#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ৪২
#নাফিসা নীলয়া!
আজকে রেহানের ইম্পর্টেন্ট কাজ থাকায় তিতলিকে সে নিতে আসতে পারেনি। শিহাবও কাজে ব্যস্ত সে ও আসতে পারবে না। শিহাব বলেছিলো তিতলির জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তিতলি কলেজের সামনে দাড়িয়ে গাড়ির জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সবসময় রেহানই তাকে নিতে আসে। রেহান নিতে আসলে কখনো দেরি করে না। আজই তিতলিকে নিতে ড্রাইভারকে পাঠানো হয়েছে। আর ড্রাইভারের আসতেও দেরি হচ্ছে। তিতলি বিরক্ত ভঙ্গিতে রোদের মধ্যে দাড়িয়ে আছে।
নির্বান দূর থেকে তিতলিকে দেখছে। ওইদিনের পর থেকে তিতলির সাথে তার আর সামনাসামনি দেখাই হয়নি। সে তিতলির কথা রাখবে। কিন্তু তিতলিকে না দেখে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব না। এজন্যই সে মাঝেমাঝেই তিতলির কলেজ থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে তিতলিকে দেখে চলে যায়। নির্বান এবার তিতলিকে অনেকক্ষন যাবত দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই তিতলির কলেজের সামনে এগিয়ে গেল। তিতলি ঘড়িতে সময় দেখছিলো। নির্বান গিয়ে তিতলিকে ডাকলে তিতলি মাথা উচু করে তাকালো। নির্বান বললো।
-এতোক্ষন দাড়িয়ে আছেন যে! রেহান ভাই নিতে আসেনি এখনো?
তিতলি নির্বানকে দেখে অবাক হয়ে গেলেও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো।
-ছোট ভাইয়ের কাজ আছে। তাই আজ নিতে আসতে পারবে না। তবে ড্রাইভার পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এখনো আসছে না।
-ও কিছু মনে না করলে আমার সাথে আপনি আসতে পারেন। আমি নাহয় আপনাকে লিফ্ট দিলাম।
তিতলি নির্বানের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। তারপর বললো।
-ধন্যবাদ কিন্তু তার প্রয়োজন হবে না।
তিতলির কথা শুনে নির্বানের মনক্ষুন্ন হলো। তবুও সে হাসিহাসি মুখ করে বললো।
-আচ্ছা আমার সাথে যেতে হবে না। আমরা একটু বসে কথা বলতে পারি?
নির্বানের কথা শুনে তিতলি বললো।
-আপনাকে আমি ভালো করে চিনি না। আপনার সাথে কোথাও যাওয়া কি আমার ঠিক হবে?
তিতলির কথায় যুক্তি আছে আর এভাবে তিতলিকে বলা ঠিক হয়নি এটাও ভাবলো নির্বান। তাই সে বললো।
-আচ্ছা স্যরি। কিন্তু আপনার সাথে অনেকদিন ধরেই কিছু কথা বলতে চাইছিলাম। এখানে দাড়িয়ে কথা বলাও হয়তো ঠিক হবে না। এজন্যই বলেছিলাম কোথাও বসতে পারি। আচ্ছা থাক। অন্যদিন বলবো।
নির্বানের দিকে তাকিয়ে তিতলি কিছু ভাবলো। তারপর বললো।
-আচ্ছা চলুন সামনের পার্কটায় যাই। আমার ইচ্ছেমতো জায়গায় গেলে প্রবলেম হবে না।
তিতলির কথা শুনে নির্বান খুশি হলো।
-অনেক ধন্যবাদ।
তিতলি আর নির্বান একসাথে হাটতে হাটতে পার্কে গিয়ে বসলো। বসার পরে নির্বান চুপ করে রইলো। এতোক্ষন যা কথা বলছিলো। এখন সে তাও বলছে না। তিতলি দেখলো নির্বান চুপ করে আছে। সেজন্য সে বললো।
-আপনি এভাবে চুপ করে থাকলে আমরা এখানে আসলাম কেন? সময় চলে যাচ্ছে।
তিতলি তারপর ঘড়ি দেখে বললো।
-আপনার কাছে আধা ঘন্টা সময় আছে। আমাদের ড্রাইভার কাকাকে আমি চিনি। সে সবসময় লেট করে। আজও করবে। কিন্তু অনেকক্ষন পেড়িয়ে গেছে। আর আধা ঘন্টার ভেতর তিনি আসতে পারেন। আপনার যা কথা এই আধা ঘন্টায় বলতে হবে।
তিতলির কথা শুনে নির্বান মনে মনে কথা গুঁছিয়ে নিচ্ছে। তিতলি নির্বানের দিকে তাকালো। নির্বান বলতে শুরু করলো।
-কিছু মাস পরে আমি বাইরে যাচ্ছি আমার ভাইয়ের কাছে,স্টাডিজের জন্য । আসলে বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিলো আমি আমার স্টাডিজ ওখান থেকেই কমপ্লিট করবো। আমিই চাইছিলাম না। তবে সেদিন আপনার বলা কথাগুলো ভাবলাম। আর এবার বাবা আর ভাইয়াও খুব জোর দিচ্ছেন। তাই হয়তো আমার যেতেই হবে।
নির্বানের কথা শুনে তিতলি স্বাভাবিক ভাবেই হাসলো। বললো।
-বাহ্ এটা তো ভালো খবর। গুড বাবা-মায়ের কথা শুনতে হয়। সমস্যা কি! কিছু বছর পর তো এখানেই আসবেন নাকি ওখানেই কোনো বিদেশীনির সাথে সেটেল্ড হবেন?
তিতলির এরকম কথা শুনে নির্বানের মুখ কালো হয়ে গেল। সে মনে মনে বললো।
-“আপনার জায়গা পৃথিবীর আর কেউ নিতে পারবে না তিতলি। কোনো বিদেশীনি তো দূরের কথা। আমি এখানেই যোগ্য হয়ে ফিরে আসবো আর ফিরে এসে আপনার ভাইদের কাছে আপনাকেই চাইবো। ”
কিন্তু এই কথা গুলো নির্বান মনে মনে বললেও মুখে বলতে পারলো না। মুখে শুধু বললো।
-এখানেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ। ওখানে থাকা সম্ভব না। কখনো না।
নির্বানের কথা শেষ হলে তিতলি বললো।
-আচ্ছা এটাই বলার ছিলো?
নির্বান তিতলির প্রশ্ন শুনে বললো।
-আরো কিছু বলার ছিলো কিন্তু বলতে পারছি না।
তিতলি কিছুক্ষন চুপ থাকলো। তারপর বললো।
-আপনি যে এখনো মাঝেমাঝেই আমার কলেজের সামনে আসেন। সেটা আমি জানি। আপনাকে আমি বলেছিলাম এমন সিলি কাজ না করতে।
তিতলির কথা শুনে নির্বান মাথা চুলকালো। তিতলি হেসে ফেললো। তারপর বললো।
-আর কিছু বলবেন? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নির্বান এবার তিতলির কথা শুনে মনে সাহাস জুগিয়ে বললো।
-আমার জন্য আপনি অপেক্ষা করবেন? আমি আপনার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে পারি। আপনি শুধু কিছু বছর অপেক্ষা করুন। ততোদিনে আপনার নিজের স্বপ্নগুলোও পূরণ হবে।
কথা শেষ করেই নির্বান ভয়ে চোখ বন্ধ করলো। আবেগে সে তো তিতলিকে কথাটা বলে বসেছে। এবার কি তিতলি তাকে চড় মারবে! হে আল্লাহ্ তিতলির হাতের চড় যেনো না খেতে হয়। মনে মনে এই ফরিয়াদ করছিলো নির্বান।কিন্তু অনেকক্ষন পরে তিতলির হাসির শব্দে সে চোখ খুললো। তারপর বললো।
-আপনি হাসছেন কেন?
তিতলি হাসতে হাসতেই বললো।
-আপনি এতো ভীতু কেন?
নির্বান লজ্জা পেয়ে গেল। তিতলি বলতে শুরু করলো।
-ততোদিনেও যদি আপনার আমার জন্য এমন অনুভূতিই থাকে। তাহলে আপনি আমার ভাইদের কাছে বলে দেখতে পারেন।
নির্বানের এই কথা শুনে খুশি হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সে খুশি হতে পারলো না। সে ভীত গলায় বললো।
-ততোদিনে যদি আপনার জীবনে অন্যকেউ এসে যায়?
তিতলি হালকা হেসে বললো।
-আমার এখনো অনেকদূর যাওয়া বাকি। আমি এখন থেকে আগামী কিছু বছর এসব ভাববোও না। আপনি হলেও ভাবতাম না। বাকিটা আল্লাহর হাতে। তিনি যা করবেন নিশ্চয়ই আমাদের ভালোর জন্যই করবেন। তাই না?
নির্বান মাথা নাড়লো। তিতলি আবার বললো।
-আমি আশা করছি আপনি এসব না ভেবে সম্পূর্ণ নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস্ড হবেন। কি হবেন না?
নির্বান এতোক্ষন দুঃশ্চিন্তায় থাকলেও এবার তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে হেসে বললো।
-আপনি আমার জীবনে দেখা সেরা একজন। বয়সে আপনি আমার ছোট কিন্তু চিন্তাভাবনায় অনেক বড়।
নির্বানের কথা শুনে তিতলিও হাসলো।
-আচ্ছা এবার তাহলে যাওয়া যাক। নইলে আমার সত্যিই লেট হয়ে যাবে।
তিতলির কথা শুনে নির্বান উঠে দাড়ালো। তিতলিও উঠলো। দুজন একসাথে হেসে পার্ক থেকে বের হলো। তিতলি কলেজের সামনে গিয়ে দেখলো গাড়ি এসে পরেছে। সে নির্বানের দিকে তাকালো। নির্বান হাসলো। তিতলি নির্বানকে বললো।
-ভালো থাকবেন।
নির্বান হাসিমুখেই বললো।
-আপনিও ভালো থাকবেন।
তিতলি চলে গেল। নির্বান সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো।
-“আল্লাহ্ যেনো আমার জন্য তোমাকেই রাখেন।”
নীরা ক্লাস শেষ করে বের হয়েছে। আজকের মতো তার আর কোনো ক্লাস নেই। রুমারও নেই সেজন্য তারা দুইজন ভাবলো এনজিও থেকে ঘুরে আসবে। তারা আগেও এনজিওতে সময় দিতো। তবে বিয়ের জন্য কয়েকদিন পারেনি। এজন্য এখন রেগুলার এনজিওতে যাচ্ছে। রুমার সাথে আসাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হয়েছে এই কয়দিনে। তবে নীরা আসাদের সাথে বেশি কথা বলে না। আসাদের ভাবসাব তার ভালো লাগে না। নীরা আর রুমা স্কুল থেকে বের হলো এনজিওতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রুমা নীরাকে বললো।
-আসাদ কিন্তু ভালো মানুষ। কতো সুন্দর বন্ধু হয়ে গেলাম। তুই ওর সাথে কম কথা বলিস কেন রে?
নীরা বিরক্ত হয়ে রুমার দিকে তাকালো।
-কয়দিন চিনিস আসাদকে? যে ওকে ভালো মানুষ বানিয়ে দিলি!
নীরার কথা শুনে রুমা বললো।
-বেশিদিন চিনি না। তবে আমি বলতে পারি ও ভালো মানুষ। দেখিস না কতো ডিসেন্ট কতো সুন্দর ব্যবহার।
নীরা রুমার দিকে তাকিয়ে বললো।
-হু বুঝলাম। এবার তাড়াতাড়ি চল।
রুমা নীরার হাত জড়িয়ে বললো।
-জেলাস হ্যা? আমার আরেকটা বন্ধু হয়েছে বলে।
রুমার কথা শুনে নীরা রুমার দিকে রেগে তাকালো। রুমা চুপসে গিয়ে বললো।
-আচ্ছা কিছু না চল। ওইতো উবার এসে গেছে। আমি কল করেছিলাম।
নীরা আর কিছু বললো না। দুজন মিলে গাড়িতে বসলো।
তিশা নিজের আলমারি খুলে পুরনো জিনিসপএ নাড়াচাড়া করছিলো। হঠাত একটা এলবাম তার চোখে পরলো। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার সময় ফ্যামিলি ফটো এলবামও সে নিয়ে এসেছিলো। সে এলবামটা বের করে নিয়ে বসলো। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সে সবার ছবি দেখছিলো। হঠাত একটা ছবিতে এসে তার নজর আটকে গেল। তার বোনের বিয়ের ছবি। শিহাবরা সবাইও এসেছিলো৷ হলুদের দিন তারা সবাই মিলে রাতে অনেক মজা করেছিলো। সে মজা করে শিহাবকে জড়িয়ে ধরেছিলো। সেই ছবিটা ক্যাপচার করেছে তাদেরই এক কাজিন। পরবর্তীতে শিহাব তাকে ধরে সরিয়ে দিয়ে অনেক ধমকে দিয়েছিলো। এমন মজা করার জন্য। তিশা ধমক খেয়ে স্যরি বলেছিলো ঠিকই। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই মজার নাম করে জড়িয়ে ধরেছিলো। আর ওই মুহূর্তের ছবিটা এমনভাবে ক্যাপচার করা হয়েছে যে মনে হচ্ছে দুজন দুজনকে ইচ্ছে করেই জড়িয়ে ধরেছে। ছবিটা দেখে তিশার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে ছবিটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো। ইস এই জিনিসটা তার হাতে আগে কেন আসেনি। এটা ভেবেই তার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আরো আগে হাতে আসলে আরো আগেই কাজে লাগিয়ে দেওয়া যেতো। যাক! কি আর করার আছে। এখনো এটাকে কাজে লাগানো যাবে। তিশা ছবিটা নিয়ে এসবই ভাবছিলো। তখনই তার ফোনে কল আসলো। তিশা ফোন নিয়ে দেখলো আসাদ তাকে কল করেছে। সে রিসিভ করলো।
-বলো। নীরার কাছাকাছি থাকছো তো?
আসাদ হাসতে হাসতে বললো।
-আমার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করেই এই খোঁজ নিচ্ছো।
আসাদের কথা শুনে তিশা বিরক্তবোধ করলো। তারপর বললো।
-হু কেমন আছো?
আসাদ মিটিমিটি হেসে বললো।
-খুব ভালো আছি। অনেস্টলি তোমার কথামতো সিলি কাজে শামিল হলেও এখন আই ইনজয় ইট। নীরা কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর। তোমার থেকেও সুন্দর। প্রথমে আমি ভাবছিলাম শিহাব তোমাকে রিজেক্ট করলো কেন! নাও আমি বুঝলাম কেন রিজেক্ট করেছে।
আসাদের কথা শুনে তিশার মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সে চিবিয়েচিবিয়ে বললো।
-তোর মতো ক্যারেক্টারলেসের সাথে ব্রেক আপ করে আমি ঠিকই করেছি।
আসাদ আবারও বললো।
-যাই বলো তিশা। আমাদের কিন্তু এদিকটায় মিল আছে।
তিশা রাগ করে ফোন কেটে দিতে চাইলো পরক্ষনেই কিছু ভেবে নরম কন্ঠে বললো।
-তোমার নীরাকে ভালো লেগেছে?
আসাদ জানতো তিশা প্রথমে রেগে গেলেও তারপর এই প্রশ্নটাই করবে। সেজন্য আসাদ হাসলো। বললো।
-অবশ্যই আগে ওর দেখা পেলে শিহাবকে কি ওকে বিয়ে করার সুযোগ দিতাম! আমি নিজেই বিয়ে করতাম।
তিশাও হাসলো। বললো।
-এখনো সুযোগ আছে।
আসাদ শুধু হাসলো। আর কিছু বললো না। তিশাকে বাই বলে ফোন রেখে দিলো। তিশা ফোন রেখে বিড়বিড় করে বললো।
-“আহারে! আমাকে তুমি অপমান করেছো না শিহাব। সবার সামনে থাপ্পড় মেরে ক্যারেক্টারলেস বলেছিলে। এবার দেখো কি করে তোমার বউয়ের চোখে তুমিই ক্যারেক্টারলেস হয়ে যাও। আর তোমার বউও এই শোকে অন্যের সাথে কি করে জড়িয়ে যায় শুধু দেখে যাও!
নীরা আর রুমা এনজিওতে পৌছানোর পর ফান্ডের বিষয়ে ডিসকাস করে। বাচ্চাদের সাথে দেখা করলো। ওদের সাথে নিজেরাও ক্রাফ্টিংএর কাজ করলো। আসাদও ওদের সাথেই ছিলো সারাটা সময়। রুমা কাজ শেষে পানি খেতে গেলে। নীরা বাচ্চাদের সাথে একাই সব গুঁছিয়ে দিচ্ছিলো। আসাদ গিয়ে নীরাকে হেল্প করলো। নীরা পেন্সিলগুলো সব সরাতে গেলে আসাদ নীরার হাত ধরে ফেললো। নীরা হতভম্ব হয়ে তাকালো। তারপর কঠিন স্বরে বললো।
-হাত ধরেছেন কেন আসাদ? হাত ছাড়ুন।
নীরার ধমক শুনে আসাদ হাত ছেড়ে দিলো। বললো।
-এক্সট্রেমলি স্যরি। আসলে এতোকিছু তুমি গোছাচ্ছো তাই আমি এগুলো তোমার হাত থেকে নিতে চাইছিলাম।
নীরা ধমকে বললো।
-হাত থেকে নিতে চাইলে হাত ধরতে হবে কেন? আর হাত ছাড়তেও এতো সময় লাগবে কেন?
আসাদ আবারও হেসে বললো।
-আমি স্যরি এজন্য। আসলেই ঠিক হয়নি স্যরি।
রুমা এসে দেখলো নীরা আসাদের ওপর রেগে আছে। রুমা কারন জিজ্ঞেস করলো।
-কি হয়েছে?
নীরা তাকিয়ে দেখলো বাচ্চারা যে যার মতো কাজ করছে। এদিকে লক্ষ করেনি। সে রুমাকে বললো।
-কিছু না চল।
বলেই রুমার হাত ধরে বেড়িয়ে গেল। রুমা বারবার কারন জিজ্ঞেস করলো। নীরা বাইরে গিয়ে রুমাকে সব বললো। এতে রুমা প্রথমে বিচলিত হলেও পরে বললো।
-নীরা কাম ডাউন। আসাদ একটু বেশিই ফ্রি মিক্সিং। ও এমনই আমারও হাত ধরেছিলো। বি পজিটিভ।
রুমার কথা শুনে নীরা অবাক হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে বললো।
-হোয়াট! তুই বলছিস আমাকে এই কথা?
-হ্যা বলছি। প্লিজ ইয়ার রাগ করিস না।
নীরা রাগে হতবিহ্বল হয়ে বললো।
-সাইফ ওয়াজ রাইট। ইউ আর আ ফুল! আসলেই তুই একটা বোকা। আই কান্ট বিলিভ ইট।
রুমা নীরার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। নীরা তোয়াক্কা না করে। অন্যদিকে চলে গেল।
আসাদ তাড়াহুড়ো করে এসে দেখলো। রুমার সাথে নীরা নেই। সে রুমার কাছে এসে ইনোসেন্ট ফেস করে বললো।
-আমি জানতাম না ও এতো কনজার্ভেটিভ। জানলে কখনো এমন করতাম না। কি যে গিল্ট ফিল হচ্ছে আমার। নিজেকে নিজে মারতে ইচ্ছে করছে।
রুমার আসাদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আসাদ সত্যিই অনুতপ্ত। সে আসাদকে বললো।
– তুমি আর এমন করো না। ও আসলে এসব ব্যপারে খুব স্ট্রিক্ট। তোমার বোঝা উচিত রাইট। সো এরপর থেকে কেয়ারফুল থাকবে!
আসাদ হতাশ হয়ে বললো।
-অবশ্যই। আচ্ছা ওকে স্যরি বলেছি তাও খুব রেগে ছিলো। কি করে ওকে ইজিলি মানানো যেতে পারে। যাতে ও আর আমাকে অন্যরকম মনে না করে।
রুমা বললো।
-এখন না বলে কাল আসলে বলবে এমন আর হবে না। সুন্দর করে বলবে। ওকে? তাহলেই হবে। নীরার কাছে কেউ সুন্দর করে স্যরি বললে ও রেগে থাকতে পারে না।
আসাদ হাসলো রুমার কথা শুনে। বললো।
-তোমরা দুইজন দুই মেরুর। তবুও বেস্ট ফ্রেন্ড। ইম্প্রেসিভ।
রুমাও হেসে বললো।
-ইয়েস। আমাদের আত্মার সম্পর্ক। আমরা দুজন দুজনের জন্য যেকোনো স্টেপ নিতে পারি। আচ্ছা এখন আসি। নইলে ও আমার ওপর আরো রেগে যাবে। রেগে থাকলেও আমার জন্য ঠিকই ওয়েট করছে। বাই। কাল দেখা হবে।
-বাই আমিও বাড়ির দিকে যাবো। রেগে না গেলে তোমাদের পৌছে দিতাম। যাক অন্য একদিন।
রুমা হেসে বিদায় নিলো। আসাদও হাসলো। মনে মনে নিজেকে বকলো সে। নীরা তো তিশার মতো না তবুও এতো এডভান্স কি করে হলো সে। এখন নিজেকেই বকতে হচ্ছে। যাক সুন্দর করে ক্ষমা চেয়ে নিজের গুড ইমেজ তৈরি করতে হবে।
নীরার মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। সে রাস্তায় রুমার সাথে হু হা ছাড়া আর কোনো কথা বলেনি। রুমা বারবার নীরাকে স্যরি বলেছে। নীরা মুখে ইট্স ওকে বললেও গম্ভীর হয়ে ছিলো। রুমা সেটা বুঝেছে। তারপর রুমা ভাবলো সকাল হলেই এই রাগ গায়েব হয়ে যাবে। সেটা সে জানে। কারন নীরা রুমার ওপর রেগে থাকতে পারে না। সেজন্য রমা নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরলো।
নীরা বাড়িতে আসতে আসতে লেট হলো। বাড়িতে এসে দেখলো শিহাব এখনো আসেনি। সে ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখলো সব এলোমেলো। তিতলি পড়তে না বসে সোফায় শুয়ে ফোন ইউজ করছে। আর রেহান ফ্লোরে শুয়ে সোফায় পা রেখে চিপ্স খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। এসব দেখেই নীরা আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই তার বিকাল থেকে মেজাজ খারাপ। আর বাড়ি ফিরে এসে এমন অনিয়ম দেখে আরো খারাপ হয়ে গেল। সে একটু ধমকে বললো।
-এসব কি হচ্ছে?
নীরার ধমক শুনে তিতলি ধরফর করে উঠে বসলো। মোবাইল লুকিয়ে ফেললো। রেহান তাড়াতাড়ি উঠে বসলো চিপ্স রেখে। দুই ভাই বোন দুইজনের দিকে আড়চোখে তাকালো। নীরা তিতলিকে বললো।
-পড়া রেখে মোবাইল টিপছিলে। আবার আমাকে দেখে মোবাইল লুকিয়েছে। কিন্তু লাভ কি আমি তো দেখে ফেলেছি।
নীরার কথা শুনে তিতলি আমতাআমতা করে বললো।
-স্যরি ভাবিমনি। আর এমন হবে না।
নীরা এবার রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
-আর তুমি এভাবে শুয়েছিলে কেন? এভাবে পা উপরে তুলে ফ্লোরে পুরো বডি রেখে কে শুয়ে থাকে! আর টিভি দেখছো। ইংলিশ লিটারেচারে পড়ো। সামনে তোমার ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম। আর তুমি না পড়ে ইউজলেস মুভি দেখছো? পড়ার কথা তুললে বলো। তুমি সারারাত পড়ো। অথচ এটা মিথ্যা। বইও ধরো না।
রেহান অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বললো।
-স্যরি ভাবিমনি। কিন্তু আমার সিলেবাস শেষ। সত্যি! এজন্যই চিল করছি।
রেহানের কথা শুনে নীরা বললো।
-সিলেবাস একবার শেষ করার জন্য না। বারবার শেষ করার জন্য।
নীরা রাগে গজগজ করতে করতে বললো।
-আমি প্রথম প্রথম এসে তো দেখেছিলাম খুব ডিসিপ্লিন্ড তোমরা। আর এখন!
এই কথায় তিতলি ফিঁক করে হেসে বললো।
-আস্তে আস্তে আসল রূপ বের হচ্ছে।
নীরা তিতলির কথা শুনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। তিতলি হাসি বন্ধ করে চুপসে গেল। নীরা রেহান আর তিতলির উদ্দেশ্যে বললো।
-এমন যেনো আর নাহয়। খালা তো বোনের বাসায় গেছেন,কাল আসবেন। তোমরা খেয়েছো?
দুজনেই মাথা নাড়িয়ে না জানালো। নীরা বললো।
-ফ্রেশ হয়ে এসে যেনো দেখি ভদ্র মানুষের মতো সব গুঁছিয়ে দুজনে খাবার টেবিলে বসেছো।
রেহান বললো।
-আচ্ছা কিন্তু তোমার কি কিছু হয়েছে? মুড অফ নাকি?
নীরা আগের মতোই বললো।
-নাহ্ ঠিক আছে সব। আমি এসে যেনো দুজনকেই ঠিকঠাক দেখতে পাই।
রেহান আর তিতলি দুজনেই একসাথে বললো।
-ওকে!
নীরা ফ্রশ হতে গেল। রেহান আর তিতলি দুজন মিলে এলোমেলো সবকিছু ঠিকঠাক করলো। তারপর নিজেরা খাবার টেবিলে বসলো। নীরা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো সব ঠিকঠাক। সে এতোটাও আশা করেনি। নীরা হালকা হেসে বললো।
-আই এম ইম্প্রেস এতোটাও আশা করিনি।
তিতলি আর রেহান হাসলো। নীরা রান্নাঘর থেকে খাবার এনে সার্ভ করে দিতে দিতে বললো।
-এই এলোমেলো সবকিছু আমি নিজে অথবা অন্য মেইডদের দিয়ে গোঁছাতে পারতাম। কিন্তু কেন করলাম না জানো?
রেহান হাসতে হাসতে বললো।
-কারণ আমরা ইচ্ছে করে গোঁছানো জিনিস এলোমেলো করেছি। আমাদেরই দোষ আমরা শুধু সব এলোমেলো করি। কিন্তু এগুলো গোঁছাতে তো একটু না একটু কষ্ট হয়। আর এসব তুমিই আমাদের বলেছিলে ভাবিমনি। কিন্তু আমরা আসলে মজা করতে করতে করে ফেলেছি। স্যরি ফর দ্যাট।
রেহানের সাথে তিতলিও বললো।
-এক্স্যাক্টলি আগেইন স্যরি।
নীরাও হেসে ফেললো। বললো।
-ওকে এবার খাও। শিহাবের হয়তো দেরি হবে আসতে। তোমরা অপেক্ষা করো না। খেয়ে নাও। তারপর গিয়ে ঘুমাও। বেশি রাত জাগবে না। আর বাবা ওনার বন্ধুর বাড়ি থেকে কবে আসবেন বলেছেন কিছু?
তিতলি খেতে খেতে বললো।
– ফোন দিয়েছিলো। বললো দুই একদিনের ভেতর আসবে। তোমাকে নাকি ফোনে পায়নি। ফোন দিও তো। আর এখন তুমিও বসো। আগে তো আমি ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকতাম যতোই লেট হোক না কেন। কিন্তু তুমি আসার পর তা হচ্ছে না। তুমিও বসো না ভাবিমনি।
নীরা হেসে বললো।
-আচ্ছা দিবো। আমার বেশি ক্ষিদে নেই। এনজিওর বাচ্চারা কেক বানিয়েছিলো। খেয়েছি ওদের সাথে। তোমাদের জন্যও এনেছি। খাওয়া শেষ করো তারপর দিবো।
তিতলি আর রেহান খাওয়ার পর নীরার কথামতো ঘরে চলে গেল। নীরা বাড়িতে আসতে আসতেই রাত নয়টা দশটা বেজে গেছিলো। আর এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। শিহাবের এখন প্রায়ই আসতে দেরি হয়। আর নীরা শিহাবের জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করার মাঝেও মজা আছে। সেটা নীরা বুঝেছে শিহাবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে। অপেক্ষা করতে করতে নীরার ঘুম পেয়ে গেল। কিন্তু সে শিহাবকে ফোন করলো না। শিহাব যখন দেরি হবে জানানোর প্রয়োজা মনে করেনি। নীরাও তাহলে ফোন করবে না। তারপর নীরার নিজেরই চিন্তা হলো তাই সে ফোন নিয়ে শিহাবের নাম্বারে ডায়াল করলো। ডায়াল করতে করতেই বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ আসলো। নীরা ফোন কেটে দিয়ে দরজা খুলে দাড়ালো। বাইরে থেকে সুন্দর বাতাস আসছে। গা ঠান্ডা করা বাতাস। বাতাসটা নীরার ভালো লাগলো। শিহাব গাড়ি পার্ক করে হেটে হেটে আসছে। নীরা রেগে ছিলো শিহাবের ওপর। কিন্তু আস্তে আস্তে শিহাব আলোতে আসলে নীরা শিহাবের ক্লান্ত মুখ দেখলো। তখন তার রাগ পরে গেল। তবুও সে গম্ভীর মুখেই দাড়িয়ে রইলো। শিহাব দরজার কাছে এসে নীরাকে দেখে বললো।
-রাতের বেলা এমন দরজা খুলে দাড়িয়ে আছো কেন?
শিহাবের কথা শুনে নীরার আরো রাগ হলো। সে গম্ভীর মুখে বললো।
-বাতাস খাওয়ার জন্য।
শিহাব নীরার কন্ঠ শুনেই বুঝেছে নীরা রেগে আছে। সে নীরার হাত ধরে ভেতরে ঢুকলো। নীরা হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো।
-ফ্রেশ হয়ে আসো। আর খেয়েছো না খাবে?
শিহাব ক্লান্ত গলায় বললো।
-আমি জানি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তাই খাইনি।
নীরা আর কিছু বললো না। চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো। শিহাব দেখলো নীরা তার সাথে ঘরে না গিয়ে এখানেই বসেছে। সে বললো।
-ঘরে চলো।
নীরা ভ্রু কুঁচকে বললো।
-তুমিই তো বললে খেয়ে আসোনি। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি বারবার ঘরে যেতে পারবো না।
শিহাব আর কিছু না বলেই ঘরে চলে গেল। নীরা চুপচাপ বসেই ছিলো। শিহাব তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো। নীরা কথা না বলে চুপচাপই রইলো। শিহাব ভাত মেখে আগে নীরার মুখের সামনে ধরলো। নীরা ভ্রু কুঁচকে বললো।
-নিজে খাও। এতো আহ্লাদ লাগবে না। নিজেই খেয়ে নিবো।
শিহাব হেসে বললো।
-কিন্তু আমার তো আহ্লাদ না করলে ভালো লাগে না। এখন হা করো।
নীরা চুপচাপ হা করে খেলো। শিহাব হাসতে হাসতে বললো।
-আই এম স্যরি দেরি হবে এটা জানানো উচিত ছিলো।
নীরা মুখ ফুলিয়ে বললো।
-তোমাকে বিয়ে করাটাই ভুল হয়েছে। টিপিক্যাল বউ হয়ে গেলাম। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষ!
শিহাব নিজে খেতে খেতে বললো।
-তো! টিপিক্যাল হাজবেন্ড ওয়াইফও সবাই হতে পারে না। কুল,পশ হাজবেন্ড ওয়াইফ হতে গিয়ে নিজেরা নিজেদের সময়ই দিতে পারে না। আমরা একে অপরের জন্য এভাবেই সময় বের করবো। অপেক্ষা করবো। হোক সেটা টিপিক্যাল। টিপিক্যাল হাজবেন্ড ওয়াইফও কিন্তু সবাই হতে পারে না।
নীরা রেগে থাকতে চেয়েও পারলো না। শিহাবের কথা শুনে হেসে ফেললো। শিহাব নীরার হাসি দেখে বললো।
-এই হাসিটাই এতোক্ষন যাবত মিস করছিলাম।
-চলবে!