#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১১
অপরাহ্নের শুরু। প্রবল রৌদ্রত্তাপ। কাঠ ফাটা গরমে রাস্তাঘাট চৌচির। বৃষ্টির থেকে বেশি এই রৌদ্দুরে এখন পথচারিদের হাতে শোভা পায় ছাতা। সূর্যালোকের দাপটে বাতাসও বোধহয় অভিমান করে আর বইছে না। এতো গরমে রাস্তার একপাশে রিক্সার অপেক্ষায় দাড়িয়ে শৈলী। কিন্তু রিক্সা নামক বস্তুটি আজ যেন সোনার হরিণ। তার কোনো হদিস নেই। এমনকি ভার্সিটির গলি থেকেও আজ তারা গায়েব। এদিকে শাড়ি পরে রোদের তান্ডবে শৈলীর অবস্থা যায় যায়। আঁচল দিয়ে চেপে চেপে কপোলের ঘাম মুছে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর মনে মনে আউড়াচ্ছে,
– রিক্সাওয়ালা মামা আপনারা আজ কই? আজ যে আমাকে বাসায় পৌছে দিবে তাকেই আমি চল্লিশ টাকার জায়গায় একশ টাকা ভাড়া দিব। কেউ আসেন, প্লিস।
তবে ওর মনের আকুতি কোনো রিক্সা ওয়ালা মামার হৃদয়ে পৌছালো না বোধহয়। এক সময় রাগে শৈলী চিন্তা করলো হাটা ধরবে। গরম তো যা লাগার লেগেই গেসে, আর একটু বেশী না হলে লাগলোই।
যেই চিন্তা সেই কাজ, ফুটপাথের উচু পাটাতন থেকে নামলো শৈলী। রাস্তা পার করতে হবে ভেবে কদম ওঠাতেই ওর সামনে এসে দাড়ালো একটি গাড়ি। সাথে সাথে ওঠানো কদম নামিয়ে পিছিয়ে নিল ও। গাড়িটা দেখে অবাক হলো। মাহিরাদের গাড়ি।
শৈলীর কোচকানো ভ্রু জোড়ার সামনেই প্যাসেন্জার সিটের কাঁচটা নিচে নেমে গেল, প্রকট হলো মিহরানের নিরেট, উজ্জ্বল শ্যামল মুখশ্রি। বাম পাশ ফিরে সোজা অবলোকন করলো শৈলীর বিভ্রান্ত মুখাবয়ব। তারপর আবার সামনে তাকিয়ে নিজের কথা ছুড়লো,
– ভেতরে আসুন।
শৈলী এখনো একটা ভ্রমে জড়ানো। মিহরান স্যার… এখানে? মানে…আসলেই?
– কি ব্যাপার? উঠছেন না কেন শৈলী?
শৈলীর এবার ভ্রম ভাঙে পুরোপুরি। হকচকিয়ে উঠে উত্তর দেয়,
– ন..ননা স্যার থ্যাংকইউ। আমি একা চলে যেতে পারবো।
-কিভাবে যাবেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এই ভর দুপুরে রিক্সা পাওয়ার আশা রাখাই বোকামি। চলে আসুন, আমি নামিয়ে দিব।
শৈলী তাও ইতস্তত করলো,
– স্যার আমি কোনো এক ভাবে ম্যানেজ করে চলে যাব। আপনার আমাকে নিয়ে কষ্ট করার দরকার নেই।
এবার ভ্রুজোড়া কুচকানোর পালা মিহরানের। মেয়েটা আজ বেশি কথা বলছে না? এতো না করার কি আছে? যাবে তো দুজন একই জায়গায়। যেটা মাথায় আসলো সেটাই থমথমে মুখে আউড়ালো ও,
– আমাদের দুজনের গন্তব্য একই জায়গায়, তাহলে আলাদা যাওয়ার মানেটা কি? দেখুন রোদের তাপ গাড়িতেও ঢুকছে। আমার গরম লাগছে, তাই ভেতরে আসুন, আমি কাঁচ ওঠাবো।
শক্ত স্বরের কাছে শৈলী শেষমেশ হার মানলো। তাছাড়া স্যার কথাও ঠিক মনে হলো ওর। যাবে তো দুজন একই বাসায়। এতে শৈলীর একটু আরামই হবে বৈকি। আর চিন্তা না করে উঠে পরলো ও গাড়িতে। নিজেই প্রথমে কাঁচ লাগিয়ে তারপর সিট বেল্ট বাধলো।
শৈলীকে ঠিক ঠিক হয়ে বসতে দেখেই মিহরান গাড়ি স্টার্ট দিল। প্রথম কয়েক মিনিট পুরো গাড়ি জুরেই নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো। শৈলীর দৃষ্টি বাম পাশের কাঁচ ভেদ করে উজ্জ্বল আকাশে নিবদ্ধ। নিজের মাঝেই গুটিয়ে ছিল ও যখন পাশ থেকে এক পুরুষালি স্বর ওর কানে বাজলো,
– আপনাকে রিক কবের থেকে ডিস্টার্ব করছে?
একদম সরাসরি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে শৈলী প্রস্তুত ছিল না, তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মিহরানের রুষ্ট, বিরক্ত চেহারার দিকে,
-আপনাকে কি আজ সব প্রশ্নই দুইবার করে করা লাগবে মিস শৈলী?
মিহরানের জোরালো কন্ঠে আবার হকচকায় শৈলী। আবার ঝটপট উত্তর দিতে যায়,
– না, আসলে…স্যার…
-রিক আপনাকে এভাবে উত্যক্ত করছে কবে থেকে?
শৈলী মাথা নিচু করে শুধায়,
– গ..ত বছর থেকে স্যার।
স্টিয়ারিংয়ে নিজের অজান্তেই হাত শক্ত হয়ে আসে মিহরানের।
-আপনি কারও সাহায্য নেন নি?
-বলেছি স্যার, অন্য স্যার, ম্যাডামদের জানিয়েছি। তবে কেউ বিষয়টা নিয়ে খুব…ইম্পরটেন্স দেয় নি।
চোয়াল শক্ত হলেও মিহরান নিজের প্রশ্ন চালিয়ে যায়,
– বাসায় জানিয়েছেন? আপনার বাবা মা জানে এই ঘটনা?
-না স্যার।
-কেন জানাননি? ওনারা জানলে তো ডিন স্যারের ওনারাই সরাসরি কম্প্লেইন দিতে পারতেন।
-আসলে…স্যার, আব্বু আম্মুকে জানাতে চাইনি। অযথা আমাকে নিয়ে টেনশন করবে তারা এবং পরে শরীর অসু…
শৈলী কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ মিহরান এমন জোরে হার্ড ব্রেক কষে যার ফলে দুজনই দ্রুত সামনে ধাক্কা খায়। শৈলী চোখ বড় বড় করে ডান পাশে ফেরে। দেখে মিহরানের রাগান্বিত চোক্ষু যুগল,
– ওয়াট ননসেন্স! আপনি কি বোকা মিস শৈলী? বাবা মা অসুস্থ হবে ভেবে নিজের নিরাপত্তার খেয়াল রাখবেন না? আপনার কিছু হলে তারা কি সুস্থ থাকবেন আপনার মনে হয়?
শৈলী আবার মাথা নোয়ালো। মিহরানের বাক্য বিরোধীতা করার মতন যুক্তি ওর কাছে নেই।
আবার মিনিট খানেকের নিরবতা ছেয়ে গেল দুজনের মাঝে। মিহরান ওর নিম্নাষ্ট চেঁপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। শৈলীর দিকে তাকিয়ে শীতল হয়ে এলো ওর দৃষ্টি। এই মুহূর্তে মেয়েটার প্রতি ভীষণ মায়া হচ্ছে ওর। মাহিরার কাছ থেকে যদিও সব উত্তরই আগে পেয়েছিল ও, তবে সয়ং শৈলীর মুখ থেকে শোনার পর রাগ, ক্ষোভটা যেন তিরতিরিয়ে বাড়ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহরান সামনে তাকিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিল। এবার আর কোথাও থামলো না, সোজা বাসার নিচের গ্যারেজে নিয়ে আসলো গাড়ি।
শৈলী তো প্রথম থেকেই চুপ ছিল, স্যারের প্রশ্নের বাণে যেন আরও স্তব্ধ হয়ে পরেছিল। ভীষণ বিব্রতবোধের লজ্জায় ঘিরে ছিল ও, মনে হচ্ছিলো পালাতে পারলেই ভালো। বাসার নিচে গাড়ি থামতেই তাই ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে নামতে চাইলো ও। তবে পেছন থেকে ডাক শুনে আবার থমকে ঘুরে বসলো,
– মিস শৈলি,
-জ্বী স্যার।
মিহরান শৈলীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে,
– আপনি রিক কে নিয়ে আর কোন চিন্তা করবেন না। আমি বিষয়টা নিজে দেখবো। ও আপনাকে আর জ্বালাবে না।
কর্ণকুহুরে কথা গুলো প্রবেশ করতেই শৈলীর চোখ বড়বড় হয়ে উঠলো। কৃতজ্ঞতায় ধন্যবাদ বলার জন্য উদ্যত হলেও সেটা পারলো না মিহরানের জন্য,
– আর…এখন থেকে ভার্সিটি যাওয়া আসা কোনোভাবেই একা করবেন না। মাহিরা, মেহরাবের সাথে যাবেন। মনে থাকবে?
মাহিরা আবার স্তব্ধ। এই কেমন এক অধিকারবোধ নিয়ে বলা বাক্য শুনে ও নির্বাক বনে গেছে। কি অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ইতিমধ্যে মিহরানের চোখে মুখে আবার ভর করে বিরক্তি,
– আচ্ছা আপনি সবসময়েই এরকম, নাকি আজ কোন স্পেশাল ব্যাপার আছে?
ভ্রু কুচকে উঠে শৈলীর,
– মানে… স্যার?
– আপনাকে প্রতিটা প্রশ্ন দুইবার করে করতে হচ্ছে কেন?
শৈলীর ভ্রু জোড়া শিথিল হয় এবার। আমতা আমতা করে বলে,
– সরি স্যার।
– আপনি কি আমার কথা বুঝেছেন? একা যাতায়ত করবেন না।
– জ্বি স্যার।
-গুড। এবার নামুন, আমি গাড়ি পার্ক করবো।
সাথেসাথেই বলা যায় এক প্রকার হুড়মুড়িয়ে গাড়ি থেকে নামলো শৈলী। ও নেমে দাড়াতেই মিহরান বেইজমেন্টের দিকে ড্রাইভ করে চলে গেল। শৈলী আর দাড়ালো না। মিহরানের সামনে এই মুহূর্তে থাকতে লজ্জা বোধ হচ্ছে। আর তাছাড়া উনি তো ওয়েট করতে বলেননি, তাহলে শৈলী দাড়াবে কেন? এই সাত পাঁচ চিন্তা নিয়েই শৈলী পেছন ফিরে লিফ্ট চাপ দিল। লিফ্ট আসতেই উঠে পরলো।
মিহরান গাড়ি পার্ক করে স্বাভাবিকের থেকে হালকা ধ্রুত হেটে লিফ্টের কাছে এসেছিল। শৈলী ওর জন্য অপেক্ষা করবে এটাই মনে হয়েছিল ওর। কিন্তু আশানুরুপ কারো দেখা না মেলায় একটু কি আহত হয় মিহরান? হয় বোধহয়। নয়তো সেই মুহূর্তেই কপালের রগ কেন ফুলে উঠলো ওর?
………………………….
সারা ঘরময় পায়চারি করছে রিক। বেড সাইড টেবিলের ল্যাম্পের খন্ডিত টুকরো গুলো মাটিতে লুটানো। খাটের ওপরে সজ্জিত কুইল্ট এখন এলোমেলো ভাবে ছড়ানো ফ্লোরে। এসবের মাঝেই চলছে ছেলেটার অদম্য হাটাচলা। ওর মনে হচ্ছে যে কোন সময় মাথার দু একটা রগ ফেটে যেতে পারে। এতো বড় অপমান করা হলো ওকে আজ! তাও আবার করলো কে? একটা দুই পয়সার টিচার? এতো দাপট ঐ শা*লা দেখায় কিভাবে? তাও আবার রাকিব শাহজাহানের সাথে? ও কোথায় হাত দিয়ে ফেলেছে তাই মনে হয় বোঝেনি এখনো। কোনো সমস্যা নেই। বোঝেনি তো কি হয়েছে। তাকে বোঝানোর সময় তো পার হয় নি।
হোচট খেয়েই নিজেকে থামায় রিক। মুখে ছড়িয়ে পরে এক বিচ্ছিড়ি হাসি। মস্তিষ্কের নিউরনে একটা জবরদস্ত প্ল্যান এই মাত্র বাসা গেড়ে বসলো। সেটা বাস্তবায়ন করা না গেলে রিকের শান্তি নেই। ঐ শৈলীকে আর মিহরানকে জীবনের সবচাইতে বড় সবক দিতে তার প্ল্যান পূরণ করা অতিব জরুরী। আর দেরী না করে রিক ছুটলো রুমের বাইরে। উদ্দেশ্যে তার বাবার সাথে দেখা করা।
………………………
সন্ধ্যায় আবার ঝুম বৃষ্টি নামলো। আবহাওয়ার যেন কি হয়েছে। সারাদিন কাঠ ফাটা রোদ আর গরম ছড়িয়ে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে অম্বর বারি ধারা। প্রায় রোজই এক রুটিন। সন্ধ্যা টা হয় মনোরম, আর সকালটা? একদমই রুষ্ঠ।
শৈলী এই সবই ভাবছিল বারান্দায় দাড়িয়ে যখন ওর পাশ দিয়ে উকি দিল গরম এক মগ কফি। মুচকি হেসে কফির মগ ধরা হাতটা অনুসরণ করে নিজের বান্ধবীর দিকে তাকালো ও। মাহিরা হেসে সামনে এগিয়ে এলো। এই কিছুক্ষণ আগেই শৈলী এসেছে মাহিরার কাছে। আজ ভার্সিটিতে দুই বান্ধবীর তেমন আলাপ হওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই এখন আড্ডার আসর জমাতে এলো। তাছাড়া আজকে হয়ে যাওয়া রিকের ঘটনা তো মাহিরাকে বলাই হয় নি।
শৈলীর কাছ থেকে দুপুরের ঘটনা শুনার সময় একেক জায়গায় মাহিরার চেহারা একেক ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিল। কখনো ভয়, তো কখনো চাঞ্চল্য অনুভূতি, আবার শেষের দিকে ঠোট জুড়ে মিটিমিটি হাসি। এতো জগাখিচুড়ি মার্কা এক্সপ্রেশন দেখে শৈলী এক সময় বিরক্ত হয়ে গেল।
– কি রে? তুই এরকম করছিস কেন? এক চেহারায় কয় ধরনের মুখ বানাস?
মাহিরা চওড়া হাসে,
-তো কি করবো? তোর ঘটনাটাই এতো মিশ্র থিম আর ক্যারেক্টার দিয়ে ভর্তি যে এক এক্সপ্রেশনে সব কাভার হয় না।
-তুই এতো সিরিয়াস ইশ্যুতেও ফান করছিস মাহি?
মাহিরা এবার নিজেকে ধাতস্থ করলো,
– আচ্ছা বাবা সরি। শোন, রিকের বিষয়টা কিন্তু আসলেই সিরিয়াস। এই ছেলেটার মাথার তার সবকটাই ছেড়া লাগে আমার কাছে। তার ওপর বাপের পাওয়ার তো আছেই। সব মিলিয়ে তোর জন্য এগুলো একটু রিস্কই বটে। তাই মেঝো ভাইয়া যা বলেছে তাই তোর চুপচাপ মেনে নেওয়া উচিত। আমাদের সাথেই তুই যাবি আর আসবি। ইভেন ক্যাম্পাসেও আমাদের সাথেই থাকবি, বিশেষ করে আমার সাথে। আর ক্লাসে তোর বান্ধবীদের মাঝেই বসবি। তাছাড়া ভাইয়া তো আছেই সেখানে। তোর সমস্যা হবে না।
এক দমে এতোগুলো নির্দেশনা দিয়ে মাহিরা থামতেই শৈলী হেসে ফেললো। মাহিরাও বুঝলো বান্ধবী কেন হাসে, তাই নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিল। কিছুক্ষণ পর অবশ্য মাহিরা ঠোটে মজার হাসির বদলে রহস্যময়ী এক হাসি ধরা পরলো। সেটা দেখে শৈলী চোখ কুচকাতেই মাহিরা স্বর খাদে নিয়ে বললো,
– তবে যাই বল, তোর ভাষ্যমতে মিহরান ভাইয়া আজ যা এন্ট্রি মেরেছেন না, এটা কোনো সিনেমার হিরোর থেকে কম না। নিজের হিরোইনকে বাঁচাতে ভিলেনের সামনে রুখে দাড়ানোর বিষয়টা বেশ জমেছিল তা বোঝাই যায়। ইশ্! আমি যে কেন আজ ওখনে ছিলাম না রে। থাকলে নিশ্চিত ভিডিও করে রাখতাম সবকিছু।
মাহিরার কথাগুলো শৈলীর মাথার একফুট ওপর দিয়ে ভেসে চলে গেল। এতো সিরিয়াস একটা ঘটনা ঘটলো, শৈলীর চিন্তায় মাথার চুল পরে যাওয়ার জোগাড়, আর সেখানে এই মেয়ের এই সব মুভির সিন মনে হচ্ছে? হায় রে মাহিরা! তুই জীবনেও সুধরাবি না।
এরই মাঝে আবার বিদ্যুত চমকে বৃষ্টির বেগ আরও বাড়িয়ে দিল। মাহিরা আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরায় পাশে,
– এই শৈলী চল ছাদে যাই। বৃষ্টি ওখান থেকে দেখতে আরও বেশী মজা।
শৈলী সাথেসাথে মাথা নাড়লো,
– না না, ছাদে যাওয়ার দরকার নেই। এখান থেকেই দেখ্।
মাহিরা যেন অষ্টম আশ্চর্য দেখেছে এমন অবাক মুখ বানিয়ে বান্ধবীকে দেখলো
– এইটা তুই বললি শৈলী? তোর মতন বৃষ্টি প্রেমি খোলা ছাদে না যেয়ে এই গ্রীলের পেছন থেকে বৃষ্টি উপভোগ করতে চাইছে? এও সম্ভব।
শৈলী কোনো উত্তর দেয় না। সত্যিই তো! বৃষ্টি হচ্ছে আর ও এই বন্ধ কারাগারের ভিতর থেকে তা দেখছে, এটা হলো? কিন্তু কি করবে, ছাদের পাশে যেই মানবের বসবাস তার সামনে যাওয়ার ইচ্ছা ও সাহস কোনোটাই এখন নেই ওর। আর সেই বারিস সন্ধ্যায় ওর আর মিহরানের প্রথম দেখা হওয়ার পর তো শৈলী প্রতিজ্ঞাবদ্ধই হয়েছিল সে ছাদে যাবে না আর।
চিন্তায় আচ্ছন্ন শৈলীর হাতে আচমকা টান পরে। পাশ ফিরেই দেখে মাহিরা ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে,
– আরে মাহি, কি করছিস?
-চল্ ছাদে যাব।
-না না এখন ছাদে যাব না রে।
-কেন?
-এমনিই।
-কোন ভ্যালিড রিসন ছাড়া আমি তোর কথা শুনবো না। ছাদে যাবই আমরা।
-কিন্তু তুই একবার….
– মমমহম..একবার দুবার না, কোনোবারই শুনবো না তোর কথা। এখন চল্।
নাছোড়বান্দা মাহিরার কাছে পরাজিত হতেই হলো শৈলীকে। ঝুম বৃষ্টির মাঝে অর্ধছাদ টায় পা রাখলো দুজন। সাথে সাথেই বাতাসের শীতল পরস ছুয়ে যায় তাদের অঙ্গে। মাহিরা খিলখিলিয়ে উঠে।
-ওয়াও! ওয়াট আ ওয়েদার। তাই না রে?
শৈলীর দৃষ্টি তখন তিমিরে ডোবা আসমানে। আবহাওয়ার মায়াচ্ছনে মহোবেষ্টিত হয়ে মাহিরার প্রশ্নে শুধু উপর নিচ মাথা দোলায় ও। মাহিরা আবার টান দেয় বান্ধবীকে, সাথে নিয়ে পুলের পাশে যেয়ে দাড়ায়।
শৈলীর সতর্কতায় হুট করেই কিছুটা বেড়ে যায়। আড়চোখে একবার পুলের পাশের থাই গ্লাসের দিকে তাকায়। বন্ধ দরজার ভেতরে আলো জ্বলতে দেখে কিছুটা চঞ্চল হয় ওর মন। স্যার তাহলে ভেতরে আছেন। এই সময়ে এখানে আসাটা সমিচিন হয়নি।
শৈলী এবার নিজে মাহিরার হাত টানে। মাহিরা তাকাতেই স্বর খাদে নিয়ে এসে শৈলী বলে,
– দোস্ত চল্ নিচে যাই।
মাহিরা রীতিমতো অবাক।
– কি বলিস? মাত্রই তো আসলাম। এখন কেন নিচে যাবো?
– না না। এখানে এখন থাকার দরকার নেই। পরে আসবনে।
– এই শৈলী? তোর কি হয়েছে বলতো? আজ এরকম করছিস কেন?
শৈলী নিজে ফিসফিস করে কথা বললেও সেই তরঙ্গে সুর মেলাচ্ছে না মাহিরা। সে জোরেই কথা বলছে। এতে ব্যতাব্যস্ত হয়ে শৈলী ওর মুখ চেঁপে ধরতে গেল,
– আরে আস্তে কথা বল্ মেরি মা।
তবে মাহিরা আগেই সরে যায়। চোখে বিশ্বয় নিয়ে বলে ওঠে,
– আস্তে কথা বলবো কেন?
-কারণ…
শৈলী এক বাক্য শেষ না করতেই পেছনে আওয়াজ শুনতে পায়। চকিতে ঘুরে তাকায় দুজন। থাই গ্লাস ভেদ করে দাড়ানো মিহিরানের নিরেট সুঠাম অবয়ব স্পষ্ট হয় ওদের সামনে।
এই মুহূর্ত, ঠিক এই মুহূর্তেরই ভয়ে ছিল শৈলী। তাই হলো এখন। আমতা আমতা করে নিজের মাথা নোয়ালো ও। মিহরানের চেহারার দিকে অব্দি তাকালো না।
মাহিরা নিজের ভাইকে দেখে ঝকঝকে এক হাসি উপহার দিল,
– কি সুন্দর ওয়েদার তাই না ভাইয়া। বারান্দা থেকে দেখতে একদম ভালো লাগছিলা না, তাই শৈলীকে নিয়ে ওপরে চলে আসলাম।
মিহরান মাহিরার কথার কোনো জবাব দিল না। হেটে ওদের সামনে এসে দাড়ায়। ওর দৃষ্টি আটকে আছে বোনের পেছনে শির নোয়ানো রমনীর পানে। কৌতুহল জাগছে মনে, মেয়েটা ওকে দেখলেই মাথা নুইয়ে ফেলে কেন? আজব তো!
হঠাৎ বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজকে ছেদ করে চিৎকার দিয়ে ওঠে মাহিরার মোবাইল। ভার্সিটির এক বান্ধবীর ফোন দেখে ও ধরতে যায়, তবে হ্যালো বলতে না বলতেই মোবাইল অফ হয়ে যায় ওর। নিজের ওপর ঘোর বিরক্তি প্রকাশ করে মাহিরা,
– আমি যে কি এক নমুনা। উফ! ভার্সিটিতেই মোবাইলে লো ব্যাটারি দেখাচ্ছিলো, কিন্তু বাসায় এসে একদম ভুলে গিয়েছি। ভাইয়া তোমার রুমে একটু মোবাইলটা চার্য দেই? জরুরি কল ছিল।
– দে।
– থ্যাংক্স।
বলতে বলতেই মাহিরা মিহরানের ফ্ল্যাটে ঢুকে যায়। রেখে যায় মিহরান আর শৈলীকে একে অপরের সামনে। শৈলী এবার মাথা উঠায়, কারণ নোয়ানো মাথা দৃষ্টিকটু দেখায় এখন। চঞ্চল মনিযুগল এদিকে ওদিক দেখে মিহরানের দিকে একবার চেয়েই সরে আসতে চায়। তবে বিধিভাম, সেই অবকাশ তাদের দেয় না মস্তিষ্ক। আটকে যায় শৈলীর দৃষ্টি রিমলেস চশমা পরিহিত সুদর্শন এক মুখশ্রির পানে। ধপাধপ কয়েকটা হার্টবিট মিস হয় ওর। ইয়া মাবুদ! চশমায় মানুষকে এতোটাও সুন্দর লাগতে পারে নাকি? ওতো জানতো চশমা চোখের সৌন্দর্য ঢেকে দেয়, কিন্তু এখানে তো ঘটনা পুরাই উল্টো। সামনে দাড়ানো এমনিতেই সুদর্শন গড়নের মানবের রুপ চশমাটা যেন আরও অনেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। আরও পুরুষালি এক ব্যক্তিত্যের পরিচয় দিচ্ছে।
-মিস শৈলী?
হকচকিয়ে ওঠে শৈলী। এক মুহূর্ত ভ্রু কুচকে নিজের স্থান বোঝার চেষ্টা করে। যখন মাথায় ধাক্কা দেয় মিহরানকে নিয়ে ওর করা এতো সব বেশামাল চিন্তাগুলো, রীতিমতো ভড়কে যায় ও।
তখনি ঠিক একসাথে দুটি ঘটনা ঘটে যায়। শৈলী ভড়কে যেয়ে নিজের ব্যালেন্স হারাতে যায়, আর একই সাথে পুরো পরিবেশকে তিমিরে ডুবিয়ে দিয়ে চলে যায় কারেন্ট। এতে শৈলীর ভয় বেড়ে হয় দ্বিগুন, ভেজা মেঝেতে পরলে কত ব্যাথা পাবে চিন্তা করে চোখ খিচে আসে, তবে তখনি নিজের কোমরে কারও বলিষ্ট হাতের ছোয়া পেয়ে অক্ষিপলক বড় করে ফাক হয় ওর। কেউ টেনে তোলে ওকে পরা থেকে, কারও শক্ত বুকে আছড়ে পরে শৈলী।
চলবে।