#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
ভোররাত, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত পরিবেশ। দূর থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি। ধড়ফড়িয়ে উঠলাম আমি। জানালা টা খুলে দিলাম। শা শা করে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো পুরো রুম জুড়ে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সাবিহা হাত-পা ছড়িয়ে এখনও শুয়ে আছে। ওর শোয়া ভীষণ রকম বাজে। হুটহাট শরীরের উপর হাত পা তুলে দেয়। প্রথম প্রথম আমার ঘুম হতো না। ভেঙে যেতো ঘুম। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নিলাম। গতকাল রাতে সাবিহা পইপই করে বলে দিয়েছে যেন আজকে ওকে ডেকে দিই নামাজের জন্য। মেয়েটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। সকালের নামাজটা প্রায়ই মিস করে। কিন্তু সে এইবার থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এখন থেকে ফজরের নামাজটা পড়বেই পড়বে। যেকোনো ভাবে যেন আমি তার ঘুম ভাঙিয়ে দিই। দরকার পড়লে যেন তার শরীরে পানি ঢেলে দিই। কিন্তু আম্মা ওকে একটা বড়সড় ধমক দিয়েছে। আমাকে মানা করেছে এইরকম পাগলামি যেন না করি আমি। তাহলে তো বিছানা ভিজে যাবে। সেটা তো আম্মাকেই পরিষ্কার করতে হবে। আম্মার কথা শুনে মুখ গোমড়া করে সাবিহা বলেছিল,” আপু, তুমি তাহলে হালকা পানিরই ছিটা দিও। বেশি দিও না। তাহলে আবার একটুখানি ভিজলেও তো সমস্যা। ”
আমি সাবিহাকে ডাকলাম। ওর কোনো সাড়া নেই। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কি যেন বললো৷ বুঝলাম না। ইচ্ছে হলো ওকে তুলে আছাড় মারি। কিন্তু উপায় নাই। উল্টো ওর কান্না শুনতে হবে। বাবা ওকে আদর না করা পর্যন্ত ওর কান্না থামবে না। কিন্তু এখন বাবা বাসায় নেই। ঢাকার বাইরে আছে। তাই হুট করে ওকে নিয়ে এইরকম সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হবে না। আবার ওকে ঘুম থেকে না ডেকে দিলেও ও অনেক রাগারাগি করবে। আমার সাথে, আম্মার সাথেও করবে। আম্মার একটা রামধমক না খাওয়া পর্যন্ত সেটা থামবে না। আমি সাবিহাকে আস্তে করে ডাকলাম,”সাবু, উঠে পড়। আম্মা না হলে কিন্তু তোকে অনেক বকা দিবেরে।”
কোনো নড়নচড়ন নেই। ও আজও বকা খাবে। আজকে ওকে ডেকে আমার মোড নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না। কারণ, আজকে আমার প্রথম কলেজে যেতে হবে। আজকের দিনে সকাল থেকে আমি ওর সাথে ঝগড়া করতে চাইছি না।আমি ধীর পায়ে উঠে নামাজ শেষ করে কিচেনের দিকে গেলাম। দেখলাম আম্মা ইতোমধ্যে চা বানিয়ে ফেলেছে। আমাকে দেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,” আজকেও উঠেনি?”
“উহু।”
“মেয়েটা বড্ড ঘুমকাতুরে। ওকে নিয়ে যে কি করি বুঝতে পারছি না। কিছুদিন পরেই পরীক্ষা দিবে। জানো, আমার মা আমার চুল টেনে ঘুম থেকে উঠাতো। আমাকে কেন, আমার সব ভাইবোনকে। না উঠলে কি কি যে করতো, বলার বাইরে। এখনকার বাচ্চাদের লাই দিতে দিতে মাথায় উঠায়ে ফেলছি আমরা। আগে থেকেই যদি এই অভ্যাস করতাম, তাহলে আজ আর এইরকম হতো না।”
“হুমম। তা অবশ্য ঠিক। তবে, আগেরদিনে তো মানুষ ঘুমাতোও আগে। তাই ঘুমও ভাঙতো তাড়াতাড়ি। এখন তো ঘুমায় ও পরে৷ তাই উঠেও পরে।”
“হুমম, তাই তো। আর এর কারণ টা কি?মোবাইল। হ্যাঁ… ঐটা পেলে তো আর দিন দুনিয়ার খবর থাকে না। রাতের পর তার জেগে মোবাইল টিপা শুধু। আর ফলাফল কী?চোখের নিচে কালি পড়া ছাড়া আর কি তেমন কোনো লাভ হয়?আমাকে বলো তো মায়া।”
আমি মিটিমিটি হাসতে থাকলাম। এইগুলো আম্মার প্রতিদিনের ভাষণ। এতো আমলে নেওয়ার কিছু হয়নি।
“আজই তোমার বাবাকে বলবো ওর থেকে মোবাইল টা নিয়ে নিতে। পড়ে তো মাত্র ক্লাস এইটে।আর এখনই কিসের মোবাইল?চোখের নিচে কালি জমে আছে। বেয়াদব একটা মেয়ে।”
আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কেন খারাপ হলো জানিনা।কিংবা হয়তো জানি। কিন্তু স্বীকার করতে চাইনা। আমি চা নিয়ে আমার রুমে চলে এলাম। ঘুমন্ত সাবিহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ওর মোবাইল যেদিন নিয়ে যায়, সেদিন কি কান্নাটাই না করে৷ পুরো বাসা মাথায় তুলে নেয়। বাবা না আসা পর্যন্ত আম্মা মোবাইল দেয় না। আমার কী ওর প্রতি হিংসা হচ্ছে? হিংসা কেন হচ্ছে?আমার তো ভালোই। আমি সারাদিন সারারাত মোবাইল টিপলেও তো আম্মা আমাকে কিছু বলে না। বড়জোর বলে যে ঘুমিয়ে পড়ো মায়া। বেশি রাত জাগা ভালো না।
আমি বাইরে তাকালাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার অনুভূতিই আলাদা। আমি আজ কলেজে যাব। ভাবতেই ভালো লাগছে। ভালো রেজাল্ট করে স্কুল শেষ করেছি। ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছি। মা কে ভীষণ মনে পড়ছে। গত ১ বছরে সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি এখন এই পরিবারেরই একটা অংশ। আসলেই কি তাই? হয়তো। আমিও এখন বাবার আদরের মেয়ে। আম্মাও আমাকে ভালোবাসেন। সাব্বির আর সাবিহার চলার সাথী। আমাকে ছাড়া ওরা একটা দিনও এখন কল্পনা করতে পারে না। এসএসসি শেষে আমি আমার নানাবাড়ীতে গিয়েছিলাম। সাব্বিরের কান্নায় বাবা বাধ্য হয়েছিল তার পরদিনই ওকে নিয়ে আমার নানাবাড়ি যেতে। মাত্র ২ দিন থেকেছিলাম সেখানে। নানা-নানি আমাকে অনেকদিন পর কাছে পেয়েও এতো তাড়াতাড়ি আসতে দিয়েও খুশি ছিল। অনেক খুশি ছিল। কারণ, তারা বুঝেছিল, আমি ভালোই আছি। হ্যাঁ, আমি ভালোই আছি। অনেক ভালো আছি।এই বাসাটা আর আগের মতো নিশ্চুপ থাকে না। স্কুলে যাওয়ার সময়ও গাড়িতে হৈ-হুল্লোড় হয়। আমি অবাক হয়ে দেখি, সাবিহা নামের যে মেয়েটার কাছে আমি একদিন উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা ফালতু মেয়ে ছিলাম, সেই মেয়েটার কাছেই আমি এখন তার সেরা বন্ধু। সাব্বিরও আগের চাইতে বেশি রেস্পন্স করছে সবকিছুতে। আম্মা চাইলেই এখন আবার চাকরি করতে পারে, কিন্তু কেন যেন করে না। আর বাবা, আমি এখন তার চোখের মণি।
কিন্তু আসলেই কি আমি ভালো আছি? কিংবা তারাই কি আমাকে পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন? বাবার ভালোবাসাটা আমার কাছে কেন যেন অতিরিক্ত রকমের বাড়াবাড়ি মনে হয়। যেন মনে হয় আমাকে জোর করে ভালোবাসার চেষ্টা করছে। আর আম্মা? সে কী আসলেই আমাকে এখন নিজের সন্তানের মতো ভেবেছে? নাকি ভাবতে পেরেছে? আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম আমার চোখের নিচেও অনেক কালি জমেছে। পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়েছি আর আম্মার বকা খাওয়ার জন্য মোবাইল টিপেছি। কই, আমাকে তো আম্মা বকে না? আমাকে কেন শুধু আদর করে? আমি তো এমন আদর চাইনা। আমি চাই আমাকেও সাব্বির আর সাবিহার মতো বকা দিক। আমাকেও বাকিদের মতোই দেখুক। আমি আম্মার শখের জিনিসটাও নষ্ট করলে আমাকে কিছুই বলবে না। কিন্তু ওরা দুইজন একটা সামান্য গ্লাস ভাঙলেও ওদের বকবে। আমরা ৩ ভাই বোন কোনো কিছুর জন্য পার্মিশন নিতে গেলে ওরা আমাকে পাঠায় আম্মার কাছে। কারণ, ওরা জানে আমি যাই চাই না কেন, আম্মা আমাকে দিবে।ওরা কি জানে, আমি এমনটা চাই না? আমি চাই আম্মা আমাকেও শাসন করুক। দরকার পড়লে মারুক। কিন্তু আমি এমন ভালোবাসা চাই না, যেখানে শাসন নেই।
“আমাকে ডাকো নি কেন আপু?”
বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম,সাবিহা উঠে চোখ ডলছে। আমি ওকে বললাম,” ডেকেছিলাম তোকে। তুইই জাগিস নি। সেটা কি আমার দোষ?”
“আম্মা এখন আমাকে মারবে।”
” মারবে না। যা, এখন ফ্রেশ হয়ে নে।”
ভাবা যায়, আমরা এখন একই রুমে,একই খাটে ঘুমুচ্ছি।অথচ আগে….
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দেখলাম সেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেটা আর গরম করার ইচ্ছে নেই এখন। ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলাম। এটাকে অবশ্য চা বলেনা। এইটাকে শরবত বলা চলে।
★★★
“আজকে থেকে তোমাকে তো আলাদা যেতে হবে, মায়া। আজকে অবশ্য তোমার সাথে আমি যাব। প্রতিদিন রিকশায় যেতে তোমার অসুবিধা হবে না তো?”
” হবে না আম্মা।”
” তোমাকে অনেক মিস করবো আপু।” পরোটা চিবুতে চিবুতে বললো সাব্বির।
“আমিও মিস করবো তোকে।”
“বাবা কবে আসবে মা?” সাবিহা বললো।
“মনে হয় কালকে বা পরশু। কথা না বলে খাবার খাও। বাবা আসলেই তো মজা, তাইনা?”
“ভয় লাগছে, মায়া?”
“না, আম্মা।”
“আজ হয়তো তোমাদের বরণ করে নিবে। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে হয়তো।”
“হুমম। আমারও তাই মনে হচ্ছে। ”
“আমাকে তো ভিতরে ঢুকতে দিবে না মায়া। তোমাকে একাই যেতে হবে।”
” আচ্ছা, তুমি তাহলে চলে যাও আম্মা। আমি ভিতরে ঢুকি।”
“আচ্ছা, ভয় পেও না। আমি ছুটির আগেই গাড়ি নিয়ে চলে আসবো। আমাকে না পেলে ভয় পেও না যেন আবার।”
“আচ্ছা, আম্মা।”
আমি ভিতরে না ঢুকা পর্যন্ত আম্মা গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মাও হয়তো এইভাবে থাকতো আজ। তবে, সেটা হয়তো গভীর মমতা নিয়ে। আর আম্মা হয়তো নিজের দায়িত্ববোধের জন্য থেকেছে। কি-জানি, উনিও হয়তো আমাকে ভালোবাসেন।
আমি ভিতরে গিয়ে দেখলাম, ছোটখাটো না, বেশ ভালোই আয়োজন হচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কাউকেই চিনি না এইখানে। হঠাৎ মনে হলো পেছনে থেকে কেউ আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরতেই যাকে দেখলাম, তাতে আমার বুক কেঁপে উঠলো। এই মানুষটাকে দেখার জন্য আমি কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি। কত কথা ভেবে রেখেছি। অথচ আজ তাকে এতোটা কাছে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। কি বলবো সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, কথা এলোমেলো হচ্ছে, নাকি আমি নিজে?
চলবে….