#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব
#নাফিসা নীলয়া!
নীরা একইভাবে মাথা ধরে বসে আছে। কিন্তু অনেকক্ষন যাবত সে শিহাবের কোনো সারাশব্দ পাচ্ছে না। সেজন্য নীরা মাথা উচু করে দেখলো শিহাব কাউকে ফোন না করে তার সামনে বসে একধ্যানে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা তাকানোর পরও শিহাব একইভাবে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষন পর শিহাব কথা বলে উঠলো।
-আমাকে বিশ্বাস করো না?
শিহাবের এই প্রশ্নের উওরে নীরা কিছুই বলতে পারলো না। নীরার নীরবতা শিহাবকে আরো রাগিয়ে তুলছে। সে রেগে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
-বুঝেছি বিশ্বাস করো না। কেন করো না?
নীরার এখন সব এলোমেলো লাগছে। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে তার মাথায় এখনো ঢুকছে না।
-তুমি এখন চুপচাপ কেন? বলো কথা বলো।
শিহাবের ধমকানো শুনে নীরা কথা বলে উঠলো।
-তিশার কথাটা কি তুমি আমাকে আগে জানাতে পারতে না? তোমার কি উচিত ছিলো না আমাকে জানানো?
নীরার কথা শুনে শিহাবের কাছে সবই পরিষ্কার হয়ে গেছে। সে এবার নরম স্বরে বললো।
-আমি ক্লিয়ার করি। আমার মা তিশার কথা বলেছিলেন বাবাকে। বাবা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন তিশাকে আমি বিয়ে করতে চাই কিনা। আমি তখন সোজা না করে দিয়েছি। তখনই তোমার কথা বাবাকে জানিয়েছি। নীরা তিশাকে আমি কখনোই ওভাবে দেখিনি। ও আমাদের কাজিন এর চেয়ে বেশি কিছু কখনোই ছিলো না। আমার কাছে আমার মায়ের কথার গুরুত্ব নেই। বাবা আমার কাছ থেকে জাস্ট জানতে চেয়েছেন আমিও আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। দ্যাট্স ইট। এটাকে বিয়ে ঠিক হওয়া বলে না।
-মিথ্যা কথা বলবে না। তোমাদের বিয়ের কথা অনেক আগে থেকেই চলছিলো। তোমাদের মধ্যে আন্ডার্সট্যান্ডিং ও ভালো ছিলো। এজন্যই সবাই তোমাদের বিয়ের কথা ভেবেছে তাই না?
নীরার কথা শুনে শিহাবের এখন ইচ্ছে করছে নীরাকেই ঠাস করে চড় মারতে। আজব মেয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই ব্লেম করা শুরু করেছে।
-অনেক আগে থেকে চলছিলো না। ইভেন মা বাবাকে কয়দিন আগে জানায় এর আগে বাবাও কখনো তিশাকে নিয়ে ভাবেননি। আমার মায়ের একটা ভুল ধারনা ছিলো। যে আমি ওনার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করবো। কিন্তু সেই ধারনাটা শতভাগ ভুল।
নীরা চুপচাপ বসে আছে। শিহাব নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে না। আবার জায়মা আর তিশার কথাও নীরা হালকাভাবে নিতে পারছে না। দোটানায় পরে গেছে সে। শিহাব নীরার দ্বিধান্বিত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার কষ্ট হচ্ছে নীরা এখনো তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করছে না। সে বিষন্ন গলায় বললো।
-তোমার দ্বিধান্বিত মুখ আমার বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
নীরা মুখ তুলে শিহাবের চোখের দিকে তাকালো ওই চোখে এখন বিষন্নতা রয়েছে। শিহাব উঠে গেল বসা থেকে তারপর বললো।
-কাল বাবাসহ সবাই আসবেন আমাদের বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে। আমি চাইলে আজই তোমাকে জোর করে বিয়ে করতে পারতাম কিন্তু আমি সেটা করলাম না। কেন জানো? থাক তুমি তো জানতেই চাও না। তবে এটাও ভেবো না যে তোমাকে কখনো ছাড়বো। কখনো না। আসি।
শিহাব আর কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে গেল। নীরা ওভাবেই বসে রইলো।
শিহাব নীরাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সাইফের ক্যাফের দিকে গেল। তার সবকিছু জানা দরকার। শিহাব জানে নীরা এখন তাকে কিছুই বলবে না। সাইফ আর রুমা যেহেতু নীরার বেস্টফ্রেন্ড সেক্ষেত্রে কিছু না কিছু তো ওদের দুজনের একজন জানতেই পারে। এটা ভেবেই শিহাব সাইফের কাছে যাচ্ছে। শিহাবের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তিশা না জানি আরো কি কি বলেছে নীরাকে। আর নীরাও সেসব হয়তো বিশ্বাস করেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই সে সাইফের ক্যাফেতে এসে পরলো।
সাইফ খাবারের কোয়ালিটি নিয়ে শেফদের সাথে কথা বলছিলো। তখনই তার ম্যানেজার এসে জানালো শিহাব তার জন্য অপেক্ষা করছে। শিহাব প্রায়ই সময় পেলে সাইফের সাথে দেখা করতে আসে। সাইফও মাঝে মাঝে শিহাবের সাথে দেখা করতে যায়। এজন্য সাইফ তাড়াতাড়ি কিচেন থেকে বেড়িয়ে গেল শিহাবের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে।
শিহাব অস্থির হয়ে বসে আছে সাইফের অপেক্ষায়। সাইফ এসে দেখলো শিহাব বসে আছে তার জন্য। সে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলা শুরু করলো।
-আরে শিহাব ভাই হোয়াটস আপ? অনেকদিন পর। নীরার কাছে শুনেছিলাম তুমি রাজশাহীতে আছো। কবে ফিরলে?
শিহাব উঠে এসে সাইফকে হাগ করলো। তারপর সাইফকে বললো।
-এইতো আজকেই। তোমার সাথে কিছু কথা আছে। এজন্যই আসা।
সাইফ বসতে বসতে বললো।
-হ্যা বলো। তার আগে বলো কি খাবে?
-কিছু না ব্যস্ত হতে হবে না সাইফ। যেজন্য এসেছি মেইস পয়েন্টে আসি। নীরা কয়েকদিন ধরে ডিস্টার্ব। তুমি নিশ্চয়ই জেনে থাকবে। ইভেন তোমার বন্ধু আমাকে এই কয়দিন অনেক ইগনোর করেছে। আমার ফোনকল্স এটেন্ড করেনি। মেসেজেসের জবাব দেয়নি। তোমাদের সাথেও কি ও এরকমই ছিলো? আই মিন ওর ডিস্টার্বনেসের কারনটা কি?
শিহাবের কথা শুনে সাইফ একটু অবাক হলো। সাইফ ভেবেছিলো ওর বোঝানোর পর হয়তো নীরা বুঝেছে। ওসব নিয়ে হয়তো দ্বিতীয় বার ভাবেনি। কিন্তু শিহাবের কথা শুনে মনে হচ্ছে নীরা বোঝেনি। তবে ওর ভেতরকার হতাশাটাও ও সেদিনের পরে কারো কাছে প্রকাশ করেনি। এখন শিহাবের কথা শুনে সাইফ নিজেই খুব হতাশ হলো। শিহাব আবারও বলে উঠলো।
-এখন প্লিজ না বলবে না। আমি জানি রুমা আর তুমি নীরার জন্য কি। নীরা মিলাকেও সেসব বলে না যেসব তোমাদের বলে জাস্ট বিকজ মিলা দুঃশ্চিন্তা করবে বলে।
-ও আমাদের কাছেও সব বলে না শিহাব ভাই। নীরা এমনই নিজের সমস্যার কথা কাউকে জানায় না। কাউকে ইনভল্ভ করতে চায় না। তবে হ্যা মাঝে মাঝে কোনোকিছু নিয়ে খুব হতাশ হয়ে গেলে আমার কাছে টুকটাক শেয়ার করে। সেদিনও খুব ডিস্টার্ব হয়ে আমার কাছে এসেছিলো। ও আবারও হীনমন্যতায় ভুগছে শিহাব ভাই। ও আমাকে সেদিন কি বলেছে জানো? কখনো যদি তোমার ওকে নিয়ে আফসোস তৈরি হয়। কখনো যদি মনে হয় ইউ ডিজার্ভ বেটার? তুমি নিশ্চয়ই একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়েকে ডিজার্ভ করো। ওর মাথায় এসবই ঘুরছিলো। তারপর আমি ওকে বারবার এসিউর করলাম ভেবেছি কাজ হয়েছে। কিন্তু আজ তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওর মনে এখনো এসবই রয়ে গেছে। আই ডোন্ট নো ও এখনো এসব কেন ভাবছে। ও তো তোমার মায়ের সাথেও দেখা করেছে সেদিন। তারপরও এসব কিভাবে ভাবলো আমার মাথায় আসছে না।
সাইফের সব কথা শুনে শিহাব থমকে গেল। আর কিছু জানার প্রয়োজান নেই বোধ হয়। সে সাইফকে থামিয়ে দিলো।
-নীরার মাথার ভূত আমিই নামাবো সাইফ টেনশন করো না। সব ঠিক হবে এখন আসছি আমি।
-আরে কিছুই তো খেলে না?
-আবার পরে আসবো। বন্ধুর বিয়ের আয়োজন করো। খুব শিঘ্রই তোমার বন্ধু কম বোনের বিয়ে হতে যাচ্ছে।
শিহাবের কথা শুনে সাইফ হেসে ফেললো। শিহাব সাইফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে দিতে জায়মাকে ফোন করলো।
জায়মা আপনমনে বসে বসে বই পড়ছিলেন। তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। তিনি ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন শিহাব ফোন করেছে। শিহাবের ফোন নাম্বারটা তার ফোনে সেভ করাই আছে। কিন্তু কখনোই শিহাব তাকে ফোন দেয় না। কখনোই না। আজ দিলো বলে তিনি প্রচন্ড অবাক হলেন। অবাকের ধাপ কাটিয়ে তিনি ফোন রিসিভ করলেন।
-শিহাব এতোদিন পর মায়ের কথা মনে পরলো? এতোদিন কি বলছি তুমি তো আমাকে কখনো ফোনই করো না। আমি খুব খুশি হয়েছি বাবা।
-আপনি এখন আমাদের বাড়িতে আসতে পারবেন?
শিহাবের প্রশ্ন শুনে জায়মা যারপরানই অবাক হলেন।
-মানে?
-মানে আমাদের বাড়িতে আসুন। সেখানেই সব কথা হবে।
-আচ্ছা আসবো।
-তাড়াতাড়ি আসবেন।
বলেই শিহাব ফোন কেটে দিলো। জায়মা ভেবে চলেছেন শিহাব কেন তাকে ওই বাড়িতে যেতে বললো। কিন্তু এর কোনো যুক্তিযুক্ত কারন তিনি খুঁজে পেলেন না। আবার ভাবলেন নীরার বিষয়টা নিয়ে কিছু হয়নি তো। এটা ভেবেই তার ভয় লাগলো। তবুও তিনি মনকে শান্ত করলেন। আজ যদি সেরকম কিছু হয়েই থাকে তবে তিনি শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলেকে বোঝাবেন।
মিলা মালিহা আর নূরজাহান বেগম বাড়িতে এসে দেখলেন দরজা খোলা। আর নীরা চুপচাপ বসে আছে। মালিহা অবাক হয়ে গেলেন সাধারণত নীরা দরজা খুলে বসে থাকে না। আর বাড়িতে কেউ না থাকলে তো এরকম করেই না। মিলাও অবাক হয়েছে। মালিহা ভেতরে ঢুকে নীরাকে জিজ্ঞেস করলেন।
-কিরে এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন? কি হয়েছে?
মালিহার কথার আওয়াজ শুনে নীরা ধড়ফড়িয়ে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো সবাই এসে গেছে। আর তারই কোনো খেয়াল নেই। সে উঠে দাড়ালো। নূরজাহান বেগম বিষয়টা তেমন আমলে নিলেন না তিনি বললেন।
-আমি ঘরে যাচ্ছি বউমা। আমার একটু বিশ্রামের দরকার।
নূরজাহান বেগমের কথায় মালিহা সায় জানালেন।
-হ্যা আম্মা আপনি ভেতরে যান।
তারপর মিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
-তুইও যা গিয়ে ফ্রেশ হ।
নূরজাহান বেগম ঘরে চলে গেলেও মিলা ঠায় দাড়িয়ে রইলো। তার আপার থমথমে চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু হয়েছে। আর সেটা না জানা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। মিলাকে ঠায় দাড়ানো দেখে মালিহা আবার বললেন।
-কিরে যা ঘরে যা। আর নীরা কি হয়েছে তোর? এভাবে দরজা খুলে তো কখনো বসে থাকিস না। কি হয়েছে?
মালিহার ক্রমাগত প্রশ্নে নীরা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। মেকি হেসে মাকে আশ্বস্ত করলো।
-কিছুই হয়নি আম্মা ভালো লাগছিলো না। তাই তোমাদের অপেক্ষায় দরজা খুলে বসে ছিলাম।
নীরার কথা মালিহা আর মিলার বিশ্বাস হলো না। কারন নীরা মুখটাই কেমন যেনো হয়ে আছে। নীরা দেখলো মালিহা আর মিলা দুজনেই তার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এজন্য সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো।
-আরে তোমরা কতদূর থেকে এসেছো দাড়িয়ে আছো কেন? যাও না ফ্রেশ হও। আমি ঠিক আছি শুধু শুধু এতো প্রশ্ন করছো।
কথা শেষ করেই নীরা নিজের ঘরের দিকে গেল। মালিহা মিলার দিকে তাকালেন। মিলা কাধ ঝাঁকিয়ে বুঝালো সে ও বুঝতে পারলো না কিছু। মালিহা মিলাকে বললেন।
-তুই যা তো তোর আপার কাছে। গিয়ে দেখ ওর চোখ মুখের এমন অবস্থা কেন।
মালিহার কথা শুনে মিলা তৎক্ষনাত বললো।
-হ্যা আম্মা এখনই যাচ্ছি।
মালিহা ভাবলেন মিলা নিশ্চয়ই বের করতে পারবে নীরার কি হয়েছে। এজন্য তিনি নিশ্চিন্ত মনে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
মিলা নীরার ঘরে ঢুকে দেখলো নীরা কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। সে নীরার কপালে হাত দিলো। নীরা উঠে বসে বললো।
-আমার কিচ্ছু হয়নি মিলা। যা ফ্রেশ হ। এতো চিন্তিত হতে হবে না।
-তুমি আমাকে বোঝাচ্ছো আপা? তোমার চোখ মুখের অবস্থা দেখে যে কেউ বলে দিবে তুমি ঠিক নেই।
মিলার কথা শুনে নীরা চুপ করে রইলো। মিলা আবারও বললো।
-বলো না কি হয়েছে তোমার?
-মিলা তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি আমার। আই এম ওকে। শুধু শুধু চিন্তা করছিস।
-তাহলে তুমি বলবে না কি হয়েছে?
মিলার এতো কথা শুনে এবার নীরা রেগে গেল। মিলাকে ধমকে বলে উঠলো।
-বলেছি তো কিছু হয়নি। বারবার একই প্রশ্ন কেন করছিস। বেয়াদব মেয়ে। যা নিজের ঘরে যা আমাকে একদম বিরক্ত করবি না। এখনই যাবি যা।
নীরা ধমক শুনে মিলা কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। তার আপা কি জানে না তার আপার একটু বকাও মিলা সহ্য করতে পারে না তবুও এভাবে ধমক দিলো। সেদিনও রাস্তায় এভাবেই বকেছিলো ভেবেই মিলার কষ্ট লাগলো। সে আর কিছু না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
নীরা খুব জোরে ধমক দিয়েছে মিলাকে যা মালিহাও ঘর থেকে শুনতে পেয়েছেন। তিনি নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখলেন মিলা মুখ গোমড়া করে ড্রয়িংরুমে এসে বসেছে। মালিহা এগিয়ে এসে মিলাকে জিজ্ঞেস করলেন।
-নীরা এভাবে তোকে ধমক দিলো কেন? ও তো এরকম করে না কি হয়েছে মিলা?
-আমি জানি না আম্মা। আপার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করাতে আমাকে ধমকে বের হয়ে যেতে বললো।
মিলার কথা শুনে মালিহা নিজেও অবাক হয়ে গেলেন। তিনি নীরার ঘরের দিকে গেলেন। দরজার নব ঘুরালেন দেখলেন ভেতর থেকে লক করা।
-নীরা দরজা বন্ধ করেছিস কেন? আর মিলাকেই বা বকলি কেন? দরজা খোল মা।
নীরার এখন প্রচন্ড মাথা ধরেছে সে দরজা বন্ধ করে আবার শুয়েছে। তাই সে বললো।
-আম্মা আমার একটু মাথা ধরেছে। আমি এখন একটু ঘুমাবো। তোমরা শুধু শুধু চিন্তা করো না।
নীরার এই কথার পৃষ্ঠে মালিহা আর কিছু বললেন না। তিনি তার মেয়েকে বোঝেন। নিশ্চয়ই এখন নীরা একা থাকতে চাইছে এজন্যই দরজা বন্ধ করেছে। যা হয়েছে তা পরেও জানা যাবে। নীরা তার খুব ভালো বাধ্যগত মেয়ে। নিজের ও পরিবারের খেয়াল রাখতে পারে। এখন নিশ্চয়ই কোনো স্ট্রেসে আছে যা কারো কাছে শেয়ার করতে চাইছে না। তিনি জানেন তার মেয়ে নিজের সমস্যায় কাউকে ইনভল্ভ করে না। সেজন্যই এমন করছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে ভেবেই তিনি সরে আসলেন। এসে দেখলেন মিলা মুখ মলিন করে বসে আছে। মিলার মুখ মলিন দেখে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মালিহা নিজে বকলে মারলেও মিলা এতো কষ্ট পায় না। যতোটা নীরার সামান্য ধমকে কষ্ট পায়। তিনি এগিয়ে গিয়ে মিলার মাথায় হাত বুলালেন। মিলা মাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো।
-আপার কি হয়েছে আম্মা?
-হয়তো কোনো স্ট্রেসে আছে। ঠিক হয়ে যাবে। এখন ওকে বিরক্ত না করাই ঠিক হবে। তুই আর মন খারাপ করে থাকিস না মিলা। একটু পরে দেখবি নীরা নিজে তোর ঘরে এসে তোকে স্যরি বলবে। তোকে ধমক দিলে তো ও নিজেই কষ্ট পায়।
মালিহার কথা শুনে মিলা আর কিছু বললো না। চুপচাপ রইলো।
শিহাব বাড়িতে এসে চুপচাপ বসে রইলো। তিতলি আর রেহান দুজনে ইতিমধ্যে অনেক প্রশ্ন করে ফেলেছে কিন্তু শিহাব ঠিকঠাক জবাব দেয়নি। তিতলি আর রেহান দুজন এখন চুপচাপ শিহাবকে পর্যবেক্ষন করছে। কিন্তু শিহাবের কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। সে নির্বিকার ভাবে বসে আছে। অনেকক্ষন পর সে তিতলিকে বললো।
-বাবাকে বাড়িতে আসতে বলেছিলি?
শিহাবের প্রশ্ন শুনে তিতলি মাথা নাড়লো।
-হ্যা তুই এসে বলার পরপরই তো ফোন করে বলেছি জলদি আসতে।
ওরা কথা বলতে বলতেই রেজা সাহেব বাড়িতে পৌছে গেলেন। ভেতরে ঢুকে দেখলেন পরিবেশ কেমন থমথমে। তিনি গিয়েছিলেন তার বন্ধুদের সাথে মিট আপে। তিতলির ফোন করে জরুরি তলব শুনেই তাড়াহুড়ো করে এসেছেন তিনি। আর বাড়িতে ঢুকেই তিনি দেখলেন পরিবেশ থমথমে। এরকম কখনো থাকে না। তিন ভাই বোন বাড়িতে থাকলে বাড়ি মাতিয়ে রাখে। বিশেষ করে তিতলি আর রেহান সবসময় ঝগড়া করতেই থাকে। এতে তিনি একটু অবাকই হলেন। রেজা সাহেবকে দেখে তিতলি বলে উঠলো।
-ভাই বাবা এসে গেছে।
তিতলির কথা শুনে শিহাব দেখলো রেজা সাহেব এসে গেছেন। রেজা সাহেব এগিয়ে এসে বসলেন। তারপর শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
-আজই এসেছো। আগে বলোনি তো। আর কি এমন জরুরি কাজ যে আমাকে এতো তাড়া দিয়ে নিয়ে এলে।
-দরকার আছে। আরেকটু অপেক্ষা করো। তারপরেই বুঝতে পারবে।
শিহাবের কথা শুনে কেউ কিছুই বুঝতে পারলো না। রেহান এসবের থেকে উঠে গিয়ে রান্নাঘরে গেল। রান্নাঘরে জহুরা কাজ করছিলেন। রেহান গিয়ে ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে খেতে খেতে জহুরাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-ভাইয়ের কি হয়েছে বলো তো? এমন রেগে আছে কেন?
রেহানের কথা শুনে জহুরাও চিন্তিত গলায় বললেন।
-আমিও তো বুঝতে পারছি না। ওর কি হয়েছে। তোরা জিজ্ঞেস করিসনি?
-আল্লাহ জিজ্ঞেস করিনি আবার। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু কোনো কিছুই বললো না। বোম্ব হয়ে আছে। না জানি কি হয়েছে!
-কি খাবি আজকে তোরা?
-খালা আগে ভাইয়ের কাহিনী দেখে নেই। তারপর বলবো। ভীষণ রেগে আছে। সেই রাগে কাকে ভস্ম করবে কে জানে।
রেহান জহুরার সাথে কথা বলতে বলতেই গাড়ির হর্ন শুনতে পেলো। তারপর জহুরার হাত থেকে ছুড়ি নিয়ে বললো।
-রাখো তোমার কাজ ভাই আবার কাকে ডেকেছে কে জানে চলো দেখে আসি।
বলেই জহুরাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল রেহান।
জায়মা বাড়িতে ঢোকার পর উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল। জায়মার উপস্থিতি এখন কেউই আশা করেনি। তিতলি জায়মাকে দেখেই রেগে গেল। রেহান এসে জায়মাকে দেখে একটা হাসি দিলো। এগিয়ে এসে বললো।
-মা কেমন আছো?
জায়মা হালকা হেসে বললেন।
-ভালো আছি তুমি কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ।
রেজা সাহেব অবাক হয়ে শিহাবের দিকে তাকালেন। শিহাব বললো।
-আমিই ডেকেছি।
তারপর জহুরাকে উদ্দেশ্য করে বললো
-খালা তিশা আর খালামনিকে ডেকে নিয়ে এসো। এতোক্ষন হয়ে গেল ওরা ঘরে কি করছে!
শিহাবের কথা শুনে জহুরা তিশাদের ডাকতে গেলেন।
রেহান জায়মাকে বসতে বললো। জায়মা বসলেন। তিশা আর আসমাও ততোক্ষনে এসে গেছে। তিশা আর আসমা জায়মাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। জায়মা মনে মনে অনেককিছুই ভাবছেন। তবে সবার সামনে স্বাভাবিক থাকছেন।
শিহাব এক পলক সবার দিকে তাকালো তারপর তিতলি আর রেহানকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-মাকে তোমরা ভালোবাসো?
তিতলি আর রেহান একে অপরের দিকে তাকালো। কিন্তু কিছুই বুঝলো না। নীরব রইলো। শিহাব ওদের নীরবতা দেখে ধমকে উঠলো।
-আন্সার মি!
তিতলি আর রেহান মাথা নাড়লো। তারমানে বাসে।
রেজা সাহেব জায়মা তিশাসহ সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শিহাবের দিকে। শিহাব আবার বললো।
-কেন বাসো? যেই মহিলা নিজের স্বার্থের জন্য তোমাদের কথা ভুলে নিজের এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে তাকে কেন ভালোবাসো?
তিতলি আর রেহান এই কথার কোনো জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে রইলো। জায়মা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আজ পর্যন্ত শিহাব তাকে এভাবে বলেনি। কখনোই না। মনে রাগ দুঃখ ঘৃণা থাকলেও এসব কথা তাকে শিহাবের থেকে কখনোই শুনতে হয়নি।
-মা যাওয়ার পর সবসময় তোদের খেয়াল কে রেখেছে?
তিতলি ইতিমধ্যে কেঁদে দিয়েছে। সে এখন হিচঁকি তুলে কাঁদছে। রেহানের আর রেজা সাহেবের চোখ ও ছলছল করছে। রেহান আর তিতলি একসাথে শিহাবকে বললো।
-তুমি ভাই।
-তাহলে আজ এখন তোরা ঠিক কর। তোদের কাছে আমি বড় না তোদের সো কল্ড মা বড়?
জায়মার গাল বেয়ে পানি পরছে। এই দিনও তার দেখতে হলো। তিশা ইতিমধ্যে বুঝে গেছে শিহাবের রাগের কারন। সে কিছু বলেও পারছে না এখন। শিহাব সবাইকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে উঠলো।
-এই মহিলা আমাদের ছেড়ে রাতের আধারে তার প্রাক্তনের সাথে পালিয়ে গেছে। স্বার্থপরের মতো। তার ভাষায় আমার বাবার সংসারে ও বাবার প্রতি তার বিতৃষ্ণা এসে গেছিলো। এজন্যই সুখের খোঁজে সে পালিয়েছে। এরপরের গল্পটা কি সবাই জানে? এরপরের গল্পটা হচ্ছে আমি আর রেহান বাইরে গেলে স্কুলে গেলে রিলেটিভদের বাড়িতে গেলে বেড়াতে গেলে সবজায়গায় আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। সবাই আমাদের জিজ্ঞেস করতো আমাদের মা কার সাথে পালিয়েছে। আমরা কিছু দেখেছি কিনা। কোনো বাইরের লোক বাবার অনুপস্থিতিতে বাড়িতে আসতো কিনা। আরো জঘণ্য সব কথা শুনতে হতো আমাদের। আর তিতলি? ও তো দুধের শিশু ছিলো। যেদিন এই মহিলা চলে গেল সেদিনের পর তিতলি মায়ের দুধের অভাবে কাঁদতো। গলা ফাটিয়ে কাঁদতো। আমি আর রেহান তখন কিছুই বুঝতাম না। বুঝতাম না আমাদের পুতুলের মতো ছোট্ট বোন কেন এতো কাঁদে! বুঝতাম না আমরা। পরে যখন বুঝলাম ও খিদের চোটে কাঁদে তখন ওকে এমনি দুধ খাওয়াতাম। ওতে কি ওর পেট ভরে। ওটুকু বাচ্চা মায়ের দুধ ছাড়া কি কিছু খেতে পারে! আর আমাদের বাবা এই মহিলাকে এতো ভালোবাসতেন যে শোকে পাথর হয়ে গেছিলেন। আমাদের প্রতি তার কোনো খেয়ালই ছিলো না। এতোকিছুর পরও বাবা এই মহিলার প্রতি কোনো অভিযোগ করেননি। বিনাবাক্য ব্যয়ে মুক্তি দিয়েছেন। তারপর আমাদের খেয়ালই রাখেননি। তখন আমি তোদের দেখেছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের খেয়াল রেখেছি। বাবা তার কয়েকটা মাস পর জহুরা খালাকে নিয়ে এসে বললেন এখন থেকে উনিই আমাদের দেখে রাখবেন। খালার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। সেসময় খালা না এলে আমি আমার ভাই-বোনদের ভালোভাবে দেখভাল করতে পারতাম না।
একসাথে এতো কথা বলে থামলো শিহাব। তার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে কথাগুলো বলছে শক্ত কন্ঠে। রেজা সাহেব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিতলি কাঁদছে রেহানকে জড়িয়ে ধরে। জায়মা মাথা নিচু করে আছেন। শিহাব আবার তিতলি আর রেহানকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-আমি স্কুল থেকে এসেই তোদের খাইয়ে দিতাম নিজ হাতে। জহুরা খালার কাছে তোরা খেতে চাইতিস না। বলতিস ভাই না খাইয়ে দিলে খাবি না। আমি তোদের এই আনাড়ি হাতে খাইয়েছি, গোসল করিয়েছি,পড়িয়েছি,যত্ন করেছি। ভালোভাবে বড় করেছি। আমার এই ভালোবাসা,ত্যাগ যদি তোদের কাছে মনে থাকে তাহলে আজকের পর থেকে তোরা এই মহিলার সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগ করবি না। অনেক হয়েছে। আমি কখনো বাঁধা দেইনি। ওনার যখন মনে হয়েছে তোদের সাথে দেখা করেছেন। যখন মনে হয়েছে তোদের কাছে এসেছেন। যখন মনে হয়েছে দূরে ছুড়ে ফেলেছেন। আমি কিছুই বলিনি। তবে আজ বলছি। আমি তোদের না করলাম। এরকম মহিলা কখনো কারো মা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তোরা ওনার সাথে যোগাযোগ রাখবি না।
তিতলি আর রেহান দুজনেই এসে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-রাখবো না। আমাদের কাছে আমাদের ভাই বড়। যেই ভাই আমাদের জন্য এতোকিছু করেছে তার কথা আমরা কখনোই অমান্য করবো না। আমরা আমাদের ভাইকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
তিতলি আর রেহানের কথা শুনে জায়মা সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেললেন। এতোক্ষন তিনি বহু কষ্টে নিজের কান্না আটকে রেখেছিলেন। এখন সম্ভব হচ্ছে না। জায়মা কাঁদতে কাঁদতে শিহাবের কাছে মিনতি করলেন।
-এতো বড় শাস্তি আমাকে দিয়ো না বাবা। দিয়ো না। আমার সন্তানদের কাছ থেকে আমাকে আলাদা করো না।
জায়মার বলা কথা শুনে শিহাব শান্তভাবে বললো।
-আপনি কবে আপনার সন্তানদের কাছে ছিলেন? যে আজ আলাদা হবেন?
শিহাব এবার উঠে তিশার সামনে আসলো। তিশা ভড়কে গেল। তিশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শিহাব তিশাকে জোরেসোরে চড় মারলো। এতে তিশা ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পরে গেল। আসমা হতভম্ব হয়ে বললেন।
-আমার মেয়েকে কেন মারলে তুমি?
-কারন আপনার মেয়ে আমার ভালোবাসাকে কষ্ট দিয়েছে। শুনে দেখুন ওর কাছে। ও আর এই মহিলা মিলে নীরাকে কি বলেছে! শুনে দেখুন।
জায়মা কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতেই চিৎকার করে বললেন।
-শিহাব ওই মেয়ে তোমার যোগ্য না। এটাই বুঝিয়েছি আমি ওই মেয়েকে। আমার ছেলে একটা ডিজেবল্ড মেয়েকে বিয়ে করবে সেটা আমি কি করে হতে দেই?,তুমি ওর থেকে আরো ভালো মেয়ে পেতে। আর তুমি কিনা ওই মেয়ের জন্য আমাকে এভাবে অপমান করলে? আমি ঠিকই করেছি তাহলে। একদম ঠিক করেছি ওই মেয়েকে ওর নিজের জায়গাটা দেখিয়ে।
জায়মার কথা শুনে শিহাব ভয়াবহ রেগে গেল।
-আপনার কোনো জায়গা আছে? যে আপনি নীরার জায়গা ওকে দেখাবেন? আপনার আর আপনার পছন্দের তিশার কি যোগ্যতা আছে? আপনি তো প্রথমে আমার বাবার টাকায় আলিশান জীবন কাটিয়েছেন। আর এরপর আপনার সেকেন্ড হাজবেন্ডের। আর আপনি জায়গক দেখাবেন নীরাকে? প্লিজ এটা বাইরের কাউকে বলবেন না। নইলে নিজেই হাসির পাএী হয়ে যাবেন।
শিহাব এবার তিশার দিকে তাকিয়ে বললো।
-তোর বয়ফ্রেন্ড কি ছেড়ে দিয়েছে তোকে? নাকি এখন আর দুজন দুজনের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই কোনটা? সবাই জানে যে তুই তোর সো কল্ড বয়ফ্রেন্ডের সাথে অনেক গভীর সম্পর্কে ছিলিস? স্পষ্ট ভাষায় বলবো আরো? এখানে সবাই এডাল্ট। সবাই বুঝে গেছে আশা করি। সাহস কি করে হলো নীরাকে ওসব বলার? বল সাহস কি করে হলো ওর সেল্ফ রেস্পেক্টে আঘাত করার? খুব বড় ভুল করেছিস তুই। খুব বড়। কান খুলে শুনে রাখ আমার লাইফ পার্টনার হওয়ার যোগ্য একমাএ নীরা। তোর মতো কেউ না। কখনোই না।
তিশা এর আগে এতো অপমানিত কখনোই হয়নি। অপমানে রাগে কষ্টে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সে তো শিহাবকে শুধু ভালোইবেসেছে। মাথা উচু করে কারো দিকে তাকাতে পারছে না সে।
শিহাব জায়মাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-আপনি আর যাই করুন নিজের মতোই কাউকে চুজ করেছেন। তিশাও আপনার মতোই কংগ্রাচুলেশনস। বাই এনি চান্স আমার সাথে ওর বিয়ে হলে ও নিজেও আপনারই মতো একসময় প্রাক্তনের সাথে পালিয়ে যেতো। আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন রাইট?
জায়মার বলার আর কিছুই রইলো না। তিনি নিঃশ্বব্দে কাঁদতে লাগলেন। তিশা এবার সবার সামনে বলে উঠলো।
-যা করেছি তোমাকে ভালোবেসে করেছি শিহাব। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে দয়া করো তোমার কাছে একটু জায়গা দাও।
শিহাব তিশাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আসমাকে বললো।
-খালামনি আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনারা তিশাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। দয়া করে ওকে নিয়ে যান। আর কখনো যেনো আমার বাড়িতে ও না আসে।
জায়মার কাছে গিয়ে শিহাব আস্তে করে বললো।
-নীরাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি এতোটা ভালোবাসি ওকে। আমাকে যদি আপনি সত্যিই নিজের ছেলে ভেবে থাকেন। তাহলে ভুলেও নীরাকে কটু কথা বলে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ইনিয়েবিনিয়ে ব্রেনওয়াশ করার চেষ্টা করবেন না। আরেকটা কথা আপনি তিশাকেও খুব ভালোবাসেন আমিও সেটা জানি। তাই আপনাকেই বলছি। তিশাও যদি কখনো কোনোদিনও নীরাকে কষ্ট দেয়। একটুও কষ্ট দিয়ে কথা বলে বিশ্বাস করুন আমি তিশার লাইফটাই হেল করে দিবো। তিশাকে তো আপনি মেয়ে ভাবেন। মেয়ের লাইফ জাহান্নামে পরিণত হলে কেমন লাগবে আপনার? আপনি এখন আসতে পারেন।
কথা শেষ করেই শিহাব চলে আসলো। রেজা সাহেব জায়মাকে বললেন।
-আমি তোমাকে বহুবছর যা বলতে পারিনি আমার ছেলে আজ তা ই বলে দিয়েছে।
কথা শেষ করেই রেজা সাহেব নিজের ঘরে চলে গেলেন। আজ আরও বেশি আত্মগ্লানিতে ভুগছেন তিনি।
জায়মা তিতলি আর রেহানের দিকে তাকালেন। ওরা দুজনেই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। জায়মা তবুও ওদের সামনে গিয়ে বললেন।
-মাকে পারলে ক্ষমা করে দিস। শিহাবকে বলিস ও যেনো আমাকে ক্ষমা করে দেয়।
তিতলি আর রেহান দুজনের কেউই কিছু বললো না। জায়মা একরাশ কষ্ট নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। তিশা রাগে শক্ত হয়ে নিজের ঘরে গেল। আসমাকে ধমকে বললো ব্যাগ প্যাক করে নিতে। আসমা নিজের মেয়ের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। এতোকিছুর পরও নিজের মেয়ের এহেন অবস্থা দেখে। তবে কিছু বললেন না। তিশা আর আসমা তাড়াতাড়ি ব্যাগ প্যাক করে বাড়ি থেকে চলে গেল। সবার সামনে দিয়েই গেল। তাদের কেউ কিছু বললো না আর তারাও শোনার অপেক্ষাতে রইলো না।
শিহাব নিজের ঘরে খাটে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। অনেকক্ষন হয়ে গেছে সে একইভাবে বসে আছে। রাত হয়ে গেছে বসে থাকতে থাকতেই। সে ওভাবেই বসে নীরাকে ফোন করলো।
নীরা শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। রিংটোনের আওয়াজে উঠে বসলো। শিহাবের ফোনকল দেখে একবার ভাবলো ধরবে না। আবার ভাবলো যেই ঘাড়ত্যাড়া ফোন না ধরলে বাড়িতেই এসে পরবে। বাধ্য হয়ে ফোন ধরতে হলো। ফোন ধরেই নীরা চুপ করে রইলো। শিহাব বলে উঠলো।
-আই এম স্যরি। তখন আমার ওরকম বিহেভ করা সত্যিই উচিত হয়নি।
নীরা তবুও কিছু বললো না। শিহাব নীরার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বললো।
-তোমার সাথে এসব ঠিক যাচ্ছে না।
এবার নীরা কথা বললো। জিজ্ঞেস করলো।
-কোনসব?
-এইযে এমন বিহেভ।
-কেমন বিহেভ?
এইবার শিহাব শব্দ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো।
-কিছু না।
-রাখছি।
-তুমি কি আবার রেগে গেলে?
নীরা ভ্রু কুঁচকালো শিহাবের কথা শুনে। শিহাব আবার বললো।
-তুমি নিশ্চয়ই এখন ভ্রু কুঁচকে আছো?
শিহাবের কথা শুনে নীরা অবাক হয়ে গেল।
-আমি কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছি। আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি। আমার সত্যিই ভীষণ কষ্ট হয়েছে।
নীরা আনমনে বললো।
-হু।
-হু আবার কি? আচ্ছা আমাদের বিয়েতে তুমি কি পরবে? সব তোমার পছন্দ অনুযায়ী হবে।
নীরা বিরক্ত হলো এবার।
-তুমি সত্যিই একটা যা তা।
শিহাব হাসতে হাসতে বললো।
-শুধু তোমার জন্য।
–চলবে!
(রি-চেইক হয়নি। পাঠকদের জন্য ভালোবাসা।💜)
#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ৩০
#নাফিসা নীলয়া!
শিহাব নীরার সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছে যে সে নিজেই নীরার ফোন আছাড় মেরে ভেঙে এসেছে। কথাটা মনে পরতেই সে নীরাকে প্রশ্ন করলো।
-এক মিনিট তোমার ফোন কি অক্ষত অবস্থায় আছে? আমি না আছাড় মেরে ভেঙে আসলাম। কথা বলছো কি করে?
শিহাবের কথা শুনে নীরার মনে হলো শিহাবকে সামনে পেলে সে তার ভাঙা ফোনটা দিয়ে শিহাবের মাথায় বাড়ি মারুক। কওবড় সাহস! ফোন ভেঙে আবার জিজ্ঞেস করছে। নীরার শিহাবকে আর সহ্য হচ্ছে না। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
-পুরোপুরি ভাঙেনি। তবে একেবারে বিদ্ধস্ত হয়ে গেছে। কুড়িয়ে নিয়ে জোড়া লাগিয়েছি। আমি ঠিক করেছি আমি তবুও এটাই ইউজ করবো। আমার ডিসিশন ফাইনাল। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো ঘাড়ত্যাড়া শিহাব আমার ফোন ভেঙেছে। আর আমি এটাই ইউজ করবো। যতো যাই ই হোক।
নীরার কথাবার্তা শুনে শিহাব হুহা করে হেসে ফেললো। নীরা তো এভাবে কথাই বলে না। আজ বললো বলে শিহাবের খুব হাসি পাচ্ছে। সে বললো।
-নট ফেয়ার। শিহাব রেজার বউ হয়ে তুমি কিনা ভাঙা ফোন ইউজ করবে! এটা মানাই যায় না। কি যে বলো না তুমি নীরা।
-চুপ থাকো। একদম বউ বউ করবে না। তোমার ব্যবহার আমি ভুলিনি। ফোন রাখো। আর বিদায় হও।
শিহাবের মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। তবুও সে হেসে বললো।
-স্যরি বলেছি তো। ফরগিভ মি।
-ওই ব্যবহার আমি ইহজীবনে ভুলবো না। সারাজীবন তোমাকে এই কথা শুনতে হবে।
নীরার এমন কথা শুনে শিহাব মিটিমিটি হেসে বললো।
-তারমানে তুমি স্বীকার করছো যে তোমার সারাটাজীবন আমার সাথেই কাটবে।
কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কথার প্যাচে কি করে ফেলতে হয় তা খুব ভালোভাবে জানে। শিহাবও ওই ক্যাটাগরির মানুষ। নীরা কপাল চাপড়ালো।
-কথার প্যাচে কি করে ফেলতে হয় তা কেউ তোমার থেকে শিখুক।
-তুমিও শিখতে পারো। আমি যেমন ব্যবসার লাভ ক্ষতি বিনিয়োগে পটু তেমনই কথার প্যাচে ফেলতেও পটু। তুমি কি লাকি তাই না? একসাথে কতো প্যাকেজ আমার মধ্যে।
নীরার মাথা ঘুরছে এই ই কি সেই শিহাব যে সারাক্ষণ মুডি হয়ে থাকতো। কম কথা বলতো। সব মেপে মেপে করতো। নীরা হতাশ কন্ঠে বললো।
-তুমি তোমার প্রথম সওাতেই ভালো ছিলে। আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। আমি কি এখন ঘুমাতে পারি?
-প্রশ্ন করছো কেন? অফ-কোর্স ঘুমাবে। যাও ঘুমাও।
শিহাব কথাটা বলার সাথে সাথে নীরা ফোন কেটে দিলো। এবং পাওয়ার বাটনও অফ করে দিলো। শিহাবকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। আবার ফোন করে বসতে পারে। শিহাব একা একাই হাসতে থাকলো। এতোক্ষনের অশান্তি গায়েব হয়ে গেল নীরার সাথে কথা বলে। শিহাব মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হয় সে ও কারো জন্য এতোটা পাগল হলো! আগে খুব গর্ব করে বলতো প্রেম ভালোবাসা বিয়ে এসব থেকে সে দূরে থাকবে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। সব দোষ নীরার। অবশ্য নীরা তার জীবনে এসেছে বলে লাভটা তারই হয়েছে। এসব ভেবেই তার শান্তি লাগছে। সে একরাশ শান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেল।
মিলা একটা সুন্দর রানীদের মতো পোশাক পরেছে। সাথে সুন্দর রাজকীয় গহনা। সে ঘুরে ঘুরে নিজেকে আয়নায় দেখছে। আজ তার বিয়ে তার রাজার সাথে। নীরাসহ সকলে তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। তার খুব আনন্দ হচ্ছে। নিজেকে বউরূপে দেখতে সে সবসময় চাইতো। আর আজ সেই দিন। নীরা তার হাত ধরে আসরে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়েই মিলা জীবনের সবথেকে বড় চমকটা খেলো। আর তা হলো। বরের জায়গায় রাজার বেশে রেহান বসে আছে। তাকে দেখে উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো রেহান। মিলা আঁতকে উঠলো। ও মাই গড! বরের জায়গায় রেহান কেন। এই বজ্জাতটা এখানে কেন। আল্লাহ। সে তার আপার দিকে তাকালো। নীরা চোখে হাসলো। মিলা চারদিকে তাকালো। দেখতে পেলো তার বাবা,মা দাদীসহ শিহাব,তিতলি,রুমা,সাইফ সবাই হাসছে। আশ্চর্য সে কি জোকার নাকি যে সবাই তাকে নিয়ে এরকম হাসাহাসি করছে। সে আবার সামনে ফিরে রেহানের দিকে তাকালো। দেখতে পেলো রেহান দাঁত কেলিয়ে হেসে বলছে।
-কি টিলা বেয়াইন। খুব তো ভাব ছিলো তোমার। সেই তো আমার গলাতেই ঝুঁলতে হলো। কি কেমন লাগে এখন?
মিলা চারিদিকে তাকালো। দেখলো রেহানের কথায় সবাই হাসাহাসি করছে। তার বন্ধুরাও তাকে নিয়ে মজা উড়াচ্ছে।
স্বপ্নে এসব দেখেই মিলা আঁতকে উঠে না বলে চিৎকার করে উঠে বসলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো নীরা বসে আছে। নীরা বোনের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পানি দিলো মিলাকে। মিলা পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্ত করলো। নীরা জিজ্ঞেস করলো।
-কি হয়েছে মিলা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? ফজরের আজান হচ্ছে এজন্য ডাকতে এসেছিলাম। এসেই দেখি তুই ঘুমের মাঝে ছটফট করছিস। কতোবার বলেছি ঘুমানোর আগে আয়তুল কুরসি পড়ে ঘুমাবি। তা তো শুনিস না। কি দেখেছিস?
মিলা ভাবনায় পরে গেল। হায়হায় এখন তো ভোর। আর ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে সে মুখ দেখাবে কি করে। ও আল্লাহ! এখনই নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলতে হবে এই স্বপ্নটা যেনো সত্যি না হয়। ভেবেই সে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে নীরাকে বললো।
-আপা নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে। চলো নামাজ পড়ি। ভয়াবহ স্বপ্ন কাউকে বলতে নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি ওজু করতে গেলাম।
মিলার এমন ভাব দেখে নীরা অবাক হয়ে গেল। তবুও কিছু বললো না। পাশাপাশি জায়নামাজ বিছিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মিলা ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এলে দুই-বোন একসাথে নামাজ আদায় করলো। মিলা নামাজ পড়তে গিয়ে কেন যেনো মন দিয়ে ফরিয়াদ করে বলতে পারলো না স্বপ্নটা যেনো সত্যি না হয়। তবুও বহুকষ্টে সে বললো। নামাজ শেষে নীরা মিলার কপালে হাত দিয়ে চেক করলো। তারপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলো। মিলা বলে উঠলো।
-তুমি বসো আপা তোমার কোলে মাথা দিয়ে একটু ঘুমাই।
নীরা হেসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। মিলা নীরার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে ঘুমাতে বিড়বিড় করে বললো।
-ইয়া আল্লাহ স্বপ্নটা যেনো সত্যি না হয়। প্লিজ যেনো না হয়।
বলতে বলতেই সে ঘুমিয়ে পরলো।
তিতলি আজ ঠিক করেছে কলেজে যাবে না। গতকালও যায়নি। এই নিয়ে শিহাব আর রেহান দুজনেই তাকে বকেছে কিন্তু তবুও সে যায়নি। তার কলেজে যেতে একটুও ভালো লাগে না। সে সকাল সকাল গুনগুন করতে করতে সুন্দর করে সাজলো। সাজতে তার ভালো লাগে। খুবই ভালো লাগে। সে নিজেকে বারবার আয়নায় দেখছে। জহুরা তিতলেকে ডাকতে এসে ওকে এভাবে ঘুরতে দেখে হেসে ফেললেন। তিতলি পিছন ঘুরে জহুরার হাসি দেখে বললো।
-হোয়াট হ্যাপেন্ড খালা হাসো কেন?
জহুরা হাসতে হাসতেই বললেন।
-তুই যে কলেজে না গিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঢঙ করছিস তোর দুই ভাই জানে?
তিতলি এই কথা শুনে ভেঙ্চি কাটলো। বললো।
-হাহ্ ওদের কি আমি ভয় পাই নাকি? উল্টো ওরাই আমাকে ভয় পায়।
তিতলির কথা শুনে জহুরা আরো জোরে হেসে ফেললেন। তারা কথা বলতে বলতেই তিতলির বারান্দা ওভারটেক করে ঘরে পরপর দুইটা ইটের টুকরোর ঢিল এসে পরলো। দ্বিতীয় বারের ঢিলে তিতলির বারান্দার কাঁচে জোরে শব্দ হলো। এতে জহুরা আর তিতলি দুজনেই আঁতকে উঠলো।
রেহান আর তিতলির ঘর পাশাপাশি। দুজনের ঘরের বারান্দা এটাচ্ড। এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দাতে যাওয়া যায় সহজেই। রেহান সবে ঘুম থেকে উঠেই বারান্দাতে এসেছিলো। তিতলির বারান্দাতে ঢিল ছোড়ার কারনে আওয়াজ হলে তার কানেও আসলো। সে চোখ কঁচলে তাড়াতাড়ি তিতলির ঘরে আসলো। এসেই জিজ্ঞেস করলো।
-শব্দ হলো কিসের?
রেহানের প্রশ্ন শুনে জহুরা ঘাবড়ে বলে ফেললেন।
-রেহান কে যেনো তিতলির ঘরে ঢিল ছুড়েছে। হায় আল্লাহ আমার তিতলির ওপর কার নজর পরলো গো!
জহুরার বিলাপ শুনে তিতলি বিরক্ত হলো খুব। রেহান তিতলির দিকে তাকিয়ে আশেপাশে ইটের টুকরো খুঁজতে থাকলো। খুঁজতে খুঁজতে সে বললো।
-এতো সিকিউরিটির ভেতরে কার এতো সাহস হলো ঢিল ছোড়ার।
রেহান চিন্তিত স্বরে বলতে বলতে ইটের টুকরো খুঁজে পেলো। তাদের বাড়ির এরিয়া অনেক বড়। রেজা সাহেবের বাবার তৈরি করা সুন্দর আলিশান তিনতলা বাড়ি। কিভাবে ঢিল ছোড়া পসিবল সেটাই রেহানের মাথায় আসছে না। সে ইটের টুকরোতে পেঁচানো কাগজ পেলো। সেটা খুলে পড়তেই সে আগুন দৃষ্টিতে তিতলির দিকে তাকালো। তিতলি রেহানের এমন দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল। সে ভয় পায় না রেহানকে। তবে আজ রেহানের দৃষ্টি দেখে সত্যিই ভয় পেলো। তিতলি ভয়ে ভয়ে রেহানকে জিজ্ঞেস করলো।
-কি হয়েছে ছোট ভাই? এনিথিং রঙ?
রেহান রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বললো।
-রঙ? পুরোটাই রঙ এটা কি? বল!
রেহান তিতলির হাতে চিরকুটটা দিলো। তিতলি হাতে নিয়ে পড়ে যা দেখলো তাতে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। চিরকুটে লেখা আছে।
—দুইদিন যাবত কলেজে যাও না কেন তুমি?তোমাকে না দেখলে আমার কতো কষ্ট হয় সেটা কি জানো না? অবশ্যই জানো। তবুও জেনেশুনে এতো কষ্ট কি করে দিচ্ছো তুমি! হোয়াই! দেখো তুমি যদি দেখা না দাও তাহলে কিন্তু আমি কিছু একটা করে ফেলবো। হয়তো তোমাকেই উঠিয়ে নিয়ে যাবো।
তিতলির আশ্চর্যজনক দৃষ্টি দেখে জহুরা চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়লেন। চিরকুট পড়েই তিনি আবারও বিলাপ শুরু করলেন।
-এ কি হলো রে তিতলি। কে এরকম হুমকি দেয়? হায় হায়। তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? এরকম চিরকুট লেখা কেন তাহলে?
তিতলি এরকম সিচুয়েশনে ভয়ে ভয়ে জহুরাকে বললো।
-বিশ্বাস করো খালা। আই সোয়্যার আমি কিছু জানি না। আমি কিছু করিনি। বিশ্বাস করো।
জহুরাকে বলে তিতলি রেহানের দিকে তাকালো। রেহান পারছে না তিতলিকে চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিতে। সে আর কিছু না বলে বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো বাইরে কেউ আছে কিনা। তাদের বাড়িটা বড় হওয়ায় অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। তাছাড়া অনেক সিকিউরিটি রয়েছে। শিহাব নিজেই আরো কঠোর সিকিউরিটি করেছে। তাহলে কিভাবে সম্ভব। এসব ভাবতে ভাবতেই রেহানের নজর গেল বাড়ির বাইরে উওরদিকে। প্রাচীরের বাইরের ওদিকটা বাড়ি থেকে কাছেই। স্পেশালি তিতলির বারান্দা থেকে কাছেই। ওখান থেকে চেষ্টা করলে ঢিল ছোড়া সম্ভব। রেহান অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারদিকে দেখলো। তার একটু দূরেই হুডি পরা দুইজন বাইকে বসে আছে। সেটা দেখেই রেহানের মাথা গরম হয়ে গেল। তবুও সে নিজেকে শান্ত রাখলো। এখন চেঁচালে ওরা ঠিক টের পেয়ে যাবে। আস্তে আস্তে গিয়ে ধরতে হবে ভেবেই সে আরেকদফা তিতলির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে গেল। তিতলি চুপসে গিয়ে বসে পরলো। জহুরা হায় হুতাশ করছেনই।
বাড়ির বাইরে যেতে যেতে সে বাগানের দিকে তাড়াতাড়ি গেল। শিহাব সেখানে এক্সারসাইজ করছিলো। রেহান তাড়াতাড়ি গিয়ে শিহাবকে ডাকলো।
-ভাই,ভাই তিতলির বারান্দাতে কারা যেনো হুমকিভরা চিরকুটের ঢিল ছুড়েছে। বাইরেই আছে জলদি চলো।
রেহানের কথা শুনে শিহাব হতভম্ব হয়ে গেল। কিভাবে সম্ভব সে ভেবেই পেলো না। শিহাবের হতভম্ব ভাব দেখে রেহান শিহাবকে ঝাঁকিয়ে বললো।
-চলো তাড়াতাড়ি চলো।
শিহাব নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রেহানের আগেই ছুটলো। রেহানও পিছু পিছু ছুটলো। শিহাব আবার থেমে গেলে রেহানও থেমে গেল। শিহাব থেমে সিকিউরিটিদের ফোন করে এলার্ট করে দিলো। তারপর রেহানকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে বললো।
-আমি থেমেছি বলেই কি তোর থামতে হবে? জলদি যা ডাফার।
রেহান থতমত খেয়ে আবার দৌড়ানো শুরু করলো। শিহাব আর রেহানসহ সবাই বাইরে বেড়িয়েছে।
নির্বান আর শিমুল বাইকে বসে ছিলো। শিমুলই বুদ্ধি করে নির্বানকে একটু সাহসী সাজানোর জন্য,আর তিতলিকে ইমপ্রেস করার জন্য ওরকম চিরকুট লিখেছে। নির্বান যেরকম ডেয়ারিং ছেলে সেরকমই লিখতে চেয়েছে। আর নির্বান ও তিতলিকে দেখার জন্য এই কাজ করেছে। নির্বান শিমুলকে বললো।
-এখনো বের হলো না বাইরে দেখেছিস? অথচ কতো আগে ঢিল ছুড়েছিলাম এখনো পায়নি নাকি?
শিমুল দেখতে পেলো তিতলির ভাইরা এদিকেই আসছে। সে জলদি বাইক স্টার্ট করলো। যতোটুকু সম্ভব স্পিড বাড়িয়ে দিলো। হুট করে বাইক স্টার্ট দেওয়াতে নির্বান প্রায় পরে যেতে ধরলো। সে শিমুলকে ধমকে বললো।
-হচ্ছেটা কি? এখনো তো তিতলিকে দেখা হলো না।
শিমুলের ইচ্ছে হলো নির্বানকে সে এখানেই মরার জন্য ফেলে যাক। সে উল্টো ধমকে বললো।
-শালা ওদিক তাকা। দেখ তোর শালারা আসছে তোকে মারার জন্য।
নির্বান ওদিকে তাকিয়ে দেখলো। দেখেই তার রক্ত ছলকে উঠলো। সে এবার শিমুলকে বললো
-জলদি যা আরো স্পিড বাড়া ভুল হয়েছে এসে। সব তোর জন্য।
শিমুল ধমকে বললো।
-সর্বোচ্চ স্পিডই দিয়েছি। তোর ঘ্যানঘ্যানানির জন্যই তো আমি এই বুদ্ধি বের করেছি। তুই ই তো মরে যাচ্ছিলি।
নির্বান শিমুলের কথা আর পাওা না দিয়ে,পেছন ফিরে দেখলো অনেকটা দূরত্বে তারা চলে এসেছে। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো।
-ভাগ্যিস হুডি আর মুখে মাস্ক পরে এসেছি।
শিহাবরা সবাই আসতে আসতে নির্বান আর শিমুল চলে গেল। শিমুল খুব ভালো বাইক রেসার। সেজন্য তাড়াতাড়ি যেতে পেরেছে।
শিহাব এবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো।
-এতো জন থাকতে আমার বোনের ঘরে বাইরের মানুষ ঢিল ছুড়ে কিভাবে? সবাইকে ফায়ার্ড করলাম।
তারপর রেহানের উদ্দেশ্যে বললো।
– আশেপাশের সব সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে বাইকের নাম্বার প্লেট জোগাড় করবি।
-ওকে ভাই।
রাগে শিহাবের মাথা ঠিক নেই। সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িতে ঢুকলো। তার পেছন পেছন রেহানও ঢুকলো। শিহাব বাড়িতে ঢুকেই তিতলিকে ডাকতে শুরু করলো। তিতলি ভয়ে ভয়ে হাজির হলো। সাথে জহুরা ছিলেন। তিনি আগুনে ঘি ঢালার মতো করে চিরকুটটা শিহাবের হাতে দিয়ে দিলেন।
চিরকুটটা পড়ে শিহাব ও রাগান্বিত দৃষ্টিতে তিতলির দিকে তাকালো। এতোক্ষন রেহানের রাগান্বিত দৃষ্টিই তিতলি হজম করতে পারছিলো না। এখন আবার শিহাবের দৃষ্টি। তিতলি কেঁদেই ফেললো।
শিহাব যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এই এক সমস্যা অতি আদরের বোনকে কখনো ফুলের টোকাও দেওয়া হয়নি। তিতলি খুব আদরের। দুই ভাইকে সে কখনোই ভয় পায় না। তবে আজ দুই ভাইয়ের রাগ দেখে তার কষ্ট লাগলো। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
-সত্যিই আমি কিছু করিনি। আমি তো চিনিই না কাউকে।
রেহান হঠাত মনে পরার ভঙ্গিতে বললো।
-তোর কলেজের সামনে একটা ছেলেকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকি টমকি দিয়ে সব ডিটেইলস নিয়েছিলাম না? ও নয় তো?
এতোক্ষন তিতলির মাথাতেও এই বিষয়টা আসেনি। বিষয়টা মাথায় আসতেই তার মনে হলো ওই ছেলেটা হতেই পারে। তবে কষ্টও লাগলো রেহান যেহেতু বিষয়টা জানে তারপরও এমন করলো। খুব অভিমান হলো তিতলির। শিহাব এবার রেহানের দিকে রেগে গিয়ে তাকালো।
-কোন ছেলে? কার এতো বড় সাহস? আর রুমার বিয়েতে এতো বড় ইন্সিডেন্টের পরেও তোরা আমাকে এই বিষয়টা জানাসনি কেন?
শিহাবের রাগ দেখে তিতলি আর রেহান দুজনেই আমতা আমতা করলো। শেষে রেহান বললো।
-ওর কলেজের সামনে একটা ছেলে দাড়িয়ে থাকতো। তো সেদিন আমি ছেলেটাকে ধমকে টমকে দিয়ে এসেছি। দেখে তো মনে হয়েছিলো ও আর কলেজের সামনেই দাড়ানোরই সাহস পাবে না। কিন্তু আজকের কাজটা কে করতে পারে!
শিহাব চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
-তিতলি সত্যি করে বল চিনিস কিনা। চিরকুটের লেখার ধরণটাই তো কেমন যেনো। সত্যি করে বল।
শিহাবের কথা শুনে তিতলি এবার আরো শব্দ করে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে রেহান আর শিহাবকে বললো।
-আমাকে বিশ্বাস করিস না? ওকে করতে হবে না। আমি তো বলেছিই যে আমি কিছু জানি না। তবুও আমাকে সন্দেহ করছিস।
বলেই তিতলি নিজের ঘরে চলে গেল। শিহাব নিজেকে শান্ত করলো তিতলি কান্না করে চলে গেল বলে তার নিজেরই খারাপ লাগছে। রেহান আর জহুরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছে। শিহাব জহুরাকে বললো।
-তিতলির কাছে যাও।
তারপর রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
-ইউনিভার্সিটি নেই এখনো দাড়িয়ে আছিস কেন?
রেহান শিহাবের কথা শুনে বললো।
-হ্যা আচ্ছা আমি যাই ফ্রেশ হই তারপর যাচ্ছি।
-হ্যা যা। এবার এমন ব্যবস্থা করবো যেনো বাড়ির ধারেকাছেও ওরকম লাফাঙ্গা না আসতে পারে।
রেহান শিহাবের কথা শুনে চলে গেল। মনে মনে ভাবলো ওই ছেলেটার খোঁজ নিবে। আবার ভাবলো বিনা কারনে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে! কোনো প্রমান তো নেই। তবুও দেখতে হচ্ছে বিষয়টা।
সন্ধ্যার দিকে ঘটলো আরেক ঘটনা। জহুরা রান্নাঘরে রান্না করতে গিয়েছিলেন। শিহাব, রেহান কেউই বাড়িতে ছিলো না। তিতলি এই ফাকে কাউকে কিছু না বলে,দারোয়ানকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। যেহেতু তার বাড়ির বাইরে যাওয়া একদম নিষিদ্ধ না তাই কোনো সমস্যা হলো না।
নীরা আর মিলা সন্ধ্যার পর মালিহার সাথে বসে পাকোড়া খাচ্ছিলো আর গল্প করছিলো। তখনই বেল বেজে উঠলো নীরা যেতে চাইলে মালিহা বললেন।
-আমিই যাচ্ছি তোর যেতে হবে না।
মালিহার কথা শুনে নীরা আর গেল না।
মালিহা দরজা খুলে দেখলেন তিতলি দাড়িয়ে আছে। তিতলির চোখ মুখ ফোলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব কেঁদেছে। মালিহা তিতলিকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি তাড়াতাড়ি তিতলিকে ভেতরে আসতে বললেন।
-একি অবস্থা তোমার মা? সন্ধ্যার পর একা বেড়িয়েছো কেন? আচ্ছা ভেতরে এসো।
মালিহা তিতলির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তিতলিকে বসিয়ে দিয়ে তিনি মিলা আর নীরাকে ডাকলেন। মালিহার আওয়াজ শুনে নীরা আর মিলা দুজনেই ড্রয়িংরুমে আসলো। তিতলিকে এই অবস্থায় দেখে দুজনেই খুব অবাক হয়ে গেল।
তিতলি নীরাকে দেখামাএই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। নীরা হতভম্ব হয়ে গেল। তিতলি ইতিমধ্যে নীরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। মালিহা আর মিলাও তিতলির কান্না দেখে ভয় পেয়ে গেল। তিতলি হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকলো। নীরা তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
-কাঁদছো কেন তিতলি? কেঁদো না লক্ষী। আপু কিন্তু কষ্ট পাচ্ছি তোমার কান্না দেখে।
নীরা তিতলিকে ছাড়িয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো।
-কি হয়েছে না বললে আপু কিভাবে সল্ভ করবো? আর তোমার কিন্তু সন্ধ্যার পর একদমই একা আসা উচিত হয়নি।
মালিহা তিতলিকে পানি এনে দিলেন। নীরা তিতলিকে পানি খাইয়ে দিলো। মিলা বলে উঠলো।
-ভাইয়া আর রেহান নিশ্চয়ই জানে না তুমি এসেছো?
মিলার কথা শুনে তিতলি চুপ করে রইলো। মিলা আবার জিজ্ঞেস করলে তিতলি নাক টানতে টানতে বললো।
-কেউই জানে না।
এতে সবাই অবাক হয়ে গেল। নীরা বললো।
-এভাবে না বলে আসাটা উচিত হয়নি তিতলি। আমি কিন্তু এটা তোমার থেকে আশা করিনি।
তিতলি চুপ করে থাকলো। মালিহা নীরাকে ইশারায় বললেন তিতলিকে ঘরে নিয়ে যেতে। নীরা তিতলিকে ঘরে নিয়ে গেল। মিলাও সাথে গেল।
জহুরা তিতলিকে সারা বাড়ি খুঁজে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। সচরাচর তিতলি ওনাকে না বলে কোথাও যায় না। তিতলি একা কোথাও যায়ই না। গেলেও গাড়ি নিয়ে যায়। আজ সেটাও করেনি। তিতলি ফোনও ফেলে গেছে। জহুরা শিহাব আর রেহানকে বলার পর তারা দুই ভাই অস্থির হয়ে পরলো। তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে গেল। রেহান বললো।
-ভাই আমাদের সকালবেলা তিতলির সাথে ওরকম আচরন করা ঠিক হয়নি।
-এখন আমি তোকে মারবো মাথামোটা। কথা না বলে চল ওকে খুঁজতে হবে। আর ওর ফ্রেন্ডসদেরও কল কর।
জহুরা চিন্তিত কন্ঠে বললেন।
-আমারই দোষ আমি কেন খেয়াল রাখলাম না। তাহলে তো আর এরকম হতো না।
শিহাব জহুরাকে কিছু বলতে চাইছিলো তখনই শিহাবের ফোন বেজে উঠলো। সে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো নীরা তাকে কল করেছে। সে ফোন রিসিভ করে অস্থির কন্ঠে বললো।
-নীরা পরে কলব্যক করছি। তিতলি কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেনো চলে গেছে। ওকে খুঁজতে যাচ্ছি।
-তিতলি আমাদের বাড়িতে এসেছে। চিন্তা করো না। ও ঠিক আছে।
কথাটা শুনে শিহাবের জান ফিরে এলো। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কাঁপা স্বরে বললো।
-ও ঠিক আছে তো? ওকে ফোনটা দাও।
– ও ঠিক আছে। তুমি এসো এখানে।
-দ্রুত আসছি।
বলেই শিহাব ফোন কেটে দিলো। তারপর জহুরা আর রেহানকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-থ্যাংক গড। নীরাদের বাড়িতে গেছে ও। নীরা বললো ঠিক আছে।
শিহাবের কথা শুনে জহুরা আর রেহানও নিশ্চিন্ত হলো। জহুরা বললেন।
-তাড়াতাড়ি নিয়ে আয় ওকে।
-হ্যা যাচ্ছি। বাবা ফেরেনি?
-না তোরা যা এবার। তোদের বাবাকে জানানোর দরকার নেই এসব। শুধু শুধু চিন্তা করবে।
জহুরার কথা শুনে শিহাব আর রেহান দুজনেই রওনা দিলো।
তিতলি রেগে নীরাকে বললো।
-আমি এসেছি তুমি খুশি নও ভাবি?
নীরা হতাশ হয়ে বললো।
-তুমি আসবে আর আমি খুশি না হয়ে পারি? কিন্তু তুমি ভুল করেছো কাউকে কিছু না বলে এসে। কখন বেড়িয়েছো বাড়ি থেকে?
-সন্ধ্যার আগে।
তিতলির কথা শুনে মিলা চেঁচিয়ে বললো।
-কিহ্! সন্ধ্যার আগে। তুমি তো আমাদের বাড়িতে এলেই সন্ধ্যার পরে। তাহলে এর আগে কোথায় ছিলে?
তিতলি মুখ গোঁমড়া করে বললো।
-পার্কে।
নীরা তিতলিকে নরম স্বরে বললো।
-চারদিকের খবর তো তুমি জানো তিতলি। আর আমি যতোটুকু জানি তুমি সন্ধ্যার পর একা কখনোই বেড়োওনি। আর বাড়ির সবাই কতো দুঃশ্চিন্তা করেছে বলো তো। তোমার প্রতি সত্যিই ডিসেপ্পয়েন্ট আমি।।
তিতলি নিজেও বুঝতে পারলো ঝোঁকের মাথায় সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো সে। তিতলি এরপর নীরাকে আর মিলাকে সকালের সমস্ত ঘটনা খুলে বললো।
-আমাকে আমার ভাইয়েরা বিশ্বাস করেনি। কিভাবে আমার সাথে কথা বলেছে আর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়েছে যদি তোমরা দেখতে।
সব শুনে নীরা বললো।
-তোমাকে তোমার ভাইয়েরা খুব বেশি ভালোবাসে তিতলি এজন্যই এমন করেছে। নইলে করতো না। ওদের দুঃশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক তাই না?
-তাই বলে আমাকে বিশ্বাস করবে না?
তিতলির এই কথার পর মিলা বললো।
-রেহান যে একটা বজ্জাত এটা তো আমি জানি। কিন্তু ভাইয়া এমন করলো কিভাবে?
মিলার এই কথা শুনে নীরা চোখ গরম করে তাকালো। মিলা চুপসে গেল।
ওরা কথা বলতে বলতেই শিহাব আর রেহান নীরাদের বাড়িতে এসে পরলো। মালিহা ওদের বসতে বললেন। শিহাব বললো।
-আগে তিতলিকে দেখে নেই আন্টি। তারপর বসবো।
রেহানও তাই বললো।
-হ্যা তিতলি কই?
মালিহা ওদের উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে বললেন।
-নীরার ঘরে। ও বের হবে না বোধ হয় তোমরা যাও।
বলার সাথে সাথেই শিহাব আর রেহান দ্রুত নীরার ঘরে গেল। তিতলি তখন মুখ ফুলিয়ে বসে ছিলো। শিহাব আর রেহান তিতলিকে দেখে শান্তি পেলো। ওরা তিতলিকে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তিতলি ওদের দেখামাএই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
মিলা তৎক্ষনাৎ বললো।
-ভেরি ব্যাড ভাইয়া। রেহান যে একটা ব্যক্কল সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আপনি কেন এমন করলেন?
মিলার কথা শুনে রেহান ক্ষেপে গেল। সে এমনিতেই চিন্তায় ছিলো। মিলার কথা শুনে সে রেগে গেল।
-টিলার বাচ্চা চুপ করো। আমি ব্যক্কল না তুমি ব্যক্কল!
-আমার নাম মিলা নট টিলা। আর ব্যক্কল তুমি এটা সবাই জানি। সুতরাং আমাকে বলে লাভ হবে না।
এই মুহূর্তে মিলা আর রেহানের বাকবিতন্ডা দেখে নীরা বিরক্ত হয়ে ধমক দিলো।
– চুপ কর দুজন। বাচ্চা নাকি তোরা? আশ্চর্য! মিলা যা বাইরে যা। আর রেহান তুমিও যাও আগে শিহাব কথা বলুক।
নীরার ধমক শুনে মিলা আর রেহান দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ভেঙ্চি কেটে ঘরের বাইরে গেল। দুজনে একসাথে দরজা দিয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় ধাক্কা খেলো। মিলা বিরক্ত হয়ে বললো।
-যাও আগে যাও।
রেহান মুখ ফিরিয়ে আগে গেল।
এদিকে শিহাব তিতলিকে কি বলবে বুঝতে পারছে না। শেষে নীরার সামনেই কানে ধরে তিতলিকে স্যরি বললো।
-স্যরি স্যরি স্যরি আমার জান। ভাইকে কি মাফ করা যায় না?
নীরা শিহাবের কান্ড দেখে হেসে ফেললো। বললো
-আমি বাইরে যাই তোমরা কথা বলো।
নীরা তিতলির পাশে দাড়ানো ছিলো। চলে যেতে চাইলেই তিতলি নীরার হাত ধরে ফেললো। বললো।
-না তুমি যাবে না বসো।
তিতলি হাত না ছাড়ায় নীরা পাশে বসলো। শিহাব তিতলির সামনে আবার কানে ধরে বললো।
-স্যরি তো জান। ভাই আর কখনো এমন করবো না। আসলে তখন মাথা গরম হয়ে ছিলো। কে আমার কলিজাকে চিরকুট দিয়ে হুমকি দিবে! কার এতো সাহস এটা ভেবেই রাগে মাথা কাজ করছিলো না। তাই অমন রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। স্যরি।
তিতলি শিহাবকে পাওা না দিয়ে বললো।
-ভাবি তোমার হাজবেন্ডকে বলে দাও তারা আমাকে অবিশ্বাস করেছে। যেখানে আমি বারবার বলেছি আমি চিনি না। তবুও করেছে।
তিতলির মুখে এমন কথা শুনে নীরা থতমত খেয়ে গেল। সে কি বলবে এখন। শিহাব এবার তিতলিকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
-মুখ ফিরিয়ে রাখছিস কেন? ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলবি। ভাবি কি বলবে! সরাসরি আমাকে বলবি।
স্যরি বললাম তো। জীবনে এতো স্যরি আমি কাউকে বলিনি যতোটা তোর ভাবিকে আর তোকে বলেছি।
শেষের কথাটা শিহাব নীরার দিকে তাকিয়ে বললো। নীরা কথাটা শুনে চোখ গরম করে তাকালো।
তিতলির অল্প অল্প রাগ পরে যাচ্ছে। শিহাব তিতলিকে ছেড়ে দিয়ে বললো।
-তাই বলে তুই কাউকে না বলে এসে পরবি? এটা ঠিক না।
তিতলি নিজের ভুল বুঝলো। তবে হার মানলো না। সে মুখ গম্ভীর করে বললো।
-হুম।
-আর কি করলে মাফ করবি তুই?
তিতলি ঝট করে বলে ফেললো।
-দুই একদিনের ভেতরে ভাবিকে একেবারে নিয়ে গেলে।
তিতলির কথা শুনে শিহাব মিটিমিটি হেসে বললো।
-একদম। তাই ই হবে।
এবার তিতলিও হেসে ফেললো। নীরা বসে বসে এদের দুই ভাইবোনের কর্মকান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে শিহাবের দিকে তাকালে দেখতে পেলো শিহাব তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। গজ দাাঁতের হাসি, টোল পরা সুন্দর হাসি। নীরা চাইলেও রাগ ধরে রাখতে পারলো না। এতো সুন্দর হাসি দেখলে কে রাগ ধরে রাখতে পারে।
–চলবে!