#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৯।
আজ বেশ অনেকদিন পর রাবীর আর সাদরাজ আবার মুখোমুখি হয়। একটা মিটিং এর দৌলতে তাদের এই সাক্ষাৎ। সাদরাজ আজ আর রাবীরকে দেখে কিছু বলেনি। তার রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ আজ আর প্রকাশ করেনি। রাবীরকে উপেক্ষা করে মিটিং শেষ করে সে চলে যায়। সাদরাজের এমন ঠান্ডা ব্যবহারে রাবীর অভ্যস্ত নয়। তাদের যখনই দেখা হয়েছে, সাদরাজ তো তখনই তার উপর ক্ষিপ্ত হয়েছে। আজ তবে সে এত শান্ত কেন?
রাবীর তার গাড়ির কাছে ফিরে এলে, তার পি.এ বলে,
‘স্যার, সাদরাজ আহমেদের এমন ঠান্ডা ব্যবহার কিন্তু মোটেও সুবিধার লাগছে না। নির্ঘাত উনি কোনো ফন্দি আটছেন।’
রাবীর নিশ্বাস ফেলে। বলে,
‘যাই করুক, অন্যায় করে অন্তত ও জয়ী হতে পারবে না।’
‘স্যার, আপনি কি আজকে এলাকায় বের হবেন?’
‘হ্যাঁ, বিকেলে বের হব। ইলেকশনের প্রচারনার কাজ কতটুকু হচ্ছে দেখতে হবে।’
‘ঠিক আছে, স্যার। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব।’
______________
খালা রান্না করছেন। রিতা রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে খালাকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা খালা, সাদরাজের বাবা কি আমাদের বিয়ে সম্পর্কে জানেন?’
খালা বললেন,
‘বড়ো সাহেবের অনুমতি ছাড়া তাঁর ছেলে কিছুই করেন না।’
‘ওহহ, তাহলে সবকিছু বাপ বেটা মিলেই করছেন?’
‘হ, বাপের বুদ্ধিতেই পোলা সব করে।’
‘আমার না উনার বাবার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে। একটা মানুষ এত খারাপ হয় কী করে, উনাকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম।’
‘থাক খালা, এসব কথা আপনে সাহেবের সামনে কিন্তু ভুলেও কইয়েন না। সাহেব কিন্তু খুব চেইতা যাইব।’
‘আপনার সাহেব এমনিই চেতে। উনার চেতার কোনো কারণ লাগে না।’
‘আপনি খালা সাহেবরে বশে আনতে পারতেছেন না? এত সুন্দর রূপরে কাজে লাগান না কেন?’
রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘রূপ দিয়ে মানুষকে কতক্ষণ বশে রাখা যায়। এই রূপের মোহ চলে গেলে বশের ক্ষমতাও চলে যাবে। তখন আর লাভের লাভ কিছুই হবে না।’
‘একটা কথা কমু, খালা?’
‘বলুন না।’
‘একটা বাচ্চা লইয়া লন। বাচ্চা হইলেই দেখবেন সব ঠিক হইয়া গেছে।’
রিতা হেসে বলে,
‘কী বলেন? বাচ্চা নিব? এই এতকিছুর মধ্যে বাচ্চা নেওয়ার চিন্তা তো আমি করতেই পারি না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আমি যাকে এখনো ভালোই বাসতে পারিনি তার বাচ্চা গর্ভে ধারণ করা, অসম্ভব ব্যাপার।’
খালা তখন চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,
‘তাইলে কেমনে কী করবেন? এই সামনের ইলেকশনে সাহেব আর রাবীর খানের ঝামেলা আরো বাড়ব। তহন?’
‘সেটারই তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দাঁড়ান, আমি একবার মেহুলকে কল দেই।’
রিতা তার লুকিয়ে রাখা ফোনটা এনে মেহুলকে কল দেয়। মেহুল ফোন দেখছিল। রিতার কল দেখে কল রিসিভ করে সে। মেহুল তার কাছ থেকে ঐদিকের খবরাখবর নেয়। রিতার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে। রিতা বলে, আপাতত সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তবে বেশিদিন এই পরিস্থিতি এমন থাকবে না। ইলেকশনের দিন যত আগাবে, দু পক্ষ ততই কঠিন হয়ে উঠবে। তাই আগে থেকেই তাদের সাবধান থাকতে হবে। মেহুল বলে,
‘সাদরাজ আহমেদের প্ল্যান কী, কিছু জানিস?’
‘না, আমার সামনে তো উনি এই নিয়ে কারোর সাথে কোনো আলোচনা’ই করেন না।’
‘তাহলে কী করে বুঝবি, উনি আসলে কী করতে চাইছেন।’
‘বুঝব। বোঝার জন্য আমাকে উনার কাছে যেতে হবে। যতটা সম্ভব উনার সামনে খুব নিঁখুত ভাবে অভিনয় করতে হবে, যাতে উনি কিছু টের না পান।’
‘আচ্ছা। যা করবি সাবধানে। লোকটা কিন্তু খুব চালাক। তাই প্লিজ, বি কেয়ারফুল।’
‘আরে চিন্তা করিস না, আমি সব সামলে নিতে পারব। আমাদের এখন যেভাবেই হোক ঐ শাহাদাত আহমেদকে ধরতে হবে। উনার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে।’
‘একটা মুখ্যম প্রমাণ তো আছেই, খালা।’
রিতা খালার দিকে তাকায়। খালাও তার দিকে চেয়ে আছে। সে বলে,
‘হ্যাঁ। তবে, এই প্রমাণের জন্য আমাদের অনেক খাটতে হবে।’
‘তা তো খাটতে হবেই। খালা তো আর এমনি এমনি কিছু বলবেন না।’
খালা তখন হুট করেই বলে উঠলেন,
‘খালা, ফোন রাখেন। গাড়ির শব্দ শোনা গেছে। সাহেব মনে হয় আইছেন।’
রিতা তাড়াহুড়ো করে মেহুলকে বলল,
‘আচ্ছা মেহুল, রাখি। পরে আবার কল দিব।’
রিতা তাড়াতাড়ি কল কেটে ভাবছে, ফোনটা কোথায় রাখবে। পরে সে তাড়াতাড়ি খুঁজে রান্নাঘরের চালের ড্রামের ভেতর সেটা রেখে দিল।
সত্যিই সাদরাজ এসেছে। সে কখনো মেইন দরজায় নক করে না। ডিরেক্ট চাবি দিয়ে বাইরে থেকে লক খুলে ঢোকে। আজও তাই করে। সে এসে ড্রয়িং রুমে বসে। খালাকে ডেকে বলে, ঠান্ডা পানি দিতে। রিতা বরাবরের মতো তার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে যায়। রিতাকে দেখে সাদরাজ বলে,
‘তোমাকে না এসব করতে বারণ করেছি।’
রিতা তার সামনের শরবতের গ্লাসটা রেখে বলে,
‘কেন, এখনো কি আমার উপর বিশ্বাস আসেনি? শরবতে কিছু মেশাইনি। খেতে পারেন।’
সাদরাজ কিছু বলে না। তবে তার চোখে মুখে বিরক্ত স্পষ্ট। রিতার এই আগ বাড়িয়ে নরম ব্যবহার তার একদম পছন্দ হচ্ছে না। সে জানে, এই মেয়ে এত সহজ না। উপর দিয়ে যা প্রকাশ করছে, মোটেও সে তেমন না।
সাদরাজ শরবত শেষ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে। গরমে গায়ের পাঞ্জাবীটা ভিজে আছে তার। চোখ মুখ দেখে ক্লান্ত লাগছে। রিতা মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘মাথা টিপে দিব?’
সাদরাজ বিরক্ত সুরে বলে,
‘আমি বলেছি?’
‘না, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে মাথাটা টিপে দিলে একটু আরাম পাবেন, তাই…’
‘আমাকে নিয়ে তোমার এত ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজেকে নিয়ে ভাবো। সামনে তোমার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে। তাই আগে থেকেই সে সবের প্রস্তুতি নাও।’
রিতা তখন মৃদু হাসে। বলে,
‘হ্যাঁ, আমি জানি তো। সামনে আপনার ইলেকশন। আর সেই ইলেকশনে আপনি জিতবেন। আর সবাই তখন আমাকে নেতার বউ বলবে। আর এই কথাটা শোনার জন্য তো আমি এখন থেকেই প্রস্তুত।’
সাদরাজ এবার উঠে বসে। রিতার দিকে কপাল কুঁচকে চেয়ে বলে,
‘মাথায় কী চলছে তোমার? আমার সাথে চালাকি করতে এসো না, রিতা। আমার সাথে তুমি পেরে উঠবে না।’
রিতা জোরে নিশ্বাস ফেলে সাদরাজের পাশে বসে। সাদরাজের দিকে চেয়ে বলে,
‘আপনার সাথে লাগার সাহস আমার নেই। আমি তো শুধু একটা সুন্দর সম্পর্ক চাই। বিয়ে যখন হয়েছে, তখন সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিন না। এত রাগ, এত জেদ আর আক্ষেপ দেখিয়ে কী লাভ? কী পাবেন? একটু ক্ষমতা, যেটা আবার ক্ষণস্থায়ী। তাহলে এই ক্ষণস্থায়ী জিনিসের জন্য এত কেন কষ্ট? দরকার কী। জীবনকে সহজ চোখে দেখুন। দেখবেন, সবকিছু কত সুন্দর।’
সাদরাজ সামনের গ্লাসটা দূরে ছুড়ে মারে। সেটা এক নিমিষেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। সাদরাজের এমন কান্ডে রিতা হতভম্ব। সাদরাজ তার দিকে চেয়ে বলে,
‘যাও, ঐ গ্লাসটা আবার জোড়া লাগিয়ে নিয়ে এসো। তারপর আমি তোমার সব কথা মেনে নিব।’
রিতা কী বলবে বুঝে না। সাদরাজ বলে,
‘কী হলো, পারবে না? তাহলে আমিও পারব না। আমার থেকে যে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে তাকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারব না।’
‘আপনার থেকে কে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে?’
সাদরাজ দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়,
‘রাবীর খান।’
রিতা বলে,
‘আমি যদি বলি, না, রাবীর খান কিছু কেড়ে নেয়নি।’
সাদরাজ বাঁকা হাসে। বলে,
‘তা তো তুমি বলবেই। উনি তো আবার তোমার বেস্টফ্রেন্ডের হাসবেন্ড।’
‘অন্যায় যে করবে, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। আর সে হোক,আমার বেস্টফ্রেন্ডের হাজবেন্ড অথবা আমার হাজবেন্ড। শাস্তি সবার জন্য সমান।’
সাদরাজ উঠে দাঁড়ায়। কর্কশ স্বরে বলে,
‘তুমি যেটা জানো না, সেটা নিয়ে কথা বলতে এসো না।’
রিতা তখন শক্ত গলায় বলে উঠে,
‘আপনার মা’কে রাবীর খান মারেননি।’
সাদরাজ থমকে দাঁড়ায়। রিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘তুমি এসব কী করে জানলে?’
চলবে….