#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৯
রাত সাড়ে দশটা বাজে! তীর উপুর হয়ে শুয়ে আছে আর পা দুটো শূণ্যে তুলে সমানতালে নাচাচ্ছে মনের খুশিতে। চোখের সামনে বই খোলা কিন্তু বইয়ের দিকে তার কোনো মনযোগেই নেই। মনযোগ বইয়ের মাঝে থাকবে কি করে তার মন তো পড়ে আছে ইশান নামক পুরুষ মানুষটার কাছে। আজকে দিনটা তীরের কাছে সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তীর হাত বাড়িয়ে গলায় পরিহিত ধনুক আকৃতির লকেট’টা ছুঁয়ে দেয়। এই লকেট’টা আজ ইশান নিজের হাতে তীরের গলায় পরিয়ে দেয়। তীরের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগে আছে। তীরের কিছু একটা মনে পড়তেই দু হাত দিয়ে লজ্জায় মুখ ডেকে চিৎ হয়ে বালিশে শুয়ে পড়ে বিড়বিড় করে বলে।
–আজ আর আমার পড়া হবে না। একি করে ফেলেন আমায় মিস্টার ইশান ফরাজী। আমি তো আপনাকে ছাড়া তো থাকতেই পারছি না। এবার কি হবে আমার সবাই তো আামকে পা’গ’ল বলবে। আমাকে পা’গ’ল করার অপরাধে আপনাকে জে’লে দেওয়া দরকার।
বলেই তীর কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিয়ে আজকের মিষ্টি মুহূর্ত গুলা মনে করে।
_____
এগারোই এপ্রিল রাতটা পার হলেই ইশা আর তীরের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু। তীর তো টে’ন’শ’নে ম’র’ম’র অবস্থা। পরীক্ষার কয়েকদিন আগেই থেকেই টে’ন’শ’নে ছিলো। কিন্তু যখন থেকে ইশানের মুখ থেকে শুনেছে “পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না হলে খুব ভ’য়ংক’র শাস্তি দিবে তাকে” সেদিন থেকেই রাতে দিনে পড়ায় মনযোগ দিয়েছে। যে করেই হোক একটা ভালো রেজাল্ট করে ইশানকে দেখিয়েই দিতেই হবে। এমন পড়াই পড়ছে যে নিজের হাতে পর্যন্ত খেতে পারছে না। আয়েশা সুলতানা তীরকে রাতের খাবার খাইয়ে দিছে আর তীর পড়ছে। আয়েশা সুলতানা মেয়ের এমন পাগলামো দেখে বলে।
–তীর এমন করচ্ছিস কেন? গলায় তো খাবার আটকে যাবে মা।
তীর বি’র’ক্ত’ক’র ভাব নিয়ে বলে।
–উফফ মা! ডিস্টার্ব করো না তো আরো দুইটা অধ্যায় বাকি আছে এগুলা রিভাইস দিলেই আমার পড়া শেষ।
অন্য দিকে ইশা সোফায় বসে পায়ের উপরে পা তুলে আপেল খাচ্ছে আর বইয়ের উপর চোখ বুলাচ্ছে। ওদিকে তীর টে’ন’শ’নে ম’রে যাচ্ছে আর এদিকে এই মেয়ের মনে পরীক্ষা নিয়ে কোনো প্রকার চিন্তাই নেই। পরীক্ষার কেন্দ্রে ইশান নিয়ে যাবে ওদের দু জনকে। ইশান ডিনার করার জন্য নিচে নেমে বোনকে এমন চিন্তাহীনভাবে বসে থাকতে দেখে বোনের মাথায় চটি মারতেই ইশা হু’কা’র দিয়ে বলে।
–ভাইয়া এভাবে মা’র’লে কেন?
–তোকে মা’রা’ই উচিত। তোর তো দেখে যায় কোনো চিন্তা নেই যে রাত পেরুলেই তোর বোর্ড পরীক্ষা। শুধু আছিস খাওয়ার চিন্তা নিয়ে।
–ভাইয়া শুনো এতো চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। যাহ হওয়ার হবেই তাই এতো চিন্তা করে কোনো লাভ নেই শুধু চিল হবে।
–তোর যদি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ তাহলে তোকে রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিবো বলে দিলাম।
–উমমম। তোমার কথায়।
–আমার কথাই। তোকে রিক্সাওয়ালার সাথেই বিয়ে দিবো আমি।
ইশা এবার রা’গে চিৎকার করে বলে।
–মা দেখো ভাইয়া কি বলছে আমাকে!
নেহা বেগম মেয়ের চিৎকার শুনে রান্না ঘর থেকে দৌঁড়ে এসে বলে।
–কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করছিস কেন?
–মা তোমার ছোট ছেলে নাকি আমার বিয়ে রিক্সাওয়ালার সাথে দিবে আমার রেজাল্ট খারাপ হলে।
নেহা বেগম ইশানের দিকে তাকিয়ে বলে।
–ইশান এটা কি ধরনের কথা। মেয়েটার সকালে পরীক্ষা আর তুমি কি বলছো এসব?
–তো কি বলবো তোমার মেয়েকে। পড়ালেখায় তো কোনো মনযোগ দেখতে পারচ্ছি না আমি।
ইশা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে আবার বলল।
–তোমাকে কোন দুঃখে আমি আমার পড়ালেখার মনযোগ দেখাতে যাবো হুম।
–দেখলে মা দেখলে কিভাবে পায়ের উপর পা তুলে ঝ’গ’ড়া করছে আমার সাথে। আবার ওর নাকি বোর্ড পরীক্ষা।
–তুমি তো প্রথমে এসে ঝ’গ’ড়া শুরু করেছো আমার সাথে ভাইয়া। আমি তো চুপচাপ বসেই পড়চ্ছিলাম।
দুরে দাঁড়িয়ে কেয়া ইশান আর ইশার ঝ’গ’ড়া দেখচ্ছে। এই বাড়িতে যবে থেকে ও এসেছে তবে দেখে দেখে এসেছে ইশা আর ইশানের ঝ’গ’ড়া। ভালোই লাগে ওর ওদের দুষ্টু মিষ্টি ঝ’গ’ড়া গুলো দেখতে। নেহা বেগম এক পর্যায়ে চিৎকার করে বলে উঠে।
–উফফ! থামবি তোরা দু’জন।
তারপর ইশানের দিকে তাকিয়ে বলে।
–আর ইশান তুমি কি দিনদিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো নাকি যে ছোট বোনের সাথে এভাবে ঝ’গ’ড়া করছো। কোথায় ওকে বুঝাবে যাতে ভালো করে পড়ে তা না করে উল্টো ওর সাথে তুমি আ’জে’বা’জে কথা বলছো।
ইশা মায়ের কথা শুনে ভাইয়ের দিকে তাকিয়র বলে।
–ঠিক হয়েছে।
ইশাকে কথা বলতে দেখে নেহা বেগম বলেন।
–কোনো কথা নয় চুপচাপ পড়ো। আর ইশান খবার দিচ্ছি খেতে আসো।
নেহা বেগম চলে যান কথাটা বলে। ইশান একটা কথাও বলে না কারণ এখান হাওয়া গরম আছে আর মূলত দো’ষ’টা ওরেই তাই চুপ থাকাটাই ঠিক মনে করলো। আর তার উপরে ইশার কালকে পরীক্ষা। ইশান খাবার টেবিলে যাওয়ার আগে ইশাকে বলে।
–ভালো করে পড়। যা যা রিভাইস দেওয়া বাকি সেগুলা রিভাইস দে।
ইশা মুখ বেঁকিয়ে বলে।
–তোমাকে বলতে হবে না।
এমন সময় সোহেল ফরাজী বলতে বলতে আসেন।
–কি হয়েছে? এতো চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?
ইশা বাবাকে দেখে বাবার কাছে গিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলে।
–বাবা ভাইয়া নাকি আমাকে রিক্সাওয়াল সাথে বিয়ে দিবে আমার রেজাল্ট খারাপ হলে।
সোহেল ফরাজী মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন।
–কে বলেছে আমি আমার রাজকন্যাকে রিক্সাওয়ালার কাছে বিয়ে দিবো। আমি আমার আদরের রাজকন্যাকে একজন রাজকুমারের কাছে বিয়ে দিবো যে রাজকুমার আমার মেয়েকে অনেক সুখে রাখবে আর যত্নে রাখবে।
ইশা বাবার কথায় মুচকি হাঁসে। সত্যিই তো তার জীবনে একটা রাজকুমার আছেই যে তাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু সেই রাজকুমারটাকে কি সবাই মেনে নিবে। যদি না মেনে নেয় তাহলে কি হবে?
_____
তীর আর ইশা সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বের হয়ে পড়ে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে। আজকে প্রথম পরীক্ষা তাই একটু আগেই বের হয়েছে। ইশানেই দু জনকে পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে যাবে বাকি সকলকে যেতে বললে না বলে দেয় কারণ এত গার্জিয়ান গিয়ে কোনো লাভ নেই। তাই বাড়িতেই বসেই সন্তানদের জন্য দোয়া করবেন।
ইশান ড্রাইভ করছে আর লুকিং গ্লাসে তীরকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটার সারা মুখে আতঙ্কের চাপ স্পষ্ট ফুটে উঠছে পরীক্ষার জন্য। ইশানের এখন মনে হচ্ছে তীরকে ভয় দেখিয়ে বড়সর একটা ভু’ল করে ফেলছে। নিজেকে নিজে এখন চড়াতে ইচ্ছে করছে। তবে ইশা তীরের এমন টে’ন’শ’ন করা দেখে বার বার সান্ত্বনা দিছে।
গাড়ি এসে থামে নিজেদের গন্তব্যে। পরীক্ষার কেন্দ্রের সামনে ছাত্র-ছাত্রী তে ভর্তি সাথে তো গার্জিয়ান আছে। ইশা আর তীর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। ইশানও ওদের দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে।
–এতো টে’ন’শ’ন করার কিচ্ছু হয় নি। তোদের দুজনের পরীক্ষাই ইনশাল্লাহ ভালো হবে। আর পরীক্ষার হলে মাথা ঠান্ডা রাখবি। প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর আগে প্রশ্ন গুলা ভালো করে পড়বি তার পর এন্সার করবি। যেই প্রশ্ন গুলা কমন পড়বে সেগুলা আগে এন্সার করবি। আর বিশেষ করে সময়ের দিকে খেয়াল রাখবি কেমন।
ইশা আর তীর মাথা নাড়ায়। ইশান তীরের দিকে তাকায় মেয়েটাকে টে’ন’শ’ন মুক্ত করতে হবে এখন। না হলে পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে পারবে না। তাই তীরকে কোমল কন্ঠে ডাক দেয়।
–তীর!
তীর ইশানের দিকে চোখ তুলে তাকায়। ইশা ওদেরকে প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য একটু দুরে সড়ে গিয়ে অন্যান্য ফ্রেন্ডদের পাশে গিয়ে দাঁড়া। ইশা চলে যেতেই ইশান তীরের দিকে দু কদম এগিয়ে এসে বলে।
–এতো প্রে’সা’র নেওয়ার কিচ্ছু হয় নি। ওই দিন আমি ওই কথাটা জাস্ট মজা করে বলেছি তাতে এতো টে’ন’শ’ন করার কিচ্ছু হয় নি। তুই যতটুকু পারিস ততোটুকু দিয়েই পরীক্ষা দিবি। তোর রেজাল্ট ভালো হোক বা খা’রা’প হোক তাতে আমার ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণও কমবে না। তাই প্লিজ এই ছোট্ট মাথায় এতো প্রে’সা’র দিবি না।
তীর অবাক চোখে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোককে তীর জীবনেও বুঝতে পারবে না। কেমন যেন গোলক ধাঁধার মতো। তীরকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশান বলে।
–কি হলো? আমি যা বললাম মনে থাকবে তো।
তীর মুচকি হেসে মাথা নাঁড়িয়ে সায় দেয়।
–ঠিক আছে তাহলে এবার ভেতরে যা। ভালো করে মন দিয়ে পরীক্ষা দিবি কেমন।
কিন্তু তীর টাই দাঁড়িয়ে আছে। তীরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশান ভ্রু-কুচকে বলে।
–কি হলো যা?
তীর নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে।
–আপনি আগে গাড়িতে উঠুন।
–কেন?
–আপনি আগে উঠুন তারপর বলছি।
–তোরা দুজন পরীক্ষার কেন্দ্রে ডুকবি তারপর আমি গাড়িতে উঠবো।
–নাহ আপনি এখনি উঠবেন।
–তীর কি ছেলে মানুষি হচ্ছে এগুলা।
তীর মুখটা কালো করে বলে।
–প্লিজ। এমন করছেন কেন? তাড়াতাড়ি একটু গাড়িতে উঠুন না আমার হাত বেশি সময় নেই। আপনি যতো দেরি করবেন তত সময় ন’ষ্ট হবে আমার।
ইশান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠে বসে। অন্য দিকে তীর ইশাকে ইশারা করে একটু অপেক্ষা করতে বলে। ইশান গাড়িতে উঠেই বলে।
–হয়েছে! এবার যা।
তীর কিছু না বলে উল্টো নিজেই গাড়িতে উঠে বসে। ইশান তীরের এমন কাজ করাতে অবাক হয়ে বলে।
–তুই গাড়িতে উঠচ্ছিস কেন তীর? পরীক্ষা দেওয়ার কি কোনো ইচ্ছে নেই।
তীর গাড়িতে উঠে আগে গাড়ির সব গ্লাস লাগিয়ে দেয়। তীরের এমন কাজ করাতে ইশান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ইশান কিছু একটা বলতে যাবে তার মাঝেই তীর ইশানকে অবাক করে জড়িয়ে ধরে। তীরকে এমন করাতে ইশান অবাকের চূড়ায় পৌঁছে যায়। এই প্রথম তীর নিজ থেকে ইশানকে জড়িয়ে ধরেছে তাও আবার এমন সময়। ইশান নিজেকে সামলিয়ে তীরের মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে বলে।
–কি হয়েছে জান? এভাবে হঠাৎ করে..
তীর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইশানকে। মনে হচ্ছে যেন নিজেকে ইশানের মাঝে ডুকিয়ে ফেলবে। তীরের এমন অদ্ভুত আচরণ করতে দেখে বিচলিত কন্ঠে বলে।
–কি হয়েছে জান? এমন করচ্ছিস কেন? কিছু কি হয়েছে?
ইশানের বিচলিত কন্ঠ শুনে তীর নিজের হোঁসে ফিরে এসে ইশানের কাছ থেকে তড়িৎ বেগে দুরে সরে যায়। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছে না ইশানের দিকে। আবেগের বশে সাংঘাতিক একটা কাজ করে বসেছে সে। এবার ইশান কি ভাববে তাকে। ইশ! কি লজ্জার বিষয়। ইশান তীরের লজ্জা মাখা মুখটা দেখে ঠোঁট চেঁপে হেসে বলে।
–নিজের ইচ্ছেতে জড়িয়ে ধরলি আর এখন নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিস। তা মিস তীর আপনি হঠাৎ আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরলেন….
ইশানের কথার মাঝেই তীর বলে উঠে।
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি আমি।
কথাটা বলে তীর ঝড়ের বেগে গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌঁড় মারে। তীরকে এভাবে দৌঁড় দিতে দেখে ইশান জোরেই বলে।
–আরে আস্তে যা পড়ে যাবি তো।
তীর দৌঁড়ে ইশার কাছে এসে বলে।
–ইশু চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তীরের এমন করাতে ইশা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু আপাতত কিছু বলে না। ইশা পিছন ফিরে ভাইয়ের দিকে তাকালেও তীর একবারও পিছন ফিরে তাকাই নি লজ্জায়।
#চলবে______