#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৪
” হৃদি হা করো সোনা। খাবারটা খেতে হবে তো। ”
দিনমণির কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। নিজ ঘরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে হৃদি। নিষ্পলক তাকিয়ে জানালায়। শূন্য চাহনিতে দেখছে বাহ্যিক সৌন্দর্য। অনুভব করছে পাখিদের মধুরতম গুঞ্জন। পুরো ঘর জুড়ে পাখপাখালির গুঞ্জন। এছাড়া নীরবতা ঘিরে দু মানব-মানবীকে। হৃদি’র বিপরীত দিকে বসে ইরহাম। পড়নে বাহিরে যাওয়ার পরিপাটি পোশাক। হাতে প্লেট। তাতে রয়েছে পুষ্টিকর খাবার। রোজকার মতো আজও স্ত্রীর ভোজনের দায়িত্ব নিয়েছে সে। কতক্ষণ ধরে খাবার হাতে বসে। কিন্তু মেয়েটির তাতে খেয়াল রয়েছে কি? সে তো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বাহিরে। আদৌও কিছু শুনেছে? দিনকে দিন কেমন প্রাণহীন মানবীতে পরিণত হচ্ছে। যে শুধু নামমাত্র জীবিত। চলছে শ্বাস প্রশ্বাস। কিন্তু প্রাণবন্ত-উচ্ছল রূপটি হারিয়ে সাত সাগরের ওপারে। উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত সে। ইরহাম আরো একবার হৃদির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। লাভ হলো না। কোলের ওপর প্লেটটি রেখে বাঁ হাতে স্ত্রীর মুখখানি নিজের পানে ঘুরিয়ে আনলো। চোখে চোখ পড়লো দু’জনার। নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে হৃদি। সে চাহনিতে নেই কোনো অনুভূতি, ভালোবাসার ছাপ। লহমায় হুঁ হুঁ করে উঠলো কাঠিন্যতায় মুড়িয়ে রাখা বুকের ভেতর। ফাঁকা হলো হৃদ সাম্রাজ্য। জ্বালা হচ্ছে দু চোখে। তবুও নিজেকে সামলে অনিচ্ছুক মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে তুললো অধরকোলে। মানুষটি মিহি স্বরে স্ত্রীকে বললো,
” তুমি না খেলে বাবুরা ক্ষুধার্ত থাকবে যে সোনা। একটুখানি খেয়ে নাও। তুমি না ওদের মা? ”
” মাহ্! ”
অস্ফুট স্বরে আওড়ালো হৃদি। কতগুলো ঘন্টা বাদে কিছু বললো। উজ্জ্বল মুখে মাথা নাড়লো ইরহাম,
” হ্যাঁ। দুই দুইটা বাবুর মা তুমি। কত দায়িত্ব তোমার বলো তো। না খেয়ে থাকলে চলবে? এবার হা করো তো। হা। ”
নিয়ন্ত্রিত রোবটের ন্যায় আস্তে ধীরে অল্প মুখ খুললো হৃদি। যত্নবান স্বামীর ন্যায় মুখে খাবার তুলে দিলো ইরহাম। চামচে করে ভরে নিচ্ছে পুষ্টিকর সবজি খিচুড়ি। খাইয়ে দিচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে। চুপটি করে কিছুটা খেয়ে নিলো হৃদি। আরেকবার মুখের কাছে চামচ তুললে হৃদি মুখ খুললো না। শক্ত হয়ে বসে। সে আর খাবে না এটাই বোঝাচ্ছে। কিন্তু এটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। গর্ভবতী সে। এসময়ে পাখির মতো একটু একটু করে খাওয়া চলবে না। বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। তাই অনড় হয়ে বসে ইরহাম।
” হা করো। আরেকটু খেতে হবে। এমন করে না। তুমি না ভালো মেয়ে? ”
” খাবো না। ”
ক্ষীণ স্বরে জানালো হৃদি। ইরহাম আদুরে কণ্ঠে বললো,
” আমাদের বাবুর তো পেট ভরেনি। ওরা এখুনি কেঁদে উঠবে। তুমি মা হয়ে সেটা সহ্য করতে পারবে? ”
কতকাল নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। এরপর আস্তে ধীরে নিজে থেকেই ছোট্ট হা করলো। কিন্তু মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে কতটা অসন্তুষ্ট। ইরহাম ব্যথাতুর হাসলো। ছোট্ট অথচ অর্থপূর্ণ শব্দ ‘মা’ তে বড্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে ওর হৃদরাণী। এই একটি শব্দ দিয়েই ওকে বাগে আনা যায়। বোঝানো যায়। অন্যথায় কেমন জীবন্ত লা”শের ন্যায় আচরণ করে। স্থির, নিশ্চুপ, অসাড় তার হৃদি। হৃদয়হীনা এ মেয়েটি কি জানে তার এই ভিন্নতর রূপ কারোর বুকে কতখানি র-ক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে! জানে না। জানলে কখনোই এমন বদলে যেতে পারতো না। স্বামী নামক মানুষটির জন্য হলেও নিজেকে সামলে রাখতো। সুস্থ থাকতো। এমন নির্দয়া হয়ে নয়। ইরহাম যত্ন করে স্ত্রীকে খাবার খাইয়ে দিলো। নিজে গ্লাস ধরে পানি পান করতে সহায়তা করলো। অতঃপর ন্যাপকিনে মুছে দিলো মুখ। এঁটো প্লেট হাতে উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। রোজকার মতো ঘর হতে প্রস্থানের পূর্বে স্ত্রীর ললাটে স্নেহময় চুম্বন এঁকে দিলো। প্রস্থানের পূর্বে টেরও পেল না এ স্নেহময় পরশে কিঞ্চিৎ প্রসারিত হয়েছে নিষ্প্রভ মেয়েটির অধরকোণ।
.
বদ্ধ এক ঘর। নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় বলিষ্ঠদেহী মানুষটি। দু কানে নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন। নভোনীল চক্ষুদ্বয় আড়াল হয়েছে সেফটি গ্লাসের আবরণে। পড়নে রোজকার থেকে ভিন্ন পোশাক। শুভ্র রঙা টি-শার্ট আঁটোসাঁটো ভঙ্গিতে চেপে বসেছে দেহে। ফুলেফেঁপে উঠেছে দু হাতের বলিষ্ঠ পেশি। পেশিবহুল-তাগড়াই দু হাত, গলা ঘাড়ের ত্বকের উপরিভাগে স্পষ্টত দৃশ্যমান শিরা উপশিরা। নিম্নে কৃষ্ণবর্ণ কটন জগার (jogger). সম্মুখে নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধানে স্থাপিত শুটিং টার্গেট বোর্ড। তেজী-শক্তিশালী গ্রিপ আঁকড়ে ধরে পিস্তল। সেফটি গ্লাসের আড়ালে লুকায়িত চক্ষুদ্বয়ের শাণিত-জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নিবদ্ধ একেবারে টার্গেট বোর্ডের কেন্দ্রস্থল বরাবর। অতঃপর লোড, এইম, ট্রিগার পুশ। সশব্দে একের পর এক বু লে ট বি’দ্ধ হচ্ছে শুটিং বোর্ডের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। ক্ষি প্র মেজাজে একের পর এক গু-লি বিদ্ধ করে চলেছে ইরহাম। ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে বোর্ডের কেন্দ্র। চৌধুরীর সম্পূর্ণ মনোযোগ ওই শুটিং বোর্ডের কেন্দ্রে। যেন সেথায় স্বশরীরে দাঁড়িয়ে রুদ্রনীল। এফোঁড় ওফোঁড় হচ্ছে ওই প”শুটার চওড়া ছাতি। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে র-ক্তের পর র ক্ত। প্রতিশো”ধের নে-শায় মত্ত মানুষটি এক ম্যাগাজিন খালি হতে না হতেই ভরে নিচ্ছে আরেক ম্যাগাজিন। দ্রুত ওঠানামা করছে বুক। তবুও অটল নিশানা। সম্পূর্ণ কম্পনমুক্ত দু হাতে চলছে ট্রিগারের খেলা। কোনোরূপ বাঁধাবিপত্তি বিহীন পরপর ছয়টি ম্যাগাজিনের ছত্রিশটি বু লে ট বি”দ্ধ হলো একদম নিশানা বরাবর। সব কয়টি শুটিং বোর্ডের কেন্দ্রে গেঁথে গেল। ফোঁস করে দম ছাড়লো মানুষটি। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সব কয়টি বু লে ট নিশানায় বিদ্ধ হয়েছে। সেফটি গ্লাসের মধ্য দিয়েই পাশে তাকালো ইরহাম। অগ্নিতেজা দু চোখ যেন অদৃশ্য ইশারায় জানতে চাইলো,
‘ সফলকাম হয়েছি কি? ‘
মাঝবয়সী প্রশিক্ষক মানুষটি তখন প্রসন্ন বদনে ওর পানে তাকিয়ে। ওনার এই নব্য শিষ্যটির মধ্যে আলাদাই এক স্ফু’লিঙ্গ রয়েছে। যা লহমায় দুনিয়া জ্বা’লিয়ে পু’ড়িয়ে দিতে সক্ষম। এর রাজনীতিতে না এসে আর্মিতে যোগদান করা উচিত ছিল। একজন আর্মি হবার সবরকম যোগ্যতা নিঃসন্দেহে এর মধ্যে বিদ্যমান। প্রশিক্ষক মানুষটি মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট। তবে মুখভঙ্গিতে তা প্রকাশ করলেন না। বরং রাশভারী কণ্ঠে বললেন,
” কাল নিউ চ্যালেঞ্জ থাকবে। বি রেডি। ”
শূন্য ম্যাগাজিনে ব্যস্ত অবস্থায় সম্মতি জানালো ইরহাম। মায়ের নি’র্মম মৃ ত্যু বদলে দিয়েছে সব। নিজেকে আরো শক্তিশালী, দক্ষ করে তুলতে শুটিং শিখছে মানুষটি। নিজের নামে নিয়েছে লাইসেন্স করা এক পি স্ত ল। শত্রুর মোকাবেলায় শুধুমাত্র শুটিং নয়, এছাড়াও বহু পূর্বে শেখা ‘ক্রভ মাগা’ কৌশলটিও আরো উন্নত রূপে ঝালাই করে নিচ্ছে। সর্বরূপে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত হচ্ছে চৌধুরী। বুঝিয়ে দেবে প্রতিপক্ষকে সে-ও কম নয়। ভুল করেও যেন হেয় প্রতিপন্ন না করে। তাহলেই জীবনের অন্যতম বড় একটি ভুল করে বসবে। কেননা বদলেছে চৌধুরী। বদলেছে খেলার ধরণ। এখন খেলা হবে সমানে সমানে।
অ্যান এক্সাইটিং গেম ইজ অ্যাবাউট টু স্টার্ট স্যুন।
•
ইরহামের বিশ্বস্ত খোচর’রা পুরোদমে খোঁজ করে চলেছে জহিরের। মায়ের মৃ ত্যু যার হাতে হয়েছে তাকে কি করে ছেড়ে দেবে চৌধুরী? যেকোনো মূল্যেই ওই জহিরের খোঁজ চা-ই চাই। সে যে এখনো ভুলতে পারে না ওই সিসিটিভির দৃশ্য। সে বি-ভৎস রাতে আনন্দাঙ্গনের পেছনের অংশ দিয়ে পলায়ন করেছিল শত্রুরা। জহিরের কলার চেপে ধরে পালাচ্ছিল একেকটা ন*রাধম। বাড়ি হতে বেশ দূরের একটি সিসি ক্যামেরায় সে দৃশ্য ধারণ হয়। শত্রুরা ভাবেনি অবেলায় এভাবে পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে হবে। তারা তো পরিকল্পনা মোতাবেক সামনের সদর দরজা দিয়ে বীরদর্পে প্রস্থানের চিন্তায় মগ্ন ছিল। অকস্মাৎ ইরহামের আগমন সব ভণ্ডুল করে দিলো। হৃদি’কে মা-রতে তো পারলো না। উল্টো ম-রলো মালিহা। পালাতে বাধ্য হলো শত্রুরা। তবে তাদের অগোচরেই জহিরের অনাবৃত মুখটি ধারণ হলো ‘আনন্দাঙ্গন’ হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত এক এটিএম বুথের সিসি ক্যামেরার যান্ত্রিক চোখে। তবে মুখাবয়ব স্পষ্ট ছিল না। ইরহাম পুরোদমে বিশ্বাসী ছিল ওটা ওর নরাধ-ম মামা জহির। শুধুমাত্র নিশ্চিত হবার দরকার ছিল। সেটাও একসময় হয়ে গেল। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে থেরাপি চলাকালীন সম্মোহিত হৃদির মুখনিঃসৃত হলো ‘মামা’ শব্দটি এবং এলোমেলো কিছু শব্দ। ব্যাস। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। ইরহাম বুঝে গেল সে রাতের সেই বিভীষিকাময় মুহুর্তে উপস্থিত ছিল জহির আহসান। চোখের সামনে ছোট বোনটাকে ম-রতে দেখেছে। তবুও বাঁচানোর কোনোরূপ চেষ্টা করেনি। হয়তো নিজেও জ্ঞাত বা অজ্ঞাত আঘাত করেছে। ওই পশুটাকে সে ছাড়বে না। এই তেজস্ক্রিয় স্পৃহা আরো শক্তিশালী-তুফানি রূপ নেয় কয়েক রাত পূর্বে। ঘুমের ঘোরে অবিরাম এলোপাথাড়িভাবে ছটফট করছিল হৃদি। মামার নাম ধরে আকুতিমিনতি করছিল। অত্যন্ত বিষন্ন সেই মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে গেল জহির দ্বারা প্রথম আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে ওর মমতাময়ী মা। এতেই আ-গ্নেয়গিরি জ্ব’লে উঠলো হৃদ গহ্বরে। আরো উ ন্মা দ হলো ইরহাম। যে করেই হোক ওই জহিরকে তার চাই। অ্যাট এনি কস্ট।
সে-ই থেকে চলছে খোঁজ। এখন অবধি তেমন কোনো খবর মেলেনি। তবে আশাবাদী ইরহামের বিশ্বস্ত খোচর’রা। তারা কোনোমতেই ‘ভাই’কে নিরাশ করবে না। শত্রু হায়েনার খোঁজ এনেই দেবে।
•
গর্ভকালীন সাত মাস চলছে। ইদানিং হৃদির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎই প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়ে মেয়েটা। সাইকোথেরাপি নিতে অনীহা প্রকাশ করে। তখন ওকে সামলানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। ফারহানা আজকাল প্রায়ই ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ আসা-যাওয়া করছেন। মেয়ের দেখভাল করছেন। গর্ভবতী মেয়ের এই দুরবস্থা ওনাকে প্রতিনিয়ত কাঁদিয়ে চলেছে। তখন অশ্রুসিক্ত ফারহানা’কে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে পল্লবী। পল্লবীরা সপরিবারে এখন এ বাড়িতেই থাকেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এই বাড়ির বিমর্ষ লোকগুলোর খেয়াল রাখতে এ বাড়িতেই থাকছেন পল্লবী, রাহিদ, ইনায়া, রায়না। পাশাপাশি হৃদির যত্ন নিচ্ছেন। রাজেদা খানম আগের চেয়ে শারীরিক ভাবে সুস্থ। তবে মানসিকভাবে বেশ বি-ধ্বস্ত। এজাজ সাহেব তো দিনরাতের বেশিরভাগ সময় গৃহবন্দি থাকছেন। তখন কোম্পানির হাল ধরতে হয় ইরহামকে। ইরহামের ওপর আজকাল বেশ চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও অটুট মনোবলের সহিত যথাসাধ্য সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে দৃঢ়চেতা মানুষটি।
সন্ধ্যা সাতটা বেজে দশ মিনিট তখন। নিত্যদিনের চিত্র অনুযায়ী আকস্মিক উত্তেজিত হয়ে পড়েছে হৃদি। জোরে জোরে পড়ছে শ্বাস। মানসিক অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলছে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাঁ হাতে চেপে ধরলো ভারী উদর। লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে মুখমণ্ডলে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ঘাবড়ে গেল পল্লবী, ইনায়া। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে গেল ওর সন্নিকটে। হৃদি তখন অনবরত স্বামীর নাম জপ করে চলেছে। অস্ফুট স্বরে ডাকছে। কাঁদছে। পা-গলামি করছে। ইনায়া, পল্লবী কোনোমতেই ওকে শান্ত করতে পারছে না। আরো উ-ন্মাদনা প্রকাশ করছে মেয়েটা। রাজেদা খানম স্বল্প দূরত্বে সোফায় বসে। দুর্বল দেহে একাকী উঠতে পারছেন না। বয়স ও দুঃখের ভারে ভঙ্গুর নারীটি অশ্রুসজল নয়নে দেখছেন নাতবৌয়ের দুরবস্থা। উনি কাঁদছেন। স্রষ্টাকে ডাকছেন। হৃদির অবস্থা তখন অনিয়ন্ত্রিত। ছটফট করে চলেছে মেয়েটা। উদরে যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীকে ডাকছে। কোথায় মানুষটা? ওকে একা ফেলে কোথায় গেল? সে-ও কি তবে ফাঁকি দিয়ে পালালো! অশান্ত হৃদি’কে কোনোমতেই শান্ত করা গেল না।
বাধ্য হয়ে ইনায়া ফোন করলো ভাইকে। প্রথমবার সংযোগ স্থাপন হলো না। দ্বিতীয়বারের বেলায় ফোন রিসিভ করলো ইরহাম। সালাম দিয়ে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে শুধালো,
” কি হয়েছে ইনু? হৃদি। হৃদি ঠিক আছে তো? ”
” ভাইয়া তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো বাসায় আসো। ভাবী আবার পা গলামি করছে। তোমাকে খুঁজছে। আমরা কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না। তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো। ”
কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিল ইরহাম। স্ত্রীর দুরবস্থা শোনা মাত্রই হট করে উঠে দাঁড়ালো। চমকালো উপস্থিত সকলে! সম্প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করা বসের হঠাৎ কি হলো? উনি তো এভাবে হুটহাট মিটিং ত্যাগ করার মানুষ নন? তবে? উপস্থিত সকলের মনোভাবে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো না মানুষটি। বরং বিশ্বস্ত-বয়স্ক ম্যানেজার সাহেবকে কোনোরূপ বুঝিয়ে শুনিয়ে কনফারেন্স রুম থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। অবাক নেত্রে এ অভাবনীয় দৃশ্য অবলোকন করলো সকলে!
করিডোর ধরে ব্যস্ত পায়ে ছুটে চলেছে ইরহাম। কানে ঠেকে স্মার্টফোন। ওর পানে চমকিত নেত্রে তাকিয়ে স্টাফরা! তাদের অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলেছে মানুষটি। ফোনের ওপাশে তখন হৃদি। ক্রন্দনরত কণ্ঠে ওকে আসতে বলছে। আকুতি জানাচ্ছে। এপাশ হতে আকুলতার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ আদুরে গলায় বলে উঠলো ইরহাম,
” আর একটুখানি অপেক্ষা করো। আমি এক্ষুনি আসছি জান। ”
” তু-মি এক্ষুনি আসো। কোথায় তুমি? আসো। আমার একটুও ভালো লা-লাগছে নাহ্। ”
ক্রন্দনরত সে মেয়েলি কণ্ঠস্বর বুকের মাঝে তীর বিদ্ধ করছিল। এলিভেটরে প্রবেশ করে আরো আদুরে স্বরে বলতে লাগলো ইরহাম,
” এই তো সোনা। কাঁদে না। আমি আসছি তো। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। শরীর খারাপ করবে তো। আর কাঁদে না। হুশশ্! ”
.
তমসায় আবৃত ধরিত্রী। বিছানায় শায়িত মেয়েটি। মগ্ন নিদ্রায়। পাশেই বসে বিমর্ষ স্বামী। পরম যত্নে স্ত্রীর ডান হাতের ক্ষততে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। পাশেই দাঁড়িয়ে পল্লবী, দুঃখিনী ইনায়া। অয়েন্টমেন্ট লাগানো শেষে ইরহাম নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো স্ত্রীর পানে। ওর ভেতরকার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছিলেন পল্লবী। তাই তো ভাগ্নের কাঁধে ভরসার হাতটি রাখলেন। ইরহাম স্ত্রী হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো না। সে অবস্থাতেই আনম্র স্বরে বললো,
” আমি ঠিক আছি। ”
কণ্ঠে মিশে বড় ক্লান্তি। ক্রন্দনে ভেঙে পড়লো ইনায়া। ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর হতে। পল্লবী তাকিয়ে ওই বিষন্ন মাখা মুখে। আর কত সহ্য করবে?
‘ ইয়া আল্লাহ্! তুমি ছেলেটাকে আরো ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করো। ‘
মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে সেথা হতে প্রস্থান করলেন পল্লবী। খানিক বাদে উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। যথাস্থানে অয়েন্টমেন্ট রেখে আটকে দিলো দ্বার। পোশাক নিয়ে অগ্রসর হলো ওয়াশরুমে। ক্লান্ত দেহ মুখিয়ে রয়েছে একটুখানি সতেজতার জন্যে।
নিদ্রায় তলিয়ে হৃদি। টেরও পেলো না তার দুরবস্থা কতখানি র-ক্তাক্ত করছে একান্ত পুরুষটিকে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে মানা। তারা পটু দুঃখময় অনুভূতি লুকোতে। কোথায় সেই চিরচেনা বাক্যের সত্যতা! আজ এ মুহূর্তে স্ত্রীর উঁচু উদরে মাথা ঠেকিয়ে বসে ভগ্নহৃদয় মানুষটি। আকুল স্বরে বলে চলেছে তার সন্তানদের,
” তোমাদের মা’কে একটু ঠিক হতে বলো সোনা। ওর এই কষ্ট যে আমাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। আমি তো এই হৃদি’কে চিনি না। এ তোমাদের মা হতে পারে না। আমার হৃদি তো ছিল নদীর মতো উচ্ছল। প্রাণবন্ত। যার হাস্য কলরব আমার পাথর কঠিন হৃদয়ে ধুকপুক ধ্বনির আগমন ঘটাতো। যার অবিরাম কলতানে ধন্য হতো আমার কান। আমার হৃদি এত দুর্বল ছিল না। ছিল না। ”
বাকশূন্য হয়ে পড়ছে মানুষটা। লৌহকঠিন রূপ ধারণ করতে করতে ক্লান্ত সে। ঝাঁপসা দু চোখে জমে অশ্রু কণা। সন্তানদের সন্নিকটে বসেছে বিচারের ঝুলি নিয়ে। কাঁদছে সে। সহ্য করতে পারছে না স্ত্রীর দৈন্যদশা। আর কত? এবার তো একটু স্বস্তি মিলুক। ঘুমন্ত হৃদির বক্ষদেশে মাথা এলিয়ে রাখলো ইরহাম। পরম শান্তির স্থলে চোখ বুজে নীরব রোদনে লিপ্ত সে। বদ্ধ অক্ষিকোল বেয়ে এক ফোঁটা দু ফোঁটা করে করে ঝরে যেতে লাগলো ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বোঝ। অশ্রুরা চিনে নিতে লাগলো তাদের ক্ষণিকের ঠাঁই। ভিজে যেতে লাগলো হৃদির বুকের উপরিভাগ। হালকা করে ছেড়ে রাখা নিজস্ব ভর। ক্রন্দনে লিপ্ত মানুষটি তবুও খেয়াল রেখে যাচ্ছে তার দ্বারা আর একফোঁটা আঘাত না পাক হৃদরাণী। ভালো থাকুক সে। সুস্থ থাকুক। ওই মিষ্টি অধরকোলে সদা অটুট থাক খুশির ছোঁয়া।
চলবে.
[ চমক থাকছে পরবর্তী পর্বে। বি রেডি এভ্রিওয়ান 🖤 ]
গল্প সংক্রান্ত মতামত পেশ করতে জয়েন করুন আমাদের গ্রুপে 👇
Fiction World By Taheerah