#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
“কি বিশ্বাস হচ্ছে না? সব তোমারই জন্য। সাফা আরহান থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল। লন্ডনেই একটা ভার্সিটিতে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু যখন আরহানের এইনগেজমেন্টের কথা জেনেছে সেদিন আমি ওর সাথে ছিলাম। আমি দেখেছি ও কীভাবে কান্না করেছে। তারপর.. তারপর…”
নিজের বাক্য অসমাপ্ত রেখে থমকে গেল রাফাত। অক্ষিপটে ভেসে উঠলো সেই দুঃসহনীয় স্মৃতি। যা রাফাত কল্পনাতেও কল্পনা করতে চায় না। সে নিরবে রুম থেকে বেরিয়ে চলেই যাচ্ছিল তখন রুহানী ওর হাত ধরে বসে। সে রিকুয়েস্ট করে সবটা বলতে। তাই রাফাত বলতে শুরু করে,
“আরহান ও তোমার এইনগেজমেন্টের পরপরই আমি রাতের ফ্লাইটেই লন্ডনে আসি। তখনও সাফা জানতো না। তারপরের দিন রাতে লন্ডন ব্রিজের উপর দুইজনে হাঁটছিলাম। আমি চাইছিলাম নিরিবিলিতে সাফাকে খবরটা দিতে। ব্রিজের উপর গাড়ি চলাচল করছিল ঠিক কিন্তু মানুষজনের ভিড় ছিল না। তারপর আমি ওকে খবরটা দেওয়ার পর ও অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর হুট করে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুক্ষণ কান্না করে হুট করে আমাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আর কি! দিকবেদিক হয়ে দৌঁড়ে ছুটে যেতে নিয়ে মাঝ রাস্তায় চলে যায়। তখন একটা গাড়ির সাথে… আমারই চোখের সামনে আমার ছোটো বোনটা র*ক্তাক্ত হয়ে মাঝ রাস্তায় ছিট*কে পড়ে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে সেখানেই স্থির হয়ে ছিলাম। গাড়ি চালক দ্রুত ছুটে এসে সাফাকে ডাকতে থাকে তখন আমার হুঁশ ফিরে। ছুটে যেতেই গাড়ির মালিক বলে হসপিটালে নিয়ে যাবে এবং সব চিকিৎসার দায়ভার সে নিবে। তাও যেন কে*স না করি। তারপর ১ মাস হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে শেষমেশ কোমাতে চলে গেল। সেই গাড়ি চালক কোমাতে থাকাকালীন ট্রিটমেন্টের খরচ দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি এখন আর চাই না। আমার বোনের বাকি চিকিৎসা আমি করাব। ওর পরিচিতদের কাছে ও নিখোঁজ। কেউ ওর খোঁজ জানে না। আরহান দুয়েকদিন খোঁজ করে আর খবরও নেয়নি। বেস্টফ্রেন্ড নিখোঁজ তার কিন্তু সে একটা কথাই ধরে বসে আছে, সাফা ওকে প্রপোজ করেছিল। নিজের জীবনে সবকিছুতে ক্লিয়ারকাট থাকতে বেস্টফ্রেন্ডকেও কষ্ট দিতে তার বাধেনি। আমার বোনটাও! সে জানেও না, কেউ তার পাশে না থাকলেও তার ভাই তার পাশে থাকবে।”
রুহানী সব শুনে নিশ্চল দৃষ্টিতে সাফার নিথর দেহের দিকে চেয়ে রইল। ভালোবাসা মানুষকে কী থেকে কী করে দেয়! কিছু সময় পর আচমকা রাফাত রুহানীকে টেনে সাফার ঘর থেকে বের করে পূর্বের সেই কক্ষে নিয়ে যায়। আর বিছানায় ধা*ক্কা দিয়ে বলে,
“তুমি এখানেই থাকবে। তোমাকে সময় মত সবকিছু যা প্রয়োজন দেওয়া হবে। আমি আজ দেশে যাব। সপ্তাহ পর আবার এখানে আসব। আরহানকেও তো সামলাতে হবে! আফটারঅল আমি তার বেস্টফ্রেন্ড!”
রাফাত দরজা লাগিয়ে চলে যায়। রুহানী কয়েকবার ডেকেও সাড়া পায় না। অতঃপর সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে।
_________
আয়েশা খানম ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে দেয়ালঘড়ি দেখছেন তো একবার দরজার দিকে দেখছেন। সদর দরজা খোলা। আজমল খান সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন,
“মা, আপনি ঘরে গিয়ে বসুন। ওরা আসলে নিচে আসবেন। আপনার শরীর এমনিতেই খারাপ।”
“না। আমি এখানেই বসে থাকব। ২৪ বছর পর নিজের মেয়েকে চোখের সামনে দেখব। সাথে তো আবার নাতি-নাতনীও আছে। আচ্ছা, ও কি আমার উপর রাগ করে আছে?”
আয়েশা খানমের দৃষ্টিতে খুশির উচ্ছলতা। আজমল খান তার মায়ের পাশে এসে বসলেন। তারপর বললেন,
“এতো বছর পর যে আপনি ওদের মেনে নিয়েছেন তাতে রাগ থাকলেও পরে গেছে।”
“তাই যেন হয়।”
কিছুক্ষণ পর গাড়ির হর্নের শব্দে আয়েশা খানম বসা থেকে দাঁড়িয়ে যান। তারপর আস্তে আস্তে সদর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। আজমল খানও পিছনে আসেন। তখন গাড়ি থেকে প্রথমে নামেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। পরনে তার জলপাই রঙের কুর্তি। তারপর এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। চেহারা-সুরতে শ্বেতাঙ্গ। মধ্যবয়সী মহিলাটি অশ্রসিক্ত নয়নে কয়েক মুহূর্ত আয়েশা খানমে দিকে চেয়ে থেকে দৃঢ় পায়ে এসে তার সামনে থামে। তারপর জড়ানো স্বরে বলে,
“কেমন আছেন মা?”
আয়েশা খানম আর নিজের অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন। মা-মেয়ের কান্নার মাঝে শ্বেতাঙ্গ পুরুষটি স্পষ্ট বাংলায় বললেন,
“মা, এতো কাঁদবেন না। আপনার মেয়ে আপনার কাছেই থাকবে।”
আয়েশা খানম মেয়েকে ছেড়ে চোখ মুছে বললেন,
“হ্যাঁ। আমার ম*রার আগে যেতে দিব না।”
“এসব কী বলেন মা? আমরা আজ এতো বছর পর আপনার নাতি-নাতনীকে নিয়ে এলাম আর আপনি ম*রার কথা বলছেন! এমন করলে কিন্তু আমরা চলে যাব।”
মেয়ের কথা শুনে আয়েশা খানম হালকা হাসেন। তারপর বলেন,
“নারে আর বলব না। চল এবার।”
আজমল খান বোনকে বলেন,
“চলো আলো। ভেতরে গিয়ে কথা হবে। তোর ছেলে-মেয়েকে ডাক দে। ওরা তো সামনে এলো না।”
আলো খান তার স্বামী স্টিভেন আকবরকে বলেন,
“তোমার ছেলে-মেয়েরা কী অসামাজিক নাকি? বের হতে বলো। গাড়ির ভেতরে এতো সময় বসে থাকার মানে কী?”
“বলছি।”
স্টিভেন তার বাচ্চাদের বলে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে আসেন। আলো খান তার ছেলে-মেয়েকে মায়ের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়।
“সেরিনা, আহান, ইনি তোমাদের নানু। সালাম দেও।”
ওরা দুজনেই সালাম দিল। আয়েশা খানম বলেন,
“ওরা জমজ ভাই-বোন?”
“হ্যাঁ মা। আহান ২ মিনিটের বড়ো।”
“মাশাআল্লাহ। আসো সবাই ভেতরে আসো।”
অতঃপর সবাই বাড়ির ভেতরে গেল।
_____
দুপুর বেলা সবাই একসাথে খেতে বসেছে তখন আরহান বাড়িতে ঢোকে। আয়েশা খানম আরহানকে ডেকে বলেন,
“সেই ভোরবেলা বেরিয়ে গেছিস আর এখন এলি! কতোবার কলও করেছি। ধরিসনি। তোর ফুফি-ফুফা এসেছে। সেই ছোটো বেলায় তোর ফুফিকে দেখেছিস। তারপর আর তো দেখিসনি।”
আরহান তার ফুফি-ফুফাকে বিরস মুখে সালাম দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যেতে ধরলে, আয়েশা খানম তাকে আবারো ডাক দিয়ে বলেন,
“ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। সবাই আজ একসাথে খাচ্ছি।”
“আমার ক্ষুধা নেই দাদী। তোমরা খেয়ে নাও। ”
কথাটা বলেই আরহান উপরে চলে গেল। তা দেখে আয়েশা খানম ও আজমল খান দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তখন সেরিনা বলে ওঠে,
“হোয়াই হি সো রুড?”
“না সেরিনা। আরহান রুড না। আজ ৮/৯ দিন হলো ওর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, যাকে ও ভালোবাসে সেই মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কি*ডন্যা-প করে নিয়ে গেছে। এখনো কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাই ও…. ”
সেরিনা হুট করে খেতে খেতে এমন একটা কথা বলে ফেলল যে আয়েশা খানম ও আজমল খান বিস্মিত হয়ে গেছেন।
“হয়তো নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে। যে স্বেচ্ছায় হারায় তাকেই কেবল কোনোভাবে খোঁজ করা যায় না। তাছাড়া একজনের জন্য এতো কষ্ট পেয়ে লাভ কি! এরকম কতো ব্রেকআপ দেখেছি। চিট করে ব্রেকআপ, মিউচুয়াল ব্রেকআপ। ইটস নরমাল। তাছাড়া বিয়ে তো হয়নি। আই ডোন্ট থিংক এসব ব্যাপার নিয়েই ইমোশনাল ফুল হয়ে সেন্টি খাওয়ার কোন মানেই হয় না। লাইফ তো একটাই। জাস্ট এন্জয় ইট। বাই দা ওয়ে…”
সেরিনা কথাগুলো বলার মাঝেই তার ভাই আহান সবার আড়ালে তার হাতে চিম*টি কা*টে। সেরিনা ‘আউচ’ শব্দ করে ভাইয়ের দিকে তাকালে আহান ইশারায় থামতে বলে। আহান বলে,
“খাওয়ার সময় এত কথা বলার কিছু নেই। চুপচাপ সবাই খাও। আরহান ভাইয়া কী করবে ভাইয়া বুঝে নিবে।”
সেরিনা ও আহানের বাবা স্টিভেন বলেন,
“সবার ইমোশনের লেভেল একরকম না সেরিনা। তুমি যেমন সবকিছুকে যেমন সিম্পলি দেখো সব কিন্তু তেমন না। তুমি যেই কালচারে বড়ো হয়েছো এখানে কিন্তু তেমন কালচার না। সব কিছু ডিফারেন্ট। মানুষ ডিফারেন্ট, তাদের ইমোশন ডিফরেন্ট, মানুষের চলাফেরা ডিফারেন্ট, টোটালি সবকিছুই।”
“ড্যাড! আই জাস্ট গিভ মাই ওপিনিয়ন। এন্ড সরি ফর দ্যাট গাইজ।”
সেরিনা উঠে চলে যেতে নিলে তার মা হাত ধরে বসেন। তিনি বলেন,
“খাবারটা ফিনিশ করে উঠবে সেরিনা। তুমি এখন তোমার কানাডার বাড়িতে নেই। এখানে খাবার মাঝপথে ছেড়ে উঠে যাওয়াকে রুডনেস বলে। তুমি একটু আগে রুডনেসের ব্যাপারে বলছিলে না? তোমার এই কাজটাও কিন্তু রুড। ”
“অকেই মম।”
সেরিনা বিরক্ত হয়ে বাধ্য হয়ে খেতে বসে।
আরহান বিছানায় মাথা নিচু করে বসে কিছু ভাবছিল। আজ সে একাডেমির ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল পিঠে ব্যথার কারণে। সেখানে গিয়ে জানতে পারে তার স্কিনে কিছু একটা আছে। ঘারের কাছে এটা। ডাক্তার যখন চেক করছিল তখন খুব সূক্ষ্ণ একটা কালো চিপ স্কিনের নিচ দেখে তারপর সেটা সেখান থেকে বের করে আনে। ওটা একটা মাইক্রোচিপ। কিন্তু আরহান ভাবছে, এই মাইক্রোচিপ তার স্কিনের ভেতরে কে ইন্সটল করেছে? কোন পরিচিত ব্যক্তিই করেছে। কারণ অপরিচিত কেউ তার শরীরে মাইক্রোচিপ ইন্সটল করতে হলে সার্জারি বা তার জ*খমি অবস্থায় করবে। কিন্তু সে এমন অবস্থায় এখনও পরেনি। আরহান তার হাতের মুঠোয় মাইক্রোচিপটা দেখে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মাইক্রোচিপটার মালিকের কাছে খবর পৌঁছে গেছে, এই মাইক্রোচিপটা আরহানের স্কিনের নিচ থেকে বের করা হয়েছে। তাহলে কি মাইক্রোটার মালিক কোন অ্যাকশন নিবে? তার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই মাইক্রোচিপটার সাথে রুহানীর কোন না কোন কানেকশন ঠিক আছে!
চলবে ইনশাআল্লাহ,
আমি একটু অসুস্থ ও প্রেশারে আছি। কালকে আরেকটা পার্ট পাবেন।
আমার প্রথম বই “মেঘের আড়ালে উড়োচিঠি” প্রিঅর্ডার করুণ আপনাদের পছন্দের যেকোনো বুকশপে। রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।