#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১২
শৈলীর মস্তিষ্ক কাজ করছে না। নিজেকে এক ঘোরের মাঝে মনে হচ্ছে ওর। কোথা থেকে যেন একটা ঘ্রান আসছে…সুঘ্রান। খুব কাছ থেকে আসছে মনে হচ্ছে। আশপাশে তিমিরে ডোবা পরিবেশে এমন সুঘ্রাণ ওকে সেই ঘোরে ফেলে দিচ্ছে। শৈলী সরতে চাচ্ছে না, উঠতে চাচ্ছে না। চোখ মুদে পরে থাকতে ইচ্ছে করছে ঠিক এভাবে….
ঠান্ডা বাতাসে চারিপাশ নিস্তব্ধ। এতোটা চুপচাপ কেন সব? তবে এই নীরবতা মন ছুয়ে দিচ্ছে শৈলীর। আচ্ছা ও কি করছে? কোথায় আছে?
আচমকা পরিবেশটা আলোকিত হয়ে উঠে। চকিতে চোখ খোলে শৈলী। নিজের কপোলে কোনো শক্ত কিছুর স্পর্শ পেয়ে চমকায়। আস্তে করে মাথা সরিয়ে বোঝ নেয় নিজের আশপাশের। ছাদে ও, নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যাচ্ছিলো কিছুক্ষণ আগে, তারপর…
ধ্বক করে ওঠে শৈলীর বুক। আসলেই কি তাই ঘটেছে যা ও মনে করছে। নিজের সন্দেহ প্রমাণিত করতে অতি ধীর গতীতে মাথা ওপরে ওঠায়। প্রথমে মিহরানের শক্ত চোয়াল ও তারপরে সেই সুদর্শন কিন্তু গম্ভীর মুখশ্রী চোখের সীমানায় ধরা পরতেই শৈলী দ্রুত বেগে ছিটকে দূরে সরে যায়। মিহরানের বাহুবন্ধনে আগেই ঢিল ছিল, তাই সরে যেতে কোনো বাধা আসেনি।
শৈলী পুরোই দিশেহারা। কি করবে কি বলবে, কিছুই মাথায় ঠাওর করতে পারছে না। মিহরানের স্যারের বুকে ও? সর্বনাশ!
সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকা শৈলীর দিকে মিহরান উদ্বিগ্নতা নিয়ে আগায়। মেয়েটা নিশ্চিত লজ্জা পেয়েছে ভীষণ। পাওয়ারই কথা, মিহরান নিজেই হতভম্ব হয়ে বসে আছে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে। আসলে শৈলী পরে গেলে ভীষণ ব্যাথা পেত ভেবেই ও হাত বাড়িয়েছিল, কিন্তু ঘটনা যে এরকম অপ্রস্তুত এক মোড়ে পৌছে যাবে তা ও বুঝতে পারে নি। মেয়েটাকে হয়তো বেশী জোরে টেনে ফেলেছিল। তাইতো ওর বুকে আছড়ে পরলো। সব দোষই ওর।
এটা বোঝাতেই মিহরান যখন আরেকটু আগায়, শৈলী হুট করে ঘাবড়ে দুপা পেছনে যায়। এতে ও ছাদের ছাউনির বাইরে চলে যেতে নেয়। বৃষ্টির ফোটা ওর মাথায় পরবে ভেবে ওকে আবার টানতে মিহরান হাত বাড়ায়, ওমনি এক আজব কথা বলে বসে শৈলী,
– প্লিস আমাকে ছুবেন না।
ঝটকা দিয়ে থমকে যায় মিহরান। কারেন্টের শক্ খেল মনে হয় ওর পুরো দেহ। মেয়েটা কি বললো? ও ছুয়ে দিচ্ছে? মানে কি?
মিহরানের যদি মনে হয় ওর দেহ কারেন্ট শক্ খেয়েছে, সেখানে শৈলীর তো মনে হচ্ছিল রীতিমতো আকাশ থেকে বিদ্যুতের বাজ পরলো ওর শরীরে। এটা কি বলে ফেললো ও? মুখ ফষ্কে এ কি উদ্ভট কথা বের হলো ওর?
মিহরান সোজা হয়ে দাড়ায়। অপমানে আর রাগে কপালের শিরা দপ দপ করছে ওর। শৈলীকে আচ্ছা মতন একটা কথা শোনাতে যায় কিন্তু তার আগেই পেছনে ওর রুম থেকে ভেসে এলো মাহিরার চিৎকার,
-উফ! হতচ্ছাড়া কারেন্টের এখনি যাওয়ার ছিল? জেনারেটরের লাইনে মোবাইল চার্জ দিব কিভাবে?
মাহিরার চিৎকারে শৈলী কেঁপে উঠে। যেন ঘোর কেটে বাস্তবে বের হয়। ওমনি বুঝতে পারে ও দৌড়ে ছাদ থেকে বের হয়ে এসেছে।
শৈলীর এহেন কান্ডে মিহরানও অপ্রস্তুত হয়ে যায়। শৈলীর দৌড়ে যাওয়া দেখেই ও পেছন থেকে উদ্যত হয় ডাকার জন্য। ঠিক তখনই মাহিরা এসে দাড়ায় ভাইয়ের পাশে,
– উফফ্! পারলাম না চার্য দিতে ভাইয়া। আরে? শৈলী কই? চলে গেছে নাকি?
মিহরানের চাহনি এখনো দরজার পানে,
-হু।
-হঠাৎ চলে গেল যে? কেন?
– আমি কি জানি কেন চলে গেল? আমি তোর বান্ধবীর সব খবর রাখি নাকি?
ভাইয়ের ঝাঝালো উত্তরে মাহিরা চুপ বনে যায়। সাথে কিঞ্চিৎ অবাকও হয়। ভাইয়া হঠাৎ এভাবে রেগে গেলেন কেন? শৈলী আবার উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে নাকি?
পরোক্ষণেই আবার চিন্তাটা বাতিল করলো মন থেকে। শৈলী আর কি উল্টাপাল্টা বলবে? ও কি অবুঝ বাচ্চা নাকি? আর মেজো ভাইয়া তো এমনিতেই বদরাগি। এরকম কথা ওনার মুখ থেকে আসাটা স্বাভাবিক।
মাহিরা নিজের ভাবনাতে তুষ্ট হয়ে হেসে দিল। এসেছিল বান্ধবীর সাথে বৃষ্টি উপভোগ করতে, সেই বান্ধবী আর বৃষ্টি দুটোই গায়েব। তো ওর আর এখানে থেকে কি লাভ? ভাই কে বিদায় জানিয়ে ততক্ষনাৎ ই বের হয়ে আসলো ও। তবে ভাই যে ওর বিদায়ের উত্তরটাও দিল না এটাতে আবার অবাক হওয়ায় আক্রান্ত হয় মাহিরা।
মিহরান বোনের বিদায়ের কিভাবে উত্তর দিবে? ওর মন ও মনোযোগ বোনের পাশে থাকলে সে না! ও তো চরম বিরক্তিতে ডুবে আছে, শৈলীর কাজে। কিভাবে মেয়েটাকে ও একথা বললো? আর এভাবে কেউ দৌড় দেয়? বাচ্চা নাকি?
সাথেসাথেই অভিমান ও ক্ষোভ মিহরানের মস্তিষ্কে জেঁকে বসলো। কেন, কোন অধিকারে এই অভিমান হানা দিল ও জানে না, তবে অভিমান হয়েছে শৈলীর ওপর। গভীর অভিমান।
…………………
এদিকে শৈলী যে এক দৌড়ে নিচে নামলো, সেই দৌড় থামলো ওর রুমে এসে। প্রবল হাপানি নিয়ে খাটে বসলো ও। বিব্রতোকর লজ্জায় মাথা আর উঠছে না।
এই মুহূর্তে শৈলী কে দেখলে, আর ওপরের ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনলে সবাই মনে করবে শৈলী মিহরানের বুকে আছড়ে পরা নিয়ে লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছে। টিভি সিরিয়ালের নায়িকাদের মতন ন্যাকামো করছে। কিন্তু আসল কথা হলো, বুকে পরে যাওয়া নিয়ে শৈলী লজ্জিত না। তাল সামলাতে গিয়ে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই না। বডি রিফ্লেক্স মাত্র। শৈলী তো লজ্জিত এই কান্ডের আগের ও পরের ঘটনা নিয়ে।
মিহরানের ওপর যে আজ একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে শৈলী রীতিমতো ক্রাশ খেয়েছে তা ওর বুঝতে বাকি নেই। একদম নির্লজ্জের মতন হা করে তাকিয়ে মিহরানের চশমা পরিহিত সুদর্শন চেহারাটাকে শুধু গিলে খেয়েছে ও। এরকম একটা অস্বস্তিকর কাজ কেমনে হলো শৈলীর দ্বারা এটাতেই ও ভীষণ ভীষণ লজ্জিত। এইসব বেসামাল ভাবনা গুলোর জন্যই তো পরতে গেল ও।
আর বিষয়টা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলেও তো মানা যেত। মিহরানের বুকে পরে যাওয়ার পর কি করলো শৈলী? একবারেই দিক বিদিক ভুলে গেল? মিহরানের দেহের ঘ্রানে এমনই এক ঘোরে জড়ালো যে আশপাশ সব মস্তিষ্ক থেকে বিদায় নিল? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কি একটা অবস্থা। ছিঃ।
আর তারপর? মিহরান হয়তো ওকে কিছু বলতেই আসছিল, কিন্তু শৈলী কি করলো? পুরো ঘটনার দোষ এক প্রকার ওনার ওপরেই চাপালো? শৈলী এতোদিনে বুঝে গেছে এই মানুষটা কতোটা আত্মসন্মানী একজন ব্যক্তি। তাকে এভাবে বলাতে, তা শুধু একটা ছোট লাইনই হোক না কেন, তাকে এভাবে বলাতে উনার ভীষণ মাইন্ড করার কথা।
হঠাৎ শৈলীর মনে হলো ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বেডসাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাস উঠিয়ে সরাসরি পানি গলায় চালান করলো। যখনই একটু দম নিতে পারলো তখনই খাটে রাখা ফোনটার কাঁপুনিতে ফিরে তাকাতে হলো ওকে। মাহিরার কল দেখে চমকে গেল,
“হায় হায়! এই সবের মাঝে আমি মাহিরাকে ভুলেই গিয়েছি। ওকে ছাড়াই তো চলে আসলাম। ধুর! সব দিকেই ভুল হচ্ছে আজ।”
দ্রুত হাতে বান্ধবীর কলটা রিসিভ করলো শৈলী। ওমনি কান ফাটানো চিৎকারে আক্রমণিত হলো। ফোনটা একটু কান থেকে সরিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করলো একপলক। তারপর আবার কানে নিল,
– দোস্ত, দোস্ত…সরি রে..
-কিসের সরি? আমাকে এভাবে রেখে দৌড় মারলি কেন? এরকম মির জাফর গিরির কি মানে হয়?
– আসলে…
-আসলে কি?
-আসলে… আম্মু ডেকেছিল দরকারে। তাই আরকি…
ওপাশ থেকে এবার কন্ঠ নরম হলো,
– ও আচ্ছা…. আচ্ছা বাদ দে। শোন কালকে রেডি থাকিস কিন্তু, নয়টায় বের হবো।
শৈলী ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। কালকে মিহরানের সাথে এক গাড়িতে ওঠা অসম্ভব,
– দোস্ত তোরা চলে যাইস। আমি একটু পরে আসবো কালকে, আমার জন্য ওয়ে…
– একদম না শৈলী। ভাইয়ার কড়া নির্দেশ তোকে একা না ছাড়তে। আর তার ওপর আজ রিক যা করলো, এরপর তো আমি নিজেই তোকে একা ছাড়ার সাহস পাব না।
-কিন্তু মাহি, আমার একটা কাজ আছে…
– কি কাজ?
– হম? কি কাজ? ঐ আ..আম্মু দিয়েছেন একটু..
-কোন সমস্যা নেই, আন্টির এই ‘একটু’ কাজ টা আমরা দুজন মিলে করে ফেলবো। এখন হলো তো? নাকি আরও কোনো সমস্যা?
বরাবরের মতনই শান্ত শৈলী, চঞ্চল মাহিরা কাছে হার মানলো। ওদের সাথে যাবে জানিয়ে ফোনটা রেখে দিল।
………………………
মালিহা নিজের ঘর থেকেই বৃষ্টি বিলাশে মগ্ন যখন আফিয়া বেগম দরজায় নক্ করলেন,
– মালিহা?
-আম্মু আসো?
আফিয়া বেগম রুমে ঢুকতেই মায়ের কাছে এসে পৌছায় মালিহা। আফিয়া মুচকি হাসেন। থিসিসের চক্করে মেয়েটা বেশ ব্যস্ত থাকে ইদানিং। ঘরেই দেখা যায় না ওকে। তার ওপর ভার্সিটি টা দূরে হওয়ায় আরো কষ্ট বেড়েছে। মিহরান, মেহরাব আর মাহিরা যেরকম এক ভার্সিটি থেকেই পাশ করা। কিন্তু মালিহা সেটায় ভর্তি হয়নি। ওর পছন্দের ভার্সিটি চুজ করেছে।
আফিয়া মেয়েকে নিয়ে খাটে বসেন। চুলে হাত দিয়ে কপট রাগ প্রকাশ করেন,
-চুলের কি হালোত হয়েছে তোর? জট্ বেধে গেছে কেমন দেখ। একটুও তেল দিসনা।
মায়ের রাগের পেছনের যত্নটাকে উপলব্দি করতে পেরে এক প্রকার গলে পরলো মালিহা। গদগদ সুরে বললো,
-সময় পাই না তো আম্মু।
আফিয়ার ভীষণ মায়া হয়,
-তেল নিয়ে আয়, আমি দিয়ে দিচ্ছি।
আফিয়ার বলতে দেরী, মালিহার তেল নিয়ে মাটিতে বসতে সময় লাগলো না। এত্তো বড় মেয়ের এরকম বাচ্চামো দেখে আফিয়া জোরেই হেসে ফেললেন। সেই হাসি সংক্রমিত হলো মালিহার মাঝেও। দুই মা মেয়ে কিছুক্ষণ এভাবেই এদিক ওদিকের গল্পে মশগুল রইলেন।
একপর্যায়ে আফিয়া বেগন সেই প্রসঙ্গে কথা তুললেন যেটার কারণে আজ বিশেষ ভাবে তার বড় মেয়ের রুমে আসা। একটু সময় নিয়ে নিজের ভেতর কথা গোছান তিনি। তারপর মুখ খোলেন।
– হ্যা রে মা। তোকে একটা প্রশ্ন করি?
মালিহার তখন চোখ জোড়া বন্ধ, চুলে মায়ের হাতের ম্যাসাজের মজা নিচ্ছে,
– আমাকে প্রশ্ন করতে তোমার পারমিশন নিতে হবে কেন আম্মু? বলে ফেল।
-না..মানে। আচ্ছা শোন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু বলবো না। সোজা জিজ্ঞেস করছি, তোর জীবনে কি কেউ আছে?
ধপ্ করে মালিহার চোখ খুলে যায়। শক্ত হয়ে আসে ওর পুরো শরীর। মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে আফিয়া বেগম আবার নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
– কি রে মালিহা? উত্তর দিচ্ছিস না যে? আছে নাকি কেউ?
এবার মালিহা ধরফরিয়ে ওঠে,
– ককই? নননা আম্মু। কে থাকবে? কেউ নেই।
আফিয়া বেগম প্রশণ্ণ হলেন। মনে মনে হাফ ছাড়লেন। আসলে মেয়ের জন্য একটা ভালো প্রস্তাব এসেছে। ছেলে ডাক্তার, ওদেরই এলাকার। আফিয়ার ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে। তবে তিনি এই বিষয়ে এখনো কারও সাথে আলাপ করেননি। কারণ আগে তিনি মালিহার মনের খবর জানতে চান। ওর পছন্দের কেউ থাকলে তো আবার সেটাকেই আগে প্রাধান্য দিতে হবে।
আফিয়া আবার মেয়ের দিকে মনোযোগ দিলেন,
– আচ্ছা। ভালো কথা এটা। তাহলে আমার জন্য বিষয়টা সহজ হয়ে গেল।
মালিহার শরীরে তখনো ঢিল পরেনি,
– আম্মু, তুমি হঠাৎ এসব কি নিয়ে কথা শুরু করলা?
– আরে? কি নিয়ে কথা শুরু করলাম মানে? মেয়ে আমার বড় হয়েছে,বিয়ের উপযোগী হয়েছে, এখন এসব নিয়ে কথা বলবো না তো কখন বলবো?
-আম্মু আমি এখন বিয়ে করবো না। আমাকে কি তোমাদের কাছে বোঝা লাগে যে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাচ্ছো?
আফিয়া হাসেন। মনে পরে আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগের কথা যখন তিনিও তার বাবা মায়ের কাছে এরকমই কিছু বলেছিলেন। তাই আজ নিজে সেই মোড়ে এসে পরম মমতায় মেয়ের কাধ জড়ালেন।
এইসব কথা বলে কেউ আজ পর্যন্ত পার পায় নি মা। আমিও বলেছিলাম। আমার মা কে ধরে কেঁদেছিলামও। কোন কাজ হলো? সেই তো তোদের আব্বুর সংসারে এলাম। এক দুইটা না, পাঁচ পাঁচটা দুষ্টু বাচ্চার মা হলাম তাই না?
শেষের কথায় মা মেয়ে দুইজনই হেসে দেয়। তবে পরক্ষণেই আবার মালিহা গম্ভীর রুপে ফেরে,
– আম্মু, সত্যি বলছি এখনই এই বিয়ে শাদি নিয়ে আমি চিন্তা করতে চাই না। আমার কতো স্বপ্ন আছে। এখনো থিসিস শেষ করতে সময় লাগবে, গ্র্যাজুয়েট করবো, তারপর পোসগ্র্যাজুয়েট করবো, চাকরিতে ঢুকবো, নিজের পায়ে দাড়াবো, আরও কতো কি…
আফিয়া মেয়েকে মাঝ পথে থামান,
-এগুলো একটাও করতে কি তোকে নিষেধ করা হচ্ছে নাকি? আর এখনকার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও মডার্ন চিন্তাভাবনা করেন। বউকে বাসায় বন্দি রাখার মনো অনেক জায়গা থেকেই উঠে গেছে এখন। আর তোর বিয়ের কথা বললেই কি হয়ে গেল নাকি। তোর কোনো পছন্দ যেহেতু নেই, তাই আমাদের তো খুজতে হবে, সেটাতে সময় লাগবে না? আমরা যেচে বুঝে সব গুছিয়ে আনতে আনতে তোর থিসিসের কাজ শেষ হয়ে যাবে। সো এটা নিয়ে এখুনি এতো প্রেশার নিস না। আমি তো শুধু তোর মতামত জানতে আসলাম।
ততক্ষণে মালিহার চুলে সুন্দর একটা বেণী গেথে দিয়েছেন আফিয়া। এবার মেয়ের মলিন মুখখানা সামনে টানলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
– টেনশন করিস না এটা নিয়ে। যা হবে, যখন হবে ভালোর জন্য হবে। এখন এসব চিন্তা বাদ দে। তাড়াতাড়ি নিচে আয়। মিহরান এখনই চলে আসবে ডিনার করতে।
মালিহা মায়ের দিকে মায়া নিয়ে তাকায়,
– তুমি যাও মা। আমি আসছি।
– তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু। আবার ডাকতে না লাগে।
– না না, তুমি যাও। আসছি আমি।
…………………………
আফিয়া রুম থেকে বের হতেই মালিহা আস্তে করে দরজা আটকে দেয়। ভেতর থেকে লক করে দৌড়ে যায় নিজের ফোনের কাছে। কল করে এক নির্দিষ্ট নাম্বারে। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে শোনা যায় সেই কাঙ্ক্ষিত সুর।
-হ্যালো জান।
মালিহা থমকায়। এই নামে ওকে এই ব্যক্তিটা ডাকলেই ও বারংবার থমকায়। এতো সুরেলা লাগে বুঝি এই শব্দ?
-রায়হান তুমি কোথায় আছো? ব্যস্ত?
– একটু বাইরে জান। তবে ব্যস্ত না। তোমার জন্য আমি সবসময় ফ্রি।
মালিহার ঠোটে তুষ্টির হাসি ফোটে,
– তোমার সাথে জরুরী কিছু কথা ছিল আমার।
– বলো না। শুনছি তো।
মালিহা এক পলক থামে, নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়,
– রায়হান, আমার আম্মু আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা উঠিয়েছেন আজকে।
-কি বলো? তাই নাকি?
– হ্যা।… আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন… কাউকে পছন্দ করি কি না।
-তো তুমি কি বললা?
মালিহা এবার একটু চুপ হয়। সময় নিয়ে উত্তর দেয়,
-আমি…মানা করে দিয়েছি। বলেছি কোনো পছন্দ নেই। তুমিই তো এটা আমাকে বলতে বলেছিলে।
ওপাশ থেকে মালিহা সুরেলা হাসি শুনতে পায়,
-হ্যা জান। তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ। আসলে আব্বু দেশে নেই তো এখন তাই আমাদের কথা বাসায় জানাতে পারছি না। আমি জানানোর পর তুমি জানিও কেমন?
– আঙ্কেল কবে ফিরবেন রায়হান?
– এইতো আর কিছুদিনের মাঝেই ফিরে আসবে।
– আচ্ছা। আঙ্কেল আসলেই প্লিস আমাদের কথাটা বইলো। কারণ আম্মু একবার যেহেতু এই নিয়ে কথা তুলেছেন তার মানে বাসায় এটার আলোচনা এখন চলতেই থাকবে। তারওপর মেজো ভাইয়াও দেশে…
– মালিহা জান আমার.. তুমি হাইপার হয়ে যাচ্ছো কেন? সব হবে, সব হবে, তুমি এতো টেনশন করো না ঠিক আছে? এখন শোন আমি একটু বাইরে আছি তো। বাসায় যেয়ে তোমার সাথে রাতে গল্প করবো। এখন রাখি?
মালিহা আসলেই বেশ উত্তেজিত হয়ে পরেছিল তাই এখন শান্ত হয়ে হাসলো,
– আচ্ছা রাখো। বাই।
– বাই জান।
…………………….
বি:দ্র:
১/ আজকের পর্বে আমি মালিহার ব্যক্তিগত জীবনের ওপর একটু হাইলাইট করতে চেষ্টা করেছি। আমার পুরো গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক হলেও মালিহার ঘটনাটা পুরোপুরি সত্য। আগেই জানিয়ে রাখি এই ঘটনাটা পরলে আপনাদের অনেকের কাছে ব্যাপারটা ভীষণ আজগবি লাগতে পারে, তবে বিশ্বাস করুন আমি নিজ সত্বায় এই কাহিনীর প্রতোক্ষদর্শী।
2/ নিজের একমাত্র দেবরের বিয়ের জন্য এখন আমি শ্বশুরবাড়ির আঙ্গিনায়। তাই বুঝতেই পারছেন কাজের জোর কেমন। তাই এই কদিন গল্প একদিন পর পর আসবে। আশা করবো আমার সমস্যা আপনারা বুঝবেন। সবাইকে অনেক ভালোবাসা।