#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩৫

0
821

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩৫
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

তিনটে কালো কুচকুচে কাক লাইন ধরে কারেন্টের তারের উপর বসে আছে। গলা থেকে মাথার অংশটা কালো, ধূসর নয়। এগুলো সাধারণ কাক না, এদেরকে বলা হয় দাঁড় কাক। রাত্রি ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সূর্যের রশ্নি উপেক্ষা করেই সেদিকে তাকালো। বিষণ্ণার মতো চেয়েই রইলো অনেকক্ষণ, ছোটবেলায় বাবা বলতো দাঁড়কাক নাকি রাতের বেলা ভূত হয়ে যায়। বাসার ছাদে ঘুরে বেড়ায়। ড্রইংরুমের সোফায় শুয়ে থাকে। বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলে থাকে। সেই গল্প শুনে সবসময় দুষ্টামি ছেড়েছুড়ে চুপটি করে শুয়ে পড়তো সে। আর কোনোকিছুতে ছোটাছোটি থামানো না গেলেও এই দাঁড়কাকের ভয়ে সবসময় দমিয়ে রাখা যেতো তাকে। আর বাবা সেই সুযোগটাই সবসময় কাজে লাগাতে।

রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালের সবুজ বাতিটা লাল হলো। ভাবনা কাটিয়ে মানুষজনের হুড়মুড় মিছিলে যোগ দিলো রাত্রিও।
ভার্সিটি শেষে নিভ্রান রোজ গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আজকেও পাঠিয়েছিলো কিন্তু সে আবার পাল্টা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। রোজ রোজ ওই বদ্ধ বাহনে চড়ে শহর ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগেনা। জীবনে একটু হাঁটাহাঁটির প্রয়োজনও আছে। শরীরের হাড়ে মরিচা ধরে যাবে নয়তো। বৃদ্ধ হবার আগেই লাঠির সাহায্য লাগবে। কিন্তু ওই পাগলটা কি আর বুঝবে সেসব? নিশ্চিত একটু পর ফোন দিয়ে ধমকাধমকি করবে। সেজন্য আগেভাগেই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে সে। এখন পড়াতে যেতে হবেনা। স্টুডেন্ট সকালে জানিয়ে দিয়েছে তারা আজ বাসায় থাকবেনা কোথায় যেনো যাবে তাই রাত্রির ছুটি।
এবড়োথেবড়ো ধাক্কাধাক্কির মাঝেই একটা শক্ত হাত কোথথেকে যেনো এসে সেখান থেকে টেনে বের করে আনলো তাকে। রাত্রি হকচকালো। সামনের মানুষটার দিকে তাকানোর আগেই মনে মনে ঝাঁঝালো ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কত বড় সাহস! রাস্তার মাঝে হাত টানাটানি করে।
তার ধমক শুরু হবার আগেই হাতের মালিকের তুমুল বিরক্তিসূচক তিতা কন্ঠ শোনা গেলো,
—“ধ্যাত ভাবি, আপনাকে এই যুদ্ধ যাত্রা থেকে উদ্ধার করতে যেয়ে তো আমার সর্বনাশ হয়ে গেলো। ইহহি। ছিহ্। ইয়াক।”

রাত্রির হতভম্ব ভাবটা কাটলো না। নিশাদ দাড়িয়ে আছে। চোখমুখ অস্বাভাবিক। বিশ্রিভাবে কুঁচকানো। চোখের বাদামী শেডের রোদচশমার উপর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে চোখ কুঁচকে রেখেছে ছেলেটা। মাথার চুলে সাদা সাদা আঠালো পদার্থ। একহাতে রাত্রির হাত ধরে অপরহাতে রুমাল দিয়ে চুল মোছার চেষ্টা করছে সে।
রাত্রি হাল্কা ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,”ভাইয়া, আপনি..”বাকিটা শেষ হলোনা। নিশাদ খেঁকিয়ে উঠে বললো,

—“ওয়াক থু। ছিইইহ, ভাবি মুছেন এগুলা। ইয়াক! বমি পাচ্ছে আমার।”

রাত্রি একসেকেন্ড চেয়ে থেকে পায়ের পাতা একটু উঁচু করলো। রুমালটায় হাত দিয়ে বললো,
—” আপনি হাত সরান, আমি মুছে দিচ্ছি। কিছু হয়নি।”

নিশাদ হাত সরিয়ে নিজেই একটু ঝুঁকে দাড়ালো। রাত্রি ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে চুল পরিষ্কার করলো। নিশাদ ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে। রাত্রির হাতের বোতলটা ছিনিয়ে নিয়ে সে বললো,
—“এই মাঝরাস্তায় আমি শাওয়ার নিবো কিভাবে? আপনার কাছে কি একবালতি পানি হবে? নাকি এতটুকুই?”

রাত্রি জোরজবরদস্তি হাসি আটকিয়ে আস্তে করে বললো,”এতটুকুই।”

—“একটু পানি রাখবেন না সাথে? ধুরো, আচ্ছা পাবলিক টয়লেটে কি গোসলের ব্যবস্থা থাকে?”

রাত্রি চুলটা ভালোমতো মুছে দিয়ে হাত নামালো। রুমাল দেখিয়ে বললো,
—” গোসল করা লাগবেনা। এইযে দেখুন, সব পরিষ্কার হয়ে গেছে।”

নিশাদ একপলক তাকালো। পরমূহুর্তেই বমি করার ভঙ্গি করে বললো,
—“ওয়াক…ছি! ভাবি ছি! ফেলেন এটা। ধরে রেখেছেন কেনো? ইয়াক।”বলে নিজেই রাত্রির হাত ঝেড়ে রুমালটা রাস্তায় ফেলে দিলো। গড়গড় করে বোতলের অবশিষ্ট পানিটুকু রাত্রির দু’হাত মুঠো করে টেনে তার ওপর ঢেলে দিলো। তপ্ত গলায় বললো,

—“সাবান কিনে আনি দোকান থেকে। আসেনতো সাথে।”

রাত্রি বারণ করার চেষ্টা করলো। নিশাদ শুনলোনা। দোকান থেকে সাবান কিনলো। মিনারেল ওয়াটার কিনলো দু’তিন বোতল। রাস্তার ধারে দাড়িয়েই সাবান পানি দিয়ে হাত ধোঁয়ালো রাত্রির। নিজের চুলে ঢেলে দিলো পুরো একবোতল পানি। পুরো পাগলের ভাই বদ্ধপাগলের বেগতিক কাজকর্মে হতবিহ্বল হয়ে রইলো রাত্রি। সে কি নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছে? মাথা ঘুরাচ্ছে কেনো?
পানিটানি ঢেলে নিশাদ হাফগোসল সেড়ে ফেলেছে। রাত্রি মিনমিন করলো,”আপনি এখানে কিভাবে এলেন?”

—“আগে বলেন আপনি এখানে করছেন টা কি? মানুষের চাপাচিপায় আলুভর্তা হবার শখ? এতো পছন্দ আলুভর্তা? বাসায় বানিয়ে খেলেই তো পারেন। আলু নেই বাসায়? ভাইয়া এনে দেয়না? এতো কিপ্টা হয়ে গেছে ও?”

রাত্রি বেকুবের মতো বললো,
—“আপনার আমাকে আলু মনে হলো?”

—“মানুষভর্তা বললে কেমন যেনো বিদঘুটে শোনায়। হিংস্র হিংস্র লাগে। অবশ্য আপনার কথাও ঠি ক। আপনাকে আলু শব্দটা মানায়না। বড়জোড় চিকন বেগুনের মতো লাগে। আচ্ছা বেগুন কি ভর্তা করা যায় ভাবি? কিভাবে করে বলেনতো? আমি খাইনি কখনো।”

রাত্রি উওর দিলোনা। নিশাদ পানির বোতলগুলোর ছিপি আটকিয়ে একসাথে করে পাশের ময়লার স্তুপে ছুড়তে ছুড়তে বললো,
—“ওই জেদিটা আপনাকে এভাবে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটায় তাইনা? অফিসের ভেতরেও কি এক কেবিন থেকে অন্য কেবিনে গাড়িতে বসে যায় ও?”

রাত্রি তাড়াহুড়ো করে বললো,
—“না না উনি তো গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। আমিই হেঁটে এসেছি।”

নিশাদ তাকে টেনে নিয়ে গাড়ির দরজা খুললো। বসিয়ে দিয়ে ইশারা করে বললো,”সিটবেল্ট বেঁধে নেন। যে রাস্তা এদিকে। মাথা ঠুকে মরবেন নয়তো।”

রাত্রি সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। নিশাদ পাশে বসে গন্তব্যর ঠি কানা জিজ্ঞেস করলো। রাত্রি জানালো,”সে মার্কেটে যাচ্ছিলো। বেতন পেয়েছে গতকাল। সেই দিয়ে একটু জিনিসপত্র কেনার জন্যই যাওয়া।”

গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে সামনের ড্রয়ার খুলে পারফিউমের বোতল বের করলো নিশাদ। ছিট ছিট করে মাথার উপর স্প্রে করে রাত্রির দিকে চেয়ে বললো,”গন্ধ লাগছে এখনো?”
___________

শপিংমলে আজকে ঢের ভিড়। জম্পেশ কেনাকাটা চলছে। নিশাদ কাজকর্ম ছেড়ে রাত্রির সাথে সাথে ঘুরছে। ঘেমে নেয়ে একাকার পিঠ। রাত্রির ব্যাগশুদ্ধ কাঁপছে থরথর করে। ফোনের উপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে নিভ্রান। সে ধরার সাহস পাচ্ছেনা। ভাইব্রেশনের শব্দ বাইরে অবধি শোনা যাচ্ছে। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,”ফোন ধরছেন না কেনো?”

রাত্রি কাঁচুমাচু করলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ফোন বের করলো। কয়েকসেকেন্ড স্ক্রিনে চেয়ে আচমকাই রিসিভ করে নিশাদের কানের সাথে চেপে ধরলো ফোনটা। দ্রুত বললো,
—“আপনি কথা বলেন। আমাকে বকবে।”
নিশাদ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো। অগোছালো ভাবে ফোনটা ধরে বললো,
—“আ…হ্যালো..”

ওপাশে কিছুক্ষণ নিরবতা। তারপর প্রশ্ন ভেসে আসলো,” তুই রাতের সাথে?”

—” না, ভাবির ফোন চুরি করে নিয়ে আসলাম আরকি।”

—“রাত কোথায়? দে তো ওকে।”

নিশাদ ফটাফট উওর দিলো,
—“ভাবি কথা বলবেনা। তুই নাকি বকবি।”

নিভান উত্তেজিত গলায় বললো,
—“বকবোনা? আমি গাড়ি পাঠিয়েছি আর ও এই গরমে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। কই তোরা এখন?”

—“মার্কেটে।”

নিভ্রান চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। রাগ সামলে ঠান্ডা স্বরে বললো,
—“আচ্ছা, তুই একটু ওর সাথেসাথেই থাকিস।”

নিশাদ উওর দিলো,
—“তুই না বললেও থাকতাম।”

_________________

আকাশটা বড্ড গাঢ় নীল। একটু একটু সাদা মেঘের ভাঙা টুকরো ছিঁটকে আছে। স্তুপ স্তুপ অপরাজিতার বাগান মনে হচ্ছে যেন। অর্ধচাদটা নির্নিমেষ জ্যোতি ছড়াচ্ছে সেই বাগানে।
রাত্রি শপিং ব্যাগগুলো খাটে বিছিয়ে বসেছে। নিভ্রান টাওয়াল দিয়ে নিজের ভেজা চুল ঘঁষতে ঘঁষতে পাশে বসলো। তিনটা একইরকম কালো পান্জাবি। নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখলো তিনটা একেবারে সেইম। কপালে ভাঁজ পড়লো,
—“এতকিছু কি? একইরকম তিনটা কিনেছো কেনো?”

রাত্রি শাড়ির ভাঁজ খুলে দেখতে দেখতে উওর দিলো,
—“আপনার, বাবার, আর ভাইয়ার। আচ্ছা, এটা কেমন হয়েছে?সুন্দর না? ওইযে আম্মুর জন্য একইরকম কিনেছি।” অফ ওয়াইট রংয়ের শাড়িটা দেখিয়ে বললো রাত্রি। মুখের তৃপ্তিকর মিষ্টি হাসিটা সব সৌন্দর্য ছাপিয়ে গেছে। নিভ্রান মুচকি হাসলো। কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে বললো,”খুব সুন্দর হয়েছে রাত। কিন্তু এতকিছু কিনার কি দরকার ছিলো? তোমার কষ্টের টাকা। আমাকে বলতে, আমি কিনে দিতাম।”

—“টাকা নিয়ে কি আমি কবরে যাবো নাকি? টাকা তো খরচ করার জন্যই। তাছাড়া আপনি আমার ব্যয়ের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। জমিয়ে রেখে কি করবো?”

নিভ্রান নরমভাবে তাকে আগলে ধরলো। কাছে টেনে চুলের সাইডে চুমু খেয়ে বললো,”আচ্ছা ঠি কাছে, গোছানো হলে চলো খেয়ে নেই। আন্টিও না খেয়ে আছেন আমাদের জন্য।”

রাত্রি “হু, যাচ্ছি” বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।

—“নিজের জন্য কিছু কিনোনি?”

রাত্রি একপলক কি যেনো ভাবলো। অত:পর এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে উওর দিলো,
—“কিনেছিতো।….ওইযে দুলগুলো। আপনার হাতের কাছের প্যাকেটটায় আছে। বের করে দেখেন।”

নিভ্রান বের করলো। চারজোড়া সিলভার কালারের ঝুমকা। একেকটা একেকরকম। দুটো ছোট সাইজের আর দুটো একটু বড়। নিভ্রান হাতের তালুতে একটা রেখে পরখ করতে করতে বললো,
—“শুধু এইগুলো?”

রাত্রি মুচকি হেসে উওর দিলো,
—“এগুলোই পছন্দ হয়েছে। আর কিছু ভালোলাগেনি।”

—“নিশাদ জানে আমরা কাল যাবো?”

—“না তো।”

—“তো এগুলো কিভাবে কিনলে?”

—“কিনেছি। উনি বুঝেনইনি।”

নিভ্রান লম্বা শ্বাস ফেললো। এ মেয়েকে বোঝা মুশকিল!
_____________

নদীর নীরে সোনারঙা রোদ। ঘর্মাক্ত দুপুরের ঝলমলে রোদে দাড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়ছে রাত্রি। গায়ে মেরুন কালারের একটা জামদানী জড়ানো। গলার সোনার চেনের ছোট্ট হীরের পাথরটা চিকচিক করছে। কানের তুলনামূলক বড় পাথরের দুলদুটো রিফ্লেক্ট করছে রোদের আলোয়। এই ধরণীর সৌন্দর্য নয় এ যেনো! অপার্থিব কিছুর ছোঁয়া সর্বাঙ্গে!
হঠাৎই বরফ ঠান্ডা কোমড়ে তপ্ত স্পর্শ পেতেই চাপা গলায় চিল্লিয়ে উঠলো সে,
—“ও আল্লাহ! এটা বারান্দা। মানুষ দেখবে।”

নিভ্রান সদ্য গোসল করে আসা পানিতে পরিপূর্ণ বুক দিয়ে রাত্রির পিঠ ভেজাতে ভেজাতে বললো,
—“তো কি হয়েছে?”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here