প্রনয়ের_দহন #Nusrat_Jahan_Bristy #পর্ব_২৩

0
647

#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_২৩

ফ্লোরে পরে আছে তীর অজ্ঞান হয়ে। তীরের এমন অবস্থা দেখে আয়েশা সুলতানার মাথা আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ইহান জলদি তীরকে কোলে তুলে বেডে শুয়েই দেয়। তীরের সারা শরীর জ্বরে পুঁড়ে যাচ্ছে। শরীরের হাত পর্যন্ত দেওয়া যাচ্ছে না এত পরিমানেই জ্বর এসেছে। ইহান তীরের পালস চেক করে বলে।

–জ্বর এসেছে আর সাথে পালসের গতিই খুব একটা স্বাভাবিক নয়।

আয়েশা সুলতানা দু কদম পিছিয়ে যায়। এই জ্বরটা তীরের জীবনে একমাত্র দুশমন। গতবারের জ্বরে তীরের অবস্থা খুব খা’রাপ হয়ে গিয়েছিলো। আয়েশা সুলতানার শরীর অবশ হয়ে আসছে আগের জ্বরের ঘটনার কথা মনে পড়তেই ধপ করে ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলে।

–আমার মেয়েটাকে বাঁচাও ইহান। ওর কিছু হয়ে গেলে আমার সুখের সংসারটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ওর বাবা তো পাগল হয়ে যাবে ইহান তুমি কিছু একটা করো বাবা।

নেহা বেগম আয়েশা সুলতানাকে জড়িয়ে ধরে বলে।

–ভাবি আপনি শান্ত হোন এভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে কি করে হবে। তীরের কিচ্ছু হবে না সব ঠিক হয়ে যাবে একটু সময় দেন।

ইহান বলে।

–ইশা বাড়িতে গিয়ে আমার অফিসের ব্যাগটা নিয়ে আয়।

ইহান বলার সাথে সাথে ইশা ছুটে চলে যায়। কিছুক্ষন পরেই ইশা ফিরে আসে। ইহান জলদি তীরের চিকিৎসা শুরু করে দেয়। এখন হসপিটালে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই যা করতে হবে সব বাড়ি থেকেই করতে হবে। থার্মোমিটার দ্বারা চেক করে দেখে ১০৪° জ্বর তীরের। সবাই এটা শুনে আতংকে উঠে। গত বারেও এমনটা হয়েছিলো। এবারও যদি গত বারের মতো খারাপ কিছু ঘটে তাহলে? সবাই তীরের জন্য উপরওয়ালার কাছে দোয়া চাইতে লাগলো। ছোট অভি তো বোনের এমন অবস্থা দেখে কেঁদেকুটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।

ইহান তাড়াতাড়ি করে তীরকে ইনজেকশন পুশ করে। ইনজেকশন পুশ করার পাঁচ মিনিট পরেই তীরের শরীরের স্বাভাবিক হতে শুরু করে। আয়েশা সুলতানা জট করে উঠে মগ দিয়ে পানি এনে মেয়ের মাথায় ক্রমাগতভাবে জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে যার জন্য আরও তাড়াতাড়ি জ্বরটা নেমে যাচ্ছে। এর মাঝে তীর পিটপিট চোখে একবার তাকিয়ে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। আয়েশা সুলতানা মেয়ের তাকানো দেখে প্রফুল্ল কন্ঠে বলে।

–তীর মা আমার তুই ঠিক আছিস? এক বার মা বলে ডাক না মা আমার।

ইহান বলে।

–আন্টি ওকে ডাকবেন না। ঘুমিয়ে পড়েছে তবে ও এখন আউট অফ ডেঞ্জার তাই চিন্তা করার কিছু নেই।

ইহান তীরের পালস চেক করার সময়ে নজর যায় তীরের কাটা স্থানটার দিকে। ভ্রু-কুচকে নেয় ইহান এটা ভেবে হাতটা এভাবে কাটলো কি করে? তাই আয়েশা সুলতানাকে প্রশ্ন করে।

–ওর হাতটা কাটলো কি করে?

–লৌহাতে লেগে নাকি কেটে গেছে।

–উহু! দেখে তো মনে হচ্ছে অন্য কিছু দ্বারা কেটেছে। কিন্তু কি দ্বারা কেটেছে বুঝতে পারছি না। আমি ওর হাতটা ড্রেসিং করে দিচ্ছে। এই কাঁটা স্থানটার বিষক্রিয়ার জন্যই ওর জ্বরটা উঠেছে।

ইহান তীরের হাতটা ভালো করে ড্রেসিং করে ঔষুধ লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলে।

–তীরের জ্ঞান ফিরতে কিছুক্ষন সময় লাগবে। তবে চিন্তার কোনো কারন নেই সময় মতো ইনজেকশনটা দেওয়াতে অনেকটা কট্রোলের ভেতরেই আছে জ্বরটা আর একটু দেরি করলেই হয়তো প্রবলেম হতে পারত।

আয়েশা সুলতানা ভাঙ্গা গলায় বলেন।

–তোমাকে কি করে ধন্যবাদ দিবো তা আমার জানা নিয়ে ইহান। আজ যদি তুমি বাড়িতে না থাকতে তাহলে যে কি হতো মেয়েটার।

–আন্টি আপনি প্লিজ এভাবে বলবেন না। আমি একজন ডাক্তার আমার কাজটাই রোগীর সেবা করা তার জন্য ধন্যবাদ দেওয়ার কোনো দরকার নাই। আমি বরং ওর প্রেসারটা চেক করে দেখি।

ইহান তীরের প্রেসার চেক করে দেখে প্রেসারও স্বাভাবিকেই আছে। কপালে হাত দিয়ে তাপমাএ চেক করে বলে।

–এখন স্বাভাবিক হয়েছে শরীরের তাপমাএ। আর ঘুম থেকে উঠার পর কিছু খাইয়ে দিয়ে ঔষুধ গুলা খাওয়াবে। ওকে ডেকে তুলে খাওয়াবে না ওর নিজে থেকে যখন ঘুম ভাঙ্গবে তখন খাওয়াবেন।

—আচ্ছা বাবা।

–তাহলে আমি এখন আসি আন্টি আমার আবার হসপিটালে যেতে হবে।

সোহলে ফরাজী, ইহান আর কেয়া চলে যায়। শুধু থেকে যায় ইশা আর নেহা বেগেম। ইশা তীরের মাথার পাশে বসে বন্ধবীর মাথা পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ছোট অভি বোনের পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। শাপলা বেগম আগেই চলে গেছেন নাতনীর এমন অবস্থা দেখে ওনার প্রেসার “ল” হয়ে গিয়েছিলো। তাই ঔষুধ খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। নেহা বেগম তীরের মাকে বলে।

–ভাবি এখন আর চিন্তা করবেন না। তীর এখন বিপদমুক্ত আপনি বরং একটা কাজ করেন ও কি খেতে পছন্দ করে সেটা বানিয়ে ফেলুন। ঘুম থেকে উঠার পর খাইয়ে দিবেন।

–জি ভাবি। কিন্তু মেয়েটাকে একা রেখে আমি কিভাবে?

এর মাঝে ইশা বলে।

–একা কোথায় আন্টি? আমি আছি তো! মা আজকে আমি এখানেই থাকবো তীরকে এমন অবস্থায় রেখে বাড়িতে যেতে পারবো না।

নেহা বেগম মুচকি হেসে বলে।

–ঠিক আছে মা তুই থাক তর প্রিয় বন্ধবীর কাছে।

তারপর আয়েশা সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলে।

–তীরের পাশে ইশু আছে আপনি বরং নিচে গিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করুন।

–হুমম।

__________

রাত সাড়ে আটটা বাজে ইশান তখন বাড়ি ফিরে। কলিং বেল বাজানোর কিছুক্ষন পরেই বাড়ির কাজের মাহিলা রেহেলা খালা এসে সদর দরজা খুলে দেয়। ইশান বাড়িতে ডুকে সোজা নিজের ঘরে ডুকে ফ্রেস হতে চলে যায় ওয়াসরুমে। আধ ঘন্টা পর নিচে নেমে আসে ইশান টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে। চুল গুলা এখনও ভিজা সদ্য শাওয়ার নিয়ে নিজেকে খুব সতেজ লাগছে ইশানের। নিচে নেমেই মাকে ডাকতে থাকে কিন্তু কারোর কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাড়িটা কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। বাড়ির কারোর কোন সাড়াশব্দ নেই গেলো কোথায় সবাই? ইশান মায়ের ঘরে যেতে নিলেই রেহেলা খালা এসে বলে।

–ছোট ভাইজান বাড়িতে কেউ নেই!

ঈশান ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বলে।

–নেই মানে! কোথায় গেছে এই অসময়ে সবাই?

–আসলে ভাইজান হয়েছে কি? তীর আপার….

তীরের নামটা শুনার সাথে সাথে ইশানের বুকটা ধ্বক করে উঠে। অজানা ভয় কাজ করতে থাকে মনের ভেতরে। মেয়েটার হাত কেটেছে এখন আবার কি হলো! রেহেলা খালার কথা মাঝেই ইশান অস্থির কন্ঠে বলে।

–কি হয়েছে তীরের?

–আসলে তীর আপায় জ্ঞান হারায়া ফেলাইছিলো জ্বর আসার কারনে। বড়ো ভাই জান বাড়িতে থাহনে রক্ষা হইছে না হলে যে কি হইতো তীর আপার আল্লাই জানে। এহন একটু আগেই জ্ঞান হিরছে আপার তাই সব্বাই মিলে দেখতো গেছে।

ইশানের পা জোড়া থমকে গেছে। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে তীরের আগের বারের জ্বর উঠার দৃশ্যটা যে জ্বর সবাইকে এক প্রকার কাঁদিয়ে ছেড়েছিলো। ইশানকে এমন ভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রেহেলা খালা বলে।

–কি হইছে ছোট ভাই জান?

ধ্যান ভেঙ্গে ইশানের কিছু না বলে ছুটে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে উদ্দেশ্য তীরকে এক নজর দেখার। মেয়েটা এখন কি অবস্থায় কে জানে? ইশান বার বার খোদার কাছে একটা দোয়াই করছে তীরের যেন কিছু না হয়। এই মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে যে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। ইশানের তো এখন মনে হচ্ছে যা কিছু তীরের সাথে হচ্ছে সবটা ওর জন্যই। তাই নিজেকে যত পারছে তত গালি দিচ্ছে।

ইশান তীরের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় শব্দহীন ভাবে। কেউ এখনও বুঝতে পারে নি যে ইশান এসেছে সবাই তো ব্যস্ত অসুস্থ তীরকে নিয়ে। ইশানের নজর যায় তীরের দিকে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে আধ শুয়া হয়ে‌ শুয়ে আছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কেমন কাল সেটে দাগ পরে গেছে মেয়েটার। আগের সেই উজ্জ্বলতাটা হারিয়ে গেছে যেন এই দুইদিনে।

তীর ঔষুধ গুলা খাওয়ার পরপরেই নজর যায় ইশানের দিকে। ইশানকে দেখার সাথে সাথে তীর অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তীরের এই ইগনোরটা ইশান সহ্য করতে পারছে না একে বারে বুকের বা পাশটায় গিয়ে ধনুকের তীরের মতো যেন বিঁধছে। ইশান অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তার ভালোবাসার মানুষটার দিকে। ইশান কি করে বুঝবে এই মেয়েটাকে ওর কিছু হয়ে গেলে যে ও নিঃস্ব হয়ে যাবে।

এমন সময় অভি তীরের ঘরে ঢুকতে যাবে তখন ইশানকে দেখে থেমে যায় আর সাথে সাথে বলে।

–ইশান ভাইয়া তুমি এখানে?

অভির কথা শুনে সবাই ইশানের দিকে ফিরে তাকায়। ইশানকে দেখে আজিজুল আহমেদ বলে।

–একি ইশান তুমি বাইরে কেন দাঁড়িয়ে ভেতরে এসো।

–না না আঙ্গেল আমি এখানেই ঠিক আছি। আসলে বাড়িতে এসে জানতে পারি রেহেলা খালার কাছে তীর নাকি অসুস্থ। তাই তীরকে দেখতে আসলাম। এখন ও কেমন আছে?

–ভালো আছে বাবা এখন। তুমি ভেতরে এসো।

ইশান ঘরের ভেতরে পা ফেলতে নিবে সাথে সাথে তীর বলে উঠে।

–বাবা আমি এখন রেস্ট নিবো তাই ঘরটা খালি করলে একটু সুবিধা হয় আমার জন্য। এত কোলাহল ভালো লাগছে না আমার মাথা ব্যথা করছে। শুধু ইশু থাকুক আর তোমরা সবাই যাও এখান থেকে।

ইশানের পা জোড়া থেমে যায় ভেতরে ডুকতে গিয়েও ডুকতে পারলো না। ইশান বুঝতে পারছে তীর যে ওকে দেখেই এই কথাটা বলেছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ইশান। ভেতরে থেকে এক দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। তীরের চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে #প্রনয়ের_দহন যে দহনে এত দিন ও পুড়েছে আজকে সেই দহনে পুড়ছে তীর। আজিজুল আহমেদ বলে।

–হে হে মা তুমি রেস্ট নাও আমরা চলে যাচ্ছি।

একে একে সবাই বের হতে শুরু করে ঘর থেকে। ইশান এখনও দাঁড়িয়ে থেকে তীরকে দেখে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটা বুকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু একটা অদৃশ্য জড়তা যেন বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সামনে। নেহা বেগম যখনেই বের হতে নিবে তখনেই ইশানকে বলে।

–চল বাবা ও রেস্ট করুন।

ইশান মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। ইশান বের হতে নিবে তখনেই কিছু একটা মনে পড়ে তীরের দিকে তাকিয়ে বলে।

–ভালো থাকিস তীর। আসি আমি। নিজের খেয়াল রাখিস।

ইশান চলে যেতে ডুকরে কেঁদে উঠে তীর। ইশা হতভম্ব হয়ে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে।

–কি হয়েছে তীর?

তীর কোনো উত্তর দেয় না নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে আর মনে মনে বলে।

–কেন এমন করছেন আমার সাথে ইশান ভাইয়া কেন? কেন নিজের মনের কথা বলছেন না? কেন এত লুকোচুরি কেন এত জড়তা কাজ করে আপনার মনে কেন?

ইশান বাড়িতে ডুকেই নিজের ঘর থেকে নিজের ফোন, ওয়ালেট আর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হতে নিবে তখনেই সামনে এসে মা দাঁড়ায় আর বলে।

–কোথায় যাচ্ছিস ইশান এই সময়?

–আমি একটু আসছি মা।

–না কোনো আসা আসি নাই। তুই এখন বাইরে যাবি না ব্যস্।

–প্লিজ মা এমন ছেলে মানুষী করো না তো।

বলে পাশ কেটে চলে যায় আর নেহা বেগম চিৎকার করে বলে।

–ইশান আমার কথা শুন বের হোস না এখন।

কে শুনে কার কথা ইশান মার কথা অগ্রাহ্য করে বের হয়ে পড়লো। ইশানের ধম বন্ধ হয়ে আসছে ঘরে থাকতে তাই নিজেকে হালকা করার জন্য এখন বের হওয়াটা খুব দরকার ওর জন্য।

#চলবে______

আমি চাইছি ইশান আর তীরের মিল করাতে কিন্তু পারছি না গল্প তার গল্পের গতিতেই চলছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি বলে দিবে ইশান তার মনের কথা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here