সত্ত্বাহীন_আমরা #পর্বঃ২ #বর্ষা

0
205

“বড় আপা ও বড় আপা মইরা গেলাম গো আপা!”

আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম।রহিমের অস্পষ্ট বেদনাধ্বনি যখন আমার কর্ণকহুরে প্রবেশ করে তখন আমি লাফিয়ে উঠে।রহিমা দেখছি মাথায় জলপট্টি করছে।মাঝরাত অব্দি রাহেলা,রেহানাকে নিয়েই বসেছিলাম।তাই হয়তো দেরি হয়েছে।ঝটপট বিছানা ছেড়ে ভাইয়ের কাছে ছুটে আসলাম।মেঝেতে পাটির ওপর শুয়ে আছে সে।আমি রেহানাকে বলে রহিমকে বিছানায় তুললাম।গায়ে হাত দিয়ে যেন আঁতকে উঠলাম।ছেলেটার যে বেশ জ্বর।

“ঝর্ণা ও ঝর্ণা!”

হঠাৎ মেজ মামার ডাক কর্ণকহুরে প্রবেশ করতেই বাইরে আসলাম। বারান্দার এসে দাঁড়িয়েছেন সে মাত্রই। জৈষ্ঠ্য মাসের শুরু হয়েছে।বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি।আমাকে দেখেই মেজ মামা রাগান্বিত চোখে বললেন,

“ঝর্ণা তোর মামারা কি মইরা গেছে?তোর আব্বায় তোগো লিগা সৎ মা আনছে আর তাও তোরা আমগো কিছু জানাস নাই।ওই হারাম*** মনে হয় ভুইলা গেছে কেমনে আমগো কাছে তোর মায়রে বিয়া করতে চাইছিল!যা তোগো জামা কাপড় গুছা।আইজই তগো নিয়ে যামু আমি।”

মামা কথাগুলো দাঁতেদাঁত চেপে বলছিলেন।আমি তখন মামার বলা সহানুভূতিশীল কথাগুলো শুনছিলাম। মনে পড়ে গেল কুদ্দুসীর বলা কথাগুলো।মা মরার পর মামায় তাদের ভাই-বোনদের নিয়ে গিয়েছিলো।হায়, ভাগ্য সহায় ছিল না। অত্যন্ত ভালোবাসার সাগরে ভেসে যাওয়া মামীও নাকি কুদ্দুসীদের জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছিলো।

“না মেজ মামু তা হয়না।আমগো আব্বা এখনো বাইচ্চা আছে।আমার ভাই-বোনেরা আব্বার কাছেই থাকবো।আর তুমগো বাড়ি তো পাশের গ্রামেই।ওরা দিনে ঘুইরা আইতে পারবোই!”

“ঝর্ণা তুই…”

“মামু তোমার বাড়ি যাইয়া মাইনসের কাছে ওগো ছোট হইতে হইবো।এর চায়ে আব্বার কাছেই থাকুক।কষ্টে থাকলেও আব্বার কাছে এইডা জাইনা শান্তিতে থাকবো।আর মামু আমার ভাই-বোনেরা এইহান থেকেই শিখতে পারবো মা মরলে সন্তানের পরিস্থিতি কেমন হয়!ওরা ওদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হবে!”

মেজ মামার আক্রোশ যেন ক্রমেই নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে গেল।তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“মারে তুই বড় হইয়া গেছোস!বড়দের মতো ভাবতাছোস!”

আমি মুচকি হাসলাম।আপন মনেই বললাম,

“মা মরলে একটা ছোট বাচ্চাও যখন প্রাপ্তবয়স্কের মতো আচরণ করতে পারে সেখানে আমি তো কারো মা হতে যাচ্ছি।”

কথাটা বলে মামার থেকে বিদায় নিয়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হতে নিতেই দেখতে পেলাম আমার সৎ মা মাথা মুছতে মুছতে পাশের ঘরের দিকেই গেলেন।আমার পাশে তৎক্ষণে রেহানা এসে দাঁড়িয়েছিল।রেহানা তার বাচ্চামনা কৌতুহল মেটাতে প্রশ্ন করেই বসলো,

“আপা নতুন আম্মা এতো সকালে গোসল করছে কেন?”

রেহানার প্রশ্নে আমি,মামা উভয়ে লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ করলাম না। মামা বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।আমি রেহানা প্রশ্নের জবাবে বললাম,

“নতুন আম্মার হয়তো অনেক গরম লাগতাছিল তাই এখন গোসল করছে। তুই এতো ভাবিস না।যাগগে দৌড়ে গিয়ে তুলসী চাচীকে নিয়ে আয় তো।”

তুলসী চাচি আমাদের গ্রামের একজন নামকরা বৈদ্য।তার হাতে জাদু আছে বটে। খুব শীঘ্রই গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিকেও সাড়িয়ে তুলতে পারেন এমনটাই ভাবনা অধিকাংশ গ্রামবাসীর।আমার কথায় রেহানা ছোটে।

“বড় আপা, নানী আমগো লিগা খাওন পাঠাইছে!আর তোমার লিগা শহর থাইক্কা এইডা আইছে।”

রোকেয়া হাতে মাঝারি সাইজের এক বোল নিয়ে ঘরে ঢোকে।ভোর হতেই মেয়েটা বেরিয়ে গিয়েছিল।এখন ফিরলো।ঝর্ণার বড্ড চিন্তা হয় মা মরা সন্তানেরা সৎ মায়ের সংসারে এভাবে টিকতে পারবে তো।

ঝর্ণা সবার পাতে খাবার তুলে দেয়। ভাইয়ের মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে সে।রহিম ঘুমিয়ে পড়েছে।ঝর্ণা কাঁথাটা আরো টেনে দেয়।জানালা দিয়ে বাইরে দেখে।থেমে যাওয়া বৃষ্টি যেন আবার শুরু হবে তারই পূর্বাভাস দিচ্ছে।ঝর্ণার চিন্তা হয় রেহানা ফিরতে পারবে তো।

রাজিব মিয়া পানের পিক ফেলে তার নতুন স্ত্রী উপমা বেগমের দিকে তাকালেন।এককালে এই রমনীই তার ছোট ছেলে রকিবুলের দুধমাতা ছিলেন।বছর দুয়েক আগে উপমার সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপরই সে সন্তানের মৃত্যু ঘটেছিল।স্বামী তাকে অপয়া,অলক্ষী বলে তালাক দিয়েছিল।গরীব ঘরের বৃদ্ধ পিতা-মাতার ঘরে আবারও বোঝা হয়ে ফিরেছিলেন তিনি।তার পর হঠাৎ একদিন রকিবুলের দুধমাতার জন্য তাকে নিয়ে আসা হয়।আর আজ সে রকিবুলের দুধমাতা থেকে সৎ মা।

ঝর্ণার সৎ নানী আয়েশার কারণেই হয়েছে এ বিবাহ।তিনিই ওর মামাদের আড়ালে রাজিব মিয়াকে বলেছিলেন,

“আমার নায়-নাতকুর ছোট ছোট।জামাই বাবা তুমি থাহো না বাড়ি সবসুম।কামের লিগা সদরেই তোমার দিনের বেশিরভাগ সময় যায়। তুমি পুলাপানডির লাইগা একখান বিয়া কর।”

প্রথমে রাজিব মিয়া রাজি না হলেও রকিবুলের জন্য বিয়েতে রাজি হন। কিন্তু পাত্রি পাবেন কোথায় এমন প্রশ্ন উঠে আসতেই বৃদ্ধা আয়েশা বলেন,

“আমগো রকিবুলের দুধমাতারেই নাহয় প্রস্তাব দিবা।আমগো রকিবুল তো এহন ওই মাইয়ার দুধ পান করে।এহন রকিবুলের দুধমাতা,তহন নাহয় তোমার বাকি পোলাপাইনের মা আর তোমার বউ হইয়া সংসার দেখবো। এমনেও গরীব মানুষ ওর বাপে।তালাক পাওয়া মাইয়ারে আর কতদিন পালবো!”

রাজিব মিয়া শাশুড়ির পরামর্শে প্রস্তাব প্রদান করতেই রাজি হয়ে যান জাফর আলী। শুক্রবার করে শুভ দিনটা বেছে বিয়েও হয়ে যায় ঘরোয়া ভাবে।

“আপনি আইজ সকালে কি খাইবেন?কি রানধুম?”

“তুমি বসো।আমি পুলাপানডিরে জিঙ্গাসা করে আসি ওরা কি খাইবো!”

“ওগো লিগা তো খাওন পাঠাইছে ওগো নানাবাড়ি থেইকা।আর সকাল পানে তো ওগো মামাও আইছিল।”

রাজিব মিয়া ছোট্ট করে জবাব দিলেন,”ওহ!”

“আপনি কি খাইবেন কইলেন না তো!”

“তোমার যা খুশী রাধো!”

বলেই বেরিয়ে গেলেন রাজিব মিয়া।আজ বহুদিন পর তিনি ঘাটের দিকে রওনা দিলেন।হয়তো বাজারে যাচ্ছেন।হাতে ছাতা ঝুলিয়ে নিয়েছেন তিনি।বৃষ্টি তো যখন তখন ঝুম করে ভাসিয়ে দিতে পারে।ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন পানি বেড়েছে।আগামী কয়েকদিন এমন টানা বৃষ্টি হলে বাড়ির ঘাঁটায় যাতায়াতের জন্য নৌকা বাঁধতে হবে।

তুলসী চাচী রহিমকে দেখে যেতেই আমি চিঠি পড়তে বসলাম।আমার ওনার চিঠি এসেছে।উনি আমায় সপ্তাহখানেক পরেই নিতে আসবেন।আগামী কয়েকমাস আমাকে আমার শশুরবাড়িতে রেখে আসবেন। সেখানে আমার আরেক আম্মা যে আছেন আমার দেখভালের জন্য তা ভেবেই তিনি নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমার হৃদয় অসন্তুষ্ট।কিভাবে থাকবে আমার সহোদরেরা এই ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে বেরতেই চায়না। হঠাৎ রেহানা বলে,

“আপা তুমি এতো কি ভাবতাছো?দেহো বাইরে কি সুন্দর বৃষ্টি হইতাছে!”

মাটির বাড়ির দোতলা এ বাড়িটা তাদের নানা তাদের জন্যই করে দিয়েছিল।নানার কাছে এ বাড়িটার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে না পারলেও অন্তত সন্তোষ ঝর্ণা।বাচ্চা থাকাকালীন মা-বাবার পাশের ঘরে সব ভাই-বোন গাদাগাদি করে থাকলেও বিয়ের পর আর তা সম্ভব হয়নি।তখন নানার থেকে প্রাপ্ত মাটির দোতলা এ বাসাই ছিল অতিথি আলয়। এখানেই থাকে এখন ওরা।মা মরার পর আর ও দু’ঘরের চৌকাঠ পেরোয়নি ঝর্ণা।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায় ভাই-বোনেরা।রহিম ঘুমে।আর রোকেয়া আর রাহেলা রহিমের ঘাটের পাশে বসে হাঁড়ি-পাতিল খেলছে।বয়সে বছর দুয়েকের ছোট হলেও রাহেলা খেলার সাথী হিসেবে রোকেয়ার নিকট বেশ।তবে মাঝে মাঝে ঝগড়া লাগলেই আড়ি হয়ে যায় ওদের।আড়ি ভাঙতে বড় আপা মানে ঝর্ণার প্রয়োজন ওদের বরাবরই হয়।

“ওই রাহেলা তুই আমার খাবার খাইলি কেন?”

“এহ,,,ওই আপা আমি তোর খাবার খাই নাই। তুই আমার পানি দিয়া রানদোস কেন?”

“ঢং করবি না রাহেলা। তুই যা এইখান থাইকা আমি খেলবো না তোর লগে!”

“আমি তো খেলার লিগা মইরা যাইতাছি।তোর খেলনা দিয়া আমিও খেলমু না।আব্বারে কইলে আমারও হাঁড়ি পাতিল কিন্না আইনা দিব। হুঁ!”

এই বলেই রাহেলা বাইরে যেতে নেয়।যেতে গিয়েও যায়না।ফিরে এসে রোকেয়া সব খেলনা লন্ঠভন্ড করে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে আরেক রুমে দৌড় লাগায়।

ইনশাআল্লাহ চলবে,

#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ২
#বর্ষা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here