#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৯
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
সূর্যের মাত্রাতিরিক্ত তেজে গায়ের চামড়া ঝলসে যাচ্ছে।জলপ্রপাতের মতো ঘাম ঝরছে শরীর থেকে।
বারবার ওড়না দিয়ে সেই ঘাম মুছতে মুছতে ক্লান্ত-অবসন্ন রাত্রি এবার হাল ছেড়ে রিকশার পিছের অংশে কাত করে মাথা এলিয়ে দিলো।হুট তোলা তবু গরম কমেনি একরত্তিও।মুখ হা করে খেঁই হারানো উল্টাপাল্টা শ্বাস ছাড়লো রাত্রি।মাথাটা কেমন ঝিমিঝিম করছে।নিভু নিভু চোখের পাপড়ি খুলে রাখা বড় দায়।ভাঙা রাস্তায় ঠাঁই না পেয়ে পুরো রিকশা বারবার ঝাঁকি দিচ্ছে।শরীরের নরম হাড়গুলো যেনো চুরমার হয়ে যাচ্ছে।কি অসহ্য অনুভূতি!
সকালে গোসল করেই বেরিয়েছিলো।এখন ঘেমে নেয়ে মনে হচ্ছে আবারও একছুটে গা ভিজিয়ে আসতে।কিন্তু উপায় নেই।যাচ্ছে টি উশনি করাতে।স্টুডেন্টের পরীক্ষা সামনে।স্টুডেন্টের মা কড়াভাবে বলে দিয়েছেন এমাসে একদিনও যাতে ছুটি না যায়।গেলেও হিসেব করে বেতন কেটে রাখা হবে।সুতরাং না যেয়ে উপায় নেই।
যানবাহনের তীব্র হর্ণে গা গোলাচ্ছে।চোখ বুজেই রাত্রি বুঝতে পারলো শরীরটা বেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।অসুস্থ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে ধীরগতিতে।
গাড়ি আটকে আছে জ্যামে।তবুও যেন প্রশান্তিময় মুগ্ধতার ছোঁয়া ড্রাইভিং সিটে বসা নিভ্রানের নয়নজুড়ে।কাঁচের গ্লাসের ভেতর দিয়ে দিনের আলোয় ঘেমে নেয়ে একাকার হওয়া তার ‘রাত’ কেই দেখে যাচ্ছে যে।
মেয়েটার ক্নান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়াটাও যেন স্নিগ্ধতায় ঘেরা।গলার ঘামে সিক্ত হয়ে আলগোছে লেপ্টে থাকা চুলও যেন উপহাস করছে নিভ্রানকে।আনমনেই হাসলো সে।চুলগুলোও তার থেকে ঢের ভাগ্যবান।অন্তত মেয়েটাকে ছুঁয়ে তো দিতে পারে।তার তো এতেও ঘোর বাঁধাবিপত্তি।
হঠাৎই চকিতে চোখ মেললো রাত্রি।এভাবে জ্যামে বসে থাকলে আর পৌছানো লাগবেনা ব্যাপারটা মস্তিস্কে খেলে যেতেই দ্রুত ব্যাগ থেকে টাকা বের করলো।ঘাড় উঁচিয়ে সামনের গাড়ির অবস্থানগুলো দেখে নিয়ে
হতাশ ভঙ্গিমায় বললো,
—“চাচা,টাকাটা রাখেন।আমি এখানেই নেমে যাবো।”
মধ্যবয়স্ক রিকশাচালক লোকটা ঘাড় ঘুরালেন।মেয়েটা তার ছোট মেয়ের মতো দেখতে।কি অপার মায়া সরল চোখদুটিতে।নিদারুন ক্লান্তি গলার স্বরে।রাত্রির বাড়িয়ে রাখা টাকাটা হাতে নিলেননা তিনি।স্নেহমাখা কন্ঠে বলে উঠলেন,
—“তুমি হাইট্টা যাইতে পারবা মা?বসো,একটু পড়ে জ্যাম ছাইড়া দিবোনে।”
রাত্রি মলিন হাসলো।পৃথিবীতে খারাপ মানুষের ভাঁজে ভাঁজে এক দুটো প্রচন্ড ভালো মানুষেরাও লুকিয়ে থাকে।টাকাটা আরো একটু এগিয়ে সে বললো,”আমার দেরি হয়ে যাবে চাচা।জ্যাম কখন না কখন ছাড়ে
ঠি ক নেই।”
রিকশাচালক লোকটা ঠোঁট এলিয়ে স্নেহার্দ্র হাসলেন।টাকাটা নিয়ে পকেট ঢোকালেন।
রাত্রি কাঁধের ব্যাগটা ঠি ক ঠাক করে নামার জন্য এক পা বাড়াতেই মাথাটা প্রচন্ডভাবে চক্কর দিয়ে উঠলো।নিমিষেই চোখমুখ অন্ধকার কালো আঁধারে ছেঁয়ে গেলো।চোখ বন্ধ অবস্থায় তাল হারিয়ে ফেললে রাত্রি।
পরণের জর্জেটের জামার হাতাটা বাজেভাবে ছিঁড়ে গেলো রিকশার বেরিয়ে থাকা পেরেকের সাথে লেগে।পাতলা চামড়া ভেদ করে বাহু থেকে রক্ত গড়িয়ে গেলো।কোনোমতে দু’পা মাটিতে নামালেও ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলোনা রাত্রি।রিকশাওয়ালা চাচা দ্রুত একহাত ধরলো।লাভ হলোনা।দূর্বল শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে।রাস্তায় বসে পড়ার আগেই শক্তপোক্ত হাতের বাঁধন তাকে বাঁচিয়ে নিলো।চেনা মানুষটার বাহুবন্ধনীতে জায়গা পেতেই মস্তিষ্কের উথালপাথাল থেমে গেলো।খুব আরামে নিশ্চিন্তে বুকটায় মাথা এলিয়ে দিলো সে।
নিভ্রানের বুক বিদ্যুৎ বেগে লাফাচ্ছে।বুকের ধুকপুকানিটা স্পষ্ট।কন্ঠ কাঁপছে।
—“রাত?রাত চোখ খুলুন।হঠাৎ কি হলো?রাত?”
রাত্রির মনটা কেঁদে উঠলো।এত অস্থিরতায় ভরপুর ভয়ার্ত কন্ঠের ডাকটা শুধু তার জন্য ডাকা হচ্ছে।তার জন্যও কেও চিন্তিত?পরক্ষণেই সীমাহীন স্নিগ্ধতায় আবার হেসেও উঠলো।লোকটা এখনো ডাকছে।সেই একই উৎকন্ঠা নিয়ে।
নিভ্রানের অস্বাভাবিক হৃদকম্পন কানে আঘাত করছে।পুরুষালী হাতজোড়া যে জড়িয়ে ধরার কৌশলে খুব সন্তর্পণে বাহুর ছেঁড়া অংশটা ঢেকে রেখেছে তা বুঝতেও বেগ পেতে হলোনা রাত্রির।মনে মনে আরো একচোট লোকটাকে অনুভব করে খুব হাল্কা তেজহীন স্বরে সে বললো,
—“ঠি ক আছি।শান্ত হন।”
রাত্রির কন্ঠ কানে আসতেই বুক ভরে শ্বাস নেয় নিভ্রান।এতক্ষণ এগুলো ভেতরেই আটকে ছিলো।
আশেপাশে মানুষ জমে গেছে।নিভ্রান রাত্রিকে আরো একটু জড়িয়ে নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললো,”আমার পরিচিত উনি।আপনারা অযথা ভীড় করবেন না।আমি নিয়ে যাচ্ছি উনাকে।”
লোকজন চলে গেলো।রিকশাচালক চাচা এতক্ষণ কিছু না বললেও এবার সে মুখ খুললো।নিভ্রানকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখে নিতে নিতে বললো,
—“আন্নে আসলেই চিনেনতো নাকি..”
নিভ্রান একহাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসা।রাত্রির হালকা গোলাপি রংয়ের সালোয়ার কামিজ ধুলোয় মাখামাখি।নিভ্রান ধীরে ধীরে তার ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে একহাতে ধরলো।অপরহাতে তখনো আবৃত রাত্রির দৃশ্যমান বাহু।
রিকশাচালক চাচার দিকে না তাকিয়েই সে বললো,
—“আপনার ওকে দেখে কি মনে হচ্ছে চাচা?”
রিকশাচালক গভীর দৃষ্টিতে দেখলেন।মেয়েটা যেভাবে ছেলেটার বুকে মাথা রাখছে আবার একহাতে পিঠ জড়িয়ে ধরছে এটা দেখে আর সন্দেহ করার অবকাশ নেই।দাঁতের পাটি বের করে হাসলো সে।বললো,
—“মনে হইতাসে চিনেন।”
নিভ্রান উওরে হাল্কা ঠোঁট এলালো।রাত্রির দিকে মাথা নামিয়ে নরম গলায় বললো,
—“রাত,দেখিতো ছাড়ুন।এভাবে রাস্তায় বসে থাকলে হবে নাকি?”
রাত্রি টলমলে মাথা তুললো।বাহুটা জ্বলছে।আলতো করে নিভ্রানের পিঠ থেকে হাত সরালো সে।মাথা এখনো ভার ভার লাগছে।নিভ্রান একটু উঠলো।রাত্রির ব্যাগটা একহাতের কুনইয়ে ঝুলিয়ে নিতেই রাত্রি কাতর কন্ঠে বললো,
—“আমাকে একটু ধরে উঠান প্লিজ।একা পারছিনা।”বলেই কোনমতে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।নিভ্রান হাত ধরলোনা।বরং একমূহুর্ত বিলম্ব না করে রাত্রিকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো।থতমত খেয়ে গেলো রাত্রি।জোর গলায় কিছু বলার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই।উপায় না পেয়ে আলতো করে নিভ্রানের গলা জড়িয়ে ধরলো সে।নিভ্রান তাকে দ্রুত গাড়ির পেছনের সিটে নিয়ে বসালো।তারপর দরজা আটকে ড্রাইভিং সিটে বসলো।দ্রুত গাড়ি সাইড করে রেখে সামনের ড্রয়ার থেকে পানি আর ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসি বাড়িয়ে দিয়ে আবারো পিছে ফিরে এলো।গাড়ির ভেতর এমনেও ঠান্ডা ছিলো এখন তা আরো তীব্র হয়েছে।
নিভ্রান রাত্রিকে টেনে নিলো বুকে।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মুখের সামনে পানির বোতল ধরে শক্ত স্বরে বললো,
—“হা করুন,পানি খান।”
রাত্রি বাধ্য মেয়ের মতো মুখ খুললো।নিভ্রান অনেকগুলো পানি খাইয়ে নিজ হাতে ঠোঁট মুছিয়ে দিলো।লোকটা রেগে আছে খুব।আচার-আচরণে বোঝা যাচ্ছে।কিছু করার আগে রাত্রির অনুমতি নিচ্ছেনা মানে সে বেশ ভালোই ক্ষেপেছে।
—“ভালো লাগছে?”
রাত্রি মৃদুভাবে উপরনিচে মাথা নাড়ালো।নিভ্রান তাকে বুক থেকে সরিয়ে সিটে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে ফাস্ট এইড বক্স খুলতে খুলতে নামানো গলায় বললো,
—“ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে।লোহার পেরেক দিয়ে কেটেছে।ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।”এটুকু বলে থামলো সে।রক্তাত্ব বাহুর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।অত:পর তুলোয় স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বললো,”জামা নামান।”
রাত্রি চমকে উঠলো।কাঁধ থেকে জামা না নামালে ব্যান্ডেজ করা অসম্ভব।তবু নিভ্রানের সামনে এমন নির্লজ্জের মতো কাপড় নামিয়ে দেয়াটা কেমন যেন।স্বাভাবিকতই আপত্তি করলো সে।হাত এগিয়ে বললো,
—“আমি পারবো,আমাকে দিন।”
নিভ্রান নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকালো।কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আচমকাই খচ্ করে রাত্রির পিছের চেইনটা খুলে দিয়ে তুলোটা হাতে ধরিয়ে বললো,”করুন।”
রাত্রির বলতে হলোনা।নিভ্রান নিজে থেকেই মুখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি বাইরে দিয়ে রাখলো।অস্বস্তি কাটিয়ে জামা নামালো রাত্রি।মাথার ভন ভন করাটা এসির ঠান্ডা হাওয়ার বদৌলতে এখন একটু শিথিল আছে।
ক্ষত পরিষ্কার করা শেষ হতেই হাল্কা কাঁশলো সে।নিভ্রান তার ইশারা বুঝে কাপড়ের গজ বের করে দিয়ে বললো,
—“একা বাঁধতে পারবেন?”
—“পারবো।”বলে একপাশ দাঁত দিয়ে ধরে আর আরেকপাশ হাতে ধরে পেঁচিয়ে ভেতরে তুলো দিয়ে গজ বেঁধে নিলো রাত্রি।জামা উঠিয়ে নিজেই চেনটা লাগিয়ে নিয়ে ওড়না দিয়ে ছেঁড়া বাহু ঢেকে বললো,”হয়ে গেছে।”
নিভ্রান তাকালো।রাত্রির বামগালে হাত রেখে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখের পাতার উপরে স্লাইড করতে করতে বললো,
—“সবসময় এমন কেনো করেন রাত?এত দূর্বল শরীরে কেনো ঘোরাফেরা করেন?আজ যদি আমি না থাকতাম?।”
রাত্রি উওর দিলোনা।অপরাধীর মতো চুপ করে রইলো।নিভ্রান হাত সরিয়ে ফাস্ট এইড বক্স গুছিয়ে নিলো।
ড্রাইভিং সিটে বসার জন্য বেরোতে নিলেই রাত্রি তার হাতের কব্জি চেপে ধরে বললো,
—“শুনেন?”
মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোঁণ ঘেঁষে।সমস্ত রাগ নেমে গেছে নিমিষে।এই ডাকটা,এই হাত ধরাটা।নাহ্,এরপর আর রাগ ধরে রাখার উপায় নেই।দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলেও রাগ পালিয়ে যাবে।ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সে।
রাত্রি মিনমিনে গলায় বললো,
—“আমি এক জায়গায় পড়াতে যাচ্ছিলাম।খুব জরুরি।”
নিভ্রান হতাশ শ্বাস ছাড়লো।এই মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই।কোনো লাভ নেই।এই মেয়ে কথা শোনার মেয়ে না।
চরম অবাধ্য।উপরন্ত রাত্রির ছোট্ট মুখটায় দিকে তাকিয়ে গলার আওয়াজ বাড়াতে পারলোনা সে।শান্ত স্বরে বললো,
—“এড্রেস বলুন,পৌছে দিচ্ছি।”
________________
কালোসন্ধ্যার শেষ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।ঘড়ি অনুযায়ী এসময়টাকে রাত্রিকাল বলে।প্রকৃতিজুড়ে থমকে থাকা বাতাস।আকাশে ঘনীভূত সাদা লম্বা মেঘ উড়ে বেরাচ্ছে।
মেঘকন্যা বোধহয় ধরিত্রী মাতার গায়ে বৃষ্টি নামানোর অনুমতি চাইছে দু’হাত জোড় করে।নিভ্রান ড্রাইভ করছিলো।গাড়ির ভিতর হলদে লাইটের ছাঁয়া।রাত্রি চুপটি করে বসে আছে।সারাটাদিন নিভ্রান তাকে এখান থেকে ওখানে নিয়ে গেছে শুধু।একা ছাড়বেনা কোনোমতেই।এখন বাড়ি ফেরার শেষ যাত্রা চলছে।
জানালা খোলা।ঠান্ডা বাতাসে এসির প্রয়োজন একেবারেই নগন্য।
রাত্রি তিরিক্ষি মেজাজে বললো,
—“আপনি শুধু শুধু কাজকর্ম বাদ দিয়ে পুরো দিনটা নষ্ট করলেন।”
—“আপনি সাথে থাকলে বছরের তিনশ পয়ষট্টি দিনও ‘নষ্ট’ করতে একপায়ে রাজি।”নিভ্রানের উওর যেনো তৈরি করা ছিলো।
রাত্রি হেসে ফেললো।অষ্ফুস্ট স্বরে বললো,”পাগল আপনি।”নিভ্রানও তাল মেলালো,”হয়ে গেছি বোধহয়।”
রাস্তার জ্যামের সাথে না পেরে গাড়ি ঘোরানো হয়েছে।উল্টো পথে দেরি হলেও গাড়ি চালাতে বেশ আরাম।বাঁধাহীন স্পিডে ফাঁকা রাস্তায় নিয়মহীন ড্রাইভিং।এ রাস্তাটা একদম নির্জন।জনমানব শূন্য।
ঝড়ো বাতাস শুরু হবে হবে ভাব হতেই নিজের পাশের জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিলো রাত্রি।সেকেন্ড না পেরোতেই শহর উড়িয়ে ঝড়ো হাওয়ার আগমন।বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ফোঁটা গুলোও যেনো উড়ে যাচ্ছে।ধুলোয় সামনেটা আচ্ছাদিত।নিভ্রান জানালা দিয়ে মুখ একটু এগিয়ে নাকে মুখে ঠান্ডা বাতাস মাখছে।মাথার চুল উড়ে যাচ্ছে পেছনের দিকে।রাত্রি তার বাহুর শার্ট টেনে ধরলো।বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
—“কি করেন?কাঁচ লাগান।জোরে বৃষ্টি নেমে যাবে।”
নিভ্রান ছ্যাত করে উঠলো।ভরাট গলায় ধমকের সুরে বললো,
—“আপনার এই বৃষ্টিবিদ্বেশী স্বভাব আমার মোটেও পছন্দ নয় রাত।”
—“আমি বৃষ্টিবিদ্বেশী না।”রাত্রির অবাককন্ঠের চটপট উওর।
ঘাড় ফিরিয়ে একপলক তাকালো নিভ্রান।রাত্রির ফর্সা মুখের সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে মূহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চোখজোড়া স্হির করে বললো,
—“তবে চলুন,আজ ভিজবো।”নিভ্রানের বলতে দেরি কিন্তু বৃষ্টি নামতে দেরি হয়না।ঝরঝর শব্দে মেতে উঠে প্রকৃতি।মাতাল বৃষ্টির ছটফটে আমেজ।দু’পাশে বড় গাছওয়ালা রাস্তার ধারের কাঁচা মাটির ঘ্রানে অদ্ভুত মাদকতা।
নিভ্রানকে সত্যি সত্যিই সিটবেল্ট খুলতে দেখে ধরফরিয়ে উঠলো রাত্রি।বললো,
—“পাগল হয়েছেন?”
নিভ্রান ততক্ষনে নিজের সিটবেল্ট খুলে রাত্রির টা খোলায় মনোযোগ দিয়েছে।রাত্রির কথার পিঠে তার ভাবলেশহীন ভঙ্গি”পাগলই আমি।”
—“আপনি যেয়ে পাগলামি করুন।আমি নেই এসবে।”
রাত্রির কথাটাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নিভ্রান বেরিয়ে পড়লো বৃষ্টি মাথায়।রাত্রি শক্ত হয়ে বসলো।সে যাবেনা।মাঝরাস্তায় বৃষ্টিতে ভেজার কোনো মানে আছে?এ কেমন পাগল জুটো তার ভাগ্যে?
গাড়ির একপাশ থেকে অপরপাশে ঘুরে আসতে আসতেই কাকভেজা হয়ে গেছে নিভ্রান।বৃষ্টির ফোঁটা অনবরত গড়িয়ে পড়ছে চোখমুখ বেয়ে।
গাড়ির দরজা খুললো সে।রাত্রির মোহিত চোখ নিভ্রানের উজ্জল শ্যামলা সিক্ত মুখশ্রীতে।নাকের ডগার বিন্দুপানিটা পরলো কোলের উপর।শুকনো একটা ঢোঁক আপনাআপনিই নেমে গেল গলা বেয়ে।
কম্পিত চোখের পাতা নিষিদ্ধ একটা জায়গা থেকে সরিয়ে নিলো রাত্রি।নিভ্রান অনুরোধ করলো,
—“আসুন না রাত।একবার অন্তত এভাবে ভিজে দেখুন।খারাপ লাগলে আর কখনো বলবোনা।”বলে নিজের ভেজা হাতটা রাত্রির হাতটা মুঠোয় টেনে নিলো।ঠোঁট কামড়ে ধরলো রাত্রি।নিজের সাথে হার মেনে নেমে এলো নিভ্রানের হাত ধরে।বৃষ্টি যেনো এই রুপবতীর অপেক্ষাতেই ছিলো।তার দেখা পেতেই সে তেজ বাড়িয়ে দিলো।শুরু হলো ভারি বর্ষণ।সারা গা সেই পানির আলিঙ্গনে কুঁকড়ে গেলেও ভারি জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া রাত্রির সুপ্ত চন্চল মনটা জেগে উঠলো খুব নিভৃতে।
দুহাতের আজলা সামনের দিকে মেলে বৃষ্টির পানি মুঠোবন্দি করতে করতে ধীরগতিতে চোখ বুজল সে।
নিভ্রান চেয়ে রইলো একদৃষ্টে।মনে হচ্ছে,এই অপরূপ দৃশ্যটা প্রাণভরে দেখতে না পারলে হয়তো তার পুরো জীবনটাই ব্যর্থতার কাতারে শামিল হবে।
রাত্রি যখন চোখ খুললো তখন নিভ্রান সটান হয়ে শুয়ে আছে পিচঢালা রাস্তায়।চোখদুটো একাধারে নিবদ্ধ ভেজা গায়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠা রাত্রির মেয়েলি দেহের গড়নে।বৃষ্টির অবিশ্রাম আঘাতও সেই চোখজোড়া বন্ধ করাতে পারছেনা।রাত্রি খেয়াল করলোনা সেই চাহনী।করলে হয়তো লজ্জায় মুঁচরে যেতে দুইমিনিটও লাগতোনা।
নিভ্রানকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে চোখমুখ বিশ্রিভাবে কুঁচকে ফেললো সে।তাঁড়া দিলো,
—“এমা,এভাবে কেউ শুয়ে পড়ে নাকি?উঠুন।ময়লা লাগবে গায়ে।”
কপালে রাখা হাতটা সরাল নিভ্রান।আরো একটুক্ষণ রাত্রিকে অন্যচোখে দেখে নিয়ে আচমকাই তার হাতে সজোরে টান দিলো।বেসামাল হয়ে ধপ করে নিভ্রানের পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো রাত্রি।কিছু বলার আগেই নিভ্রান মোহাচ্ছন্ন গতিতে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিলো গলার পাশটা।কেঁপে উঠলো রাত্রি।কম্পমান ঠোঁটজোড়া একটার সাথে আরেকটা লেগে গিয়ে দ্বিগুন হারে কম্পিত হতে লাগলো।
নিভ্রান আবারো টান দিলো।একহাতের তালু রাস্তায় মেলে সেই তালুর উপর রাত্রি মাথাটা সযত্নে রাখলো।রাত্রি আচমকাই নিস্তব্ধ।এ কি স্বর্গীয় সুখ!উপরে খোলা আকাশ।মাঝরাস্তায় শুয়ে থাকা সাথে মাথার পিছে এক ভরসা পূর্ণ হাত।আর কি চাই?
—“চোখ বন্ধ করুন।একটু নি:শব্দে অনুভব করুন এই মাতাল শব্দ,কাঁচা মাটির গন্ধ,প্রকৃতির জলছন্দ।আপনি প্রেমে পড়তে বাধ্য রাত।”নিভ্রানের জড়ানো কন্ঠ।
রাত্রি চোখ বুজলো।মুখের উপর সরাসরি পানি পড়ছে। নিশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হওয়ার মাথাটা কাত করে ফেললো সে।নিভ্রান আচানক প্রশ্ন করলো,
—“আপনি কখনো কাউকে ভালোবাসেননি?”
রাত্রি সময় নিলো।অত:পর গলায় স্বপ্নবিলাসী ভাব নিয়ে মিষ্টি স্বরে বললো,
—“এখন অবধি না।তবে বাসবো,আমি পবিত্রভাবে যেই মানুষটার হবো তাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবো।”
প্রেমের গন্ধে পরিপূর্ণ সতেজ প্রকৃতি।নিভ্রান রাত্রির উপর ঝুঁকে গেলো।আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল গলিয়ে নরম হাতটা চেপে ধরলো রাস্তার সাথে।চমকে চোখ মেললো রাত্রি।ঘাড় সোজা করে তাকালো।এখন আর বৃষ্টির ফোঁটা তাকে ছুঁতে পারছেনা।নিভ্রানের মুখ তার মুখ বরাবর।রাত্রির বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে।ঘন থেকে ঘন হয়ে আসছে শ্বাস-প্রশ্বাস।নিভ্রান আরো ঘনিষ্ঠে আসলো।রাত্রির কাঁধের পাশটায় উত্যপ্ত নিশ্বাসের বহর ছড়িয়ে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বললো,
—“এই বৃষ্টি সাক্ষী রইলো,আপনি শুধু আমার হবেন রাত।”
~চলবে~