#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৭
নিশুতি রাত। বদ্ধ এক ঘর। চারিদিকে বিরাজমান গাত্র কাঁপানো নীরবতা। হঠাৎই নীরবতা ভেদ করে তুলকালাম হলো শ্রবণেন্দ্রিয়ে। সশব্দে একের পর এক বু”লেট নিক্ষেপ। নিজ হতে কয়েক মিটার দূরত্বে অবস্থিত হিউম্যান টার্গেট বোর্ড। কুচকুচে কালো রঙা মনুষ্যরূপী বোর্ডে টার্গেটের সীমারেখা অঙ্কিত। এ যেন হিউম্যান টার্গেট বোর্ড নয় স্বয়ং ইরহাম চৌধুরী দাঁড়িয়ে। যার বুক, পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে অবিরাম গু;লিবর্ষণ করে চলেছে রুদ্রনীল। খালি হচ্ছে একের পর এক ম্যাগাজিন। তবুও থেমে নেই ভ’য়ানক মানব। দু কানে অনুপস্থিত নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন। বু!লেটের প্রতিটি ভয়ানক-নিষ্ঠুর ধ্বনি অবলীলায় প্রবেশ করছে কর্ণ গহ্বরে। কাঁপিয়ে তুলছে অন্তঃপুর। তবুও থেমে নেই রুদ্রর নি”ষ্ঠুর হাত। ট্রিগার চেপে ধরে অনবরত গু:লিবর্ষণ করে যাচ্ছে। যেন সে হিউম্যান টার্গেট বোর্ড নয় স্বয়ং ইরহামকে নির্মম-নির্দয় পন্থায় হ-ত্যা করছে। ধ্বং স করছে ওই বেপরোয়া চৌধুরীর সমস্ত স্পর্ধা, দুঃসাহসের পরিধি। নিংড়ে-শুষে নিচ্ছে ইতিবাচক সৎ মনোবল। ক্রুর পন্থায় করছে চৌধুরীর দ্য এন্ড। কবে সত্য হবে এ লগন? হবে হবে। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের। হিউম্যান টার্গেট বোর্ডে সর্বশেষ গু লি বিদ্ধ করে রুদ্রনীল বক্র হাসলো। বড় ভ-য়ঙ্কর সে হাসি। মুখনিঃসৃত হলো ছলনাময়ী শব্দ দু’টো,
” ব্যাং ব্যাং! ”
.
পিতৃত্ব এক পরম সুখানুভূতি। পুরুষের জীবনে শ্রেষ্ঠ এক আনন্দঘন পদোন্নতি। সন্তান, ভাই, স্বামী হতে বাবা হবার সুখময় যাত্রা আরম্ভ। নিঃসন্দেহে এ অনুভূতি অত্যন্ত কোমল।হৃদয়স্পর্শী। বলে বোঝানোর মতো নয়। এতদিন যে ছিল কারোর সন্তান, ভাই, স্বামী। আজ সে বাবা হতে চলেছে। তার ভালোবাসার ভাগীদার হতে আসছে এক ক্ষুদ্র সত্তা। তার নিজের অংশ। সন্তান। আধো আধো বুলিতে ‘বাবা’ বলে ডাকবে সে। ছোট্ট ছোট্ট অঙ্গুলি আঁকড়ে ধরবে মা-বাবার ভরসাযোগ্য হাত। হাঁটিহাঁটি পায়ে পদচারণা হবে জমিনের বুকে। যার প্রতিটি সুখে হাসবে মা-বাবা। ক্রন্দনে-বিপদে দিশেহারা হবে মমতাময়ী সত্তা। আহা সে কি অবর্ণনীয় অনুভূতি! পিতা হবার সৌভাগ্য এতটা সুখময়, আনন্দে মাতোয়ারা কেন! জানা নেই ইরহামের। মানুষটি আরেকটু গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো। তাকে সযতনে আগলে নিলো হৃদরাণী। বিছানায় শুয়ে হৃদি। তার গলদেশে মুখ লুকিয়ে ইরহাম। ডান হাতটি পরম স্নেহে স্থাপিত স্ত্রীর উদরে। আলতো করে হাত বুলিয়ে চলেছে সেথায়। অনুভব করতে চাইছে দু মাস বয়সী ভ্রুণটিকে। তাদের অনাগত সন্তানকে। অবিরাম হাত বুলিয়ে চলেছে মানুষটি। সন্তানকে ছোঁয়ার এক তীব্র অভিলাষ অন্তরে। দু চোখে বারিধারা। ভিজে যাচ্ছে স্ত্রীর গলদেশ। তা টের পেয়ে অশ্রুমাখা হাসলো হৃদি। বাঁ হাতের সাহায্যে একটুখানি তুলে ধরলো স্বামীর মুখখানা। এখন কাঁধে ঠেকে মাথা। সদা গাম্ভীর্যের আবডালে লুকায়িত মুখশ্রী আজ কোমলতায় ভরপুর। দু চোখে অশ্রু। লালাভ রঙ মেখে চোখেমুখে। পিতা হবার সুখানুভূতি এতখানি জেঁকে বসেছে অন্তরে!
” হুশশ। সব ঠিক আছে। আর কাঁদে না ইরহাম। আমাদের সোনাটা কি ভাববে বলুন? পাপা সো উইক? ”
স্বামীর কপালে ওষ্ঠ চেপে ফিসফিসিয়ে বললো হৃদি। স্বামী নামক মানুষটি আবেগে আপ্লুত। কাঁপছে কণ্ঠনালী। উদরে হাত বুলিয়ে অস্ফুট স্বরে শুধালো,
” পাপা ডাকবে আমায়? ”
মানুষটির শিশুসুলভ আচরণে হৃদি আরো আবেগী হয়ে পড়লো। এ মুহূর্তটি এত হৃদয়ছোঁয়া কেন? কেন এই আনন্দঘন মুহুর্তে দু চোখ ছাপিয়ে নামছে অশ্রু! কেন! হালকা করে ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি,
” হ্যাঁ। পাপা বলে ডাকবে। বাবাও ডাকতে পারে। ”
” বাবা সুন্দর। এটাই ডাকবে। ”
বাচ্চামো স্বরে বললো মানুষটি। আস্তে করে সরে গেল। নেমে এলো নিম্নে। আলতো করে মাথা এলিয়ে দিলো স্ত্রীর উদরে। পাছে তাদের সোনাটা ব্যথা না পায়। কম্পিত হস্তে স্ত্রীর পরিহিত কৃষ্ণবর্ণ টি-শার্ট সামান্য ওপরে তুললো। দৃশ্যমান হলো উদর। ভেতরকার পিতৃসত্তা জাগ্রত হলো। আরো একবার ভিজে গেল চোখ। সস্নেহ চুম্বন এঁকে দিলো অর্ধাঙ্গীর কোমল উদরে। তাদের অনাগত সন্তান যেন এই স্পর্শটুকু খুব করে অনুভব করলো। অধরকোণ প্রসারিত হলো ইরহামের। আরেকটু ঝুঁকে গেল। উদর ছুঁইছুঁই মুখখানা। অনাগত সন্তানকে চুপিসারে ফিসফিসিয়ে বললো,
” বাবা তোমার অপেক্ষায় সোনা। ”
এ পিতা ও সন্তানের একান্ত মুহূর্ত। তাদের গোপন আলাপ। সেথায় ঠাঁই নেই অন্য কারোর। সন্তানের মায়েরও ঠাঁই নেই। হৃদি উজ্জ্বল নেত্রে তাকিয়ে। দেখে চলেছে একান্ত পুরুষের ভিন্নতর রূপ। পিতৃত্বের সংবাদ পাওয়া মাত্রই বদলে গেছে সত্তা। কাঠিন্যতা এখন মোড়ানো কোমলতায়। একটু একটু করে ওষ্ঠ ছুঁয়ে চলেছে ইরহাম। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উদরে। গোপন আলাপণ সেরে নিচ্ছে। হৃদি ইচ্ছাকৃতভাবে অভিমানী স্বরে বললো,
” বাহ্! বেবি আসতে না আসতেই বেবির মা আউট অফ সাইট? এরপর তো আউট অফ মাইন্ড হতেও সময় লাগবে না। কি নি-ষ্ঠুর দুনিয়া! ”
সিলিং বরাবর তাকিয়ে হৃদি। দুঃখ ভারাক্রান্ত বদন। নিঃশব্দে হাসলো ইরহাম। উঠে এগিয়ে গেল স্ত্রীর সন্নিকটে। হঠাৎ আগমনে হকচকিয়ে হৃদি। চোখে চোখ স্থির হলো। নভোনীল চোখের মায়ায় আটকালো কৃষ্ণাভ চোখ। নিষ্পলক তাকিয়ে মানুষটি। তার বিপরীতে আজ এ কে! শুধুমাত্র অর্ধাঙ্গিনী নয়। তার অনাগত সন্তানের মা। তার হৃদয়ের রাণী। স্বীয় সত্তার অর্ধাংশ। মিসেস হৃদি শেখ! কৃতজ্ঞতায় ভরপুর চাহনি। আরেকটু ঝুঁকে গেল ইরহাম। দু’জনার মধ্যকার ব্যবধান মাত্র ইঞ্চিখানেক। মোহাচ্ছন্ন স্বরে বলে চলেছে মানুষটি,
” জাঝাকিল্লাহু খইরন মিসেস হৃদি শেখ, আমার একলা জীবনের চিরসঙ্গিনী হবার জন্য। ”
সলজ্জ চোখে তাকিয়ে হৃদি। নড়তে নারাজ অক্ষিপল্লব। সম্মোহিত করতে বলে চলেছে মনের গহীনে রাজত্ব করা মানুষটি,
” আকস্মিক এক লগ্নে মনের অরণ্যে এলে তুমি। আধিপত্য বিস্তার করলে অন্তঃপুরের অলিগলি সর্বত্র। প্রণয় বীজ বপন করে প্রাণোচ্ছল করলে গম্ভীর আমিটাকে। জাগ্রত করলে প্রেমী সত্তা। ওহে প্রণয়িনী! তোমার প্রণয়াসক্ত তটিনিতে আমি হারাতে রাজি বারংবার। চিরকাল থেকো এভাবে স্বভাবে শুধু আমারই হয়ে। ”
ছলছল চোখে তাকিয়ে হৃদি। লজ্জাটুকু এক পার্শ্বে রেখে মুখখানি অগ্রসর করলো। অধরে ছুঁলো অধর। শিউরে উঠলো অভ্যন্তর। তেমনিভাবে ফিসফিসিয়ে জানালো সম্মতি,
” থাকবো আ ম র ণ। ইনশাআল্লাহ্! ”
শব্দগুচ্ছ আটকে পড়লো। সন্ধি হলো অধরে অধরে। প্রবল আবেগে আঁকড়ে তারা একে অপরকে। হৃদয়ে লুকায়িত সবটুকু অনুরক্তি প্রকাশিত সে সন্ধিতে। বদ্ধ অক্ষিপুট। কতটা সময় সেভাবে অতিবাহিত হলো জানা নেই দু’টোর। অধর বিচ্ছেদ হলো। সঙ্গিনীর গলদেশে মুখ লুকালো মানুষটি। শিহরিত রমণীর নখ ডেবে গেল স্বামীর কাঁধে, পিঠে। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই ইরহামের। সে প্রগাঢ় স্পর্শ বুলিয়ে চলেছে কোমল ত্বকে। অবাধ্য রূপে চলনশীল ডান হাতটি। একান্ত মুহূর্তটি উপভোগ করে চলেছে হৃ’হাম। অনুভূতি তখন শীর্ষ চূড়ায়। আকস্মিক মৃদু আর্ত করে উঠলো হৃদি। উদরে চলমান হাতটি আঁকড়ে ধরলো। থমকে গেল ইরহাম। ঘন ঘন পড়ছে শ্বাস। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে স্ত্রীর পানে। হৃদি কেমন আদুরে হতাশ কণ্ঠে বললো,
” সোনাটা ব্যথা পাবে। ”
অনুতপ্ত হলো ইরহাম। উদরে আলতো পরশ বুলিয়ে স্ত্রীর নৈকট্যে আসলো। শুলো সোজা হয়ে। সাবধানী ভঙ্গিতে বুকে টেনে নিলো হৃদরাণীকে। চুমু অঙ্কন করলো ললাটে। যত্নশীল কণ্ঠে বললো,
” ঘুমিয়ে পড়ো জান। বেবি নিডস্ রেস্ট। ”
লজ্জালু আভা ফুটে উঠেছে মুখে। হালকা ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। ভালোভাবে মাথা এলিয়ে দিলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত স্থানে। দু’জনেই নিশ্চুপ শুয়ে। অনুভব করে চলেছে মুহুর্তটি। অপেক্ষায় সে-ই আকাঙ্ক্ষিত দিনটির। কবে পৃথিবীর আলো দেখবে তাদের সোনামনি!
.
দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসূধা। ডান কাত হয়ে শুয়ে ইনায়া। ফজরের সালাত আদায় করে শুয়েছে বটে। কিন্তু নিদ্রা নেই দু চোখে। চোখেমুখে সীমাহীন উজ্জ্বলতা। ফুপু হতে চলেছে সে। বাড়িতে একটা পুঁচকে আসতে চলেছে। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। এতদিন কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে রাজত্ব করেছে সে। এবার হবে পালাবদল। ইনুর জায়গাটি দখল করবে নতুন সদস্য। সকলের আদরের সোনামনি! ইশ্! কি উত্তেজনাময় আবেগ অনুভূতির সংমিশ্রণ! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। উজ্জ্বল বদনে পিছু ঘুরে শুলো মেয়েটা। চক্ষুতারায় বন্দী হলো স্বামীর মুখাবয়ব। অমন পেঁচামুখ করে শুয়ে কেন!
” কি হয়েছে তোমার? অমন ভালুর মতো মুখ করে আছো কেন? ”
তেঁতে উঠলো রাহিদ,
” বে দ্দ প মাইয়া। আমি ভাল্লুক? তুই উল্লুক। তোর চৌদ্দ গুষ্টি উল্লুক। ”
জিভ কেটে তৎক্ষণাৎ আমতা আমতা করে বলে ফেললো,
” ইয়ে না মানে। চৌদ্দ গুষ্টি ক্যান্সেল। আমিও তো ভেতরে আছি। ”
বোকা বোকা হাসলো ছেলেটা। সকাল সকাল নিজেকেই গালমন্দ করছে! ইশ্! কি লজ্জাজনক বিষয়! ইনায়া তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে স্বামীর পানে,
” সকাল সকাল ডেট ওভার মাল খেয়েছো নাকি? আউলাঝাউলা কিসব বলছো? ”
রাহিদ দুঃখ ভারাক্রান্ত চাহনিতে তাকিয়ে। এই ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেবে বুঝি,
” আমি আউলাঝাউলা বলছি? এত মোটা কথাটা তুই বলতে পারলি ইনু? ”
চক্ষু চড়কগাছ ইনুর!
” মোটা কথা? ”
” হ্যাঁ হ্যাঁ। মোটা কথা। শুঁটকি কোথাকার! সকাল সকাল আমাকে মোটা কথা শোনাচ্ছে। হুহ্! ”
ভেংচি কাটলো রাহিদ। ইনায়া এবার নিশ্চিত তার বরটা নেশাপানি করেছে। কিংবা আপাদমস্তক জাপ্টে ধরেছে জ্বীন। ফজরের পর বেলকনিতে হাওয়া খেতে গেল না? নির্ঘাত তখন এই অঘটন ঘটেছে। হুম। সহসা ভাবনায় হাতুড়ি পড়লো। জাপটে ধরেছে রাহিদ। ইনায়া তৎক্ষণাৎ সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। যদি লুচু জ্বীন আছড় করে থাকে? সর্বনাশ! ইনায়া যত চেষ্টা করছে রাহিদ ততই আঁকড়ে ধরছে। শক্তপোক্ত হাত-পায়ের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে পড়লো মেয়েটা।
” অ্যাই ছাড়ো। ছাড়ো বলছি। ”
রাহিদ তখন আপনমনে আহাজারি করে চলেছে,
” ইনু রে! পেয়ার করলাম আমরা আগে। আর বাপ হচ্ছে ইরু ভাই? এতবড় অন্যায় অবিচার সইবে না ধরনী। ”
তালগাছ থেকে টুপ করে ছিটকে পড়লো ইনায়া। দু চোখে রাজ্যের বিস্ময়! রাহি এসব কি বলছে! সকাল সকাল এই নিয়ে মাথা খারাপ করা দরবার? হায় রে! রাহিদ বউকে নড়াচড়া করে ডাকছে,
” এই নি;ষ্ঠুর মহিলা! আমিও বাবা হবো। আমার হালি হালি সোনামনি অপেক্ষা করছে। আর কত লেট করাবি ওদের? ওদের নিয়ে আয় না। ওই.. ”
ইনায়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” প্লে স্টোর থেকে ইন্সটল করে দিই? ”
আশাহত জবাব এলো। ক্ষ্যা পা ষাঁড় হয়ে স্ত্রীর গলদেশে নরম ত্বকে দন্তাঘাত করলো রাহিদ। মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো ইনায়া। স্বামীর বাহুতে আলতো চাপড় মে রে মেকি রাগ প্রকাশ করলো,
” রাক্ষস একটা! সকাল সকাল কিডনিতে ব্যামো হয়েছে? আওফাও কিসব বলছো? ”
রাহিদ শিশুসুলভ মুখভঙ্গি করে বায়না ধরলো,
” আমিও বাবা হবো। ”
লাজে মরি মরি অবস্থা। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত ইনায়া। মৃদু স্বরে বললো,
” আমি এখনো শিশু। আরেক শিশু আসার সময় হয়নি।”
ত্যাছড়া ভঙ্গিতে বললো রাহিদ,
” চাপকে তোর শিশুগিরি ছুটিয়ে দেবো। রাতে বরের আদর সোহাগ নেয়ার সময় মনে থাকে না ‘ আই অ্যাম অ্যা শিশু ‘? হ্যাঁ? ”
লজ্জালু চোখে রাগ দেখালো ইনায়া। বাঁ হাতের তেলোয় চেপে ধরলো স্বামীর ওষ্ঠাধর। শাসনের সুরে বললো,
” চুপ। তুমি কি গো হ্যাঁ? চাচু ও ফুপা একসাথে হচ্ছো। কোথায় সে আনন্দে নাচবে। তা না করে ‘ বাবা হবো ‘ এই বলে ধেই ধেই করে লাফালাফি করছো? ”
হালকা জোর খাটিয়ে মুখ হতে পেলব হাতটি সরিয়ে দিলো রাহিদ। টুপ করে সঙ্গিনীর ওষ্ঠ ছুঁয়ে দুষ্টুমি করে বললো,
” যখন নিজে বাবা হবো তখন কথক, ভরতনাট্যম, মনিপুরী, ভোজপুরি, পপ সব নাচবো। পুরো পঞ্চাশ কেজি মিষ্টি বিলি করবো। বুঝেছিস? ”
স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে ইনায়া। ছেলেটা কি কিডনি বেঁচে আনন্দ উদযাপনের পরিকল্পনা করছে? পঞ্চাশ কেজি মিষ্টি বিলি করবে? লাইক সিরিয়াসলি? হঠাৎই ভাবনার তার ছিন্ন হলো। কাঁধে মুখ গুঁজে ছেলেটি। ছুঁয়ে যাচ্ছে বেসামাল পরশ। কর্ণ গহ্বরে ফিসফিসিয়ে বলে চলেছে,
” আমিও বাবা হতে চাই সোনা। ”
•
মা হতে চলেছে হৃদি। ইতিমধ্যে সুখবর পৌঁছে গিয়েছে শেখ পরিবার। আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে উঠলেন ফারহানা। তার ছোট্ট মেয়েটা এত দ্রুত বড় হয়ে গেল! অন্যের ঘরণী হতে এখন সে-ও হতে চলেছে মা! উনি নানি হবেন! আনন্দে আত্মহারা মন। বিলম্ব করলেন না। ফারহানা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছুটে এলেন আনন্দাঙ্গন। পুরো বাড়ি জুড়ে হৈচৈ। রমরমা অবস্থা। সকলের মধ্যমণি হয়ে সোফায় বসে হৃদি। রাজরানীর মতো বসে সে। একটুও সোফা থেকে উঠতে দিচ্ছে না। চোখ গরম করে তাকাচ্ছে নীতি, ইনায়া। ভাবা যায় সেদিনের পুঁচকে মেয়ে দু’টো ওকে শাসন করছে। বারবার বলছে,
” ভাবী খবরদার উঠবে না। আমাদের পুঁচু ব্যথা পাবে। ”
” এই বনু তোর সমস্যা কি রে? এত লাফালাফি করছিস কেন? একটু শান্ত হয়ে বস না। বাবুটা টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে তো।”
আরো কত কি বলছে দুটো। এমনকি নিদিশা, রায়না ওরাও বাদ নেই। ছোট-বড় সকলের মিষ্টিমধুর শাসনে অবস্থা নাজেহাল। আলতো করে উদরে হাত স্থাপন করলো হৃদি। অনুভব করে চলেছে অনাগত সন্তানকে। সবেমাত্র দু মাস বয়সী ভ্রুণ। কবে আরো বড় হবে? মানব দৈহিক গঠন হবে! মুচকি হাসলো হৃদি। উজ্জ্বলতা দৃশ্যমান চোখেমুখে। দুই মা কত্ত খুশি। আনন্দে আটখানা হয়ে আলাপণ করছে। সবাই খুশি। উচ্ছ্বসিত। আনন্দিত। পরিবারের সদস্যদের প্রাণবন্ত রূপ দেখে মনে মনে দোয়া করলো হৃদি,
” সদা অটুট থাক এ বন্ধন। সুখে থাক আপনজন। ”
•
এক মাস পর…
এক তমসাচ্ছন্ন রজনী। নিশাচর পাখপাখালির কলরব ভেসে আসছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে। চারিদিকে নীরবতা। নিস্তব্ধতা। তন্মধ্যে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’জন। বছর চব্বিশের হাসিফ এবং অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। শহর হতে কিছুটা দূরে এক নিরালায় তাদের গোপন আলাপচারিতা। সামান্য দূরে অবস্থিত গাড়ি। জ্বলে রয়েছে গাড়ির হেডলাইট। সে আলোয় আলোকিত দু’জনের দেহ। গুরুত্বপূর্ণ আলাপণ সেরে হাসিফ অজ্ঞাত লোকটির হাতে তুলে দিলো একটি পেনড্রাইভ। লোকটি হাসিফকে কিছু বুঝিয়ে দিলো। ইতিবাচক মাথা নাড়ল হাসিফ। অতঃপর আলাপচারিতা সম্পন্ন করে বিচ্ছিন্ন হলো তাদের পথ। দু’জনে রওনা হলো দু গন্তব্যে। গাড়ি ও বাইক ছুটলো বিপরীত পথে। অজানা রয়ে গেল এই গোপন আলাপণের মূল উদ্দেশ্য।
চলবে.
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। সময়ের পরিক্রমায় শেষের পথে ধাবিত হচ্ছে উপন্যাসটি। আর বেশি পর্ব নেই। ধেয়ে আসছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী-পরাক্রমশালী লড়াই। আপাতত কিছু নতুন চরিত্রের আগমন ঘটবে। অতঃপর সমস্ত রহস্য উন্মোচন করে বিদায় নেবে হৃ’হাম, রা’নায়া। আশা করি শেষের এই পর্বগুলোতে আপনারা ধৈর্য ধরে পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ সবাইকে। ]