#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
কলিংবেল চেপে অপেক্ষা করতে থাকে মীরা। ঘড়িতে এখন চারটা বেজে উনিশ মিনিট। জ্যামে বড্ড ফেঁসে গেছিলো। মেট্রোর কাজ ও সেইসাথে রাস্তা মেরামতের জন্য জ্যাম। দরজা খুলল মীরার মা মিসেস মলি জাহান। মীরা লক্ষ্য করল, তার মায়ের চেহারার হাবভাব সুবিধার না। মীরা শুধালো,
“কী হয়েছে মা?”
মলি জাহান কোনো জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। মীরা ভেতরে এসে ড্রয়িংরুমে উুঁকি দিয়ে দেখল, তার বাবা কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। মীরা ঘুরে চলে যেতে নিলে রফিক তালুকদার ডাকেন। মীরা দাঁড়ালে তিনি মেয়ের দিকে না তাকিয়েই বলেন,
“তোমার বিয়ে এবার তুমি নিজে ঠিক করো। তুমি নিজে যেমন ছেলে পছন্দ করবে, আমি এবং আমরা তাতেই রাজি। ছেলের যদি আগে বিয়েও হয়ে থাকে তাতেও কোনো বাধা দিব না।”
মীরা কোনো প্রত্যুত্তর না করে সেখান থেকে সরে আসে। নিজের ঘরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বিছানায় গা এলিয়েছে মাত্র তখনি হঠাৎ দরজায় ধুমধা*ম শব্দে কপাল কুঁচকে বিরক্তিতে উঠে বসে। দরজা খুলতেই নিজের গালে সপা*টে চ*ড় পড়ার অনুভূতি হলো তার। আচমকা কাণ্ডে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়ানো নিজের মায়ের পানে বিরতিহীন চেয়ে রইল। মিসেস মলি জাহান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বলেন,
“তোর যদি পছন্দ থেকেই থাকে তবে আমাদের এত অপমান করালি কেন? নিজের নিচু মানসিকতার কথা বাহিরের মানুষকে বললি কেন? আমরা কি তোর উপর কোনোকিছু জোর করে চাপিয়েছি? তুই বলেছিস, তোর কোনো পছন্দ নাই। তাই আমরা ছেলে দেখেছি। মানুষের বয়স কি বসে থাকে? বাসায় অবিবাহিত বিবাহযোগ্যা মেয়ে থাকলে আশেপাশের মানুষ কি খুব ভালো বলে?”
মীরার নেত্রযুগল ভারী হলো। উপচে উঠেছে জলরাশি। মনে হচ্ছে সাগরে জোয়ার এসেছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে মায়ের পেছনে দুই ভাবিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তাঁরা ইশারায় কিছু বলছে কিন্তু মীরা বুঝতে পারছে না। তার মা, যে কী-না তার গালে থা*প্প-ড় দেওয়া তো দূর, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর গায়ে হাতও তুলেনি! সেই মা আজ তাকে..!
মীরাকে চুপ থাকতে দেখে মিসেস মলি জাহান ফের অশ্রসিক্ত নয়নে চেয়ে বাঁজখাই গলায় শুধালেন,
“কে সেই লোক? যাকে তুই… ছিহ্! আমার বলতেও বাধছে। আমার মেয়ে এমন করতে পারে তা আমার কল্পনাতেও আসছে না। ওই ঘটক আজকে রাদিব ও তার বউকে নিয়ে এখানে এসেছিল। রাদিবের বউ নিজ মুখে বলেছে, তুই নাকি ও-কে ব্ল্যা*ক-মেই-ল করে এসব করিয়েছিস। তোর এক বিবাহিত লোকের সাথে সম্পর্ক আছে। এটা তুই নিজে রাদিবকে বলেছিস। এইসব কিছু ওরা আজকে পাত্রপক্ষের সামনে বলেছে। তুই একটা মেয়ের সংসার ভাঙছিস! রাদিব তো নিজের উপর আনা মিথ্যা আরোপ পরিবারের কথা চিন্তা করে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের মান-সম্মানের কী হবে? ভেবেছিস একবারও?”
মীরা কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এতোকিছু কী হলো? কীভাবে হলো? কিছুই তার মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। মীরা ধপ করে বিছানায় বসলো। মীরার মা কাঁদতে কাঁদতে হাঁপাচ্ছেন। শারমিন এগিয়ে এসে জোর করে শাশুড়িকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। নিধি মীরার ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ আগের সব কাহিনী খুলে বলে। সব শুনে মীরা তার ভাবিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“বিশ্বাস করো ভাবি, আমার সাথে এখন কারো সম্পর্ক নেই। তোমরা তো বর্ণর কথা জানতে। বর্ণর পর আমি কারো সাথে কোন সম্পর্কে যাইনি। আর সংসার ভাঙ্গা! আমি ওরকম মেয়েই না। হ্যাঁ, সেদিন আমি রাদিবকে রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলাম যে আমি ও-কে বিয়ে না করে যদি এক বিপত্নীক ও এক বাচ্চার বাবাকেও বিয়ে করি, তাও ভালো। কিন্তু সে যে আমার কথার এই অর্থ বের করে সেটাকে রাঙিয়ে বিশ্রি ভাবে প্রেজেন্ট করবে! আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।”
নিধি হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“কি বলব বলো? রাদিব যে তোমার উপর প্রতি*শো*ধ নেওয়ার জন্য এই খেল খেললো, সেটা তো আমি ও বড়ো ভাবি বুঝতেই পেরেছি। ওরা আমাদেরকে যা নয় তাই বলে গেল। নিজের ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কে এসব কথা শুনলে কোন বাবা-মা ঠিক থাকতে পারে বলো?”
“তাই বলে আমাকে এরকমটা ভেবে নিবে? উনারা উনাদের মেয়েকে চেনে না? উনাদের মেয়ে কারো সংসার ভাঙার মত মেয়ে এটাই ভাবল? তাহলে তো আমি বর্ণর সংসারই ভাঙতে পারতাম। আমি কি পারতাম না? বর্ণর স্ত্রীকে বলতে? বর্ণ আমাকে চিট করেছে সেটা? আমি কি করেছি?”
“তুমি শান্ত হও। আমি তোমার ভাইকে বলেছি। ভাবিও বড়ো ভাইয়াকে বলবেন। রাতে বাবা-মাকে বুঝাব সবাই। কেঁদো না তুমি।”
নিধি নিজে মীরার চোখ মুছিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ বুকে আগলে রেখে একা থাকতে দিয়ে চলে যায়। মীরা দরজা লাগিয়ে বারান্দায় গিয়ে ফ্লোরে বসে। যান্ত্রিক শহরে মন বোঝার মানুষের অভাব হলেও ভুল বোঝার মানুষের অভাব হয় না। মীরা কিছু সময় পশ্চিম আকাশ পানে কাতর নয়নে চেয়ে থেকে। তার দৃষ্টিতে একরাশ অভিমানে ভরপুর। আকাশের দিকে চেয়ে থাকলে নিজেকে হালকা লাগে। তারপর উঠে গিয়ে অজু করে এসে নামাজে বসে।
______
রাস্তায় রাদিবকে বেশ অনেকটা উৎফুল্লিত দেখে হতাশ হয় জুলি। আজ রাদিবের হু*মকিতে বাধ্য হয়ে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে তাকে। তাদের বিয়ের দুইটা সপ্তাহ পেরোলেও, রাদিব তাকে আগের মত ভালোবাসে না। ভালোবাসা পেতে আজ সে একটা মেয়ের নামে মিথ্যা বলে আসলো। তার খারাপ লাগছে কিন্তু কী করবে? অনেক ভালোবাসে যে! জুলি ভাবতে থাকে, ‘আমরা যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, আঘা*তটা সেখান থেকেই পাই! এই তবে ভালোবাসা!’ জুলি সিটে মাথা এলিয়ে নির্নিমেষ জানালা দিয়ে বাহিরে চেয়ে থাকে।
রাদিব ফুরফুরে মনে বসে কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে। মীরা তাকে যা অপমান করেছে, সব কড়ায়গণ্ডায় শোধ করে দিয়ে এসেছে। মীরা তাকে তার পরিবারের কাছে খারাপ বানিয়েছে, সে মীরাকে পরিবার ও বাহিরের মানুষের সামনে খারাপ বানিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন সে নিজেকে জয়ী ভাবছে।
________
দুইদিন যাবত মীরা ঘর থেকে বের হয় না। কখোনো শারমিন বা কখোনো নিধি এসে ওর খাবার ঘরে দিয়ে যায়। আজ ইন্টার্ভিউ আছে তাই সবকিছু একসাথে নিয়ে বের হলো। শারমিন তা দেখে প্রশ্ন করে,
“ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাড়িতে আসবে না?”
“না ভাবি। ওখান থেকেই চলে যাব।”
“কী বলো! তোমার ফ্লাইট তো সন্ধ্যায়। এত সময় কী করবে?”
“যাই করি সময় কেটে যাবে। আসি ভাবি।”
এবার নিধি আটকাতে চাইলে মিসেস মলি জাহান কঠিন স্বরে বলেন,
“শারমিন, নিধি, যে যেতে চাচ্ছে তাকে আটকানোর প্রয়োজন নেই। যেতে দাও।”
নিধি কিছু বলতে নিবে তখনি মীরা মলিন হেসে ইশারায় মানা করে। অতঃপর বেরিয়ে পড়ে।
_______
সেমিস্টার ব্রেকে শেহজাদ, ফ্রিশা ও ড: আকবর তার স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছেন। উদ্দেশ্য ড: আকবরের ছেলে আবিরকে ডাক্তার দেখানো। উনারা জানেন যে আবির কখোনো স্বাভাবিক হবে না। কিন্তু তাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে একটু হালকা ঘোরাফেরাও হয়ে যাবে। ফ্রিশা তার বাবার সাথে নানাভাই ও মায়ের দাদুর ক*বর দেখতে এসেছে। এখানকার ক*বর গুলোতে সব প্লাস সাইন দেওয়া। ফ্রিশা প্রশ্ন করে,
“বাবা, এখানে ক*বরে প্লাস সাইন কেন? মাম্মামেরটাতে তো নেই।”
শেহজাদ হালকা হেসে জবাব দেয়,
“এখানে যাদের ক*বর দেওয়া হয়েছে, সবাই অন্য ধর্মের তাই। এটা রিলিজিয়াস মেটার।”
কিন্তু ফ্রিশার মনের কৌতুহল দমেনি। সে পালটা প্রশ্ন করে,
“ওরা তো মাম্মামের পাপা ও দাদুমনি। তাহলে একইরকম না কেন?”
“তুমি বড়ো হলে বুঝবে, বাচ্চা। এটা মনে রাখো, ইন দিস ওয়ার্ল্ড, দেয়ার ইজ সো মেনি রিলিজিয়ন। সব রিলিজিয়নে একজন বিধাতাকে বিভিন্ন নামে ডাকে। যার যার বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। যেমন, আমরা এক আল্লাহকে মানি। তাই আমরা মুসলিম।”
(এলার্ট: আমি কোনো ধর্মকে হার্ট করতে চাই না। ফ্রিওনা রূপান্তরিত মুসলিম। ফ্রিশার মনের প্রশ্নকে যতটা সহজ করে উত্তর করা যায় করেছি।)
ফ্রিশা মিষ্টি করে হেসে বাবার হাত ধরে চলে আসে।
_______
ড: আকবর আজকে মীরাদের বাড়িতে এসেছেন। সাথে এসেছে তার স্ত্রী, পুত্র ও নাতনী ফ্রিশা। শেহজাদ এই ব্যাপারে কিছু জানে না। শেহজাদ এখনও আমেরিকা থেকে ফেরেনি। একটা কাজে আটকে পড়েছে। ড: আকবর তার স্ত্রী-ছেলে ও নাতনীকে নিয়ে গতকাল ফিরে এসেছে। তিনি এসেছেন মীরার বাবার সাথে কথা বলতে। প্রথমে এসেই নিজের পরিচয় দেওয়াতে মীরার পরিবার তাদেরকে সাদরে আপ্যায়ন করে। মিসেস শাহিদা বলেন,
“আমরা এখানে একটা উদ্দেশ্যে এসেছি। আপনারা প্লিজ বিব্রত হবেন না। বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন আশা করি।”
মিসেস মলি জাহান স্বামীর মুখপানে একবার চেয়ে হালকা হেসে বলেন,
“আপনি বলেন, আপা। আমরা কিছু মনে করব না।”
মিসেস শাহিদা তার ছেলে ও নাতনীকে দেখিয়ে বললেন,
“ও হচ্ছে আমাদের একমাত্র ছেলে আবির। আর ও(ফ্রিশাকে দেখিয়ে) হচ্ছে ফ্রিশা। আমার ভাইয়ের ছেলের ঘরের নাতনী। ফ্রিশার বাবা মানে আমার ভাতিজা শেহজাদও মীরার টিচার। শেহজাদ অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে আছে। ভাই-ভাবি আমেরিকার সিটেজেনশীপ পাওয়ার পর শেহজাদ আমেরিকায় গিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়। তারপর সেখান থেকে একেবারে পিএইচডি করে আমাদের অনুরোধে দেশে আসে। ভাই-ভাবিও পরে চলে এসেছিল। উনারা এখন আর বেঁচে নেই। শেজজাদও আমাদের ছেলেই। আমাদের নিজেদের ছেলে তো জন্ম থেকে এমন। এই শেষ বয়সে শেহজাদ ও ফ্রিশা আছে বলেই আমরা কিছুটা ভালো আছি।”
কথা বলতে বলতে মিসেস শাহিদা হালকা হাতে টিসু দিয়ে চোখ মুছলেন। উপস্থিত সবাই নীরব। মিসেস মলি জাহান ফ্রিশাকে নিজের কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন,
“ওর মা কোথায়?”
“দুই বছর আগে নিজের জেদ আঁকড়ে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ও-কে মা-হারা করে চলে যায়।”
মিসেস মলি জাহান আফসোস করেন। নিধি ও শারমিন আড়ালে দাঁড়িয়ে কিছু একটা সন্দেহ করছে। মীরার ভাইয়েরা বসে থেকে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। নিধি কিছু একটা ভেবে ফ্রিশাকে মৃদুলার সাথে খেলার কথা বলে নিয়ে যায়। এবার ড: আকবর রেহমান বলেন,
“জানিনা আপনারা কীভাবে কী নিবেন। আমাদের স্বা*র্থপরও ভাবতে পারেন। আসলে আমরা নিজেদের স্বার্থেই এসেছি।”
মিস্টার রফিক তালুকদার এবার সন্দিহান হলেন। তিনি প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধালেন,
“জি বলেন।”
“আমরা শেহজাদের জন্য মীরার হাত চাইতে এসেছি। ফ্রিশার জন্য একটা মায়ের সন্ধানে এসেছি। যে শেহজাদ ও ফ্রিশার জীবনের অপূর্ণতা পূর্ণ করবে।”
মীরার বাবা-মা ও ভাই-ভাবিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।