বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ২০) #মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

0
314

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ২০)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

“দোয়া করি, সংসার জীবন সুখের হোক। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা পিচ্চি। ওহ্ স্যরি,, মানুষ তো সারাজীবন পিচ্চি থাকে না। ভুলে গিয়েছিলাম। ভালো থাকিস। বেষ্ট অফ লাক।”

বলেই নিরবে হেটে চলে যাচ্ছে রিদ। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে আরশি। হয়তো অনেক আশা নিয়ে এসেছিল আজ। এক সময় এই মানুষটা ছোট ইচ্ছে গুলোও অপূর্ণ রাখতো না তার। অথচ আজ কাঁন্নামাখা আকুল আবেদন ফিরিয়ে দিল চোখের দিকে চেয়ে। যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না, কোমল হৃদয়ের মানুষটা এত এতটা পাথর হবে গেলো কিভাবে?

ক্লান্তি মাখা শরিরে যেন দাড়িয়ে থাকাটাও একটা সংগ্রাম মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। যেখানে এই মুহুর্তের জন্য তাকে একজন পরাজিত সৈনিক বললেও ভুল হবে না। তাই তো আর স্থির হয়ে দাড়াতে পারলো না সে। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো নিরবে।

চোখ খুলতেই দেখে রুমকির ঘরে শুয়ে আছে সে। পাশে বসে আছে রুমকি। তার সাথে মামিও। রিদ দাড়িয়েছিল খাটের পাশেই। আরশি চোখ খুলতেই মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
“দুর্বলতার কারণে এমনটা হয়েছে মা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। আর দুর্বলতা কাটতে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করো।”

কি কি করতে হবে বলে দিয়ে স্থান ত্যাগ করলো রিদ। মাঈমুনা চৌধুরি পাশে বসা অবস্থায় আরশির মাথায় মমতাময়ী ভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো খাবারের ব্যবস্থা করতে।

রুমকির দিকে তাকায় আরশি। ক্লান্ত গলায় বলে,
“কি হয়েছিল আমার? এখানে আসলাম কি করে?”
“ছাদে নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলি, ভাগ্যিস ভাইয়া ধরে ফেলেছিল। তারপর কোলে তুলে নিয়ে এসেছিল এখানে।”
কিছু বললো না আরশি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বুঁজে একটা নিশ্বাস নিল। পাশ থেকে রুমকি আবার বলে,
“তোর জন্য আজ ভাইয়ার কাছে এমন ঝাড়ি খেলাম, যা সারা জীবন মনে থাকবে আমার।”
আরশি চোখ খুলে রুমকির দিয়ে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”
“তোকে আমার ঘরে এনেই ভাইয়া বললো মাকে ডেকে আনতে। ভাইয়ার চোখে-মুখে খুব অস্থিরতা মিশে ছিল। আমি মাকে না ডেকে কৌতুহল বসত ‘আরশির কি হয়েছে’ বলতেই এমন ঝাড়ি মা’রলো, বুকটা এখনো কাঁপছে আমার। ভাইয়া আর কখনো আমাকে এভাবে ঝাড়ি মারেনি।”

আরশি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“তিনি কি খুব অস্থির ছিল?”
“আর বলিস না বইন। ভাইয়ার অস্থিরতা দেখে আমি তো প্রথমে ভাবলাম তুই ম’রেই গেলি। আচ্ছা সত্যি করে একটা কথা বলবি আমায়?”
“কি?”
“তোর আর ভাইয়ার মাঝে কি হয়েছিল? খেয়াল করলাম ভাইয়া তোকে এড়িয়ে চলে। তুইও কেমন মনমরা হয়ে থাকিস। এখন শুনলাম ফুপা তোর বিয়েও ঠিক হয়ে ফেলছে অথচ ভাইয়া শুনেও না শোনার মত আচরণ করছে। আমি শিউর নিশ্চই কিছু আছে এর মাঝে। নয়তো তোকে আর ভাইয়াকে তো আমিই সবচেয়ে বেশি বুঝি। কি হয়েছিল বল তো?”

রুমকির দিক থেকে অন্য দিকে ঘার ঘুরিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে রইল আরশি। রুমকি আবারও জিজ্ঞেস করলে আরশি শান্ত ভাবে বলে,
“খুব মাথা ব্যাথা করছে রুমকি। প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দে।”

পরদিন সকাল হতেই বাড়ি ফিরে গেলো আরশি। রিদের কথা মত রোহান বাসায় পৌছে দিয়ে আসলো তাকে।
শুক্রবারে জুম্মা শেষে একসাথে খাবার টেবিলে বসলো সবাই। ছুটির দিন মানেই সবার জন্য একটা বিশেষ দিন। বাড়ির সবাই একসাথে খাবার খাওয়া। নানান রকম খাবারে টেবিল সাজানো হয়েছে। রুদ্র চৌধুরী টেবিলে এসে বসলে খাবার শুরু করে সকলে।
খাওয়ার মাঝে রিদ বাবার দিকে চেয়ে বলে,
“বাবা একটা নতুন পরিকল্পনার কথা ভাবছি আমি। ভাবছি আপনাদের সাথে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নিব।”
রুদ্র চৌধুরী কৌতুহলী দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চেয়ে বলে,
“কি সেটা?”
“প্ল্যান টা হলো একটা উন্নতমানের বড়ো হসপিটাল তৈরি করার। যেখানে মানবসেবার পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য বিনা খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করবো। যতটুক সম্ভব অসহায় মানুষদের পাশে দাড়ানো, যেটা আমার একমাত্র লক্ষ।”

রুদ্র চৌধুরী খাওয়া বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
“ভালো পরিকল্পনা। অবশ্যই সে যোগ্যতা আছে তোমার? তো কবে কোথায় বা কিভাবে কাজ শুরু করবে, ভেবেছো কিছু?”
পাশ থেকে রোহান রুদ্র চৌধুরীর দিকে চেয়ে বলে,
“আমার মনে হয় এর জন্য আমাদের কোম্পানির পাশে পরে থাকা বড়ো খালি জায়গাটাই সবচেয়ে বেটার হবে। তাছাড়া মেইন রোডের পাশেই আছে।”
রুদ্র চৌধুরী কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“আচ্ছা সন্ধার পর একসাথে বাগানে বসবো সবাই। তখন কথা হবে এই ব্যপারে। এখন খাবার উপভোগ করো।”

এতক্ষণ নিশ্চুপ থেকে পাশ থেকে রোহানের বাবা ক্ষনিকটা হাসিমুখে বলে,
“বাহ্ আমাদের দুই ছেলের মাঝে এক ছেলে ইন্ডাস্ট্রির শাখা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, অন্যজন মানবসেবার জন্য উন্নতমানের হসপিটাল। আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই তোমরা নিজেদেরকে আমাদের যোগ্য সন্তান হিসেবে প্রমান করবে।”

ক্ষনিকটা মৃদু হাসলো রিদ রোহান দুজনই। সাথে উপস্থির সবার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। মাঈমুনা চৌধুরি প্রশান্তির হাসি ধরে রেখে বলে,
“ইন’শা আল্লাহ্।”
,,

ল্যাপটপ হাতে বসে আছে রিদ। রুমকি দু’কাপ কফি হাতে এসে বসলো ভাইয়ের পাশে। রিদ কফির মগটা হাতে নিয়ে একপাশে রাখলো। অতঃপর ল্যাপটপের স্কিনে দৃষ্টি রেখে বলে,
“কিছু বলবি?”
“একটু কথা ছিল।”
“বস এখানে।”
রুমকি তার পাশে বসে ক্ষনিকটা কৌতুহল নিয়ে বলে,
“ভাইয়া, আরশির সাথে তোমার কি হয়েছিল?”
“কিছু হয়নি।”
“তাহলে তাকে দুরে ঠেলে দিলে কেন? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, যা তুমি ও আরশি দুজনই গোপন রাখছো। আর নিরবে কষ্ট পাচ্ছো।”

রিদ সোজাসাপটা ভাবে বলে,
“আমার কোনো কষ্ট নেই।”
“হয়ত এখন নেই। যখন হারিয়ে ফেলবে তখন যেন আবার পাগলপ্রায় না হয়ে যাও।”
রিদ এবার ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে রুমকির দিকে চেয়ে বলে,
“তোকে আরশি পাঠিয়েছে না?”
“আমাকে কেউই পাঠায় নি। ভাইয়া, আরশি মেয়েটা তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। কেউ না জানলেও আমি সবচেয়ে ভালো জানি সেটা। সবার জন্য কারো চোখে জল আসে না। যেটা তোমার জন্য আরশির চোখে দেখেছি আমি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় রিদ। নিজের মাঝেই গোপনে বলে,
‘আমার কাঁন্না গুলোও যে হৃদয়ে আঘাত পাওয়ার কারণেই এসেছিল। আরশির কান্না সবাই দেখছে। অথচ আমার দুর দেশে কেঁদে যাওয়া নিরব চোখ দু’টো দেখার মতোও কেউ ছিল না। যার জন্য অশ্রু ঝড়েছে সে মানুষটাও বুঝতে চায়নি আমাকে। আঘাত করেছিল খুব সহজেই। তা কি করে ভুলে যাবো আমি?”

নিজের মাঝে বললেও প্রকাশ করলো না সেটা। একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কঠিন গলায় বলে,
“এসব ছাড়া আর কিছু বলার না থাকলে আসতে পারিস এখন।”
“ভাইয়া,,,,”
“তোকে যেতে বলেছি। এসব নিয়ে আর কিছুই শুনতে চাই না আমি।”

“””””””””””””””””””””””””””””””””

দিন যেম এক এক করে কেটে যাচ্ছে। সাথে আরশির বিয়ের কথাবার্তাও বাড়ছে ঘরে। আর মাত্র কয়েকদিন আছে বিয়ের। কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে এটাও অজানা তার। ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে কোনো অচেনা মানুষের সাথে সম্পর্কের কথা ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে যেন।

তবুও এমনটাই হতে চলছে। সবার মাঝে বিয়ে বিয়ে আনন্দ। অথচ তার মাঝে নেই। যার কারণে ঘরটাও আরশির আজকাল অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে খুব। এক মুহুর্তের জন্য ইচ্ছে সবকিছু ছেড়ে দুরে কোথাও চলে যেতে যেখানে একটু মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। কোনো বিষাদ ছুঁতে পারবে না যেখানে। মাঝে মাঝে মনে হয় বারবার প্রত্যাখান হওয়ার পরও কেন বেহায়া মন ঐ মানুষটার মাঝেই আটকে থাকে? তার জন্য আমার মাঝেও এক আকাশ সমান অভিমান তৈরি হতে পারে না? তাহলেই তো সব সমাধান হয়ে যায়। দিন শেষে একটা সত্য থমকে দেয় তাকে। যেটা হলো, ভুলটা তো তারই ছিল।

খুব ইচ্ছে হচ্ছে ঐ দিন গুলোতে ফিরে যেতে। যে দিন গুলো ছিল হাসি আনন্দে ভরা। প্রিয় মানুষটার অসিম ভালোবাসায় ঘেরা। ঐ দিন গুলোতে একবার ফিরে যেতে পারলে এমন ভুল আর দ্বিতীয় বার করতো না সে।

ভালোবাসা এমন এক জিনিস যা খুব বেশি পেয়ে গেলে সেটা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। খুব পরে গিয়ে হয়তো উপলব্ধি করতে পারে যে, সে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছিল।

বিষণ্ন মনে বেলকনিতে গিয়েই চমকে গেলো আরশি। সেই নিয়মিত রেখে যাওয়া চিরেকুট। যার প্রতি এখন আর কোনো অনুভূতি নেই। সব সময় তো সকালে পায় এই চিরেকুট। তাহলে আজ সন্ধায় কেন?

পাঁচ বছর ধরে চিরেকুট রেখে গিয়েছে অগন্তুক। একটা মানুষের এতটা ধৈর্য কি করে হতে পারে? সব মিলালে প্রায় আড়াইশ থেকে তিনশ চিরেকুট হবে। যেগুলো বেশিরভাগই মুগ্ধ করেছিল তাকে। প্রথম প্রথম নিজের কাছে রাখলেও একটা সময় থেকে ফেলে দিত সব গুলো। কারণ বাচ্চা বয়স পেরিয়ে ততদিনে উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তারও একজন ব্যাক্তিগত মানুষ আছে। সে ছাড়া আর কারো অনুভূতির কোনো ঠাই নেই তার কাছে। অথচ একটা ঝড় যেন আজও বিরহের সাগরে আটকে রেখেছে তাকে।

একটা শ্বাস নিয়ে কাগজটা খুলে দেখে আরশি। কি আর হবে? আগের মতোই প্রেমকথন লিখা থাকবে হয়তো। কিন্তু আজ পড়তেই যেন সারা শরির জুরে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো তার। সারা শরির কাঁপতে শুরু করেছে মুহুর্তেই। পর পর কয়েকবার পড়লো লিখা টা। ভুল দেখছে না তো? না সত্যিই তো। স্পষ্ট লিখা আছে,

‘আমার পরীর মত প্রেয়শি,
শত অপেক্ষার পর অবশেষে নিজের করে পেতে চলেছি তোমায়। মাত্র আর গুটি কয়েক দিনের অপেক্ষা। এই মহাপ্রাপ্তির উত্তেজনায় আমি কিভাবে নিজেকে সামলে রাখি বলো তো। আমি জানি আমার দীর্ঘ পাঁচ বছরের পাগলামিতে আমাকে দেখার একটু হলেও ইচ্ছে জেগেছে তোমার। তোমার সেই ইচ্ছে টাই পূর্ণ করতে এসেছি আজ। এই পা’গল অগন্তুক তোমারই অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে তোমার বাসার ছাদের তোমার সৌন্দর্যের উপমা দেওয়ার মতোই সুন্দর সেই ফুটন্ত তাজা গোলাপের গাছটার পাশে।’

To be continue……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here