#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৪
আসরের আজানের পরপরেই ইশান বাড়িতে এসে পৌঁছায় হাতে দুটো শপিং ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু পাঁচ মিনিট যাবত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ এসে দরজা খুলছে না। রেগে গিয়ে আবার যখন কলিং বেল চাপতে যাবে ওমনি দরজাটা খুলে দেয় রেহালা খালা। ইশান রেহালা খালাকে দেখে বলে।
–এত দেরি হলো কেন দরজা খুলতে? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি!
–আসলে ছোট ভাই জান আমি ঘরে শুয়ে ছিলাম আর আমি ভেবেছিলাম ইশা আপায় দরজাটা খুলে দিবে তাই একটু দেরি হয়ে গেলো।
ইশান ড্রয়িং রুমে তাকিয়ে দেখে ইশা সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখছে মনের শান্তিতে আর চানাচুর খাচ্ছে। মানে এই মেয়ে এতক্ষণ এখানে বসে ছিলো আর কলিং বেলের আওয়াজ শুনেও দরজা খুললো না। ইশান রেহালা খালাকে কিছু না বলে সোজা টিভির কাছে গিয়ে দেখে “সানাম তেরি কসম” মুভিটা চলছে টিভির পর্দায়। যেই মুভিটা ইশা কতবার যে দেখেছে তার কোনো হিসাব নেই। আর দেখে কি আহাজারি নায়িকাকে কেন মারলো ডিরেক্টর এভাবে না মারলেও পারতো এসব বলে একা একা বিড়বিড় করবে আর পরিবারের সকল সদস্যকে জ্বালাবে বিশেষ করে রেহালা খালাকে। ইশান রেগে গিয়ে দিলো টিভি বন্ধ করে। আচমকা এমন হওয়াতে ইশা হতভম্ব হয়ে যায় রেগে গিয়ে ভাইকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইশান বলে উঠে।
–একদম চুপ। একটাও কথা নয় এতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছিলাম আর তুই এখানে বসে থেকেও দরজা খুলছিলি না কেন হুম?
–উফফ ভাইয়া সরো তো। মুভিটার একটা ইম্পর্টেন্ট পার্ট আসলো আর তখনেই তুমি দিলে টিভিটা বন্ধ করে। নায়িকা এখন মারা যাবে আর তুমি… দেখি সরো।
ইশা টিভিটা আবার ওন করতে নিলে ইশান বলে।
–একদম টিভি ছাড়বি না আর বলে দিলাম।
–তাহলে কি করবো আমি?
–কি করবি মানে পড়তে বসবি আর কয়েকদিন পরেই তো বোর্ড পরীক্ষা তার জন্য তো তোর মাথায় দেখি কোনো চিন্তাই নেই।
–ভাইয়া শুনো একদম পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিবে না এমনি টেনশন কমানোর জন্য টিভি দেখতে বসেছিলাম কিন্তু তুমি দিলে আরও টেনশন বাড়িয়ে।
–পরীক্ষার টেনশন কমাতে চাইলে টিভি না দেখে পড়তে বস গিয়ে।
–এতো জ্ঞান দিও না তো তুমি। অফিস থেকে এসেছো ফ্রেশ হও গিয়ে তোমার গা থেকে ঘামের দু’র্গন্ধ আসছে।
নাক মুখ ছিটকে কথাটা বলে ইশা।
–একটা চড় দিবো বেয়াদব মেয়ে বড়ো ভাইয়ের মুখে মুখে তর্ক করিস।
–উফফ ভাইয়া যাও তো তুমি।
বলেই টিভিটা অন করে দেয়। অন্য দিকে ইশান চলে যেতে নিলে আবারও ফিরে আসে বোনের কাছে। ভাইকে আবার আসতে দেখে ইশা বলে।
–আবার কি হলো?
ইশান কিছু না বলে শপিং ব্যাগ দুটো বোনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে।
–নীল ব্যাগটা তোর আর হলুদ ব্যাগটা… মানে হলুদ ব্যাগটা তীরের।
ইশা বিস্মিত নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায় এটা ভেবে তার ভাই হঠাৎ করে তার জন্য আর তীরের জন্য শপিং করতে গেলো কোন দুঃখে? ইশার এমন চাহনি দেখে ইশান শ’ক্ত কন্ঠে বলে উঠে।
–কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
–না মানে হঠাৎ এসব কেন?
–ঠিক আছে তোর লাগবে না তো।
বলেই ইশান চলে যেতে নিলে ইশা তাড়াতাড়ি করে ভাইয়ের কাছ থেকে শপিং ব্যাগগুলো কেঁ’ড়ে নিয়ে বলে।
–লাগবে না কে বললো! লাগবে তো তুমি একটু বেশি বুঝো।
–ঠিক আছে তীরকে তীরের ব্যাগটা দিয়ে দিস।
ইশা ব্যাগ দুটো চেক করে দেখে দুটো ব্যাগের ভেতরেই লাল রেপিং পেপার দিয়ে একটা করে বক্স মুড়ানো। এটা দেখে ভাইকে প্রশ্ন করে।
–কি আছে এতে ভাইয়া।
–নিজেরাই খুলে দেখে নিস।
বলেই দ্রুত কদমে চলে যায় ইশান। ইশা আর কোনো কিছু চিন্তা না করে টিভির পাওয়ার অফ করে দৌঁড় লাগায় তীরদের বাড়ির উদ্দেশ্য। তীরদের বাড়ির সদর দরজা খুলাই ছিলো তাই সোজা কাউকে কিছু না বলেই সিঁড়ি বেয়ে তীরের রুমে চলে যায়।
ড্রয়িং রুমে তীরের বাবা বসে ছিলেন ক্লান্ত শরীরের নিয়ে মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছেন। ইশাকে এমন ঝড়ের বেগে দৌঁড়ে যেতে দেখে ওনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় আয়েশা সুলতানা পানির গ্লাস নিয়ে এসে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। স্বামীর এমন চেহারা দেখে বলেন।
–কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
–একটু আগে ইশা গেলো। মানে এমন ভাবে গেলো ঝড়ের বেগে যা বলার বাহিরে।
–ও এই ব্যাপার এই মেয়ে তো হাওয়ার সাথে চলে নিশ্চয়ই তোমার মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। তাই এতো চিন্তা করো না তো তুমি পানি খেয়ে ফ্রেশ হও গিয়ে।
______
ইশা তীরের রুমে এসে দেখে তীর মনের শান্তিতে ঘুমাচ্ছে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে। ইশা কিছু না বলেই বেডের পাশে এসে নিজের পা দিয়ে তীরের পিঠে গু’তো মারতে মারতে বলে।
–এই উঠ কুম্ভকর্ণ। আর কতো ঘুমাবি এবার উঠে দেখে পৃথিবীটা কতো রঙিন।
তীরের ঘুম উবে গেছে ইশার গু’তো খেতে খেতে। তারপরও দু’চোখের পাতা বন্ধ রাখা অবস্থায় ইশার পা’টা সরাতে সরাতে বলে।
–উফফ ইশু যা তো এখান থেকে আমাকে একটু ঘুমাতে দে। সকালেও তুই এসে আমার ঘুমের বারোটা বাজালি আর এখন আবারও চলে আসলি ঘুমের বারোটা বাজাতে। তোর কি অন্য কোনো কাজ নেই আমার ঘুম নষ্ট করা ছাড়া।
–এতো ভাব না ধরে উঠ। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
–তোর সারপ্রাইজ তোর কাছে রাখ। আর তুই যখন খুশি তখন আমাদের বাড়িতে চলে আসিস কেন রে? তোর কি নিজের বাড়ি টাড়ি নিয়ে নাকি।
–না নেই। এবার উঠ উঠে দেখ তোর জন্য ভাইয়া কি এনেছে?
তীর ভ্র কুচকে বলে।
–কোন ভাইয়া?
–আরে ইশান ভাইয়া।
ইশানের নামটা শুনার সাথে সাথে তীর তড়িৎ বেগে শুয়া থেকে উঠে বসে। এলোমেলো চুল গুলা ঠিক করতে করতে বলে।
–কার নাম বললি?
–আরে ইশান ভাইয়া। তোর ভবিষ্যৎ সোয়ামী।
তীর ইশার মুখে সোয়ামী কথাটা শুনে লজ্জা পেলো। তীরের লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে ইশা তীরের চিবুক ধরে বলে।
–ওলে বাবালে মেয়ে তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ভাইয়া যদি তোর এই লজ্জা রাঙা মুখটা দেখতো নিশ্চিত হার্ট অ্যা’টাক করতো ভাইয়া।
–ধ্যা’ত! তুই না একটু বেশি বেশি বকছিস।
–আচ্ছা বাদ দে। এবার দেখ ভাইয়া তোর জন্য কি এনেছে?
তীর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে।
–কই দেখি কি এনেছেন ওনি আমার জন্য।
তীর রে’পিং করা বক্সটা তাড়াতাড়ি খুলে দেখে এর ভেতরের দুটো বক্স। একটা বক্স নতুন ফোনের আরেকটা খুললে বুঝা যাবে কি আছে এর ভেতরে। ইশা এসব দেখে বলে।
–কিরে ভাইয়াকে না বলতে বলতে ভাইয়া তোকে ফোন গিফট করে দিলো। দেখলি তো আমার ভাইয়াটা কত্তো ভালো।
তীর মুচকি হেসে অন্য বক্সটা খুলে দেখে এর ভেতরে তিনটা গোলাপ ফুলের গাজরা আরেকটা চিরকুট। তীর চিরকুট’টা নিতে যাবে ওমনি ইশা নিয়ে বলে।
–প্রেমপত্র! ভাইয়া তোকে প্রেমপত্র দিয়েছে রে তীর। এটা তো আমাকে পড়তেই হবে। দেখি আমার ভাইয়া কেমন প্রেমপত্র লিখতে পারে।
তীর অস্থির কন্ঠে বলে।
–প্লিজ ইশু চিরকুট’টা আমাকে দিয়ে দে না। এমন করছিস কেন?
–না না একদম না আগে আমি পড়বো তারপর তুই।
তীর আর কিছু না বলে গোমড়া মুখ করে অন্য দিকে ফিরে যায়। ইশা তীরের গোমড়া মুখ দেখে বলে।
–আচ্ছা বাবা আমি পড়ছি না। তদের পার্সোনাল বিষয়ে আমি নাক গলাচ্ছি না। নে ধর তুই পড় চিঠিটা আমি বরং আমার বক্সটা খুলে দেখি ভাইয়া আমার জন্য কি এনেছে।
ইশা রে’পিং পেপারটা ছাড়িয়ে দেখে পাওয়ার ব্যাংক যেটা ইশা কয়েকদিন যাবত ধরে চেয়ে এসেছে দুই ভাইয়ের কাছে কিন্তু পাত্তাই দিচ্ছিলো না কেউ। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে ইশা তো ভীষণ খুশি।
অন্য দিকে তীর চিরকুটটা হাতে নেয়। হার্টবিট’টা অ’স্বাভা’বিক ভাবে লাফাচ্ছে। এই প্রথম কারোর কাছ থেকে তীর প্রেমপ্রত্র পেয়েছে তাও আবার মিস্টার ইশান ফরাজীর থেকে। তবে তীরের মনে সন্দেহ কাজ করছে এটা কি অতোও প্রেমপত্র নাকি হু’ম’কি পত্র। মিস্টার ইশান ফরাজী যে প্রেমপত্র লিখবে কোনো মেয়েকে এটা যেন তীরের বিশ্বাস হচ্ছে না। তীর ঠোঁট দুটো গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে চিরকুট’টা পড়তে শুরু করে।
“আগেই সরি বলে নিচ্ছে গতকাল রাত্রে এমনটা করার জন্য। রাগের মাথায় তোর ফোনটা ভা’ঙ্গাটা আমার একদম উচিত হয় নি। ভেবেছিলাম তোকে অন্য কোনো মডেলের দামি একটা সেল ফোন কিনে দিবো। কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়লো তোর হাতে যদি অন্য মডেলের ফোন দেখে তোর পরিবার তাহলে তোকে হয়তো সন্দেহ করবে। তাই তোর আগের ফোনের যে মডেলটা ছিলো সেই মডেলেরেই ফোন কিনে দিলাম সেইম টু সেইম। যখন আমার কাছে সারা জীবনের জন্য আসবি তখন না হয় তোকে আমার পছন্দে দামি একটা ফোন কিনে দিবো। ফোনে সবকিছু আমি সেট করে দিয়েছি তোর সুবিধার্থে যাতে তোর কোনো প্রবলেম না হয়। আর গোলাপ ফুলের গাজরা গুলা কিনার কোনো প্ল্যান ছিলো না। যখন ফোনটা কিনে দোকান থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবো তখনেই পাশে দেখি ফুলের দোকান। তাই ভাবলাম তোর জন্য কিনে আনি। ভেবেছিলাম নিজের হাতে তোকে তোর হাতে গাজরাটা পরিয়ে দিবো কিন্তু মনে হয় না সেটা এখন পসিবল। তবে ইনশাল্লাহ একদিন আমার সকল মনের ইচ্ছে পূরণ করবো তোকে নিয়ে”।
তীর চিঠিটা পড়ে বুকের মাঝে চেঁপে ধরে। মুখে তার মিঠি মিঠি হাঁসি। ইশানের মতো একজন সুদর্শন আর পারফেক্ট একজন মানুষ যে তার মতো একটা আগোছালো মেয়েকে ভালোবাসবে সেটা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারে নি।
তবে সেই ভালোবাসাটা কি চিরদিন স্থায়ী থাকবে নাকি অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে। ভবিষতে কি হতে চলছে কেউ হয়তো জানেই না। ভাগ্য তাদের যেখানে নিয়ে যাবে তারা সেখানে যেতে বাধ্য থাকবে। তবে কি ভালোবাসা হেরে যাবে নিষ্ঠুর ভাগ্যের কাছে।
#চলবে_____