#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩৬
স্তব্ধ নিঃশ্বাসে দুজন দাড়ানো। দুজনেই এক মাদকময় সুতোর বাধনে জড়ানো। চাইলেও বুঝি ছুটতে পারবে না। তবে দুজনের একজনও ছুটতে চায় কি না, তা সন্দেহ হচ্ছে।
শৈলী চোখ নিচে নামিয়ে অন্ধকারে পায়ের নখ দিয়ে মাটি আঁচরাচ্ছে। আর মিহরান চুপচাপ নিষ্পলক দেখে যাচ্ছে তার প্রয়েশীকে। দুজনের ঠোটেই আল্তো হাসির রেখা। এভাবে চলে কিছুক্ষণ, তারপর মিহরান ডাকে,
– শৈলী, তাকাও আমার দিকে?
নিচ থেকেই উত্তর আসে,
– পারবো না।
মিহরান ঠোট টিপে। এক হাত নিচে নামিয়ে শৈলীর গালে রাখে, হাল্কাভাবে চাপ দিয়ে নিজের দিকে ওঠায়। ছাদের ফ্লোরেসেন্ট বাঁতির আলো ছায়ার খেলায় মসৃণ মুখশ্রিটা মায়াবি রুপ নিয়েছে। তাই মন ভরে দেখে মিহরান। শৈলী ছোট্ট করে হাসে,
– কি দেখছেন?
ঘোর ভাঙে মিহরানের। স্মিত হাসি ঠোটের দুকোণে জড়িয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়,
-কিছু না।
এতোক্ষণে আল্গা হয় শৈলী। একটু দম নিয়ে মিহরানকে পাশ কাটিয়ে রেলিঙের কাছে যেয়ে দাড়ায়। দুই হাতের ওপর ভর করে ঝুকে দাড়ায় সামনের দিকে। নিস্তব্ধ পাড়ার নির্জন গলিগুলো দেখে। মিহরান পাশে এসে একই ভাবে দাড়াতেই কথা শুরু করে,
– অনেক অনেক দিন পর এতো রাতে ছাদে উঠলাম। আসলে এটা মনে হয় দ্বিতীয়বার, তাও প্রথমবার এতো রাত হয়নি।
-হমম।
শৈলী পাশ ফিরে,
– একটা প্রশ্ন করি?
মিহরানও তাকায়,
-কি?
– আপনি বাসার সবার সাথে থাকেন না কেন? আই মিন আলাদাভাবে একটা রুমে, ছাদে কেন থাকেন?
মিহরান সোজা হয়। দুই হাত বুকে গোজে,
– তোমার কি মনে হয়? কেন একা থাকি আমি?
শৈলী ভ্রু জোড়া কুচকে ফেলে,
– জানি না।
মিহরান হাসে তারপর একটু সময় নেয়,
– আসলে তেমন কোনো কারণ নেই। একা থাকলে কাজে কনসেন্ট্রেশন বেশী হয় এই কারণেই মূলত। আমাদের বাসা তো দেখেছোই, মানুষে ভরপুর থাকে সবসময়। এতো আওয়াজে আমি কাজ করতে পারি না। আর তার সাথে একটু প্রাইভেসিও পাই।
শৈলীর ভ্রু শিথিল হয়,
-ওওও। তবে যাই বলেন, আপনি এই বাসার সবচাইতে সুন্দর এ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। একদম পুলের পাশে, একটা এক্সোটিক ভাইব আছে। বৃষ্টি পরলে সেই পরিবেশের দৃশ্যটা যে কি মায়াবী দেখায়, উফফ্ সেই রকম!
মিহরান চুপ করে শৈলীর বর্ণনা শুনছিল। ওর উত্তেজিত কন্ঠ আর চোখের চঞ্চলতা ভীষণ আকৃষ্ট করছিল মিহরানকে।
– তোমার এতো ভালো লাগে জায়গাটা?
-হমম খুব।
– তাহলে এটাই ফাইনাল।
শৈলী আবার ভ্রু কুচকায়,
-কি ফাইনাল?
মিহরান একধাপ কাছে এসে শৈলীর দিকে ঝুকে,
– ভাবছিলাম তোমাকে তুলে আনার পর মূল বাসায় শিফ্ট হয়ে যাব, আব্বু আম্মুদের সাথে। কিন্তু যেহেতু তোমার এই রুমটাই পছন্দ তাহলে আর নিচে যাব না। এটাতেই থাকবো দুজন।
শৈলী আকাশ থেকে পরে। কোথাকার কথা মানুষটা কোথায় নিয়ে গিয়েছে? না হেসে পারে না ও।
– আপনি এসব কিভাবে চিন্তা করেন বলেন তো?
– আমার দায়িত্ব পালন করছি আমি।
শৈলী হাসি থামায়,
-দায়িত্ব?
-হমম। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর পছন্দ অপছন্দকে বিবেচনায় রাখা ও প্রাধান্য দেওয়া আমার দায়িত্ব বলে মনে করি আমি।
শৈলীর চোখের কৌতুহল নিমিষেই নিভে যেয়ে ওখানে জায়গা করে নেয় মুগ্ধতা। হঠাৎই এতোটাই আবেগি হয়ে পরে ও যে নিজ থেকেই জড়িয়ে ধরে মিহরানকে। বুকের এক পাশে মাথা রাখে।
মিহরান শৈলীর আচমকা কাছে আসায় হেসে দেয়। এক হাত দিয়ে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাল্কা ভাবে ঠোট ছোয়ায়। শৈলীর আদুরে কন্ঠ শোনে পরক্ষণেই,
– আপনি অনেক ভালো, জানেন?
– আমি ভালো? সত্যি?
-হ্যা, একদম সত্য।
মিহরান দুষ্টুমি করে আরেকটু ঝোকে। গলা খাদে নামায়
– তাহলে সন্ধ্যায় যে বললা আমি খুব খারাপ? সেটা তাহলে কি ছিল?
ঝট করে তাকায় ওপরে শৈলী। কপট রাগ দেখিয়ে মাথা ওঠায়। মিহরানের বাহু বন্ধন থেকে সরে দাড়ায়,
– আপনি আসলেই খারাপ বুঝছেন? সারাক্ষণ আমাকে হেনস্তা করার উপায় খুজেন শুধু। ভালো কথা আপনার কানেই যায় না। ধুর! থাকেন আপনি। আমি গেলাম।
বলেই শৈলী হাটতে নেয়, কিন্তু মিহরান যেতে দিলে তো? হাত ধরে থামিয়ে দেয় ওকে। হাসতে হাসতে কাছে আসে,
– উফফ! আজ অনেকদিন পর অনেকবার হেসেছি শৈলী।
– আপনি হাসতেই থাকেন। আমি যাই, রাত অনেক হয়েছে।
-আচ্ছা যাও, থামাবো না। বাট একটা জিনিস নিয়ে যাও।
শৈলী জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছোড়ে,
– কি?
– মিহরান শৈলীর হাত ছেড়ে পাশ কেটে সামনে যায়। ছাদের এক কোণায় যেয়ে মিহরানকে ঝুকতে দেখে। কিছু একটা তুলতে দেখে অবাক হয়?
-ওখানে কিছু ছিল নাকি? এতোক্ষণ দেখি নাই কেন?
শৈলী ভাবতে ভাবতেই মিহরান কাছে চলে আসে। ধীরে ধীরে ওর হাতের জিনিসটা দৃশ্যমান হয়। যেই দোকান থেকে সবাই লেহেঙ্গা কিনেছে আজ সন্ধ্যায়, সেই দোকানের ব্যাগ দেখে শৈলী আরও অবাক হয়। মিহরান পাশে এসেই ব্যাগটা বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। শৈলী বিভ্রান্ত চিত্তেই নেয় ব্যাগটা,
– এটা কি?
– খুলেই দেখ?
শৈলী চোখ নামায়। বিশাল ব্যাগটাকে সামলাতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো বলে প্রথমে ওটাকে নিচে রাখে। তারপর মুখ টা খুলে ভেতরে হাত ঢুকায়। বের করে নিয়ে আসে একটা কাপড়।
শৈলীর চোখ আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ওর হাতে এই মুহূর্তে একটা লেহেঙ্গা রয়েছে। দাবানো টিয়া রঙের ওপর সেন্ফ চুমকির এমব্রয়ডারির সাথে কালো চিকন বর্ডারে নির্মিত একটা ফিউশান লেহেঙ্গা। দোকানে একটা ম্যানিকুইনে পরানো ছিল এটা তখনই দেখেছে শৈলী। ওর অসম্ভব পছন্দ হয়েছিল এটা তাই দোকানের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল এটার ব্যাপারে। উনিই বলেছিলেন, দেখতে ট্রেডিশনার লেহেঙ্গার মতন লাগলেও এটা গাউনের মতন করে পরতে হয়। বুকের এক পাশে বড় করে ফ্রিল করা দেখে মনে হবে সেটা ওড়না। পেছনের ট্রেলটাও দাড়ুন সুন্দর। এই ড্রেস ওনাদের আগে আসেনি, এবারই প্রথম তাই শুধু দুইটা রঙে এক এক পিস করে এনেছে।
শৈলী তব্দা খেয়ে মিহরানের দিকে তাকায়,
– এটা…? এটা এখানে কেন?
মিহরান পকেটে হাত ঢোকায়,
– কেন আবার? আমি তোমার জন্য কিনেছি তাই?
চোখ বড় করে শৈলী,
– মানে? আপনি কিনেছেন? কেন?
– তোমাকে তখনই বলেছিলাম কিনো কিছু? নিজে যখন কেনো নাই, তাই আমি পরে যেয়ে কিনে এনেছি।
– আপনি কখন গেলেন?
বলেই আবার থামে শৈলী। মনে পরে নিচের নামার পর মিহরান সবাইকে রেখে কোথায় যেন গিয়েছিল। তাহলে তিনি এই কান্ড করতে গিয়েছিলেন? শৈলী চিন্তা থেকে বের হয়,
– দেখুন এটা আমি নিতে পারবো না। আপনি ফেরত দিয়ে আসুন।
এবার মিহরানের অবাক হওয়ার পালা,
– কেন নিতে পারবানা?
-কারণ আমি আগেও বলেছি। আমার অনেক ড্রেস নতুন পরে আছে আলমারিতে। এভাবে শুধু শুধু ড্রেস কেনা আমার কাছে অপচয় ছাড়া কিছুই মন হয় না। সো প্লিস আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি নিতে পারছি না।
মিহরান মুচকি হাসে। শৈলীর ব্যাগ সহ হাতটাকে ধরে ব্যাগটা সরিয়ে ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মুখটা তুলে সামনে পরে থাকা চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দেয়,
– আই এপ্রিশিয়েট এন্ড ডিপলি রেসপেক্ট ইয়র থট্। সত্যি বলতে আজকাল ফ্যাশনের নামে মেয়ে ছেলে উভয়দেরই যেই ধরনের পাগলামি সোসাইটিতে শুরু হয়েছে, তাদের মাঝে তোমার চিন্তা ধারা আসলেই মুগ্ধ করেছে আমাকে শৈলী। কিন্তু এই কাপড়টা আমি একটা বিশেষ কারণে কিনেছি।
বলে একটা দম নেয় মিহরান। শৈলীকে কথা বোঝার সুযোগ করে দেয়,
– এই অনুষ্ঠান আমাদের পরিবারের একদম একান্ত অনুষ্ঠান। অঘোষিত হলেও, তুমি এখন এই বাড়ির মেঝ বউ। যেখানে বাড়ির মেয়েরা নতুন কাপড় নিচ্ছে, তুমি কেন নিবানা? তোমার শাশুড়ি যদি আমাদের ব্যাপারে আগে জানতো তাহলে অবশ্যই নিজেই তোমাকে কিনে দিত। আমারও এতো কথা বলা লাগতো না।আর….আমিও চাই আমার স্ত্রীকে নতুন ভাবে সাজাতে, ঠিক আমার মনের মতো করে।
শৈলী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সব শোনে। মূর্তির ন্যায় অপলক তাকিয়ে থাকে নিজের স্বামী নামক মানুষটার দিকে। মিহরানের প্রশ্ন ঠিক তখনই কর্ণ কুহরে বাজে,
– এখনো মানা করবা ড্রেসটা নিতে?
মানা করা তো দূর, শৈলী একটা কথাও বলে না। মিহরানের হাত থেকে এক মুহূর্তও দেরী না করে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।
ওর কাজে আবার হাসে মিহরান। সত্যিই আজ অনেক হাসছে ও। শৈলী আদুরে ভাব নিয়ে অনুমতি চায়,
-এবার যাই?
মিহরান ওর হাত ধরে নেয়,
– চলো একসাথেই নামি।
-চলুন।
………………
মালিহার আজ রাতের ঘুমের বারোটা বেজেছে। একে নতুন বিছানায় ঘুম আসতে সময় লাগে। তার ওপর রায়হানের সাথে ঝগড়া লেগে বসে আছে। তার ওপর তুরিনের সব উদ্ভট কথাবার্তা। সব মিলিয়ে মাথার ভেতর গোজামিল খাচ্ছে ওর। এতো কিছু একসাথে নেওয়া যায়?
শেষমেষ খাট ছাড়লো ও। নিচে তাকিয়ে দেখে মাহিরা ঘুমিয়ে আছে। পাশের বিছানা খালি দেখে অবাক হয়। শৈলী কই?
ওয়াশরুমের দিকে তাকায় মালিহা। দরজা আর আলো বন্ধ দেখেই বোঝে ওখানে নেই শৈলী। তাহলে গেল কই মেয়ে? নিজের বাসায় গেল নাকি? তাই হবে হয়তো।
এই ভেবে মালিহা ওয়াশরুমে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে অবাক হয়। শৈলীকে মাহিরার পাশে দেখে চোখ বড় হয়ে যায়। এ্যাঁ? মেয়েটা কখন এলো? নাকি আগেই ছিল, মালিহা বোঝেনি? কোনটা?
মালিহা মাথা ঝাড়া দেয়। আজকে ও পুরাই গেসে। এখন যেভাবেই হোক একটা ঘুম দরকার ব্যাস! নাহলে কালকে কিছুই করতে পারবে না ও।
আর কোনো কিছু চিন্তা না করে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পরে ও। চোখ জোর করে বন্ধ করে ঘুমানোর আপ্রান চেষ্টায় লিপ্ত হয়।
এদিকে মালিহার চোখ বন্ধ হতেই শৈলীর চোখ খোলে। একটু ঘাড় উচিঁয়ে ওপরে তাকায়। মালিহা ঘুমিয়ে পরেছে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একটু আগের কথা মনে পরে মুচকি হাসে তারপর। যখন রুমে ঢুকেছিল ও ভেবেছিল সবাই ঘুম। কিন্তু মালিহাকে নিজের খাটে না দেখতে পেয়ে শৈলী ভড়কে যায়। ওয়াশরুম থেকে তখন আওয়াজ আসায় বোঝে মালিহা ওখানে। জলদি জলদি নিজেকে মাহিরার পাশে শোয়ায় শৈলী। তার আগে ড্রেসে প্যাকেটটা খাটের এক কোণায়, অন্ধকারে রাখে। তারপর ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান করে। ওর ভয়, মালিহা নিশ্চয়ই দেখেছে ওর বিছানা খালি। এখন দেখলে ওকে নির্ঘাত প্রশ্ন করে বসবে। তখন কি বলবে শৈলী? তার চাইতে ভালো ঘুমের ভান করুক। কালকে দেখা যাবে যা হবে। এখন শৈলী হাসে। প্রেমে পরলে কতকিছুই করত হয়। হায় রেহ্!
………………..
পরদিন সকাল থেকেই হইহট্টগোলে ভরপুর মিহরানদের পুরো বিল্ডিং। আজ ঢাকার বাইরের সব মেহমানরা একে একে চলে আসছে। তাদের রিসিভ করা, আপ্যায়ন সব কিছুই চলছে জোরেশোরেই। বাড়ির সবার সাথে শৈলীদের পরিবারও আত্মীথেয়তায় ব্যস্ত।
মূল অনুষ্ঠান আগামীকাল হলেও আজ ঘরোয়া ভাবে ঝুমার জন্য একটা সাদের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে সাত তলার ছাদে। মাগরিবের পর থেকে শুরু হবে প্রোগ্রাম। ঝুমাকে সাজাতে পার্লার থেকে কিছু মেয়েরা এসেছে। মালিহা, মাহিরাও তাদের কাছ থেকে হালকা করে সেজে নেবে বলে নিচে গিয়েছে। যাওয়ার আগে কতোবার মাহিরা শৈলীকে সাধলো সাজার জন্য।বললো,
– তুই এই বাড়ির মেঝ বউ। তুই সাজবি না কেন? সাজ না ভাবি?
হাসতে হাসতে শৈলী উত্তর দেয়,
– ননদিনী আমার, আজ তোর এই ভাবি ভাবি শুনতে শুনতে আমার আগামী ছয় মাসের কোটা পার হয়ে গেছে। প্রোগ্রামে সবার সামনে বলে বসিস না আবার। নয়তো আন্টি আঙ্কেল মেনে নেওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। আর যেই সাজের কথা বলছিস, সেটার মতোই আমি করে নিব। তুই চিন্তা করিস না।
মাহিরা মাথা নাড়ায়,
-হ্যা। তোর অবশ্য মেকআপ অনেক সুন্দর হয়। আচ্ছা তুই শাড়ি পরে নে, আমি যাই তাহলে।
– ওকে। মাহি, নিপুণের হাতে আমার মাথায় দেওয়ার ফুলটা পাঠিয়ে দিস তো।
মাহিরা রহস্যময় হাসি দেয়।
-আচ্ছা পাঠাচ্ছি।
…………….
কিছুক্ষণ পরেই ঝুমার রুমে বেলি আর গোলাপের গাজরা ভর্তি ঝুড়ি এনে রাখা হয়। সবাই মাথায় আজ ফুল পরবে। যারা হিজাব পরে তারা পরবে হাতে। মাহিরা সাথে সাথেই একটা ফুলের গাজরা নিয়ে বের হয়। আশপাশে কাউকে খোজে। কাঙ্ক্ষিত মানুষকে দেখতে পেয়ে ছুটে যায় তার কাছে,
-মেঝ ভাইয়া।
মিহরান ফোনে কেটারার সাথে কথা বলছিল। কথা শেষ হতেই মাহিরার ডাক পায়,
-বল্।
মাহিরা কন্ঠ খাদে নামিয়ে মিহরানের কাছে আসে,
– এই ফুলটা একটু শৈলী কি দিয়ে আসতে পারবা? আমরা তো সবাই এখানে সাজছি। শৈলী তোমার রুমে একা সাজছে। আর কাউকে পাচ্ছি না দিয়ে আসার জন্য। তাই তোমাকে বললাম।
বোনের মুখের আর চোখের কথা এক হচ্ছে না দেখে মিহরান বাঁকা হাসে,
-বড় হয়ে গেছিস বোঝা যাচ্ছে। বিয়ে মনে হয় দেওয়ার টাইম চলে এসেছে।
মাহিরা খিলখিলিয়ে হাসে। ভাই ওর কান্ড বুঝতে পেরেছে। মিহরান মুখে এরকম বললেও, ওর চোখে কৃতজ্ঞতা বোধও লক্ষ্য করে মাহিরা।
-তুমি যাও। আমার আরেকটা কাজ আছে।
বলেই আর দাড়ায় না মাহিরা। ওর এখন নিপুণকে খুজা লাগবে। এই মেয়ে গেসে কই?
………………..
শৈলীর শাড়ি পরা শেষ অলমোস্ট। মেকআপ আগেই করেছে। চুলোও বাধা ডান। শুধু ফুলের অপেক্ষা। গয়না গুলো পরতে পরতেই দরজায় টোকা পরে। শৈলী ভাবে নিপুণ এসেছে বলে আওয়াজ দেয়,
-দরজা খোলা। ভেতরে আয়।
রুমের দরজা খোলে। শৈলী আয়না দিয়েই সামনে চায়,
– নিপুন আমার ফ….
শৈলীর হাত থেমে যায় কানের দুলে। মিহরানের স্তব্ধ নয়ন ওকে নিমিষেই লাজে ফেলায়।
মিহরান কতক্ষণ দরজাতেই থমকে দাড়ায়। অপলক চেয়ে রয় কিছুক্ষণ। তারপর দরজা বন্ধ করে চপল পায়ে সামনে আসে। শৈলীর মুখোমুখি দাড়ায়।
দরজা বন্ধের আওয়াজেই শৈলী যারপর নাই কেঁপে ওঠে। মিহরানের মাদকময় চাহনি এমনিতেই ওকে দুর্বল করে তোলে, তার ওপর এই পরিবেশে….
মিহরান এসে একবার গভীর মনোযোগে নিজের স্ত্রীকে দেখে নেয়। তারপর ওকে পেছনে ঘুরিয়ে দেয় নিস্তব্দে। গাজরা টা বড় খোপার চারদিকে আটকে দেয়, লাগানো ক্লিপের সহায়তায়।
চোখ খিঁচে বন্ধ করে শৈলী। দুই হাতে মুষ্টি বাধে শক্ত করে। ওষ্ট শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। হঠাৎ এতো তৃষ্ণা কেন পাচ্ছে ওর জানা নেই। প্রচুর গরমও লাগছে হুট করেই। কই? এসি তো ঠিকই চলেছে এতোক্ষণ। তবে ওকে সেটার বাতাস এখন ছুচ্ছে না কেন?
শৈলী যে আবার লজ্জা পেয়ে বসেছে বুঝে আল্তো হাসে মিহরান। পেছন থেকে কোমরে হাল্কা করে হাত বাঁধায়। শৈলীর কাঁপুনি তখন স্পষ্ট। এভাবে কাছে আসা প্রথম যে। যেন নারীর এই কাঁপুনি আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিতেই নিজের থুতনি বসায় শৈলীর নগ্ন কাধে।
-তোমাকে লাজে পরলে ভীষণ মানায়।
চোখ খোলে শৈলী। আয়নায় দুজনকে একসাথে দেখে স্মিত হাসে। তারপর ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
– এই জন্য উল্টা পাল্টা সব কথা বলে লজ্জা দেন তাই না? খারাপ লোক!
মিহরান স্ত্রীর অভিযোগে হেসে ফেলে,
-আমি এমন কি লজ্জা দিলাম বলোতো?
– দেন নাই? গুণে শেষ করা যাবে না আপনার কীর্তি।
-তাই নাকি? আচ্ছা একটা বলো?
– আপনি কি সব ম্যাসেজে লিখেছেন গতকাল বলুনতো?
– কি লিখেছি?
– আপনিই জানেন। ধ্যাত!
শৈলী সরতে চায় বাধন থেকে। কিন্তু সেখানেই কোমরের গিট হয় আরো শক্ত। আয়নায় তাকাতেই দেখে মিহরানের ঠোট নড়তে,
– মাত্র একটা গভীর চুমুতে অথবা একটু কাছে আসাতেই যদি আমার প্রেয়শি এভাবেই লজ্জায় গুটিয়ে যায়, তবে সে আমার সম্পূর্ণ ভালোবাসার রুপটা দেখবে কিভাবে? কিভাবে সেই অপরাধের সাক্ষী হবে, বলোতো?
শৈলী নিচের ঠোট কামড়ে ধরে। চোখ খিঁচে ধরে আবার। এই…., ঠিক এই কথাগুলোই লেখা ছিল গতকাল সন্ধ্যার ম্যাসেজে। তখনই লজ্জায় শৈলীর পায়ের পাতায় পর্যন্ত শুড়শুড়ি লাগছিল যেন। নিজেকে ঠিক ভাবে দাড়াও করাতে পারছিল না ও তখন। আর এখন? এখন তাহলে কি অবস্থা হচ্ছে ওর? যখন সেই হৃদয়ে ঝড় তোলা কথা গুলোই ওকে শুনতে হচ্ছে সরাসরি অর্ধাঙ্গের ওষ্ট হতে নিংড়ানো শব্দ মালায়? শৈলীর মরে যেতে ইচ্ছে করছে। বিলুপ্ত হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে পৃথিবীর বুক থেকে।
মিহরান পেছন থেকে ছোট্ট করে হাসে। নিজের আদুরে মানবীর রক্ত লাল মুখটা সরাসরি দেখার লোভ সামলাতে না পেরেই যেন শৈলীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। অক্ষি মোদা শৈলী যেন পুতুল বনে গেছে। আর মিহরানের হাতে ওকে নড়ানোর চাবি। মিহরান যেইদিকে ঘোরাচ্ছে, সেইদিকেই যাচ্ছে ও।
শৈলীর চেহারা মিহরানের সামনে আসতেই ওর হৃদয় থমকে যায়। তখন শৈলীও চোখ খোলে। ডাগর আঁখির মায়াবী মুখশ্রীর মাঝে লেপ্টে যাওয়া লাল বর্ণ দেখে ভেতর থেকে কিছু একটা অনুভব হয় মিহরানের হঠাৎ। ভয়ংকর কিছুর অনুভূতি। পরিবেশ, পরিস্থিতি, নিজেদের মাঝের বন্ধন, সব মিলিয়েই যেন ওকে এক অজানা আবেগ ঘিরে ধরে। এতোক্ষণের মুখে বলা দুষ্টুমিটা এখন ধাক্কাছে বাস্তবতায় পরিণত হতে। বার বার যেন এক ঝড় মাথা উঁচিয়ে ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছে ওদেরকে ভালোবাসার সমুদ্রে। সেই ঝড়কে ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না এই মুহূর্তে মিহরানের পক্ষে।
শৈলীও যেন বোঝে এই মুহূর্তের তরঙ্গটাকে। মিহরানের দৃষ্টি তাকে সেটা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছে। গত রাতের মতন আবার যেন তাল হারিয়ে ফেলার ভয়ে খামচে ধরে ও মিহরানের পাঞ্জাবী।
মিহরানের চোখ যায় শৈলীর হাতের ওপর। সেখান থেকে সরাসরি তাকায় ওর নোয়ানো চোখের পাতায়। তারপর গোলাপি ওষ্টে। তা থেকে নিচে নামে শুভ্র গলার ভাজে। পরপর ঠোটও আগায় সেদিকেই। চোখ বুজে আসে ধীরে ধীরে। এক হাতের কোমরের বন্ধন হয়ে ওঠে আরও দৃঢ়। আরেক হাত আপনাতেই উঠে আসে শৈলীর আঁচলের কাছে।
হঠাৎ মিহরান থেমে যায়। এতোক্ষণের বোজা চোখ খুলে যায় হুট করে। আঁচলে ভর করা হাতটা নামিয়ে ফেলে। কোমরের বাধনটাও করে শিথিল।
হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন শৈলীর দেহও বুঝে। নয়ন যুগল তুলে তাকায় ওপরে। মিহরানের স্মিত হাসিতে ভরা মুখটার পানে চায়। শুনে মিহরানের খাদে নামা কন্ঠ,
– আমাদের মাঝের সবচাইতে সুন্দর মুহূর্ত গুলো এরকম হুটহাট হোক আমি চাই না। অনেক যত্নে সেগুলো সাজাতে চাই। তবে এরকম ভীষণ ভীষণ সুন্দর হয়ে আমার সামনে আসলে আমি এবার কোনমতে কন্ট্রোল করতে পারলেও এরপরের বার আর পারবো না। তাই সাবধান শৈলী। সাবধান।
চলবে।