#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
সকাল নাস্তা করে মীরা ইন্টারনেটে কিছু জবের সার্কুলার চেক করল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ার সবাই আজ বাড়িতে। তাইতো বেশ জমজমাট আয়োজন। বিকেলে আবার ভার্সিটির কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে মীরার দেখা করার কথা। সবাই আজ রবীন্দ্র সরোবরের ওখানে বিকেলবেলা ছবি-টবি তুলে একটা রেস্টুরেন্টে বসবে, আড্ডা দিবে। জুম্মার নামাজের পর বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ফিরলে একসাথে লাঞ্চ করার পর, বেরোনোর জন্য তৈরি হতে মীরা বেশ সুন্দর একটা কালো কটন সিল্ক শাড়ি বের করে পড়ে নিল। শাড়িটা তাকে রাইমা গিফট করেছিল। সাথে কালো পাথরের বড়ো ঝুমকো ও চুড়ি। লম্বা ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে সামনে দিয়ে ঢিলে করে এনে খোঁপা করে সেট করে নিল। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা নুড শেইডের লিপস্টিক, হালকা মেকআপের ছোঁয়ায় সাজ শেষ করে কালো পার্সটা নিয়ে মা, ভাবিদের বলে বেরিয়ে পরল। আগে থেকেই উবারে বলা ছিল। বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনের গলি পেরিয়ে রোডে উবার অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠবে তখন গলির ফুলের দোকানে সাদা গোলাপ দেখে তিনটে কিনে নিল। তারপর খোঁপায় লাগিয়ে নিজেকে ফোনের ক্যামেরায় দেখে একটা সেলফি তুলে সেটা রাইমাকে হোয়াটসআপ করে দিল।
এদিকে শেহজাদ ল্যাপটপের মধ্যে ডুবে আছে। ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্ন আগামীকাল করবে। আজকে কিছু আর্টিকেল রিসার্চ করছে। ফ্রিশা সারাদিন বাসায় থেকে থেকে বোর হয়ে বাবার কাছে এসে হাজির। আবদার করে বসল,
“বাবা, চলো না ঘুরতে যাই।”
শেহজাদ ল্যাপটপেই মুখ গুঁজে বলে,
“উহুম। তুমি দাদুমনির সাথে যাও।”
“চলো না বাবা।”
শেহজাদ নরম স্বরে বলল,
“দেখছ তো কাজ করছি।”
ফ্রিশা এবার জেদ ধরে রইল। সে যাবেই যাবে। তখন মিসেস শাহিদা রেহমান এসে বললেন,
“নিয়ে যাও না। এত কাজ করে কী হবে? মেয়েটা সপ্তাহে দুটো দিন তোমাকে কাছে পায়, তাও তুমি কাজে ডুবে থাক।”
শেহজাদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“সবসময় তো আপনি নিয়ে যান। আজকেও নিয়ে যান না।”
ফ্রিশা বলে ওঠল,
“আজ আমরা সবাই যাব। তুমি, দাদুমনি, দাদাভাই ও চাচ্চুও। ওইযে বাসার সামনে লেক আছে ওখানে।”
মিসেস শাহিদা রেহমানও বললেন,
“রাজি হয়ে যাও শেহজাদ। চলো ঘুরে আসি।”
“আচ্ছা চলুন।”
ফ্রিশা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বাবার গালে চু*মু এঁকে ছুটে তৈরি হতে গেল। শেহজাদ হালকা হেসে ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখল।
_________
রবীন্দ্র সরোবরের লেক পাড়ে বন্ধুদের সাথে ছবি তোলা ও ছবি তোলা দেখাতে ব্যস্ত মীরা। মীরার ভার্সিটি লাইফের বেস্টফ্রেন্ড জিনিয়া আজ ওর হাত ছাড়ছেই না। আড্ডা মশগুলে ঝালমুড়ি যেন আরও জমে গেছে। জিনিয়া মীরাকে বেশ কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে দিয়েছে সেই সাথে মীরাও জিনিয়াকে। গ্রুপ ছবি আরেকটু পর তোলা হবে। জিনিয়া মীরাকে নিয়ে কয়েক হাত দূরে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। জিনিয়া এরইমধ্যে বলে,
“ভাই, বিয়ে করে বড্ড ফেঁসে গেছিরে। যেখানেই যাই হাসবেন্ডটাকে সাথে করে নিতেই হবে। আজকে ওকে অনেক রিকুয়েস্ট করে রেখে এসেছি। আগের লাইফটাই ভালো ছিল না-রে?”
“তা ঠিক বলেছিস। কিন্তু ভাইয়া তো তোকে কত ভালোবাসে।”
“তোর ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে বলেই তো আমি ফেঁসে গেছি। তার ভালোবাসার সাগরে ডুবে ডুবে আজ হাবুডুবু খাচ্ছি। না হলে দেখ আমার ক্রা*শগুলো যা জোস জোস ছিল!”
মীরা হাতে আ*লতো মে*রে বলে,
“চুপ। তোর বিয়ে হয়েছে না? এসব বলবি না। এখন বলার কথা আমার কিন্তু বলছিস তুই!”
“তো বল। তোর ক্রা*শগুলাকে কি তুই ভুলে গেছিস? তারমধ্যে কিন্তু ভার্সিটির হ্যান্ডসাম শেহজাদ স্যারও ছিল! যখন উনি প্রথম প্রথম ভার্সিটি জয়েন করেছিল….!”
মীরা তৎপর হয়ে আশেপাশে চেয়ে জিনিয়ার মুখে হাত দিয়ে চে*পে বলে,
“থাম থাম! আস্তে বল। উনি বিবাহিত। একটা কিউট ডলের মত বেবিও আছে। এসব বলিস না।”
“ও তাই! তুমি যে উনার ক্লাসে বসে হাঁ করে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে!”
মীরা অস্বিকার করে বলে,
“মোটেও না। আমি পড়া বুঝতাম। উনি অনেক ভালো বুঝায়।”
“হয়েছে বুঝেছি। ওই বর্ণ ভাইয়ের পাল্লায় পরে তুমি ক্রা*শ-টাশ থেকে দূরে সরে গেছ। কিন্তু ওই লোক একটা চি*ট বের হলো।”
হুট করে মীরার মন খারাপ হয়ে গেল। সে সামনের জলরাশির দিকে দৃষ্টি সরিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল,
“বাদ দে প্লিজ। ও আমার জীবনের এক বি*ষাক্ত অতীত। যদি বুঝতাম তবে ভার্সিটির প্রায় লাস্টের দিকে এসে এভাবে ফেঁসে যেতাম না।”
জিনিয়া মীরাকে পাশ থেকে জড়িয়ে বলে,
“অতীত ভুলতে বর্তমানে কাউকেতো স্থান দে। সে তো বউ নিয়ে বেশ আছে। জাপানে এখন। জাপানে গিয়েই সেখানকার মেয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। সে তো দেড় বছরের ভালোবাসা মনে রাখেনি। তুই কেন সেটা মনে রাখবি। আগের মত ফুলে ফুলে মেতে থাক মীরা। তোকে মূর্ছিত ভালো লাগে না।”
জিনিয়ার কথা শুনে মীরা আলতো হাসলো। অতঃপর চকচকে রৌদ্রময় নীল অম্বরে চেয়ে চোখ বুজল। না তার এখন আর বর্ণের জন্য কষ্ট হয় না। কিন্তু জীবনে ঠকে যাওয়ার আফসোস হয়। হঠাৎ একটা কাগজের প্লেন এসে মীরার চোখে লাগে। মীরা আকস্মিকভাবে চোখ মেলে দেখে নিল কাগজের প্লেনটা। অদূরের লালচে বাদমী চুলে দুই ঝুটি করা এক ছোটো বাচ্চা মেয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিনিয়া তার হাসবেন্ডের সাথে চ্যাটিংয়ে হঠাৎই ব্যস্ত হয়ে পরেছে। মীরা উঠলে জিনিয়া ওর দিকে চেয়ে বলে,
“কী হলো?”
“কিছু না। তুই কথা বল।”
মীরা কাগজের প্লেনটা উঠিয়ে হাসিমুখে বাচ্চাটার কাছে যায়। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে বলে,
“কী কিউট তুমি। মাশাআল্লাহ।”
বাচ্চাটা ভয়ে ভয়ে বলে,
“সরি আন্টি। আমি ইচ্ছে করে করিনি। তুমি বকো না।”
“কে বকবে তোমাকে? এত কিউট পুতুলকে বকবে কে বলো তো?”
বাচ্চাটা খুশি হয় ভীষণ। সে মীরার গালে হাত দিয়ে বলে,
“তোমাকে ফেইরিটেলের ফেইরির মত লাগছে। ইউ আর সো প্রিটি।”
মীরা মিষ্টি হাসলো। তখনই একজন পুরুষ, বাচ্চাটির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো। এসেই বাচ্চাটিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“ফ্রিশা, তুমি একা একা এসেছ কেন? দেখছ না কত মানুষ? যদি হারিয়ে যাও?”
মীরা সামনের লোকটাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। অতঃপর চুপ করে রইল। ফ্রিশা বলল,
“রিল্যাক্স বাবা। আমি প্লেন দিয়ে খেলছিলাম। দেখো, খেলতে খেলতে এই আন্টির চোখে প্লেন লেগে গেছে।”
শেহজাদ এবার সামনের রমণীটির দিকে তাকাল। কালো শাড়িতে রমণীটিকে সে চিনে। শেহজাদ বলল,
“মীরা!”
মীরা সালাম দিয়ে হাসিমুখে বলল,
“জি স্যার।”
“ও সরি। ফ্রিশা ইনটেনশনালি করেনি।”
“ইটস ওকে স্যার। বুঝতে পেরেছি আমি।”
ফ্রিশা দুজনের মুখের দিকে চেয়ে সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“ডু ইউ নো ইচ আদার?”
তখন পেছন থেকে একজন বলে ওঠল,
“হ্যাঁ ফ্রিশা। তোমার বাবা ও এই আন্টি একে-অপরকে চেনে।”
ফ্রিশা পেছনে ঘুরে দেখে তার দাদুভাই কথাটা বলেছে। সাথে দাদুমনি ও হুইলচেয়ারে বসা চাচ্চুও এসেছে। ফ্রিশা কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
“কীভাবে?”
মীরা ওর কৌতহল মেটাতে বলে,
“তোমার বাবা ও দাদুর স্টুডেন্ট আমি।”
“ও আচ্ছা। তুমি খুব প্রিটি আন্টি। মাম্মামের পর ইউ আর অ্যা প্রিটি গার্ল।”
মীরা কথাটাকে সহজভাবেই নিল কারণ প্রতিটা সন্তানের কাছে তার মা সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু সহজভাবে নিতে পারল না শেহজাদ। সে ফ্রিশাকে তাড়া দেখিয়ে বলল,
“চলো ফ্রিশা। আন্টিকে বায় বলো।”
ফ্রিশা হালকা মন খারাপ করে বায় বলে চলে যেতেই নিবে তখনি কয়েকটা কন্ঠস্বর একত্রে ডেকে ওঠল,
“স্যার! স্যার! দাঁড়ান।”
শেহজাদ পেছনে ঘুরে দেখে চৌদ্দ-পনেরো জনের গ্রুপ তাকে ডাকছে। সবাই ছুটে এসে শেহজাদকে ঘিরে ধরে। বাহানা ছবি তুলবে। প্রথমে গ্রুপ সেলফি। সেলফিতে ড: আকবর রেহমান, তার স্ত্রী-পুত্র ও ফ্রিশাও সামিল। তারপর সবার সাথে সিঙ্গেল ছবি। মীরা একটু সরে দাঁড়ালো। হুড়োহুড়ি শেষ হলে সেও ছবি তুলবে।
মীরার পাশে এসে দাঁড়ালেন ড: আকবর রেহমান। তিনি মীরাকে শুধান,
“কেমন আছো মীরা?”
মীরা আচমকা থতমত খেয়ে যায়। তার অস্বস্তি হচ্ছে। তাও সৌজন্যতার বশে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ স্যার। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। প্রস্তাবটা ভেবে দেখলে?”
মীরা কেঁপে ওঠল। এখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য মাথা নিচু করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ড: আকবর রেহমান আবারও বললেন,
“এই ছোটো বাচ্চাটাকে দেখো। তুমি রাজি হলে ও মা পাবে। আমি জানি তুমি গতানুগতিক সৎমাদের মত হবে না।”
হকচকিয়ে চাইলো মীরা। আকস্মিক শোনা অপ্রত্যাশিত শব্দগুচ্ছ তার মস্তিষ্ক গুলিয়ে ফেলছে। মনের গহ্বরে উদিত হচ্ছে অসংখ্য প্রশ্নের বাহার। কী করবে মীরা?
চলবে ইনশাআল্লাহ,
অনেকেরই নায়ক পছন্দ হয়নি, কিন্তু আমি গল্পটা এভাবেই সাজিয়েছি। দুঃখিত।
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ। আমার প্রথম বইটি “মেঘের আড়ালে উড়োচিঠি” অর্ডার করুণ আপনাদের পছন্দের যেকোনো অনলাইন বুকশপে।