চন্দ্রকিরণ কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন পর্ব:৩

0
303

#চন্দ্রকিরণ
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৩

মানুষ নিজের দুর্বলতা লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। আরিয়ান নিজের মায়ের কৃতকর্মের জন্য নানা বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। ওর মা ছিল হুমায়ুন মাষ্টারের এক মাত্র মেয়ে। ভদ্রলোক ইহজীবনের মায়া ত্যাগ করেছেন বহুকাল পূর্বে। সেখবর আরিয়ান শুনেছিলো। কিছু অর্থ বেনামি নামে পাঠিয়েছিলো তারপর আর খোঁজ রাখেনি। প্রচণ্ড অভিমান জমেছিল। কি প্রয়োজন ছিল নিজের অবিবাহিত মেয়েকে বাচ্চাসহ একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার? যদি এমন না হতো তবে আজ ঠিকই আরিয়ান বাবা মা নিয়ে সুখী পরিবারে বসবাস করতে পারতো। মায়ের মমতা ছায়ার আচল থাকতো মাথার উপরে। পুরাতন ভাঙাচুর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। গতকাল জাহানের সঙ্গে দেখা করে আসার পথে ফোন পেয়েছিলো নানিজান অসুস্থ। দেখার মতো কেউ নেই। একজন ভৃত্য আছে সেও আর থাকতে চাইছে না। আরিয়ান দ্রুত বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো। বাইরে থেকে যতটা খারাপ দেখতে ভেতরে তেমনটা না। বেশ গোছানো। এক সময় হয়তো এই বাড়িতে সুখ ঐশ্বর্য সবটাই ছিল। পাশাপাশি আটটি কক্ষ বিশাল একটা উঠান। পশ্চিমে টিন সেটের দুখানা ঘর সুন্দর একটা বেলকনি আছে। আরিয়ান প্রথমবার এই বাড়িতে পা রাখলো। ওকে এগিয়ে আসতে দেখে মধ্য বয়সি এক মহিলা দৌড়ে আসলো। এদিক ওদিকে চেয়ে চিৎকার করে বললে উঠলো,

> আরিয়ান বাবা?
আরিয়ান মাথা নাড়লো। ভদ্রমহিলা খুশীতে প্রায় কেঁদে দিয়েছে। দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে টানতে টানতে কক্ষে নিয়ে গেলেন। খোলা জানালার পাশের পালঙ্কে সাদা রঙের বিছানায় এক বৃদ্ধ মহিলা শুয়ে আছে। আরিয়ান চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো। মাথার উপরে ঘটঘট আওয়াজ করে ফ্যান চলছে। বৃদ্ধার গায়ের রঙ আর চাদরের রঙ সেম সাদা। ভদ্রমহিলা এক পাশ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মুখখানা দেখে কি যে পবিত্র লাগলো ওর মন একেবারে শান্ত হয়ে গেলো। এতদিনের রাগ অভিমান সবটা হাওয়ায় মিশে একাকার। আরিয়ান নানিজানের হাতখানা আলতো করে ছুয়ে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদুকণ্ঠে ডাকলো,

> নানু শুনতে পাচ্ছো?
কয়েকবার ডাকার পরেই উনি চোখ খুঁললেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কেঁদে বলে উঠলেন,
> তুমি আমার সুরমার ছেলে? আমার নাতি? কতবার খুঁজেছি তোমাকে। নানুর উপরে অভিমান করে দেখতে আসোনি। ওরা আমাকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে দিলোনা দাদুভাই। মা কোনো ভুল করেনি। তুমি জানোনা ওরা কিছুই সত্যি বলছে না। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার সুমরার সঙ্গে। আল্লাহ আমাকে হয়তো বাঁচিয়ে রেখেছেন শুধুমাত্র তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে। কথা দাও মায়ের নামে রটে যাওয়া প্রতিটা মিথ্যাচারের সঠিক সত্যিটা বের করে আনবে। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর মায়ের নোটবুকে লেখা আছে। তুমি এখানে এসেছো কাউকে বলোনা। সত্যিটা খুঁজে বের করো। যাদেরকে তুমি আপন ভাবো আসলেও কি ওরা তোমার আপন? কতদিন পথ চেয়ে ছিলাম আসলে না। সত্যটা সকলের সামনে আসার প্রয়োজন।

ভদ্রমহিলা আর কথা বলতে পারলোনা। শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আরিয়ান অস্থির হয়ে উঠলো। ভীষণ অসহায় লাগছে। কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। ফোন করে হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাশের ভদ্রমহিলাকে বলল,

> হাসপাতালে নিতে হবে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে?

> ডাক্তার দেখিয়েছি বাবা কিন্তু শেষ সময় উপস্থিত। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। হাসপাতাল থেকে দুদিন আগেই ফিরেছি। তোমাকে অনেকবার চিঠি লিখেছি পরে আমার স্বামী তোমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোন দিয়েছে। ভয় করে বাবা,এই বিশাল বাড়িতে অসুস্থ মানুষ নিয়ে থাকি। তাছাড়া তোমার নানুর দূর সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে বাড়ি দখল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। হুমকি ধামকী দিচ্ছে। এই বাড়িটা তোমার মায়ের। কত স্মৃতি আছে। তুমি এটাকে বাঁচাও।

আরিয়ান চোখ বন্ধ করলো। কিছু মানুষ আছে স্বার্থের জন্য যা খুশি করতে পারে। এদের বিবেক পশুর থেকেও অধম। টানা ঘন্টা খানিকটা চললো এমন অস্থির অবস্থা। তারপর পুরোপুরি শান্ত। দুপুরের আগেই ভদ্রমহিলা নিজের স্বামী সন্তানের অভিমুখে যাত্রা করলেন। পৃথিবীর ভোগ বিলাশের মায়া ত্যাগ করলেন। আরিয়ান পাথরে পরিণত হলো। চোখে পানি শূন্য। এতোদিন যার দায়িত্ব অবহেলা করেছে আজ শেষবারের সময় কি এমন করতে পারবে? কতটা ভুল করে এসেছে সেতো চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন নানিজান। বিকাল নাগাদ দাফন শেষ হতে স্থানীয় থানায় কথাবার্তা বলে নিলো। কাজের মহিলাটাকে বলে দিলো আজ থেকে এখানেই থাকতে। গ্রামের সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে সোজাসুজি বলে আসলো বাড়ি নিয়ে যেনো অশান্তি না করে। আরিয়ান চটে গেলে উড়াধুড়া পি*টিয়ে আসবে।ছোট করে হুম*কিও দিয়েছে। কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। দূরের রাস্তা বাড়িতে ফিরে ক্লান্তিতে আর চোখ খুঁলতে পারলোনা।
__________
কমোলিনি আজ বেশ খুশি। মেয়ের অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার টিকিট পেয়ে গিয়েছেন। ওকে নিয়ে চিন্তা নেই। ছেলেটা হয়েছে গাধা সারাদিন বখাটে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আজেবাজে কাজকর্মে যুক্ত থাকে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে বছর তিনেক আগে। এই নিয়ে আরিয়ান কয়েকবার শাসন করতে চেয়েছে কিন্তু কমোলিনি মানা করেছে। বাবা ছাড়া ছেলে একটু আধটু এমন হয়ে থাকে। আরিয়ান কিছু বলেনি। নিজের মায়ের জন্য এরা বাবা হারিয়েছে বিষয়টা ভেবেই খারাপ লাগে। মেয়ের খুশীতে কমোলিনি ভাবলো ইব্রাহিম খানকে ফোন করবেন। নতুন বউকে এই বাড়িতে একদিনের জন্য নিয়ে আসবেন। মেয়েটা কবে ফিরে আসবে ঠিক নেই। ভাইয়ের পরিবারকেও নিয়ন্ত্রণ করলেন। আরিয়ান নিজের কক্ষে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলো সেই সময় উনি গিয়ে উপস্থিত হলেন।

> বাবা বলছিলাম কি বউমাকে একদিনের জন্য এখানে আনলে কেমন হয়? তোমার বাবা মা আর বোনেরা আসছে। ওরাও দেখতো। ভাইজান সেদিন বলছিলেন। কি বলো তুমি?

ফুপির কথা শুনে আরিয়ান থমকে গেলো। ফুপিমাকে কিভাবে বলবে ওই মেয়েটা মোটেই সুবিধার না। এক মেয়েকে দেখিয়ে ইব্রাহিম খান অন্য মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। ওকে চুপচাপ দেখে কমোলিনি আবারও বলল,

> ও বাড়িতে নিমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিই তাহলে?

> আপনার যেমন ইচ্ছে ফুপিমা। চরম একটা ভুল করেছেন সেটা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন তখন কিন্তু কিছু বলতে আসবেন না।

কমোলিনি হাসতে হাসতে ওর কথা উড়িয়ে দিলেন। ছেলেটা বিয়ের পর থেকেই এমন করছে। বউ বদল হয়েছে সেই নিয়ে কত চিন্তা। সন্ধ্যা নাগাদ বাড়িতে হৈচৈ করে ভাইয়ের পরিবার এসে হাজির হলো। তার ঘন্টা খানিকটা পরে ইব্রাহিম খান আসলেন স্ত্রী কন্যাদেরকে নিয়ে। বাড়িতে থাকা তিনটা মেয়েকে উনি সমান নজরে দেখেন। জাহান লাল শাড়িতে ফুপি শাশুড়ির দেওয়া অলঙ্করণ পরেছে। গেটের কাছে নেমেই আলেয়া ফিসফিস করে বলল,
> জাহান আমার কিন্তু ভয় করছে। আপাকে না আনলেও পারতি। এখানে ঝামেলা হবে খুব। এরকম তো প্লান ছিল না।

জাহান নিজের ঘোমটা খানিকটা টেনে নিয়ে উত্তর দিলো,
> দূর ভয়ের কি আছে? আমার শশুর বাড়িতে এসেছিস পুটি মাছের প্রাণ নিয়ে? তুই না আলেয়া? সাহস রাখ কিছু হবে না।

ওদের কথাবার্তার মধ্যেই কমোলিনি এসে হাজির হলেন। পাশাপাশি তিন মেয়েকে দেখে খানিকটা ভড়কে গেলেন। নিজের পছন্দ করা মেয়ের হাতটা ধরে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। বাকীরা পেছনে পেছনে এগিয়ে আসলো। আরিয়ান উপর থেকে সবটা দেখছে। সকলে তখন আলাপ করতে ব্যস্ত ঠিক তখনই জাহান নিজের ঘোমটা তুলে বেশ শব্দ করেই বলল,

> শশুর বাড়িতে প্রবেশ নাই করতেই আমার ছবি এখানে স্থান করে নিয়েছে? ফুপি মা সত্যি আপনি ভীষণ ভালো।

জাহান অনবরত কথা বলছে। কারো মুখে কথা নেই। ওপাশ থেকে ফিরোজ এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল,
> মেহের আপা? সত্যিই তুমি ফিরে এসেছো?

জাহান চমৎকার করে হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বলল,
> আমি আপনার বয়সের থেকে অনেক ছোট ভাইজান। তাছাড়া আমি হাজান মেহের না। আরিয়ান শাহরিয়ারের নব স্ত্রী।

কমোলিনি এতোক্ষন চুপচাপ ছিলেন কিন্তু এখন পারলেন না। উনি ইব্রাহিম খানের দিকে চেয়ে জিঞ্জাসা করলেন,

> এসবের মানে কি ভাই সাহেব? আপনি সত্যি আমাকে ঠকালেন? এক মেয়েকে দেখিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে দিলেন? আমি আপনার নামে প্রতারণার মামলা করবো। এখুনি আপনারা এই বাড়ি থেকে চলে যাবেন। এই বিয়ে আমি মানতে পারছি না। আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নাটক করা হচ্ছে? ওরা মেহেরকে কতটা ভালোবাসে। আপনি নিজের মেয়েকে মেহের সাজিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়*যন্ত্র করছেন। এটা কিছুতেই হবে না। এখুনি বেরিয়ে যাবেন।

কলোলিনি থামতেই ফিরোজ চোখ গরম করলো। ধমক দিয়ে বলল,

> আপনি চুপ করবেন? মেহের আপার মতো দেখতে হলেও ওর ডান কপালে যে তিলটা আছে ওটা মেহের আপার ছিল না। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের এতো মিল শুধু কাকতলীয় কিভাবে সম্ভব? আমি এখুনি আঙ্কেলকে ফোন করছি। উনারা ফিরলেই সব উত্তর পাওয়া যাবে। যতদিন উনারা ফিরবেন না ততদিন ও এখানে থাকবে।

> কি বাবা একবার বোঝার চেষ্টা করো। ইব্রাহিম খান নিজের ভাগনিকে দেখিয়ে এই মেয়েকে বাড়িতে পাঠিয়েছে সেতো এমনি এমনি না। গভীর ষড়*যন্ত্র আছে। আমি কিছুতেই চৌধুরী পরিবারের কোনো ক্ষতি হতে দিব না।

> আপনি চৌধুরী পরিবারের বউ আর আমি এই পরিবারের ছেলে। আমার পরিবারের ভালো খারাপ সেসব আমি বুঝবো। তাছাড়া নিহারিকাকে দেখে আমি ইব্রাহিম আঙ্কেলকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওকে দেখে না। আমার বোনের মতো হুবহু দেখতে মেয়েটা। ওকে যেতে দিব এমনি এমনি?

কমোলিনি ঢোক গিলে অসহায় দৃষ্টিতে উপরের দিকে চাইলো। আরিয়ান এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এতোটা ঝামেলা হচ্ছে তবুও নিচে নামছে না। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখনই ম্যানেজার আসাদ আলী এগিয়ে আসলেন। উনি এই বাড়ির পুরাতন লোক। ফিরোজকে বোঝাতে মুখ খুলল,

> দেখ বাবা, ওই মেয়েটার সঙ্গে এই পরিবারের কিভাবে সম্পর্ক থাকবে বলো? মেহের মা*রা গেছে এমনকি তোমার চাচি আম্মাও পৃথিবীতে নেই । তোমার চাচাজান আজ অবধি বিয়ে শাদী করেননি। তোমার ছোট চাচি আম্মা ঠিকই বলছেন এই মেয়ের মধ্যে ঝামেলা আছে। আরিয়ান বাবার সঙ্গে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো এটাই ভালো হবে।

ম্যানেজারের কথা শুনে ইব্রাহিম খান বেশ চটে উঠলেন। তেড়ে এসে বললেন,

> আমার মেয়ে কি সস্তা? পুরোপুরি পঞ্চাশ বিঘা জমির দখলদারি দিয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। ইতিমধ্যে সেখানে ফার্ম হাউজ তৈরীর অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। মফস্বলের এমপি আমি। কিছু করতে চাইলে দশবার ভেবে নিবেন। থানা পুলিশ আমিও জানি।

কমোলিনি পড়েছে অকুল পাথারে। জমানো টাকা পয়সার অর্ধেক ফার্ম হাউজ তৈরীর কাজে খরচ হয়েছে। জমিটা এখনো জাহানের নামেই আছে। কি একটা বোকামি করে ফেলেছেন এটা ভেবে হার্ট এ্যাটাকের অবস্থা। উনি ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন,

> বিষয়টা পরে ভাবা যাবে। আমি কক্ষে যাচ্ছি। প্লিজ আর কোনো তর্কাতর্কি করবেন না। আমার শরীর ভালো লাগছে না।

উনি কথা শেষ করে দ্রুত বিদায় নিলেন। উনার পেছনে আরোহী আর ম্যানেজার দৌড়ে গেলো। আরিয়ান চুপচাপ নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো।
_________________
রাতের খাবার যে যার মতো করে নিয়েছে। আরিয়ানকে ডাকতে এসেছিল কিন্তু ও যায়নি। অশান্তিতে খাবার গলা দিয়ে নামবে না। গলা শুকিয়ে আসছে দেখে রাতে পানির জগ হাতে বেরিয়ে আসলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় জাহান আর ম্যানেজার কে বসে থাকতে দেখে ও চমকে গেলো। এই মেয়ে বাড়িতে ফিরে যায়নি বিষয়টা হজম হলো না। ও আড়চোখে দেখতে দেখতে যাওয়া সময় থমকে গেলো। জাহান ম্যানেজারকে প্রশ্ন করছে,

> আপনার বয়স কতো?
ম্যানেজার কাচুমাচু মুখে উত্তর দিলো,
> হিসাব নেই আম্মা। পঞ্চাশ হবে হয়তো।
> আপনার পরিবারে কে কে আছে? সারাবছর এখানে থাকেন আপনি?
> আমার সাতকুলে কেউ নেই। বাল্যকালে কাকাবাবু আমাকে ঢাকা শহর থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন। সেই থেকে এই পরিবারের পাশে আছি। এই পরিবারের মঙ্গল কামনা করি।
জাহান কিছু একটা ভেবে বলল,
> সেলারি নেননা?

ম্যানেজার আমতা আমতা করে বলল

> মানে কাকা বাবু আর কমোলিনি ম্যাডাম দুজনের জোরাজুরিতে নিই আর কি। পঞ্চাশ হাজারের মতো। এতেই হয়ে যায় আমার।

> বলেন কি পঞ্চাশ হাজার টাকা? থাকছেন খাচ্ছেন আবার পঞ্চাশ হাজার টাকা মাইনে নিয়ে পকেটে ভারি করছেন তাহলে এই পরিবারের মঙ্গল কিভাবে কামনা করলেন? টাকা পেলে এমন কথা যে কেউ বলে। আচ্ছা আরিয়ান সাহেব আপনি কত টাকা নেন?

জাহান আরিয়ানের দিকে চেয়ে শেষের প্রশ্নটা ছুড়ে দিলো। সাবলীলভাবে প্রশ্ন করছে। মুখটা ওর বেশ গম্ভীর। মনে হচ্ছে কোনো চুরির তদন্তে নেমেছে। ম্যানেজের দিকে চেয়ে আরিয়ান বেশ হাসি পাচ্ছে। লোকটা ভালোই ফেঁসেছে। ওকে চুপচাপ দেখে
আবারও প্রশ্ন আসলো,

> কি হলো বলুন?

> টাকা কেনো নিব? পুরোটা আমি দেখাশোনা করি নিজের ভেবে। তাছাড়া আলাদা টাকা জমিয়ে আমার কি কাজ? যখন যা প্রয়োজন সেতো নিতেই পারি। চাচা আপনি নিজের কক্ষে গিয়ে ঘুমান। আপনার সামনে বসে আছেন এই এলাকার হবু ব্যারিষ্টার। আইনের লোক সাধারণ মানুষ দেখলেই ওদের চোর মনে হয়। আপনাকে প্রশ্ন করতে করতে শহীদ ছাড়বে তবুও থামবে না।

আরিয়ানের বলতে দেরী কিন্তু লোকটার উঠতে দেরী হলোনা। জাহানও সোফা থেকে উঠে পড়েছে। লোকটাকে যেতে দেখে খানিকটা চিৎকার করে বলল,

> সুযোগ পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছেনতো?সকাল হোক আপনাকে আমার আরও প্রশ্ন করার আছে। প্রতিমাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আপনি কি করেন সেটাও দেখছি। আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ না।
আরিয়ান ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নামিয়ে এক গ্লাস পানি জাহানের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

> পানি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করুন। ফিরে যাননি কেনো? ম*রার জন্য পালক গজিয়েছে না? আমার কক্ষে আসুন। কতদিন আছেন?

> যতদিন ওই বাড়ির লোকজন ফিরে না আসছে ততদিন অবধি আছি। ফিরোজ ভাইজান রিকুয়েস্ট করেছেন। আব্বাজান আমাকে আর আপাকে রেখে গেছেন। আচ্ছা এই ম্যানেজার লোকটাকে কেমন চোরচোর মনে হচ্ছে কেনো বলুনতো?
জাহান কথা শেষ করে পানিতে চুমুক দিতেই উত্তর আসলো,
> এটা আপনি ভালো জানেন। শুনুন যতদিন আছেন আপনার সুবিধা অসুবিধা এমনকি খাওয়ার দায়িত্ব সবটা আমার। আমি চাইছি না আপনি এই বাড়ির পানি পযর্ন্ত পান করেন। আশাকরি এইটুকু কথা শুনবেন।

আরিয়ান কথা শেষ করে চলে আসছিলো ঠিক তখনই জাহান মৃদু হেসে বলল,
> আপনি আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেনতো মেহের আপার মতো শরবতের মধ্যে বি*ষ মিশিয়ে কেউ আমাকে মে*রে ফেলবে?

আরিয়ান থমকে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়ে কোমর বেধেঁ নেমেছে। তাই শুধু বলল,
> দ্রুত কক্ষে আসুন আমি অপেক্ষা করছি।

জাহান ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে চোখ বন্ধ করলো। এই বাড়ির প্রতিটা ইট পাথর জানে সামান্য অর্থের জন্য কিভাবে বাড়ির মেয়েদের বছরের পর বছর বি*ষ দিয়ে প্রাণ নেওয়া হয়। জাহান কাউকে ছাড়বে না। প্রতিটা প্রাণের হিসাব নিয়ে তবেই এই বাড়ি থেকে বিদায় নিবে।

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here