#আন্তঃনগরের_ভালবাসা
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৫
নিলয়ের গলা পুরো শুকিয়ে গিয়েছে। হাত পা পুরো কাঁপছিল নার্ভাসনেসের জন্য। বেচারার অবস্থা খুব খারাপ। তাও কোন রকম নিজেকে সামলে ও জান্নাতকে বলে,
— জান্নাত আমি তোমাকে….
~ এক মিনিট।
নিলয়কে থামিয়ে জান্নাত ওর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দ্রুত রিসিভ করে কানে দিয়ে বলে,
~ হ্যাঁ মা বলো….এই যে আমি এখনিই রওনা দিচ্ছি। বেশি দেরি হবে না। আসছি আসছি…
বলেই তড়িঘড়ি করে কল কেটে দেয়। তারপর নিলয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,
~ হ্যাঁ বলো কি যেন বলতে নিয়েছিলে?
— তুমি কোথাও যাবে নাকি? তাড়ার ভিতর আছো মনে হচ্ছে।
~ হ্যাঁ, আসলে আম্মুর সাথে এক জায়গায় যাবো। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। বলো কি বলবে।
— ওহ সিট! আগে বলবে না। তাহলে যাও যাও সমস্যা নেই।
~ ওমা! তুমি না বললে কি জানি জরুরি বলবে?
— উমম অত জরুরিও না ঠিক। অন্যকোন দিন সময় করে বলবো। আজ তুমি যাও।
~ সিউর তো?
— হ্যাঁ হ্যাঁ।
~ ওকে আসি তাহলে। বাই।
— বাই।
জান্নাত চলে যায়। নিলয় মাথার পিছনে হাত দিয়ে দুঃখী হয়ে জান্নাতের চলে যাওয়া দেখে। আজও ও পারলো না৷ নিলয়ের ফ্রেন্ডরা আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে বলে,
— শালা তুই আসলেই একটা ফাট্টু। জান্নাতকে ভালবাসিস এটা বলতে পারলি না?
— আরে ওর তাড়া ছিল। তাই আর বলি নি৷ কালকে অবশ্যই বলবো।
— কি যে বলবি জানা আছে। আজ একমাস বসে সাহস করলি আর বলতেই পারলি না৷ দুহ!
— দোস্ত ও এত্তো সুন্দরী…আমার মাথায় ঠিক থাকে না৷ প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে যাই ওর দিকে তাকালে।
— তাইলে ওরে বলবি কেমনে?
— দেখি…
— ওই সবাই ক্যান্টিনে চল। আজকে ফাট্টুটায় ট্রিট দিব আমগো। কতক্ষণ ধইরা দাঁড়ায় থাকলাম তাও শালায় পারলো না৷ আয় ব্যাটা..
নিলয়কে নিয়ে ওর ফ্রেন্ডরা হাসি ঠাট্টা করতে করতে চলে যায়। জান্নাত ওর গাড়িতে উঠে বাসায় চলে আসে৷ এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ওর মায়ের সাথে আবার ছোট খালার বাসায় রওনা হয়৷ জান্নাতের কাছে ওর খালামনিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় খালা হলো ওর ছোট খালা। যার বাসায় ও এখন যাচ্ছে। সে ওর প্রিয় কারণ ওকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন তিনিই। খালাদের মধ্যে আর কি। জান্নাতের মোট চার খালা। ওর আম্মুর আগে দুজন আর ওর আম্মুর পরে দুজন। সবার শেষেই এই নায়লা খালা। ওর প্রতি জন্মদিনেই ওর পছন্দের গিফট গুলো নায়লা খালাই দেয়। আজ তিনি অসুস্থ শুনে জান্নাতের মনটা ভীষণ খারাপ। ওরা আধা ঘণ্টা নাগাদ সময়ে ছোট খালার বাসায় পৌঁছে যায়৷ জান্নাতের বাবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকায় ওরা মা আর মেয়ে এসেছে দেখা করতে। বেল দিতেই বাসার সার্ভেন্ট দরজা খুলে ওদের দেখে প্রথমে সালাম দেয়৷ ওরা সালামের উত্তর দিয়ে সোজা নায়লা খালার কাছে চলে যায়। গিয়ে দেখে খালা একা শুয়ে আছেন। ওদের দেখে তিনিও উঠে বসেন৷ জান্নাতের মা তার কাছে গিয়ে বলেন,
~ উঠতে হবে না শুয়ে থাক। সমস্যা নেই।
~ বসি একটু। কিরে জান্নাত কেমন আছিস মামনি?
~ আমি ত ভালো আছি। তোমার কি হলো?
~ ঠান্ডা লেগেছেরে অনেক। জানোই তো আপা আমার ঠান্ডা আবার একটু বেশি।
~ তুই একটুও নিজের খেয়াল রাখিস না। রাসেল কি তোর একটুও যত্ন নেয় না নাকি?
~ কি যে বলেন না আপা। কাল সারারাত বেচারা একফোঁটা ঘুমায় নি। সারারাত বসে আমার সেবা করেছে। জলপট্টি দিয়ে দিয়ে জ্বর নামিয়েছে। মহাশয় সকালে কোন ভাবেই অফিসে যাবে না৷ অথচ আজকে অফিসে বিশেষ মিটিং আছে। তাও সে যাবে না। আমি জোর করে বকে টকে তারপর পাঠিয়েছি। ও যে আমাকে কত্তো ভালবাসে আর যত্ন করে তা যদি তুমি দেখতে তোমার হিংসা হতো।
~ হয়েছে বুঝছি৷ থাম এবার। একমাত্র তোকেই দেখলাম যে এত স্বামী ভক্ত।
~ ও যে সবার থেকে ভালো আর আলাদা তাই। এই ময়না ওনাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আয়।
~ আচ্ছা আপা।
~ দেখেছো আমার মামনিটা মন খারাপ আছে। এদিকে আয়৷ আমি এখন সুস্থ আছিরে পাগলি। চিন্তা করিস না৷
জান্নাত ওর খালার কাছে গিয়ে বলে,
~ সত্যি তো?
~ হ্যাঁ রে। তোর খালুর জন্য আমি একটুও অসুস্থ হতে পারি না। একদম পাগল হয়ে যায়।
জান্নাত খালাকে জড়িয়ে ধরে আর মনে মনে ভাবে, প্রেম করে বিয়ে করলে বুঝি ভালবাসাটা এত গভীর হয়? কারণ ওর নায়লা খালাও প্রেম করেই বিয়ে করেছেন। তাদের মাঝে মহব্বত দেখলে জান্নাতেরও ইচ্ছা হয় ওর ছোট খালুর মতো ওর জীবনেও কেউ আসুক। কেউ ওকে এভাবে আগলে রাখুক। কিন্তু জান্নাত কাউকে এখন পর্যন্ত সুযোগ দেয় নি। তবে ওর মন চাচ্ছে এবার ও কাউকে এই সুযোগটা দিবে৷ অবশ্যই দিবে। এরপর ওরা তিনজন মিলে অনেক কথার ঝুলি খুলে বসে৷
এদিকে,
নামাজ শেষ করে বাসায় চলে এসেছিলাম বাবার সাথে আমি। যাওয়া এবং আসার সময় কম হলেও বিশ জনের সাথে পরিচিত হই৷ বাবাই তার নিজের আপন ছেলে বলে পরিচয় করিয়ে দেন৷ সবার কাছেই বলেন আমার হাতের সমস্যার কথা বলেন। অবাক করার বিষয় হলেও সত্যি যে একজন লোকও নেগেটিভ ভাবে আমার সমস্যাটা নেয় নি। সবাই পজিটিভ ভাইব দিয়েছে৷ আমি শুধু অবাক হয়ে ছিলাম পুরোটো সময়৷ পরে একটু ভেবে চিন্তে বের করলাম, আসলে বাবা আমাকে তুচ্ছ করে নি বলেই বাকিরা আমাকে সদরে গ্রহণ করেছে। সে যদি একবার হলেও আমার উপর বিরক্তি প্রকাশ করতো কিংবা আমার সম্পর্কে বলতে লজ্জা পেত তাহলে হয়তো অন্যরা এই সুযোগটুকু নিয়েই আমাকে আবার লাঞ্চিত হতে হতো। এখন আমি বুঝেছি, আমি কেন সবার কাছে একটা নেগেটিভ ফিগার ছিলাম। কারণ আমার আপন পরিবারই আমাকে আজ পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণই করে নি। তারা যদি আমাকে সদরে গ্রহণ করতো, সমাজে আমাকে নিয়ে বলতে লজ্জা না পেত তাহলে হয়তো আজ আমি ঘর হারা হতাম না। কি দরকার ছিলা আমাকে বিয়ে দেওয়ার। কোন মেয়ের কাছ থেকে আমি কখনোই প্রেম, ভালবাসা এগুলো আশা করি নি। এখনো করি না৷ কারণ আমি জানি, কোন মেয়েই আমাকে স্বাভাবিক ভাবে নিবে না। সে চায় তার লাইফ পার্টানারটা সবচেয়ে সুন্দর, হ্যান্ডসাম আর ফিজিকালি ফিট হোক। আমার মতো হাত ভাঙা ছেলেকে কেউই চাইবে না। বাবা আর ভাই সেটা বুঝলোই না। তাদের মাথার বোঝা অন্যের কাঁধে তুলে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। কিন্তু লাভ হলো কি? আমি আজ ঘর ছাড়া। তবে এখন মনে হয়, আল্লাহ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই। নাহলে এত ভালো, অমায়িক পরিবার আর পরিবেশ হয়তো আমি কোন দিনই পেতাম না।
সেদিন বাবা মা আর বোনের সাথে অনেকটা সময় গল্প করি। আমার জীবনে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই তাদের বলি। তারা কেউই চোখের পানি আটকে রাখতে পারে নি। পারি নি আমিও। সেদিন ওভাবে শেষ হলে পরদিন বাবা আমাকে নিয়ে শপিং এ যান। সাথে রাজশাহীর অনেক গুলো জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখান। এর পরের দিন উনার বিশাল বড়ো ফ্যাক্টরি ঘুরে দেখান। সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন৷ এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়। আমার এখন রাজশাহীর অনেক গুলো জায়গা চেনা হয়ে গিয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন আর বসে থাকা যাবে না৷ কিছু একটা করতে হবে৷ এভাবে ওনাদের ঘাড়ের ওপর চেপে পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাবো আমি? অসম্ভব। আমি একজন ছেলে। আমাকেও ইনকাম করতে হবে৷ এখন ভাবছি কি করবো। মাথার ভিতর একটা বড়ো ইচ্ছা আছে৷ কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে লাগবে অনেক অনেক টাকা। যা এখন আমার কাছে নেই। হঠাৎই মরিয়ম দরজায় নক করে।
~ ভাইয়া ভিতরে আসি?
— হ্যাঁ বোন আয়।
ও ভিতরে এসে জানায় বাবা আমাকে ডাকছে। আমি দ্রুত তার কাছে গেলাম। উনার সামনে বসতেই উনি বললেন,
— আমার তো কাপড়ের বিশাল বড়ো বিজনেস। এতদিন তো তোকে সবই দেখালাম। তুই তো বিজনেস নিয়ে পড়েছিস। অনেক ভালো রেজাল্টও করেছিস। এখন আমার ব্যবসাটা যদি তুই ধরতি তাহলে আমার একটু সুবিধা হতো আবির।
আমি বাবার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। তারপর বলি,
— আপনি আমার কথায় রাগ করবেন না প্লিজ। তবে আমি আপনার এই কথাটা রাখতে পারবো না৷ কারণ আমি চাই আমার পড়াশোনার যোগ্যতা দিয়ে নিজে কিছু একটা করতে। আমি যদি বিনা পরিশ্রমেই এত কিছু পেয়ে যাই তাহলে জীবনের মানে টাই কখনো আমি উপলব্ধি করতে পারবো না৷ আমি কষ্ট করতে চাই। আমি কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করতে চাই। আমার একটা স্বপ্ন কিংবা বলতে পারেন বড়ো ইচ্ছা আছে। আমি চাই আমার যোগ্যতা এবং পরিশ্রম দিয়ে সেই স্বপ্নটা পূরণ করতে। জানি অনেক কঠিন হবে। তবে আমি চেষ্টা করতে চাই বাবা।
আমার কথা শুনে উনি হেসে উঠলেন। আর বললেন,
— সাব্বাশ। আমি তোর কাছ থেকে এটাই আশা করছিলাম। তোকে পরীক্ষা করার জন্যই আমি আমার বিজনেসটা তোকে দিতে চাচ্ছিলাম। অবশ্য তুই যদি না করে গ্রহণও করতি তাও আমি অখুশি হতাম না৷ তবে একটু কষ্ট পেতাম যে তুই আমার আশানুরূপ হলি না৷ কিন্তু তুই পাশ করেছিস। আমি যেমনটা ভেবেছিলাম তুই ঠিক তেমনই৷ আমার বিশ্বাস আর তোর জন্য সীমাহীন দোয়া রইলো, তুই পারবি একদিন তোর স্বপ্নটা পূরণ করে সবাইকে দেখিয়ে দিতে। সেদিন আমরা পুরো দুনিয়া তোকে দেখবে। তোর বাহ বাহ করবে দেখিস। আল্লাহ যেন সেদিন পর্যন্ত আমাদেরকে তোর পাশে রাখে বাবা। আর হ্যাঁ আবির আমার সবকিছু কিন্তু তোদের দুজনের জন্যই। এত সয় সম্পত্তি নিয়ে তো আর কবরে যাবো না, যা আছে তোরা তোদের প্রয়োজনে ভোগ করিস। আসল কথা হলো, তোর যদি আর্থিক কোন সাহায্য লাগে আমাকে বলিস বাবা। আমি তোর পাশে আছি।
খুশিতে মনটা ভরে আসছিল। আমি কিছু বলার আগেই মা পিছন থেকে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
~ দেখেছো বলেছি না আমি, যে ও লাখে একটা ছেলে। ওর কোন লোভ নেই। ও খুব ভালো একটা ছেলে। আমার ছেলে ও৷ আল্লাহ ওকে আমার জন্যই শুধু পাঠিয়েছেন। দোয়া করি বাবা তুই অনেক বড়ো হ।
অজান্তেই চোখ জোড়া ভিজে আসে। জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া কি জানেন? বাবা-মার আন্তরিক দোয়া। যেই দোয়া আপনাকে পাতাল থেকে দুনিয়ার সবচেয়ে উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে৷ আমি নিজের আপনদের দোয়া না পেলেও আমার নতুন বাবা-মার দোয়া আমি পেয়েছি। জীবনে আর কি লাগে। আমি চোখ মুছে বললাম,
— বাবা ওজু করে আসি একসাথে নামাজে যাবো।
— আচ্ছা আয়।
তারপর একসাথে নামাজে গেলাম বাবা আর ছেলে। এদিকে মাথার ভিতর ঘুরছিল কি দিয়ে শুরু করবো। আসার সময় সার্টিফিকেট গুলো কি যেন ভেবে নিয়ে এসেছিলাম। মনে ভাবছি কোন কোম্পানিতে জয়েন করবো। কিন্তু আমার মতো হাত ভাঙাকে কি তারা হায়ার করবে? এটাই বড়ো প্রশ্ন। ভাবছি কাল সকালে পত্রিকা নিয়ে বসবো। দেখি এখানেই কোন কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া যায় কি না৷
চলবে..?
সবার ভালো সাড়া চাই তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পরবর্তী পর্ব দেওয়া হবে। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্ট দেওয়া হবে। ধন্যবাদ।