#মনের_উঠোন_জুড়ে
#পর্ব_২৭
#লেখনীতে_নূন_মাহবুব
-” কি হলো বড় আব্বু? উত্তর দাও ? বলো না আমার পাপা মম কি এখনো বেঁচে আছে?”
-” হ্যাঁ , তোমার পাপা মম বেঁচে আছে।”
-” তুমি এতো বড় একটা সত্যি কেন সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছিলে? কেন সবাই কে বলো নি আমি নকল উষ্ণতা না। আমিই এসিপি রায়হান মীরের মেয়ে উষ্ণতা মীর।”
-” তোমার ভালোর জন্য।”
-” এটা কেমন ভালো বড় আব্বু?”
-” রায়হান আমার ছোট বেলার বন্ধু ছিলো। অবশ্য বন্ধু বললে ভুল হবে।সে আমার কলিজার একটা অংশ ছিলো। তোমাদের যেদিন কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিলো সেদিন আমি আর তোমার বড় আম্মু ও কক্সবাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিলো আমরা সবাই একসাথে যাবো। তোমাদের গাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছিলাম আমি আর তোমার বড় আম্মু। কিন্তু হঠাৎ করে তোমার বড় আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়ে।আমি রায়হান কে বলি সবটা। রায়হান বলে, এতো তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই। ভাবী সুস্থ্য হলে তারপর আয়। আমি গাড়ি রেখে তোমার বড় আম্মু কে নিয়ে স্থানীয় একটা হসপিটালে যাই।আর ফিরে এসে দেখি গাড়ির ডিকির মধ্যে তুমি র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছো। তোমার সাথে একটা চিরকুট ও ছিলো।যেটা ছিলো রায়হানের লেখা চিরকুট। যেইখানে লেখা ছিলো আমার কলিজার টুকরাটা কে তুই দেখে রাখিস দোস্ত।মেয়েটাকে তুই বাবার আদর স্নেহ দিয়ে বড় করিস। কখনো আবৃত্তি আর উষ্ণতা কে আলাদা চোখে দেখিস না।তবে একটা কথা , ওর আসল পরিচয় কখনো সবার সামনে আনবি না। চারিদিকে আমার অসংখ্য শত্রু রয়েছে।তারা আমার মেয়েটার আসল পরিচয় জানলে ওকে মে’রে ফেলবে। আমি তৎক্ষণাৎ তোমাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোমার স্মৃতি হারিয়ে যায়। তোমার পুরোনো অতীত তুমি ভুলে যাও।তোমাকে অনেক ডক্টর দেখানো হয়। তারা বলেন তুমি রেট্রোগ্ৰেড এ্যামনেসিয়ায় আক্রান্ত হয়েছো।যার কারনে তোমার পরিচয় ভুলে গেলে ও লিখতে ,পড়তে বা তুমি যে মার্শাল আর্ট শিখেছিলে সেটা তুমি ভুলে যাও নি।আমি সবসময় চেয়েছি তোমার স্মৃতি শক্তি ফিরে আসুক। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যেদিন আমার চাওয়া পূরণ হলো, তোমার অতীত তোমার সামনে এসে দাঁড়ালো , সেদিন আমি তোমার পাশে থাকতে পারলাম না। আমার স্থান হলো জেলখানায়।হয়তো আমার ফাঁ’সি ও হতে পারে।তবে আমার কোনো আফসোস থাকবে না। ছোটবেলায় রায়হান একবার আমাকে বাঁচিয়েছিলো।এবার না হয় আমি ওকে বাঁচিয়ে সেই ঋণ শোধ করে দিলাম।
-” তোমার কিছু হবে না বড় আব্বু। কিন্তু তুমি এটা বলো সেই মাস্টারমাইন্ড কে যে এই সব কিছুর পেছনে রয়েছে?”
-” আমি জানি না মনি।তবে এ যেই ছিলো সে এটা জেনে গিয়েছিলো যে তুমি শিক্ষা না, তুমি আসল উষ্ণতা।আর এটা ও জেনে গিয়েছিলো যে রায়হান আমার বন্ধু।আমি রায়হান কে বাঁচানোর জন্য সব করতে পারবো।তাইতো সে এই সুযোগ টা কাজে লাগিয়েছে। তিনদিন আগে যখন আমি হসপিটালে ছিলাম তখন আমার কাছে একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে কয়েক টা ছবি আর ভিডিও আসে।যেটা ছিলো তোমার মম আর পাপার। তোমার মম আর পাপার গাঁয়ে বোম লাগানো জ্যাকেট পরানো ছিলো।আমাকে বলা হয়েছিল আমি যদি সিআইডির কাছে আত্মসমর্পণ না করি তাহলে তোমার মম পাপা কে মে’রে দিবে। বিশ্বাস কর মনি আমি বাধ্য হয়েছি এসব করতে।না হলে যে তোমার মম পাপা কে বাঁচাতে পারতাম না।”
-” শিক্ষা চোখের পানি মুছে বললো, তুমি জানো আমার মম পাপা কে কোথায় আঁটকে রাখা হয়েছে?”
-” আমি শিওর জানি না মনি।তবে ভিডিও দেখে মনে হলো এটা কোনো পরিত্যক্ত জায়গা। আচ্ছা মনি তোমাদের গ্ৰামের বাড়ির কথা কিছু মনে আছে তোমার? তোমার মম পাপা কখনো তোমাকে তোমাদের গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে কিছু বলে নি?”
-” না , কিন্তু কেন?”
-” আমি রায়হানের সাথে অনেক বার তোমাদের গ্ৰামের বাড়িতে গিয়েছি। অনেক সুন্দর মনোরম পরিবেশ ছিলো। কিন্তু কয়েক বছর আগে তোমার ফুপি নিজের রুমে গলায় ফাঁ’স দিয়ে মা’রা যায়। এরপর থেকে আশেপাশের লোকজন বলতো তারা নাকি তোমার ফুপির আত্মা দেখেছে ঐ বাড়িতে।সবাই ভয় ভীতি নিয়ে থাকতো।যার কারণে একসময় বাড়ি টা কে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে দেওয়া হয়। আমার জানা মতে ঐ বাড়ির আশপাশের এক কিলোমিটার এর মধ্যে কোনো বসতি নেই।আর লোকে ভুলেও ভয়ে ঐ বাড়ি মুখো হয় না । আমার মনে হয় তোমার মম পাপা কে ঐ বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। তুমি সাহিত্য কে নিয়ে তোমাদের গ্ৰামের বাড়িতে চলে যাও।হয়তো তোমার গ্ৰামের বাড়িতেই মিলবে সব রহস্যের সমাধান।”
-” শিক্ষা সাদ্দাম শিকদারের হাতে চুমু দিয়ে বললো, ঠিক আছে বড় আব্বু। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।”
-” দেখো পাগলি মেয়ের কাণ্ড ? এইভাবে কেউ কান্না করে? তুমি যদি এইভাবে ভেঙ্গে পড়ো , তোমার বড় আম্মু, আবৃত্তি এদেরকে কে সামলাবে? তোমার বড় আম্মুর হয়তো আমার উপরে অভিমান হয়েছে।হয়তো আমাকে অনেক কথা ও শুনিয়েছে। কিন্তু আমি জানি সেসব তার মুখের কথা নয়। মেয়েটা যে বড্ড ভালোবাসে আমাকে। একবার আমি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম।সমাজে আমার মানসম্মান, টাকা, পয়সা ,ধন দৌলত কিছু ছিলো না। আমি তোমার বড় আম্মু কে বলেছিলাম আমাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু মেয়েটা আমাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে ছিলো।আমাকে ছেড়ে যায় নি।আজ এতো গুলো বছর পরে আবারো সেই অবস্থায় দাঁড়িয়েছি আমি।”
-” তুমি শুধু শুধু টেনশন করছো বড় আব্বু। তুমি যখন কিছু করো নি ,তাহলে এতো ভয় কিসের তোমার? আমি হয়তো কোনো আইনের লোক নই। কিন্তু একজন সিআইডি অফিসারের বউ ,আর একজন এসিপির মেয়ে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বড় আব্বু , তোমার এই চোখের পানির প্রত্যেক টা ফোঁটার দাম দিতে হবে ঐ খু’নী কে।আমি তাকে খুঁজে বের করবোই।এটা একটা বাবার কাছে তার মেয়ের প্রতিজ্ঞা বলে আর এক মিনিট ও দেরি না করে শিক্ষা সাদ্দাম শিকদারের হাত ছেড়ে বাড়ি চলে আসে। শিক্ষা বাড়িতে এসে দেখে ড্রয়িং রুমে সবাই বসে রয়েছে। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। একদম শুনশান নীরবতা কাজ করছে। শিক্ষা সবাইকে দেখেও না দেখার ভান করে নিজের রুমে চলে আসে। শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্য এসে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষা কে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলে, হসপিটাল ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলি তুই? আমাকে কি তোর মানুষ বলে মনে হয় না। আমার ফিলিংস এর কোনো দাম নেই তোর কাছে?যবে থেকে তুই বুঝতে পেরেছিস আমি তোর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি,তবে থেকে তুই আমাকে ইগনোর করতে শুরু করেছিস? কিন্তু কেন বল তো? কথা বলছিস না কেন ? আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি শিক্ষা?”
-” আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”
-” ওকে ফাইন। আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গিয়েছে। শুধু একবার এই ঝামেলা টা মিটে যাক ,আমি তোকে চিরদিনের জন্য মুক্তি দিয়ে দিবো।”
-” কি করবেন আপনি?”
-” ডিভোর্স দিবো তোকে। আসলে তোর কোনো যোগ্যতাই নেই একজন সিআইডি অফিসারের বউ হওয়ার।”
-” ওহ্ আচ্ছা! তবে আমি বলবো আপনার ও কোনো যোগ্যতাই নেই একজন সিআইডি অফিসার হওয়ার। কেমন সিআইডি অফিসার আপনি? কোনো সত্য মিথ্যা যাচাই না করে নিজের বাবার হাতে হাত কড়া পরালেন? একবার ও জানতে চায়লেন না এসবের আসল মাস্টারমাইন্ড কে? একজন নিরপরাধ মানুষের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়ে মনে করলেন কেস সলভ হয়ে গিয়েছে। বাহ্ দারুন । এখন সবাই আপনাদের কে বাহবা দিবে।এটাই তো চেয়েছিলেন আপনারা তাই না?”
-” কর্তব্যের কাছে সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে যায়। তুই কি মনে করছিস শুধু তোর একার কষ্ট হচ্ছে? আমাদের কষ্ট হচ্ছে না।আরে তিনি আমার জন্মদাতা পিতা।তার হাতে হাতকড়া পরাতে গিয়ে আমার ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না। বাবার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তিনি নিজের মুখে সবটা স্বীকার করেছে। তাছাড়া তার লকারে কোটি কোটি কালো টাকা পাওয়া গিয়েছে।”
-” আমি যদি ইচ্ছা করে আপনার লকারে কোটি কোটি কালো টাকা রেখে আসি ,তার মানে তো এটা নয় যে আপনি একজন কালো টাকার ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন।”
-” মানে কি বলতে চায়ছিস তুই?”
-” এটাই যে বড় আব্বু সম্পূর্ণ নির্দোষ।তাকে ইচ্ছা করে ফাঁসানো হয়েছে।এই সবকিছুর পেছনে অন্য রহস্য, অন্য কোনো মাস্টারমাইন্ড রয়েছে ।আর এই সব রহস্যের উন্মোচন করবো আমি।কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই আমার।”
চলবে ইনশাআল্লাহ।।