#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ৪৩

0
510

#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ৪৩

#নাফিসা নীলয়া!

সকাল সকাল নীরা যখন ঘর থেকে বের হলো তখন তাকে একদম স্বাভাবিক লাগলো। মালিহা আর রেজাউল একে অপরের দিকে তাকালেন। কিন্তু কেউ নীরাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারলেন না। নীরা আগের মতো সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রেখেছে৷ মিলা নীরাকে সাহায্য করছে। নীরার পেছন পেছন ঘুরছে। কিন্তু মিলাও কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। নীরা এমন ভাব করছে যেনো সবই স্বাভাবিক। মিলা তেমন সুবিধা করতে না পেরে টেবিলে এসে চুপচাপ বসলো। সকালের নাস্তা খাওয়ার পর নূরজাহান বেগম নীরাকে বলে বসলেন।

-তুই শ্বশুড়বাড়িতে কবে যাবি?

নূর জাহান বেগমের কথা শুনে নীরা থমকে গেল। তারপর নিজেকে পুনরায় স্বাভাবিক করে বললো।

-কেন? আমাকে ওই বাড়িতে পাঠানোর এতো তাড়া কেন দাদী? কয়েকদিন থাকবো আমি। কেন তোমার কি সমস্যা হবে?

নীরার এমন কথা শুনে নূরজাহান বেগম চুপসে গেলেন।মালিহা এবার বলে উঠলেন।

-রাতে শিহাবের সাথে ওরকম চেঁচালি কেন? ওভাবে বলেছিস কেন? কোনো সুযোগও দিসনি কাউকে কিছু বলার।

নীরা এবার একটু রেগেই গেল। বললো।

-ওভাবে কথা বলার যথেষ্ট কারন ছিলো আম্মা।

তারপর রেজাউলকে উদ্দেশ্য করে নীরা বললো।

-বিয়ে হয়েছে বলে আমি আমার বাবার বাড়িতে কয়েকটা দিন থাকতে পারবো না? যদি এটাই হয় তাহলে এখনই বলে দাও।

নীরার কথা শুনে সবাই থতমত খুব গেল। রেজাউল স্নেহভরা কন্ঠে বললেন।

-তা কেন মা। এটা তো তোমারই বাড়ি তুমি যখন খুশি এখানে থাকতে পারবে। যখন খুশি আসতে পারবে।

রেজাউল ভালোভাবে বললেও মালিহা নীরার ওপর রেগে আছেন। তিনি নীরাকে রাগী স্বরে বললেন।

-যাই হোক তাই বলে তুমি তোমার স্বামীর সাথে ওরকম আচরণ করতে পারো না। রাতবিরেতে তাকে বেড়িয়ে যেতে বলতে পারো না। এটা যে ওর জন্য কতোবড় অপমানের তুমি বুঝতে পারছো? যাই হয়ে যাক নীরা তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি। রাতে কাউকে কিছু বলার সুযোগটাই দাওনি তুমি। আমি ভেবেছি সকাল হলে তুমি নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তা তো পারোইনি। উল্টো উল্টোপাল্টা কথা বলছো। তোমার যথেষ্ট বোঝার মতো বয়স হয়েছে। তোমার মতো মেয়ের কাছে কি এসব আশা করা যায়? তোমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে যাই ই হয়ে থাকুক। তুমি তবুও ওকে ওভাবে বলতে পারো না। আমি ভাবতে পারছি না আমার মেয়ে হয়ে তুমি এরকম করতে পারো।

মালিহা নিজের সব কথা শেষ করে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বাকি সবাই চুপ করে রইলো। নীরার চোখে পানি এসে যাচ্ছে কষ্টে। সবাই শুধু তাকে ভুলই বুঝে গেল। তবুও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। মিলাকে বললো।

-সামনে না পরীক্ষা? আজকে তো ক্লাস আছে। চল একসাথে বেড়োবো।

নীরার কথা শুনে নূরজাহান বেগম,রেজাউল আর মিলা অবাক হয়ে তাকালো। নীরার মতিগতি তারা ঠিক বুঝতে পারছে না। মিলা হতভম্ব হয়ে বসে থাকলে রেজাউল তাকে ইশারা দিলেন। মিলা ভেতরে গেল ব্যগ আনতে। নূরজাহান বেগম নিজের ঘরে চলে গেলেন। মিলা আর নীরা বের হওয়ার সময় রেজাউলও ওদের সাথে বেড়োলেন। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় হাটার সময় নীরা মিলাকে পড়াশোনায় সিরিয়াস হওয়ার উপদেশ দিলো। নীরা আর রেজাউল মিলাকে ইউনিভার্সিটি তে ড্রপ করে নিজেদের কাজের উদ্দেশ্যে বের হলো। রেজাউল আর নীরা রিকশাতে একসাথে বসার পর রেজাউল নীরাকে জিজ্ঞেস করলেন।

-আমাকে কি বলা যায় মা?

নীরা একমনে অন্যপাশে তাকিয়ে ছিলো। রেজাউলের কন্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালো। রেজাউল আবারও বললেন।

-আমি জানি আমি বাবা হওয়ার মতো কোনো কাজই করিনি। সবসময় তোমাকে অবহেলা করেছি। তারপর যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এরজন্য আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।

নীরা রেজাউলের কথা শুনে বললো।

-এসব তো মিটেই গেছে। এখন এসব কথা কেন বলছে আব্বা?

-কারন আমি কি এখনো তোর বাবা হতে পারিনি? পারলে কি হয়েছে আমাকে কি সব বলা যায় না? আমি চিনি আমার মেয়েকে সে এমনি এমনি ওমন আচরণ করার মতো মেয়ে না।

রেজাউলের কথা শুনে নীরা খানিকক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর বললো।

-তেমন কিছুই না আব্বা। আমি সমস্যা সমাধান করবো। তোমরা অযথা চিন্তা করো না প্লিজ। আর আম্মাকেও বলো।

রেজাউল আর জানতে না চেয়ে বললেন।

-স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এমন অনেককিছুই হয় যেটা প্রকাশ্যে আসে না। আসতে দেওয়াও উচিত না। আর আমারও হয়তো জানতে চাওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু কি করবো বাবা হই তো সেজন্য জানতে মন চাইবেই। জীবন তো রূপকথা নয়। এখানে যেমন হাসি,আনন্দ আছে দুঃখ কষ্টও আছে। একটা আরেকটার পরিপূরক দুঃখ না থাকলে আমরা সুখটাকে পরিপূর্ণ ভাবে অনুভব করতে পারতাম না। আবার সুখ না থাকলে দুঃখ ও আসতো না। যাই হোক মা আমি আমার মেয়েকে চিনি সে কোনো ভুল ডিসিশন নিবে না এটা আমি মনে প্রাণে মানি। নিজেদেরকে স্পেস দাও। বোঝার সময় দাও। সম্পর্কে বিশ্বাসটাকে মজবুত করো। কারো কথায় প্রভাবিত হলে চলবে না। যেই ভুলটা আমি করেছি। অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে তোমাকে অবহেলা করেছি। সেটা তুমি করবে না। তোমার আপন মানুষকে নিশ্চয়ই তুমি ছাড়া অন্য কেউ ভালো করে চিনবে না। সুতরাং এখানে তৃতীয় কারো স্থান দিলে চলবে না। আমি আশা করছি তোমাদের মধ্যে যা ই হয়েছে তা দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।

রেজাউলের কথা শুনে নীরা কিছু বললো না। কথা বলতে বলতে রিকশা এসে নীরার স্কুলের সামনে থামলো। রেজাউল আগে নামলেন তারপর নীরাকে নামতে সাহায্য করলেন। রেজাউল এই প্রথম নীরার স্কুলে এসেছেন। এর আগে কখনো আসাই হয়নি। রেজাউল নীরাকে বিদায় দিয়ে চলে যেতে চাইলেন। ফিরতি পথ ধরলেন। কিন্তু নীরা রেজাউলকে পেছন ডাকলো। রেজাউল পেছন ফিরলে নীরা গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো।

-আমার ছোটবেলার না পাওয়া সব আদর, স্নেহ,ভালোবাসা এখন একসাথে পাচ্ছি। আমার মতো সৌভাগ্যবতী আর কে আছে!

রেজাউলের চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।

শিহাব সারারাত বাইরে ছিলো। নীরা তার সাথে এমন করবে সে সেটা মানতে পারছে না। স্বামী হিসেবে তার অধিকার আছে। তাই বলে এমন আচরণ তার পাওনা ছিলো। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তিশা নিশ্চয়ই নীরাকে এমন কিছুই পাঠিয়েছে যার জন্য নীরা ওভাবে বলেছে। আসলে দোষটা কার! তার নিজেরই নাকি অন্য কারো। একবার মনে হচ্ছে সে ঝোঁকের মাথায় নীরার সাথে ওমন আচরণ করে ভুল করেছে। আরেকবার মনে হচ্ছে নীরাও তো তার সাথে খারাপ আচরণ করেছে নীরারও ভুল রয়েছে। এসব ভেবেই সে রাতের শেষ ভাগ বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। সকালে যখন সে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলো। তখন রেহান,তিতলি আর জহুরা শিহাবকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তিতলি আর রেহান জানতো শিহাব নীরাদের বাড়িতে গিয়েছে। জহুরাই তাদেরকে বলেছেন। জহুরা নিজেও এটাই জানে। জহুরার সামনেই তো শিহাব ওই বাড়িতে গেল। কিন্তু সকাল সকাল শিহাবকে এরকম অবস্থাতে দেখে সবাই ই হতবাক হয়ে গেল। তিতলি জিজ্ঞেস করলো।

-ভাই হোয়াট হ্যাপেন্ড কি হয়েছে তোর?

শিহাব কোনো জবাব দিলো। না রেহান জহুরা সকলেই শিহাবকে প্রশ্ন করলো কিন্তু শিহাব কাউকে কিছুই বললো না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। রেহান আর তিতলি জহুরার দিকে তাকালো৷। জহুরাও ইশারায় জানালেন তিনি নিজেও কিছু জানেন না।

শিহাব তারপরে আর কাউকেই কিছু জানালো না। সে নিজেও এমন ভাব করলো যেনো সব স্বাভাবিক।

তবুও তিতলি রেহান আর জহুরার সন্দেহ গেল না। কিন্তু শিহাবকে তারা এ ব্যপারে কিছু জিজ্ঞেস ও করলো না।

রেহান ইউনিভার্সিটি তে যাওয়ার পর মিলার সাথে দেখা হলো। মিলা তখন বন্ধুদের সাথে ছিলো। রেহান ডাকলে সে বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে বেড়িয়ে আসলো। মিলা নিজেও চাইছিলো রেহানের সাথে দেখা করতে। নীরা আর শিহাবের মাঝে কি হয়েছে সে ব্যপারে সে ও জানতে চাইছে। গত রাত থেকেই মিলা খুব আপসেট। বন্ধুদের সাথেও সে ঠিকঠাক কথা বলেনি। সেজন্য রেহান ডাকা মাত্রই সে বন্ধুদের আড্ডা ফেলে আসলো। মিলা আসলে রেহান বললো।

-হাটতে হাটতে কথা বলি?

মিলাও সায় দিলো।

-হু চলো।

রেহান মিলার সাথে হাটতে হাটতে বললো।

-তোমাকে চিন্তিত লাগছে কেন?

মিলা রেহানের প্রশ্ন শুনে সোজাসুজি কথায় চলে গেল।

-ভাইয়া কি কিছু বলেছে তোমাদের?

রেহানও চিন্তিত হয়ে বললো।

-না বলেনি। তবে সকালবেলা বাড়িতে ফিরলো বিদ্ধস্ত অবস্থায়। কাউকে কিছু বললো না। স্বাভাবিক থাকতে চাইলো। কিন্তু আমরা বুঝেছি কিছু একটা তো হয়েছেই।

মিলা মলিন মুখে বললো।

-ভাইয়া আর আপার ঝগড়া হয়েছে? গত রাতে ভাইয়া বাড়িতে এসেছিলো। আমি তো আমার ঘরে ছিলাম। তারপর চেঁচানোর আওয়াজ শুনে বাইরে বেড়োলাম। আপা খুব রেগে ছিলো। দেখো রেহান আমি বলছি না ভাইয়া এমন কিছু করেছে যার জন্য আপা রেগে গেছিলো। আমি বলছি যে আপা শুধু শুধু রেগে যাওয়ার মতো মেয়ে না। কোনো ভ্যালিড রিজন ছাড়া আপা কখনোই রাগে না। রাগ ওর মধ্যে নেই। তাও আবার চেঁচানো। সেটা তো আপার স্বভাবেই নেই। এখন তুমিই বলো!

রেহান মিলার কথা শুনে একটু ভেবে বললো।

-আমি ভাবিমনিকে চিনি। আমার ভাইকেও চিনি। দুজনে শুধু শুধু তো ঝগড়া করবে না। কিছু তো হয়েছেই। কিন্তু কি সেটাই দুজনে কাউকে বলছে না। কাউকে বুঝতেও দিতে চাইছে না।

রেহান কথাটা বলার পর মিলার দিকে তাকালো। দেখলো মিলা মলিন মুখ করে আছে। রেহান জানে মিলা নীরাকে কতোটা ভালোবাসে। সেজন্য সে বললো।

-আরে টিলা ডোন্ট বি আপসেট। ভাবিমনি আর ভাই দুজনেই এনাফ ম্যাচিউর। ওরা শুধু শুধু সবাইকে চিন্তায় ফেলবে না। আর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এসব নরমাল। আমরা বরং এটাকে নরমালিই নেই। ওকে। ইউ নো হোয়াট টিলা? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্মান থাকবে ভালোবাসা থাকবে সাথে কিছু ঝগড়াও থাকবে। নইলে সংসার পরিপূর্ণ হবে না। এটা আমি বলি না খালা বলেন। দেখবে ওরা নিজেদের ব্যপার নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছে। আমরা আর চিন্তা না ই করলাম।

রেহানের কথা শুনে মিলার মন একটু শান্ত হলো। তবুও পুরোপুরি শান্ত হলো না। সে উদাস গলায় বললো।

-আপা আমার মায়ের মতো। আপাকে আমি কখনোই এতোটা রেগে যেতে দেখিনি। শত সমস্যাতেও ও রাগতো না। আমার আপার সবকিছু ব্যালেন্স করে চলার ক্ষমতা আছে। আর আপার যা রাগ দেখলাম। এটাই আমি মানতে পারছি না!

রেহান মিলার উদাস মুখের দিকে তাকালো। তারপর বললো।

-কোনোকিছুই কখনো পার্ফেক্ট হয় না টিলা। কোনোকিছুই না। ভাবিমনি আর ভাই সবদিক সামলে চললেও সবকিছু একসাথে ব্যালেন্স করতে পারলেও ওরাও কিন্তু মানুষ। ওদেরও রাগ জেদ আছে। তুমি ভেবে দেখো তো ভাবিমনি আর ভাই আমাদের জন্য কতোকিছু করেছে। কতো ত্যাগ করেছে। সব কিন্তু হাসি মুখেই করেছে। দুজনেই খুব দায়িত্বশীল। দুজনেই আমাদের কাছে আইডল এন্ড পার্ফেক্ট। কিন্তু আমরা কি করছি বলো তো? দুজনের সবকিছু পার্ফেক্ট,বেস্ট দেখতে দেখতে ওদের কাছে সবকিছুই পার্ফেক্ট এন্ড বেস্ট আশা করছি। এটা কিন্তু সম্ভব না। আমার মনে হয় ভাবিমনি আর ভাইয়ের যা আন্ডার্স্ট্যান্ডিং তাতে যদি কোনো সমস্যা হয়েও থাকে তবে তা জলদিই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা শুধু শুধু ওদের হাজবেন্ড ওয়াইফের ভেতর না ঢুকলেই বেটার হবে। ওরা দুজন দুজনকে বোঝে। সুতরাং আমাদের এতো চিন্তিত হয়ে লাভ নেই। সো দুঃশ্চিন্তা ছাড়ো।

রেহানের সব কথা শুনে মিলার একটু রিল্যাক্স ফিল হলো। আসলেই তো রেহানের কথা তো ঠিকই। মিলা রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো।

-আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসো যাও। আর শোনো আইসক্রিম আনার সময় যদি কোনোকিছু এদিক ওদিক দেখি তাহলে খবর আছে!

মিলার কথা শুনে রেহান হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো।

-আগের ফরমে ফিরে গেছে জোয়ালামুখী টিলা।

রেহানের কথা শুনে মিলা রাগান্বিত হয়ে বললো।

-রেহান,বেজি কেথাকার। তোকে মেরে ফেলবো আমি।

রেহান আর কথা না বলে দৌড়ে গেল। রেহানের যাওয়া দেখে মিলা নিজেও হেসে ফেললো।

নীরা স্কুলে ক্লাস সারাটা সময় অন্যমনস্ক হয়ে কাটলো। রুমা বারবার এর কারন জিজ্ঞেস করলেও নীরা কিছুই বললো না। রুমাও নীরার এমন ভাব দেখে চিন্তিত হলো। স্কুল ছুটির পর এনজিওতে যাওয়ার কথা থাকলেও নীরা যেতে চাইলো না। রুমাকে বললো।

-আগামীকাল যাই আজ ভালো লাগছে না।

রুমাও নীরার কথায় সায় দিলো। নীরার মুড অফ দেখে রুমা ঠিক করলো কোনো বাহানা দিয়ে শপিং এ নিয়ে যাবে নীরাকে। সেজন্য রুমা বললো।

-চল শপিং করে আসি। সামনেই সাইফের বার্থডে। আমি ওকে সারপ্রাইজ দিবো। তুই সব পছন্দ করবি। তোর চয়েস ভালো আছে।

নীরা না ই করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু রুমা ফেসটাকে এমন করলো যে সে আর না করতে পারলো না। আর নীরা জানো না করলেও রুমা যা জেদী সে নীরাকে নিয়ে যাবেই যাবে। সেজন্য নীরা মুখ লটকে বললো।

-চল। কিন্তু বেশিক্ষন থাকবো না আমরা ওকে?

রুমা নীরার কথা শুনে খুশি হয়ে গেল। উচ্ছাসিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো।

-ওকে আমার জান!

নীরাও হাসলো রুমার কান্ড দেখে। তারপর দুই বেস্ট ফ্রেন্ড মিলে শপিং করতে গেল। রুমা নীরার মন ভালো করতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শপিং করলো। নীরারও একটু ফ্রি ফিল হলো। রুমার সাথে থাকলে সে কখনো মন খারাপ করে থাকতে পারে না। রুমা মন খারাপ করে থাকতেই দেয় না। সবকিছু শেষে নীরা আর রুমা শপিং করে শপিংমলের বাইরে বের হলো। রুমা উবার কল করলো। দুজনে উবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। রুমা অপেক্ষা করে দাড়িয়ে থাকতে গিয়েও বকবক করতেই থাকলো। তার বকবক আর থামতে চাইলো না। থামলো তখন যখন ওরা দেখলো রাস্তার মাঝে একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে। মহিলা তাৎক্ষনাত অজ্ঞান হয়ে গেছেন। সবার সাথে সাথে নীরা আর রুমাও তখন দৌড়ে গেল। রাস্তায় এতো রক্ত দেখে রুমা ঘাবড়ে গেল। সে রক্তারক্তি দেখতে পারে না। তার হালকা ফোবিয়া আছে। তবুও নীরার জন্য তাকে এখানে আসতে হলো।

নীরা কাছে গিয়ে দ্রুত ব্যগ থেকে নিজের স্কার্ফ দিয়ে মহিলার জখমওয়ালা কপাল বেঁধে দিলো। তারপর রুমাকে বললো এম্বুলেন্স কল করতে। রুমা এম্বলেন্স কল করলে রাস্তার সবাই ধরাধরি করে মহিলাকে এম্বুলেন্সে উঠালো। নীরা রুমাকে বললো।

-চল।

রুমা হতভম্ব হয়ে বললো।

-আমরাও যাবো?

নীরা রেগে গিয়ে বললো।

-তো আমরা কেন যাবো না? তুই ভুলে যাচ্ছিস আমরা কি কাজ করি। এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ আমাদের না।

নীরার ধমক খেয়ে রুমাও বাধ্য হয়ে গেল। তারপর দ্রুত হসপিটালে পৌছালে মহিলাটিকে ইমার্জেন্সিতে এডমিট করা হলো। নীরা আর রুমাই সব ফরমালিটি করলো। তারপর দুজন অপেক্ষা করতে থাকলো বসে বসে। হসপিটালে আরো যারা এসেছিলো। তারা দ্রুতই চলে গেছে। নীরা আর রুমা আগ বাড়িয়ে সব করায় তারা নিজেদের কাজে চলে গেছেন। নীরার মহিলার ব্যগের কথা একটুও মাথায় ছিলো না। যখন মাথায় আসলো তখন সে দ্রুত ব্যগ চেক করলো। মহিলার ব্যাগ সে নিজেই নিয়ে এসেছে। ব্যাগ খুলে সে মোবাইল ফোন পেয়ে গেল। সৌভাগ্যবসত মহিলার ফোনে কোনো লক ছিলো না। সেজন্য নীরা দ্রুত কল লিস্টে গেল। প্রথম নাম্বার মাই সন দিয়ে সেভ করা। নীরা সেটাতেই কল করলো। আর এদিকে রুমা বসে বসে নীরার কান্ড দেখতে থাকলো। তার যে রক্তে ফোবিয়া আছে সেটা বেমালুম ভুলে আছে নীরা। মানবসেবায় নিয়োজিত অথচ নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডেরই খবর নেই। ভেবে একটু রাগ হলো রুমার।

নীরা ততোক্ষনে নাম্বার পেয়ে কল লাগিয়েছে।

আসাদ আজ এনজিওতে এসে অনেকক্ষন যাবত নীরা আর রুমার অপেক্ষা করেছে। কিন্তু নীরা আর রুমা সন্ধ্যা হওয়ার পরও আসলো না বলে তার একটু বিরক্ত লাগলো। সে নীরাকে স্যরি বলার পর তাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছিলো। নীরাও তার সাথে ইদানিং স্বাভাবিক আচরনই করছে। আসাদের কাছে ভালো লাগছে ব্যপারটা। সে ফোন বের করে নীরাকে কল লাগাতে যাবে আর তখনই আসাদের ফোনে তার মায়ের কল আসলো। সে একটু বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নীরা তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো।

-হ্যালো,আপনি মনে হয় এই ফোন যার ওনার ছেলে বলছেন। আপনার মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমরা ওনাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছি।

নীরার কথা শুনে আসাদের বুক ধ্বক করে উঠলো। সে দ্রুত জানতে চাইলো।

-কি হয়েছে মায়ের? কোন হসপিটালে আছেন?প্লিজ জলদি বলুন।

আসাদের কথা শুনে নীরা বললো।

-আপনি শান্ত হন। বেশি কিছু হয়নি। আমি এড্রেস দিচ্ছি। আপনি আসুন প্লিজ।

-দ্রুত বলুন।

নীরা আসাদকে হসপিটালের ঠিকানা দিয়ে ফোন রেখে দিলো। তারপর রুমার দিকে তাকালো। ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে! রুমা রাগী স্বরে বললো।

-আমার যে রক্তে ফোবিয়া আছে ভুলে গেছিস? ভুলবিই তো। তুই ই তো ভুলবি।

রুমার কথা শুনে নীরা জ্বিভ কাটলো। তারপর বললো।

-স্যরি আমার জান! আসলে তখন তাড়াহুড়ো তে খেয়াল ছিলো না। চল এখন ডাক্তার দেখাই। ওঠ।

বলেই রুমার হাত টানলো। রুমা হাত ঝাড়া দিয়ে বললো।

-অলরেডি ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাই আমি। লাগবে না আর ডাক্তার দেখানো।

এই কথা শুনে নীরা পুনরায় বসলো। বসে বললো।

– তোর কি বেশি খারাপ লাগছে?

নীরার নরম কন্ঠস্বর শুনে রুমার রাগ একটু পরলো। সে বলে উঠলো।

-নো আই এম ফাইন!

ওরা কথা বলতে বলতেই আসাদ ঝড়ের গতিতে হসপিটালে এসে হাজির হলো। রিসেপশন থেকে জেনে নিয়ে সোজা নীরাদের কাছে আসলো। একজন নার্স বলে দিলো আসাদকে নীরাদের কথা। আসাদ নীরাদের সামনে এসে অবাক হয়ে গেল। নীরা আর রুমাও অবাক হয়ে দাড়িয়ে পরলো। তারপর রুমা বললো।

-তোমারর মা নিশ্চয়ই? আমরাই এনেছি আন্টিকে।

আসাদের অবস্থা তখন কাহিল। সে নিজে যে কিভাবে এসেছে নিজেও জানে না। এখনো তার বুক ধুকপুক করছে। সে নীরা আর রুমাকে বললো।

-থ্যাংক ইউ সো মাচ। তোমরা না থাকলে যে কি হতো! আমি কি বলে যে তোমাদের শুকরিয়া জানাবো ভাষাই পাচ্ছি না।

নীরা আসাদকে দেখে বললো।

-আমরা না থাকলে অন্য কেউ না কেউ ঠিক সাহায্য করতো। ইভেন রাস্তার কয়েকজন এসেছিলেনও এখানে। সাহায্যও করেছেন। তো ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন। আন্টি এখন ঠিক আছেন। আপনি গিয়ে দেখে আসুন।

আসাদ আর কথা না বলে তার মাকে দেখতে গেল। রুমা আর নীরা আবার বসলো। নীরার হাত পা ব্যথা করছে সে রুমাকে ধমক দিয়ে বললো।

-তোর জন্য এখন আমার হাত পা ব্যথা করছে। না শপিং করতে যেতাম না এমন দৌড়াদৌড়ি হতো।

রুমা হতবাক হয়ে বললো।

-কিহ্! তুই বলিস এই কথা? আমরা না থাকলে তো আমাদের বন্ধুর মাকে নিয়ে আসতে পারতাম না।

নীরা ভ্রু কুঁচকে বললো।

-বন্ধু?

রুমা বলে উঠলো।

-আসাদ আমাদের বন্ধু না?

নীরা রুমার কথা শুনে রুমার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। তখনই রুমার ফোনে সাইফের কল আসলো। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে এখনো বাড়িতে ফেরা হয়নি রুমা আর নীরার। সেজন্যই সাইফ রুমাকে কল করেছে। রুমা ফোন রিসিভ করলো। নীরা উঠে একটু হাটতে লাগলো। রুমা ফোন রিসিভ করলে সাইফ বলে উঠলো।

-কই তুই আর নীরা কই? এতো রাত হচ্ছে কেন তোদের ফিরতে? নীরাটা নাকি বাড়িতে ফোন রেখে গেছে আজকে। এও কেয়ারলেস কেন তোরা? রাত হবে এটা তো জানাতে হয় নাকি? আমিই তো নিতে আসতাম। কোথায় আছিস তোরা? আমি আসছি।

সাইফের একটানে এতো কথা শুনে রুমা বিরক্ত হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে সে হসপিটালের ঠিকানা বলে বললো।

-হসপিটালে আছি।তুই তাড়াতাড়ি আয়। একটা এক্সিডেন্ট নীরার।

এটুকু বলার পরই রুমার ফোন অফ হয়ে গেল। রুমা ফোন কান থেকে নামিয়ে দেখলো তার ফোন অপ হয়ে গেছে। সে বিড়বিড় করে বকলো নিজেকে। তারপর নীরার কাছে গিয়ে বললো।

-ফোন ডেড আমার। তোর ফোন বাড়িতে রেখে আসছিস কেন?,

নীরা মুখ লটকে বললো।

-মনে ছিলো না।

তারপর হঠাত মনে পরার ভঙ্গিতে বললো।

-ড্যাম! বাড়ির কাউকে তো জানানোই হয়নি যে লেট হবে। অন্যান্যদিন তো জানিয়ে দেই। ফোন দে তো জানিয়ে দেই।

রুমা নীরার কথা শুনে বললো।

-এইমাত্র কি বললাম গাঁধি! ফোন ডেড। চিন্তা করিস না। সাইফকে বলে দিয়েছি। ও আসছে আমাদের নিতে। আর বাড়িতেও সবাইকে বলে দিবে।

রুমার কথা শুনে নীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বসলো। রুমাও বসলো। আসাদ বাইরে বেড়িয়ে এসে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললো। সে তার মায়ের কথা শুনে প্রচুর ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এখনো তার বুক ধরফর করছে। সে আবার নীরা আর রুমাকে বললো।

-থ্যাংক ইউ সো মাচ।

রুমা বিরক্ত হয়ে বললো।

-এতোবার থ্যাংস না জানিয়ে চা নিয়ে আসো যাও।

আসাদ হাসতে হাসতে বললো।

-তোমরা অপেক্ষা করো। আমি এখন যাবো এখন আসবো।

আসাদ যাওয়ার পর নীরা রুমার দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।

-খুব বন্ধুত্ব তোদের না?

রুমা কিছু না বলে চুপসানো মুখ করে রইলো।

ওদিকে সাইফ রুমার কাছ থেকে অর্ধেক কথা শুনে ভেবেছে নীরার এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। সে দুঃশ্চিন্তায় কি করবে বুঝতে পারছে না। রুমাকে বারবার ফোন দিচ্ছে। কিন্তু রুমার ফোন অফ বলছে। তার হার্টবিট দ্রুত চলছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তার দ্রুত যাওয়া দরকার সে তাও পারছে না তার হাত পা কাঁপছে। সে বহু কষ্টে প্রথমে শিহাবকে কল দিলো।

শিহাব সকালে বাড়িতে এসে আবার অফিসে গিয়েছিলো। আর রাতে মাত্রই বাড়ি ফিরে সে ফ্রেশ হতে গেছে। তিতলি বসে আছে শিহাবের ঘরে শিহাবের অপেক্ষাতে। শিহাব ওয়াসরুম থেকে বের হলে সে সব জানার চেষ্টা করবে এই আশায় আছে তিতলি। রেহানের থেকে সব শুনেছে তিতলি। শিহাব নিজের ফোন বিছানায় রেখে গিয়েছিলো। শিহাবের ফোন বাজায় তিতলি নিজেই কল রিসিভ করলো।

-সাইফ ভাইয়া ভাই ওয়াসরুমে আছে।

সাইফ তিতলিকে কাঁপকাঁপা স্বরে বললো।

-তিতলি নীরা বোধ হয় এক্সিডেন্ট করেছে। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। শিহাব ভাইকে দ্রুত বলো আসতে। আমি যাচ্ছি হসপিটালে। এড্রেস মেসেজ করে দিচ্ছি।

কথা শেষ করেই সাইফ ফোন রেখে দিয়েছে। তিতলি সাইফের কথা শুনে কতোক্ষন হতভম্ব হয়ে চুপ করে রইলো। তারপর জোরে কাঁদা শুরু করে দিলো। শিহাব তিতলির কান্নার আওয়াজ শুনে দ্রুত বের হলো। তিতলিকে কাঁদতে দেখে সে ভয় পেয়ে তিতলির কাছে এসে বললো।

-কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বোন আমার?

তিতলি হিঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললো।

-সাইফ ভাইয়া বললো ভাবিমনির নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।

তিতলির কথা শুনে শিহাব স্তব্ধ হয়ে গেল। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের করতে পারলো না। সে প্রচন্ড ঘেমে গেল। চোখ ফেটে পানি এসে পরলো।

তিতলির কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে রেহান আর জহুরাও আসলো। তিতলি তাদের সব বললো। রেহানও দুঃশ্চিন্তায় ঘেমে গেল। শিহাব কোনো কথা না বলে দ্রুত গাড়ির চাবি নিলো। রেহান তিতলি আর জহুরা বললো তারাও যাবে। শিহাব কিছুই বলতে পারলো না কাউকে। কারন তার বলার মতো অবস্থা নেই। রেহান জহুরাকে বললো।

-তুমি থাকো খালা। বাবা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। জাগানোর দরকার নেই। দোয়া করো। আমরা যাচ্ছি।

জহুরা কাঁদতে কাঁদতে সায় দিলেন। শিহাব,তিতলি আর রেহান দ্রুত বেড়িয়ে পরলো। শিহাবের অবস্থা বিবেচনা করে রেহান গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভিং সিটে বসলো। দ্রুত সবাই গাড়িতে উঠলো। তিতলি কাঁদতে কাঁদতে মিলাকে কল করে সব বলে দিলো।

মিলাও নীরার জন্য অপেক্ষা করছিলো নীরার লেট হচ্ছে বলে। সাইফ তাকে ফোন করে বলেছে রুমার সাথে কথা বলে সাইফ নিজেই নিয়ে আসবে ওদের। এটা শুনে মিলার চিন্তা কমেছিলো। কিন্তু তিতলির কাছে সব শুনে সে মালিহাকে জোরে চেঁচিয়ে ডাকলো। রেজাউল মিলার অবস্থা দেখে বারবার জানতে চাইলেন কি হয়েছে। মিলা বলতে পারলো না। মালিহা নূরজাহান বেগমকে ঘরে দিয়ে আসতে গিয়েছিলেন। এসে দেখলেন মিলা পাগলের মতো করছে। মিলা মালিহাকে দেখতে পেয়ে আরো জোরে কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতেই মালিহাও হতবাক হয়ে গেলেন। মালিহা নিজেকে শক্ত করলেন।তারপর রেজাউল মালিহা আর মিলাও বেড়িয়ে পরলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

মাঝরাস্তায় আসার পর শিহাব রেহানকে নামতে বলে নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসলো। কারন জ্যামে থাকার কারনে এমনিতেই খুব দেরি হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ স্পিড দেওয়ার আগে ওদের বললো অন্যভাবে আসতে। কিন্তু তিতলি আর রেহান রাজি হলো না। শেষে বাধ্য হয়েই শিহাব যতো দ্রুত সম্ভব ড্রাইভ করলো।

সাইফ হসপিটালে পৌছানোর পর দৌড়ে গেলে দেখতে পেল নীরা আর রুমা ঠিকঠাকই আছে। সে দেখতে পেয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নীরা আর রুমা সাইফকে দেখে কিছু বলার আগেই রেজাউল মালিহা আর মিলা এসে পৌছালো। মিলা নীরাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে নীরাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্নায় ভেঙে পরলো। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেল মিলার। মালিহা আর রেজাউল নীরাকে ঠিকঠাক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আসাদ,রুমা বুঝলো না কি হয়েছে। নীরা নিজেও হতভম্ব হয়ে গেল। মিলাকে বহু কষ্টে ছাড়িয়ে বললো।

-কি হয়েছে সবার? এরকম চেহারা কেন তোমাদের? আর হসপিটালে কেন আসলে?

মিলা তখনও কাঁদছে কাঁদতে কাঁদতে সে বললো।

-তিতলি বললো তুমি এক্সিডেন্ট করেছো?

এই কথা শুনে আসাদ আর রুমাও অবাক হয়ে গেল। রুমা বললো।

-কি বলিস এগুলো? আল্লাহ্ না করুন। আসাদের মা এক্সিডেন্ট করেছেন। ওনাকেই হসপিটালে নিয়ে এসেছি।

সাইফ তখন নিজের ভুল বুঝতে পারলো। সে সবটা ক্লিয়ার করতেই যাচ্ছিলো সবাইকে। কিন্তু কথা বলার সুযোগ সে পাচ্ছে না। শিহাব ঝড়ের গতিতে হসপিটালের ভেতরে আসলো। তার পেছন পেছন তিতলি আর রেহানও আসলো। আশেপাশে তাকাতে তাকাতে সে আসলো। রেহান রিসেপশনে জিজ্ঞেস ও করেছে একজনের এক্সিডেন্টের কথা শুনে ওরা এবার আরো দুঃশ্চিন্তায় পরে গেল। শিহাব কোনোকিছু খেয়াল না করে যতো দ্রুত সম্ভব আসলো। তারপর সামনেই নীরাদের দেখতে পেল। নীরাও বুঝেছে যে হয়তো কোনো মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং হয়েছে। সেজন্য সে মিলাকে শান্ত করে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলো।

শিহাব দূর থেকে নীরাকে দেখলো। নীরাকে দেখতে পেয়েই তার মনে হলো সে নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে। মনে হলো এতোক্ষন যাবত সে অন্য কোনো জায়গায় ছিলো। এতোক্ষন দমবন্ধকরা পরিস্থিতি তে ছিলো সে। কোনো দুঃস্বপ্নে ছিলো। এই দুঃস্বপ্ন আর কখনো না আসুক এই কথাটাই তার মাথায় চললো। নীরাকে দেখে সে একটু থেমে গেল। তারপর আবার দ্রুত হেটে আগেপিছে না তাকিয়ে সোজা নীরার কাছে গিয়ে সবার সামনেই নীরাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। সবাই অবাক হয়ে গেল। নীরা প্রথমে বুঝলোই না কি হচ্ছে। তারপর যখন শিহাবের শক্ত হাতের বাঁধন অনুভব হলো তখন নীরা বুঝলো। শিহাব নীরাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে নীরা কিছু বলতেও পারছে না। হসপিটালের ওই করিডোরে কয়েকজন চলতে ফিরতে এই দৃশ্য দেখলো। কেউ কেউ টিটকারি করে হাসলো। কেউকেউ আবার দেখলোই না।

নীরা বুঝতে পারছে শিহাব তাকে সহজে ছাড়বে না। এদিকে নীরার অনেক অস্বস্তিও হচ্ছে। সে শিহাবের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তারপর শিহাবকে আস্তে আস্তে বললো।

-মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং ছিলো। আমি ঠিক আছি আলহামদুলিল্লাহ! অন্য একজনকে নিয়ে এসেছিলাম হসপিটালে। ছাড়ো শিহাব সবাই কি ভাবছে। প্লিজ। তুমি আজকে আমার হাড়গোড় ভেঙেই ছাড়বে।

শিহাবের কানে নীরার কথা গেল কিনা বোঝা গেল না। তবে হাতের বাঁধন আলগা হলো। কয়েক সেকেন্ড ওভাবে নীরাকে জড়িয়ে রেখে শেষমেষ ছাড়লো। নীরা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। শিহাব নিজেকে সামলে নিয়ে বললো।

-কার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো?

রুমা বলে উঠলো।।

-এক্সট্রেমলি স্যরি আমার অর্ধেক কথার জন্যই সবাইকে এতো দুঃশ্চিন্তা করতে হলো। পুরোটাই ভুল বোঝাবোঝি।

সাইফ আর রুমা সবার কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করলো। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তিতলি এসে বললো।

-ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ভাবিমনি।

নীরা তিতলিকে জড়িয়ে ধরে বললো।

-ঠিক আছি আমার কিছুই হয়নি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

রেহান তিতলিকে বললো।

-গাড়িতে বসে বসে সবাইকে জানাতে বারন করেছিলাম।

রেহানের কথা শুনে তিতলি অনুতপ্ত হলো।

মালিহা সবাইকে বললেন।

-রাত হয়ে গেছে। যার যার বাড়িতে যাওয়া উচিত।

আসাদ এতোক্ষন দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছিলো। মালিহার কথা শুনে সে বললো।

-হ্যা নীরা এবার তোমাদের বাড়িতে যাওয়া উচিত। এমনিতেই আজ কতো কষ্ট করলে তোমরা।

আসাদের কথা শুনে শিহাব আসাদের দিকে তাকালো। তারপর বললো।

-আপনার মা কেমন আছেন এখন?

আসাদ শিহাবের কথা শুনে বললো।

-আলহামদুলিল্লাহ্। সকালেই ডিসচার্জ করে দিবে ওরা। নীরা আর রুমা না থাকলে যে কি হতো।

রুমা আসাদের কথা শুনে বললো।

-আবার!

আসাদ হাসতে হাসতে বললো।

-আচ্ছা আর কিছু বলবো না। তোমরা এখন বাড়িতে যাও। আমার বাড়ি থেকে লোক আসবে এখনই। সমস্যা নেই আর।

রেজাউলও তাড়া দিলেন সবাইকে। সবাই নিজেদের মতো হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে পরলো। যাওয়ার সময় ঘটলো আরেক বিপত্তি। শিহাব গম্ভীর কন্ঠে বললো।

-নীরা আমার সাথে চলো।

নীরা যেতে চাইছে না। তাই সে বললো।

-আমি কিছুদিন আমাদের বাড়িতে থাকবো। মিলার সাথে। ও অনেক ভয় পেয়েছে আজ।

নীরার কথা শুনে শিহাব আবারও বললো।

-মিলাও যাবে আমাদের সাথে। মিলা তোমার কোনো সমস্যা আছে? ভাইয়ার কথা শুনবে না?

মিলা সাথে সাথে উওর দিলো।

-অবশ্যই ভাইয়া।

মালিহা আর রেজাউলও যেতে বললেন বারবার। নীরার আর কিছুই বলার রইলো না। অগত্যা বাধ্য হয়ে তাকে যেতেই হলো। সাইফ আর রুমা মালিহাদের সাথে গেল। আর নীরা আর মিলা শিহাবদের সাথে।
-চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here