাবেন না। আর প্রয়োজন পড়লে আমাকে কল দিবেন, বুঝেছেন?’
‘জি, নেতা সাহেব। বুঝেছি।’
‘আর আজকে এত লেইট হয়েছে কেন? ড্রাইভার কি ঠিক টাইমে যায়নি?’
‘না আসলে, আমার আজকে এক্সট্রা ক্লাস ছিল। তাই একটু লেইট হয়ে গিয়েছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, ফ্রেশ হোন গিয়ে।’
‘আপনি রুমে যাবেন না?’
‘হ্যাঁ, আপনি যান; আমি আসছি।’
মেহুল রুমের দিকে যায়। রাবীর তখন একবার ভাবে ড্রাইভারের কাছে যাবে। পদক্ষণেই তার মনে পড়ে, সে কি মেহুলকে সন্দেহ করছে? না না, এটা ঠিক না? সে অবশ্যই মেহুলকে অনেক বিশ্বাস করে। সে কোনোভাবেই ড্রাইভারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে না। তাতে তো মেহুলকে অসম্মান করা হবে।
মেহুল গোসল সেরে বেরিয়ে রাবীরকে দেখে, ফোনে কথা বলছে। সে চুল মুছে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাবীর তখন কল কেটে ভেতরে আসে। মেহুল গায়ে তখন লোশন মাখছিল। রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে দু কদম এগুতেই আবার ফোন বাজে তার। সে বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করে। কথা শেষ করে মেহুলের পেছনে এসে দাঁড়ায় সে। মেহুলের ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে বলে,
‘আজকাল আপনাকে একটুও সময় দিতে পারছি না, তাই না?’
মেহুল রাবীরের দিকে ঘুরে তাকায়। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘জি। আজকাল আপনি আমাকে একদমই সময় দিচ্ছেন না। এত ব্যস্ত কেন আপনি?’
‘সামনে নির্বাচন। ব্যস্ততা তো থাকবেই।’
‘আচ্ছা, এবার যদি আপনি হেরে যান?’
রাবীর তখন মেহুলের কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে আনে। নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার কী মনে হয়, হেরে যাব?’
‘না, বলছি আরকি; সবসময়ই তো জিতেন। যদি এবার হেরে যান, তাহলে মানুষ বলবে বউয়ের কারণে হেরেছেন। কারণ সবাই তখন ভাববে, বউটা বুঝি অলক্ষী। নাহলে সে আসার পরেই জামাইটা কেন হারল।’
‘ব্যাপারটা ভীষণ হাস্যকর, মেহুল। আমার হার জিতের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?’
‘সম্পর্ক আছে। ঐসব আপনি বুঝবেন না। আচ্ছা, আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো; আপনি আমাকে তুমি করে কেন সম্বোধন করেন না? আপনি করে কেন বলেন?’
‘আপনিও তো আপনি করে বলেন।’
‘সেটা আপনি আমার বড়ো, তাই।’
‘হ্যাঁ। তাহলে আপনিও আমার চেয়ে বড়ো, তাই।’
মেহুল ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আমি কী করে আপনার থেকে বড়ো হলাম?’
‘সম্মানের ক্ষেত্রে আপনি আমার থেকেও বড়ো। আমি আপনাকে নিজের থেকে বেশি সম্মান করি বলেই আপনাকে আপনি বলে সম্বোধন করি। আপনার কি পছন্দ না?’
‘না, পছন্দ। আসলে সেদিন একটা আন্টি বলছিল…’
‘ঐসব আন্টির কথা বাদ দিন। আপনি যেটাতে অভ্যস্ত আমার কাছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
মেহুল কিছুক্ষণ রাবীরের দিকে চেয়ে থাকে। রাবীর ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী দেখছেন?’
‘আপনি কত ভালো। আমার কত ভাগ্য যে আমি আপনাকে পেয়েছি। যদি এমন ভাগ্য রিতারও হতো।’
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আল্লাহ ভালো মানুষের সাথে খারাপ কিছু হতে দিবেন না, মেহুল। আল্লাহ আছেন তো। উনি সব ঠিক করে দিবেন।’
মেহুল তখন বলল,
‘একটা কথা বলব?’
‘বলুন।’
‘রাগ করবেন না তো?’
‘না, বলুন।’
‘আপনার আর সাদরাজ আহমেদের সম্পর্কটা আবার ঠিক হয়ে গেলে ভালো হতো না?’
‘এটা সম্ভব না।’
‘কেন সম্ভব না?’
‘জানি না। তবে এইটুকু জানি, এটা আর সম্ভব না।’
‘চাইলে সব সম্ভব।’
রাবীর মেহুলকে ছেড়ে দাঁড়ায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে বলে,
‘চারটা বাজে। চলুন, খেতে হবে।’
__________
মেহুল রাবীরের পেছন পেছন ডাইনিং রুমে যায়। সেখানে খালা সব বেড়ে রেখেছেন। রাবীর একটা চেয়ার টেনে বসল। খালাকে জিজ্ঞেস করল,
‘মা কি ঘুমাচ্ছেন?’
‘জি। খালা খেয়ে দেয়ে ঘুমাই পড়ছেন।’
‘আচ্ছা।’
মেহুল ধীরে ধীরে খাচ্ছে। মনের ভেতরে কথার প্যাঁচ চলছে তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। এত কথা মনে চেপে রাখলে খাবার কি আর গলা দিয়ে নামে? নামে না।তাই সেও খেতে পারছে না। রাবীর খেয়াল করে ব্যাপারটা। মেহুলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, মেহুল? আপনি খেতে পারছেন না?’
‘না, খাচ্ছি তো।’
‘কই? প্লেটের খাবার তো নড়ছে না। কী হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না না, আমি একদম ঠিক আছি। আসলে অস্থির লাগছিল।’
‘কেন? কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা? ভার্সিটিতে কোনো প্রবলেম হয়েছে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
মেহুল ইতস্তত স্বরে বলল,
‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আপনি বিকেলে বাসায় থাকবেন, প্লিজ।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে; থাকব। এখন খেয়ে নিন।’
খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেহুল আর রাবীর তাদের রুমে যায়। রাবীর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মেহুল বিছানায় বসে বসে হাত কচলাচ্ছে। রাবীর খেয়াল করেছে, মেহুল যখন কোনো ব্যাপার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকে তখন সে এমন করে। সে মেহুলের পাশে গিয়ে বসে। মেহুলের দু হাতের উপর হাত রেখে মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, মেহুল?’
মেহুলের অস্থির চোখ জোড়া একটু শান্ত হয়। রাবীরের দিকে চেয়ে বলে,
‘আপনাকে কিছু কথা বলব। আপনি আগে প্রমিস করুন, সব শুনে আপনি আমার উপর রেগে যাবেন না।’
‘না, রাগব না। বলুন।’
‘প্রমিস করছেন?’
‘হ্যাঁ, প্রমিস।’
‘আপনি কি জানেন, আপনার আর সাদরাজ আহমেদের মাঝে এসব ঝামেলা কে তৈরি করেছেন?’
রাবীর কপাল কুঁচকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘এসব কথা আবার কেন তুলছেন?’
‘বলুন না।’
রাবীর বড়ো করে নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘হ্যাঁ, জানি।’
‘কে?’
‘সাদরাজ আহমেদের বাবা, শাহাদাত আহমেদ।’
‘আর, সাদরাজের আহমেদের মা’কে কে খু ন করেছে জানেন?’
‘আপনি এসব কথা কী করে জানলেন?’
রাবীর অবাক হয়। মেহুল বলে,
‘জেনেছি। এখন আপনি বলুন, আপনি এটা জানেন কিনা?’
রাবীর মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না, এটা জানলে তো সব সমস্যার সমাধানই হয়ে যেত।’
‘আমি জানি।’
রাবীর বিস্মিত হয়। মেহুল বলে,
‘সাদরাজ আহমেদের মা’কে উনার বাবা, শাহাদাত আহমেদ’ই খু ন করেছেন। তারপর সব দোষ আপনার উপর চাপাতে চেয়েছেন।’
রাবীরের বিস্ময় কাটছে না। সে কিছু বুঝতেই পারছে না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি এতকিছু কীভাবে জানলেন, মেহুল? কার কাছ থেকে আপনি এসব শুনেছেন?’
চলবে…