#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ৮
#বর্ষা
জয় গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে সেদিন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বাসায় ফিরলেন যেদিন জ্যোতি গুলশানের নামকরা স্কুলে তার থেকেও বড় বড় ছেলেমেয়েদের সাথে প্রতিযোগিতা করে ভর্তির সুযোগ ছিনিয়ে নিল।দেখতে দেখতেই কেটে গেছে চার-চারটা বছর।আমার মাঝে আরেকটা প্রাণের তখন বসবাস। এতটুকু মেয়ে যেন আমার কষ্ট সব বোঝে। সারাদিন গার্মেন্টসে চাকরি করে বাসায় ফিরলেই মেয়েটা পানি এগিয়ে দেয়। থালাবাটি যেমন পারে ধুয়ে রাখে।কারো সাথে উগ্র ব্যবহার কারো সাথে করে না।রাস্তায় ভিক্ষুক দেখলে নানী বানিয়ে বাসায় নিয়ে আসে।আমিও বিকেলে এসে মেয়ের এসব কারবার দেখে যতটা না রাগান্বিত হই তার চেয়ে বেশি খুশি হই। মেয়ে আমার আনন্দ ভাগ করতে জানে।বছর দুয়েক আগে তৃশার বিয়ে দিয়েছে জয়। তাঁরই এক বন্ধু প্রথম দেখায় নাকি তৃশাকে পছন্দ করে নিয়েছিল।যেহেতু ভদ্রলোক এবং আমাদের তৃশা বিধবা তাই প্রথমে হচকচ করলেও পরে তৃশার ভবিষ্যৎ সুন্দর দেখে বিয়েটা দিয়েই দেয় জয়।
“আম্মু,আম্মু এই দেখো আমার স্কুল ড্রেস!”
“আম্মু আম্মু এই দেখো আমার নতুন বই।কি সুন্দর গন্ধ!”
“আম্মু ও আম্মু…”
কিছুক্ষণ থেমে থেমে জ্যোতি আমায় ওর স্কুল ড্রেস,বই,খাতা দেখাতে লাগলো। আমাদের সময় স্কুল ড্রেসের ওতো প্রচলন ছিল না। সেলোয়ার, কামিজ আর মাথায় ওরনা দিয়েই বই খাতা হাতে স্কুলে দৌড় দিতাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবই পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে সভ্যতা এবং জীবনধারা।
“আম্মা ও আম্মা..”
জয়ের ডাক শোনা মাত্রই জ্যোতি দৌড় দেয়।জয় মেয়েকে বাসায় রেখে আবারও অফিসে গিয়েছিল।আগের থেকেও তার বেতন বেড়েছে।ম্যানেঞ্জার পদেই আছে সে। নতুন অফিসে ঢুকেছিল।একটু দূরে তবে সমস্যা হয়না ওনার।জ্যোতি বাবার ডাকে বাইরে যাওয়ার আগে আমাকে বলে যায় যে,
“তুমি তো আমার কোনো কথাই শোনো না।আমার বাবা আমার সব কথা শুনে!”
দৌড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে।গ্লাসে পানি ঢেলে নেয়।আরেকহাতে নেয় গামছা আর লুঙ্গি।বাইরে গিয়ে নিশ্চিত বাবার হাতে এগুলো তুলে দিয়ে বলবে,
“বাবা বাবা যাও গোসল করে সুন্দর হয়ে আসো!”
আর জয়ও মেয়েকে আদর করে মেয়ের হাতের জিনিস নিয়ে গোসলে যাবে।যদি আজ বেতন পায় তবে তো কথাই নেই!চকলেট, বিস্কুট,মুড়ি এবং নিত্য প্রয়োজনীয় সব বাজারের ব্যাগ থাকবে ওনার হাতে।মেয়ের জন্য চুরি বা পায়েল বা কানের দুল বা জামা কিছু একটা তো আনবেই।মেয়েকে প্রতি বেতন পেলেই কিছু না কিছু কিনে সে দিবেই।
“ঝর্ণা?”
জয় মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে আসে।হাতে একটা ব্যাগ!নিশ্চিত নতুন জামা এনেছে!এখন আমাকে বলবে মেয়েকে জামাটা পড়িয়ে একটু সাজিয়ে দিতে।তারপর স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে ছবি তুলে আনবে।মেয়েকে পাশে বসিয়ে আমার ভাবনার কথাটাই সে বললো।আমি মেয়ের দিকে রাগী চোখে তাকাতেই সে ছিটকে দূরে সরে গেলো। কিছুক্ষণ আগে যে বদমাইশই না করেছে। রোকেয়া বেচারী ভয়ে এখন আরেকরুমে সেই যে ঢুকেছে ওভাবেই আছে।এখনো বের হয়নি।আমার সাথে কথা বলার আগে সে তার মনির কাছে গিয়েছিল।মনি তখন পড়ছিল।মনির বই খাতা নিতেই ধস্তাধস্তি করতে শুরু করলেই রোকেয়া কান্না করে দেয়।আমার দুষ্টু মেয়ে তা দেখে ভারী মজা নেয় এবং সবশেষে মনির গালে হঠাৎ করে কামড় দিয়ে দৌড় দেয়।তারপর আমি কিছুক্ষণ ঝেড়ে ছিলাম।আমাকে রাগ করতে দেখেই নানা কথা বলে সে এতক্ষণ আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছিল।
“বাবা আম্মু আমায় মারে!”
“এই বজ্জাত মেয়ে আমি কখন মারলাম তোরে?”
“এইতো মাত্রই চোখ দিয়ে কেমন করছিলে..”
“চোখ দিয়ে কি করছিলাম?”
জয় জানে তার মেয়ে কতোটা ঢংগী তাই সে মা-মেয়ের মাঝে না এসে চলে গোসল করতে চলে যায়। রোকেয়া কিছুক্ষণ পর এসে আমার পাশে বসে।আমি তখন জ্যোতিকে জামা পড়িয়ে মাথায় বেনুনি করে দিচ্ছিলাম।
“আপা জ্যোতি কি কোথাও যাইবো?”
“হুম।তোর দুলাভাই আইছে।মেয়ের জন্য আর এই নে তোর জন্য জামা আনছে।যা পড়ে নে। তারপর খালা -ভাগ্নি একসাথে ছবি তুলে আসিস।”
সপ্তাহ তিনেক হলো রোকেয়া এখানে। উপমা বেগমের বছর তিনেকের ছেলে রহমত রোকেয়া মাটির তৈরি সুন্দর সুন্দর শিল্পগুলো ভাঙ্গছিল। রোকেয়া কয়েকবার কোলে করে ওকে উপমা বেগমের কাছে রেখে আসলেও রহমত আমার ওখানে চলে আসতো।রোকেয়াও যেহেতু বাচ্চা মেয়ে।ওরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।বসিয়ে দেয় দুঘা।গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে ওঠে রহমত।উপমা বেগম ছুটে এসে ছেলেকে ধরেন।ছেলের দোষ আছে কিনা তা না দেখেই ইচ্ছে মতো পেটান রোকেয়াকে। ওখানে জ্ঞান হারায় রোকেয়া। আব্দুর রহিম স্কুল থেকে দুপুরে বাড়ির ঘাঁটায় রোকেয়াকে রক্তাক্ত এবং অজ্ঞান অবস্থায় পায়।সে ছুটে গিয়ে বোনকে ধরে।পাড়া-প্রতিবেশীর সহযোগিতায় সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।তাও অনেক দূর। পথিমধ্যে ওনাদের দেখা হয় রাজিব মিয়ার সাথে। রাজিব মিয়া মেয়ের এ অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হন।নয় বছরের রোকেয়ার মলিন মুখটা যেন আরও মলিন দেখায় রাজিব মিয়ার নিকট।মেয়েকে পাঁজাকোলা নিয়ে সে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান।ঘন্টাদুয়েকে রোকেয়ার জ্ঞান ফেরে।আব্বাকে কাছে দেখে যেন ও আরো বেশি ভয় পায়।কান্না জুড়তেই আব্বা ওখান থেকে সরে যান। রোকেয়া নিশ্চুপ হয়ে যায়।আব্বার হৃদয়ে দাগ কাটে এ ঘটনা। রোকেয়া আব্দুর রহিমের কোলেই বাসায় ফেরে।সেই প্রথমবার যেন তিনি উপমা বেগমের গায়ে হাত তোলেন।বলেন,
“হারাম** তোরে আমি আনছি আমার পোলাপাইনের দেখা শোনার লিগা।আর তুই ওগো খুন করার চেষ্টা করতাছোস!আজকে তুই শেষ!”
রাজিব মিয়া আরো একটা চড় মারতে যাবেন তার পূর্বেই রহমত এসে পড়ে।সেই যাত্রায় বেঁচে যায় উপমা বেগম। রাজিব মিয়া তার সন্তানদের সামনে কখনোই তার স্ত্রীকে মারবেন না এতে সন্তানেরাও তাই শিখবে বলেই ওনার ধারণা।
উপমা বেগম সেদিন বেঁচে গেলেও রোকেয়া আর সেই মারের প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি।আব্বা চিঠি লিখে জয়কে নিয়ে যায়। এবং জয়ের কাছে অনুরোধ করে মেয়েটাকে আগলে রাখার।জয় নিয়ে আসে রোকেয়াকে!আর তারপর থেকেই আমার মেয়ে আর বোনের দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক চলছে আরকি।
“কিগো জ্যোতির মা হইলো?”
“এইতো দুজনেই প্রস্তুত।”
“দুইজন কেন তিনজন না প্রস্তুত হওয়ার কথা ছিল?”
ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে জয়।আমার আজকে অনেক খারাপ লাগছে। প্রচুর ঘামছি। পাঁচ মাস চলছে।আর মাত্র তিনমাসের অপেক্ষা।আমি বললাম,
“আমার অনেক খারাপ লাগছে।আপনি ওদের নিয়াই যান!”
“কি হয়েছে দেখি?”
জয় ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমার মাথায়,গালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে।আমার দিকে তাকায় অর্থাৎ জ্বর তো আসেনি তবে!
“মাথাটা অসম্ভব ধরেছে!! আপনি ওদের নিয়া ঘুরে আসেন!আমি রান্ধা বসাই!”
“তোমার রানতে হইবো না আমি আসার সময় খাবার কিনা নিয়া আসমু!”
“শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে কি লাভ!আমি রান্ধা…”
“চুপ আমি যা বলছি তাই!এখন শুয়ে থাকো!”
জয় জ্যোতি আর রোকেয়াকে নিয়ে বাইরে চলে গেল। রোকেয়াও বিনাদ্বিধায় তার দুলাভাইয়ের সাথে গেল। রোকেয়া জয়ের কাছে নিঃসকোচে গেলেও রহিমার জামাইয়ের কাছেও ঘেঁষতে চায় না।রহিমা দুইবছর আগে আমাদের এখানেই থাকতো।মেয়েটা চাকরি করে কিছু টাকা আয়ের পরেই লোভী হয়ে ওঠে আরো টাকার জন্য।সে আর গ্রামে যায় না।পড়াশোনাতেও তার মন না থাকায় আব্বাও আর ওর চাকরি নিয়ে কিছু বলেনি। এভাবেই সাতমাস পারের পর একদিন এসে একটা পুরুষকে নিয়ে দাঁড়ালো।সে নাকি ওই ছেলেকে ভালোবাসে।ওর দুলাভাই অনেক রেগে যায় এবং পরদিন সকালেই ওকে গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।গ্রামে গিয়ে আব্বাকে বলতেই আব্বা দু’ঘা বসিয়ে দেয়।রহিমা শহরে পালিয়ে এসে ওই ছেলেকেই বিয়ে করে।বিয়ের পর আমাদের বাসায় আসলে জয় আমাকে রাগের বসে কষিয়ে এক চড় লাগিয়ে বলে,
“তোর বোনের সাথে যদি তুই সম্পর্ক রাখিস তাইলে আমি তোরে তালাক দিমু।আমার মান-সম্মান ঢুবাইয়া দিল তোর বইনে।আমার দায়িত্বেই তো ছিল,বয়স হইলে তো বিয়া দিতামই।এতো কিসের তাড়া ছিল তোর বইনের!”
সেদিনের পর আমাদের সাথে রহিমার যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও রহিমার জামাই গ্রামে গিয়ে সবাইকে নিজের পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হয়।আব্বার জন্য,আম্মার জন্য আর আমার ভাই-বোনদের জন্য এই সেই নিয়ে যায়।ফলে আব্বা মেনে নেয় ওদের।এতে জয় অনেক ক্ষিপ্ত ছিল।সে আমাকে বাপের বাড়ি যেতেও নিষেধ করে দেয়। দু’বছর হতে চললো আমি এখনো আমার বাপের বাড়ি কিংবা শশুর বাড়ি যাইনি। কিন্তু সেদিন যখন সেই মুমুর্ষ ঘটনার বর্ণনা আসলো জয় আর থেমে থাকেনি। নিজের তৈরি বিধিমালা নিজেই ভঙ্গ করে ছুটেছিল সেদিন সে।
রোকেয়া আসার পর ওর মুখ থেকেই রহিমার স্বামীর জুবায়েরের কথা শুনেছি।উপমা বেগমের সাথে নাকি সেই ভাব জুবায়েরের।তাইতো জুবায়েরকে রোকেয়ার একদম পছন্দ না।উপমা বেগমের মতোই অপছন্দের।
★
আব্দুর রহিম সরকারি বৃত্তি পেয়েছে। আব্বার মান কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।আব্বা আজ অনেক খুশি।আব্বা হাঁস ধরে রেখে গেলেন।উপমা বেগমকে হাস রানতে বললেন।তার ছেলে তার মান বাড়িয়েছে তাকে তো ভালো খাওয়াতেই হবে! রেহানা আর রাহেলা অনেক খুশি ভাইয়ের জন্য।তবে তাদের রোকেয়াকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে! রকিবুল ভাইয়ের নিকট এসে দাঁড়ায়।বলে,
“রোকেয়ার সাথে জ্যোতি পিচ্চি আসবো ভাইজান?”
রকিবুল রোকেয়ার থেকেই এই ডাক শিখেছে। রোকেয়া রকিবুলকে জ্যোতির কথা শুনানোর সময়ই বলতে আমাদের জ্যোতি পিচ্চি।তাই সেও বলে। বোনের নেওটা বোনকে ছাড়া অনেকদিন আছে। আব্দুর রহিমেরও ইচ্ছে করে বড় আপাকে দেখার আর রোকেয়াকে নিয়ে আসার। কিন্তু দুলাভাই যদি না চায় তাহলে যে সম্ভব না।তবুও আব্দুর রহিমের ইচ্ছে তার বড় আপা আসুক।তাকে সংবর্ধনা দেক।বড় আপার সাথে তো রোকেয়া আর জ্যোতিও আসবে।জ্যোতিকে নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরবে সে।
ইনশাআল্লাহ চলবে
(বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)