#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১৪
শৈলীকে নিজের কেবিনের দরজায় কখনোই আশা করেনি মিহরান। তাই তো অবাক নয়নে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো ও।
শৈলী একবার মিহরানকে কে দেখে নিল। তারপর নিজের মাথা নুইয়ে রুমে ঢুকলো। দরজাটা পুরো বন্ধ করলো না।
মিহরান এতোক্ষণে নিজেকে সংযত করতে পেরেছে। এবং সাথে সাথেই আবার আগের অভিমান জেঁকে বসেছে ঘাড়ে। চোখে সেই ক্ষোভ নিয়েই দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ও,
– আপনি?
শৈলী ঘাড় তোলে। অপরাধীর ন্যয় মিহরানের দিকে চায়, নজরে তার অনেক কথা, কিন্তু সেগুলো প্রকাশ করার মতন ভাষা সে কোনোভাবেই খুজে পাচ্ছে না। শব্দের সাগরে ডুবে ডুবে খুজছে শৈলী, কিন্তু মানানসই বর্ণমালা হাতে ধরা দিচ্ছে না।
– আপনি কি কিছু বলবেন?
শান্ত অথচ হীম শীতল স্বরে শৈলী বাস্তবে ফেরে।
-জ্বি স্যার।
– বলুন।
– স্যার…
মিহরান ততক্ষণে নিজের ডেস্কের কাজ সারতে ব্যস্ত। ভাব এমন দেখাচ্ছে যেন শৈলীর কথা শোনার মতন সময় ও ইচ্ছা দুটোই ওর নেই। তবে মন যে কথপোকথন জমানোর জন্য প্রবল দোলা দিচ্ছে সেটা তো ডেস্কের অপর পাশে দাড়ানো রমণী বুঝতে পারছে না।
শৈলী এক পা এগোলো। বুক ভরা সাহস জুগিয়ে বললো,
– আই এ্যাম সরি স্যার।
মিহরান ড্রয়ারে হাত দিতে যাচ্ছিলো, তখনি সে থমকে গেল। ফিরে তাকালো সামনে। শৈলী ওর মনোযোগ পেয়ে আরেকটু সাহস যোগালো।
– স্যার, গতকালের ব্যবহারের জন্য আমি আসলেই দুঃখিত।
মিহরান সোজা হয়ে দাড়ায়। ডেস্কের ওপাশ থেকে সামনে আসে। শৈলীর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখেই দু হাত পকেটে ঢুকিয়ে সটান হয়ে দাড়ায়। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন ছোড়ে,
– কোন ব্যবহারের জন্য?
শৈলী হকচকায়। গতকালের কথায় এমনেই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এখন আবার ওনার সামনে রিপিট করবে নাকি? মাথা খারাপ? জীবনেও না।
– আপনি সরি কোন ব্যবহারের জন্য, বললেন না তো।
হাত কোচলে মিহরানকে এক পলক দেখে আবার শৈলী মাথা নোয়ায়,
– স্যার…ওইযে…কালকে আআমি আআআপনাকে…
-আপনি আমাকে কি?
– আআমি..আআআপনাকে…
কম্পিত কন্ঠে যখন শৈলীর শীর ওপরে উঠলো, আঁৎকে উঠলো ও। মিহরানকে নিজের বেশ কাছে দেখে আপন হতেই পিছিয়ে গেল । মিহরান দেখলো সব, কিন্তু তার হাবভাবে একটুও হেলদোল হলো না। সে এগিয়ে আসতে থাকলো।
শৈলীর অবাক হওয়াও মনে হয় ফুরিয়ে গিয়েছে। চোখ ফেটে পড়ার যোগাড় ওর। ততক্ষণে মিহরান একদম কাছে এসে দাড়ালো। দুজনের মাঝে এক হাত দূরত্বও হয় কি না সন্দেহ। ওদের অবস্থান ঠিক রুমের মাঝখানে। মিহরান সরাসরি শৈলীর দিকে চাইলো। খাদে নামানো স্বরে আবার প্রশ্ন ছুড়লো,
– আপনি আমাকে কি? বলুন?
লজ্জায় শৈলীর জ্ঞান হারানোর মতন অবস্থা। দুর্বল হৃদয়ের কেউ থাকলে আসলেই জ্ঞান হারাতো। কিন্তু এটাতো শৈলী, ও নিজেকে সামলাতে জানে।
-স্যার..আসলে..আমার আপনাকে এভাবে মন্তব্য করা ঠিক হয় নি। আআপনি…আমাকে বাঁচাতেই ধরেছিলেন। সেখানে আমি…। সরি স্যার।
শেষের কথাটা শৈলী মাথা আবার নামিয়ে, কন্ঠে নিরুপায় ভাব নিয়ে বলে। এদিকে ওর এরকম মায়া কন্ঠে মাফ চাওয়াটা হঠাৎ করেই মিহরানের কাছে বেশ আদুরে শোনায়। মেয়েটা যখন প্রথমবার সরি চেয়েছে, তখনই তো মিহরানের সব রাগ, ক্ষোভ জলে ভেসে নিরুদ্দেশ হয়েছে। এতোক্ষণ তো এই রুমে শুধুমাত্র আরও কিছুক্ষণ রাখার উদ্দেশ্যে ও শৈলীকে ঘোরাচ্ছিলো। এখন মিহরান ঠোটে পাতলা হাসি ফোটায় যেটা নিঃশব্দ। মন ভরে এক পলক মেয়েটাকে দৃষ্টিতে আটকায়। তারপর কি মনে হতেই আবার কন্ঠে গাম্ভীর্য টেনে বলে,
– আপনার শুধু সরি বলা দিয়ে তো ব্যাপারটা মিট মাট করতে পারছি না আমি শৈলী।
শৈলী চমকে তাকায় আবার। বুক দুরুদুরু করা শুরু করেছে প্রবল ভাবে। তবে ভয়কে কিছুটা দমিয়ে সাহস নিয়ে বলে,
-আপনার ক্ষমা পেতে কি করতে হবে স্যার?
মিহরান সরাসরি ওর দিকে তাকায়। তারপর হুট করেই ঘুরে দাড়ায়,
– আমি যা বলবো তা করতে পারবেন?
– যদি আমার সাধ্যের মাঝে থাকে…তাহলে পারবো।
মিহরান এক কাধ পাশ ফিরে চায়,
– আর সাধ্যের মাঝে থাকলেও ইচ্ছা যদি না হয় করতে?
শৈলী মাথা একটু এক পাশে উঁচু করে মিহরানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে,
– স্যার, আপনার সাথে আমি অন্যায় করেছি। তাই সাধ্যে থাকলে ইচ্ছা নিয়ে চিন্তা করবো না। ভেবে নেব এটাই আমার প্রায়শ্চিত্ত।
মিহরান দু ঠোঁট জোড়া দিয়ে প্রায় বের হয়ে আসা দুষ্টু হাসিটাকে থামানোর চেষ্টা চালায়। ও বোঝে মেয়েটা বুদ্ধিমান হলেও, বেশ সরল মনের। ভীষণ মায়া হয় ওর। তখনই ফিরে আসে ওর সামনে,
– আপনি ভেবে বলছেন তো শৈলী?
সামনে থেকে সরাসরি উত্তর আসে,
-জ্বী স্যার।
– ওকে দেন। আপনার সরি আমি এক শর্তে এক্সেপ্ট করবো, যদি আজ সন্ধ্যায় আপনি আপনার গিটার বাজিয়ে আমাকে একটা গান শোনান।
শৈলী আজ ঝটকা খেতে খেতে অক্কা পাওয়ার জোগাড় হবে এতে ও নিশ্চিত। নয়তো মিহরান স্যারের মতন গম্ভীর, নিরস, রাগি ব্যক্তির মুখ থেকে এমন রসে ভরা শর্ত মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি! একেবারেই অসম্ভব।
শৈলীর দৃষ্টি মিহরানের সারা চেহারা জুড়ে খোজ শুরু করলো। সত্যতার খোজ। কারণ শৈলীর এখনো বিশ্বাস, মিহরান ওকে এমন কিছু বলেইনি। ও ভুল শুনেছে। তাও নিজেকে একটু যাচাই করে নেওয়া আরকি।
হঠাৎ তুড়ির আওয়াজে চোখ নড়ে ওঠে শৈলীর। মিহরানের নজরের হাসি এবার আর ওকে এড়িয়ে যেতে পারে না।
– কি হলো শৈলী? শর্ত শুনেই পিছিয়ে গেলেন নাকি? আগেই বলেছিলাম, আমার শর্ত আপনি মানতে পারবেন না।
কন্ঠে কৌতুক ও তাচ্ছিল্যতার আঁচ পেল শৈলী। ওমনি অবাক হওয়া টওয়া সব ভুলে যেয়ে রাগের পারা বেড়ে গেল তিরতির করে।
-কেন মানতে পারবো না স্যার? আমিও আগেই বলেছি সাধ্যের মাঝে থাকলে অবশ্যই চেষ্টা করবো।
– আজ সন্ধ্যায় গান শুনছি তাহলে?
ওমনি শৈলীর দৃষ্টিতে ধরা পরলো ইতস্ততা,
– আআআজকেই শোনাতে হবে?
কন্ঠ দুষ্টুমি মেশালো মিহরানের,
– শর্ত আজকে পর্যন্তই ভ্যালিড।
শৈলী এক পরত দম নেয়। গাউনের এক পাশ হাতের মুঠোয় খামচে ধরে আবার ছেড়ে দেয়। তারপর সেই ইতস্তত কন্ঠেই একটি বাক্য উচ্চারণ করে,
-ঠিকাছে।
মিহরান মৃদু হাসে।
– ওকে, তাহলে কথা রইলো। আজ সন্ধ্যায় ছাদে আপনার গান শুনছি।
– জ্বি স্যার।
– ওকে। আপনার আর কিছু বলার আছে?
– না স্যার।
– আমার একটা মিটিং আছে। যদি আপনার আর কোনো কথা না থাকে..
– আআআমি চলে যাচ্ছি স্যার।
বলে আর এক মুহূর্তও দাড়ালো না শৈলী। মিহরানের চোখের নিমিষে দৌড়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। ও চলে গেলে হেসে ফেললো মিহরান। এমন এক আবদার যে ওর মুখের থেকে আসবে, এটা ও নিজেও প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি। ডান হাতে ঘাড় চুলকে নিজেই খানিকটা লজ্জা পেল। পর মুহূর্তে আবার সোজা হলো ওর শীর। যাই হোক, আবদার যেহেতু করেই ফেলেছে, তো থাক সেটাই।
এখন এসব নিয়ে চিন্তায় বসলে আর মিটিংয়ে যাওয়া হইসে। তাই মিহরান নিজেকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
………………………
শৈলীর পায়ে আজ পাঁখা গজিয়েছে মনে হয়। ফাঁকা করিডোর দিয়ে এক দৌড়ে নয় তলার খোলা বারান্দায় পৌছে শ্বাস ছাড়লো। ভাগ্যিস এই সময় ক্লাস চলছে বলে মানুষজন বাইরে কম। আর এটা ফ্যাকাল্টিদের ফ্লোর বলে সবসময়ই একটু চুপচাপ থাকে।
শৈলী বারান্দার ঠিক এক কোণায় যেয়ে দাড়ালো। মনের মধ্যে এখনো দমকা হাওয়া চলছে। স্যার এ কি আবদার করলেন?
হঠাৎ শৈলী ভড়কায়,
– আচ্ছা ওয়েট? উনি কেমনে জানলেন আমি গিটার বাজাতে পারি? গান গেতে পারি? আমি তো কখনো…
তখনই শৈলীর মস্তিষ্ক প্রবল দোলা দেয়। ওকে টেনে নিয়ে যায় অতীতের সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল ওর মিহরানের সাথে। শৈলী সেদিন ছাদে গানই তো গাচ্ছিলো, গিটার বাজিয়ে। হমম…সেটাই দেখেছিলেন তিনি।
শৈলী ভীষণ অবাক বোধ করে এই ভেবে যে সেইদিনের সাক্ষাৎ মিহরান এখনো মনে রেখেছে। অজান্তেই লজ্জারা ঘিরে ধরে ওকে। গানটা গেয়ে ও তো মনে করেছিল মিহরান বোধহয় ডিস্টার্ব বোধ করেছে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে…
শৈলী আবার আরষ্ট হয়ে যায়। এক নতুন চিন্তা মনে বাসা বাধে।
-ওনাকে গান শোনাবো বলে তো আসলাম কিন্তু একা একা কিভাবে ওনাকে শোনাবো? আরে গান শোনানো তো পরের কথা ওনার সামনে একা বসতেই তো পারবো না। কেমন অড্ একটা বিষয় না? মাহিরা কে বলবো আমার সাথে যেতে?
এই চিন্তায় খুশি মনে এক পা বাড়াতেই আবার পিছায় শৈলী,
– না না, মাহিরাকে কেমনে বলি? কি বলি? এইটাই যে ওর মেজো ভাই আমার কন্ঠে গান শুনতে চাইছে? তাহলেই হইসে। একে তো সে নাচুনি বুড়ি, তার ওপর পরবে ঢোলের বাড়ি। আমাকে ক্ষেপাতে ক্ষেপাতে আস্ত রাখবে না ও। ওকে বলাই যাবে না। তাহলে কাকে বলবো? মেহরাব কে? না না, ও তো আরেক বেরসিক। প্রথমেই ঝামটা মেরে আমাকে নাকচ করবে। তাহলে কি করি, কি করি?
এই চিন্তার ভার মাথায় নিয়েই শৈলী লিফ্টের কাছে উপস্থিত হলো। এই মুহূর্তে প্রবাল মামার হাতের এক কাপ গরম কফি না খেলেই নয়। ওটা খেলেই মাথায় বুদ্ধি খুলবে বলে শৈলীর বিশ্বাস। আগেও এই পন্থা প্রয়োগ করেছে ও। তাই আর বিলম্ব না করে ছুটলো ক্যান্টিনে।
………………………..
দুপুর ১:২০ বাজে যখন মিহরান নিজের কেবিনে পা রাখলো। মাথাটা ওর রাগে দপ দপ করছে। মিটিংয়ে যেই সব কান্ড হলো তা একটাও ওর পছন্দসই না। পিকনিকের ভেন্যু বদল করতে অনেক চেষ্টা করেছে সে। কয়েকবার ইশ্যুটা তুলেছে, কিন্তু প্রতিবারই বিভিন্ন সব কারণ দেখিয়ে ওর প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। একবার মনে হচ্ছিলো ও বলেই ফেলুক যে এই পিকনিকের সাথে ও জড়িত থাকতে চায় না। কিন্তু এটা প্রফেশনালিসমের মাঝে পরে না বলে অগত্যা চুপ থাকলো।
মিহরান নিজের সুইভলিং চেয়ারটায় বসে গভীর মনোযোগে একটি বিষয় অনুধাবন করলো। ভার্সিটির ইন্টার্নাল এনভাইরনমেন্টটা বেশ করাপ্টেড। “জোর যার মুল্লুক তার” পরিস্থিতি বিরাজ করছে এখানে। ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য আরও অনেকেই থাকার পরও শাহজাহান সাহেবের জোরটা খুব বেশীই খাটানো হয়। বাবার এই ক্ষমতার তান্ডব ছেলেটাকেও গ্রাশ করে নিয়েছে, তাইতো সে আজ এতো বেয়াড়া।
তবে আপাতত মিহরানের রাগ রিকের ওপর না। তাই ওর চ্যাপ্টার মাথা থেকে ক্লোজ করে দিল। পিকনিক টা নিয়ে ওর দায়িত্বে যেই ডিউটি পরেছে, তা পরিচালনা করা সুষ্ঠ একটা পরিকল্পনা ঘটন করায় লেগে গেল।
……………………..
দুপুর পার করে বিকেলের শুরু। ঠিক তখনই মালিহা আর তুরিন ঢুকলো বাসায়। আফিয়া বেগম তুরিনকে দেখে খুশি হয়ে কাছে আসলেন,
– তুরিন মামনি এসেছে দেখি।
মালিহা বান্ধবীর এক হাত নিজের সাথে পেঁচিয়ে হেয়ালি ভাবে বললো,
– এখন তো আসা যাওয়া লেগেই থাকবে মা। তুমি চিন্তা করো না।
আফিয়া মেয়ের কথা কিছু না বুঝলেও তুরিনের গাল লজ্জায় লাল টসটসে হয়ে গেল। সাথেসাথেই মালিহার হাতে চিমটি বসালো ও। “আউচ” করে উঠলো মালিহা, চোখ গাড় করলো বান্ধবীর পানে।
ঠিক সেই সময়ই বাসায় ঢুকলো মাহিরা, মেহরাব আর শৈলী। আফিয়া বেগম তখন স্ব স্ব ব্যাস্ততায় লেগে গেলেন। ছেলেমেয়েরা রাজ্য জয় করে বাসায় ফিরেছে, সাথে নিয়ে এসেছে বান্ধবীদের, আপ্যায়নের একটা ব্যাপার আছে না?
…………………
মাহিরা রোজ ফেরার পথে শৈলীকে বলে ওর সাথে বাসায় উঠতে, কিন্তু শৈলী প্রায় সবসময়ই না করে দেয়। তবে আজ মাহিরার প্রস্তাবে ও এক কথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছে কারণ এখনো ওর মাথায় কোনো বুদ্ধি খেলে উঠতে পারে নি। প্রবাল মামার কফির আইডিয়া পুরাই ফ্লপ। এখন কিভাবে কি করবে তাই চিন্তা করতে মাহিরার সাথে এসেছে। আফ্টার অল, ওরই তো ভাই, নিশ্চয়ই ওর আশে পাশে থাকলে কোন একটা আইডিয়া বের করতে পারবে শৈলী।
মালিহা আজ বেশ কয়েকদিন পর শৈলীর দেখা পেল। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে শৈলীর সাথে কথা বললো,
– কি ব্যাপার শৈলী? কতোদিন পর দেখলাম তোমাকে। এখন বাসায় একদমই আসো না দেখি।
চমৎকার একটা হাসি দিয়ে শৈলী তাকালো মালিহার দিকে,
– আসলে আপু, সারাদিন ক্লাস করে এসে, সত্যি বলতে একদম কোথাও যাওয়ার এনার্জি পাই না। মনে হয় বাসায় যেয়ে একটা ঘুম দেই বা একটু রিল্যাক্স করি। কিন্তু আজ নিজেরই মনে হলো অনেকদিন আপনাদের বাসায় আসা হয় না, তাই চলে আসা।
-ভালো করেছ এসেছো যে। আচ্ছা পরিচয় করিয়ে দেই। এটা হলো আমার বান্ধবী, তুরিন। আর তুরিন, ও হলো শৈলী, মাহিরার আর মেহরাবের বান্ধবী আর আমাদের প্রতিবেশি।
তুরিন আর শৈলী একে অপরের সাথে সৌজন্যতা বিনিময় করলো। তুরিন বেশ কিছুক্ষণ নিজের মাঝেই শৈলীকে পর্যবেক্ষণ করলো। এটা ওর স্বভাব, প্রথম প্রথম কাউকে দেখলেই সেই মানুষটার খুটি নাটি বোঝার চেষ্টায় লেগে যায়। যেমন এখন শৈলীকে দেখে কিছুটা হলেও ও মুগ্ধ। মেয়েটা বেশ আকর্ষণীয়। গতানুগতিক সুন্দরতার ব্যাখ্যা থেকে আলাদা। চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী, হাসিটা প্রাণোচ্ছল আর চুলগুলো যেন ওকে বানিয়ে দিয়েছে কোনো রুপকথার রাজকন্যা। এতো সুন্দর একটা মেয়ে এই বিল্ডিংয়ে থাকে চিন্তা করতেই তুরিনের মন অজানা চিন্তায় কু ডাকে।
……………………….
যেখানে তুরিনের মনে এক চিন্তা, সেখানে শৈলীর বক্ষ কাঁপছে নিজের চিন্তার বাণে। এর মধ্যে মাহিরাটে যে আবার কই গেল ওকে এখানে বসিয়ে?
শৈলীর উৎকণ্ঠার মাঝেই ধপাধপ পায়ে দৌড়ে আসে মাহিরা। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক টেনে চেঁচিয়ে ওঠে,
– আজকে পার্টি হবেএএএ।
ড্রয়িং রুমে বসা সবাই চমকে তাকায় ওর পানে। চোখে কৌতুহল টেনে মালিহা প্রশ্ন ছোড়ে,
– কি আবল তাবল বলিস মাহি? কিসের পার্টি?
মাহিরা ধপ্ করে বসে শৈলীর পাশে,
– আমি কোনো আবল তাবল বলছি না আপু। মেজো ভাইয়া ফোন দিয়েছিল এইমাত্র। বললো, আজ রাতে পুলের পাশে ভাইয়া বারবিকিউ এ্যারেঞ্জ করবে। আমরা সবাই পার্টি করবো।
এতোক্ষণে মাহিরার চোখের সেই ঝিলিক মেহরাব, মালিহার মাঝেও সংক্রামিত হলো। খুশিতে লাফিয়ে উঠলো দুজন। এদিকে ততক্ষণে ঝুমাও চলে এসেছে ওদের সাথে যোগ দিতে। বেচারি ভারি পেট নিয়ে লাফাতে না পারলেও হাত তালি দিয়ে নিজের খুশি জাহির করলো।
মাহিরা এক পর্যায়ে উঠে দাড়ালো ভীষণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে।
– আমার অনেক কাজ আছে এখন। আম্মু, তুমি রহমান ভাইকে দিয়ে কয়লা আনানোর ব্যবস্থা করো। বার বি কিউ মেশিনটাও ওনাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নাও। আর মেহরাব, তোকে আর আমাকে ভাইয়া বেঙ্গল মিটে যেতে বলেছে। ওখান থেকে সব ম্যারিনেট করা আইটেমস নিয়ে আসতে বলসে।
এতোক্ষণ আফিয়া চুপ থাকলেও এখন নড়ে চড়ে বললেন,
– বাইরের থেকে ঐ হাবিযাবি মাংস আনা লাগবে কেন রে? বাসায় সব আছে, আমি ম্যারিনেইট করে দিচ্ছি।
মাহিরা সাথে সাথেই থামিয়ে দিল মাকে,
– ভাইয়া জানতো তুমি এটাই বলবা, তাই আগেই তোমাকে কড়াভাবে নিষধ করেছে কোনো ঝামেলায় যেতে। আর এখন ম্যারিনেইট করে রাখলে হবে না, সময় কম। তাই বাইরে থেকে আনাটাই ভালো।
আফিয়া ছোট মেয়ের কথা শুনে স্মিত হাসি হাসলেন। ছেলে যে তার কষ্টের কথা চিন্তা করেছে, এতেই তিনার বুকটা ভরে উঠলো।
মাহিরা মায়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে শৈলীর দিকে তাকায়,
– শৈলী তুই আর নিপুণও কিন্তু আজকে রাতে আমাদের পার্টিতে জয়েন করবি।
শৈলী এতো হইচইয়ের মাঝে এতোক্ষণ চুপ মেরে বসে ছিল। মনের ভেতরের মুগ্ধতা যেন ছড়ানোর জায়গা পাচ্ছিলো না। আজ সারাটা দিন যেই দুশ্চিন্তায় শৈলীর মাথা খারাপ হয়েছে, সেই সমস্যা মিহরান কতো সুন্দর করেই না সমাধান করে দিল। মাহিরার দেওয়া পার্টির আমন্ত্রণ নাকচ করার প্রশ্নই আসে না শৈলীর। ও যাবে মিহরানের পার্টিতে, অবশ্যই যাবে।
চলবে।