#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৫
দেখতে দেখতে দুটো দিন পেরিয়ে গেছে। আজ সোমবার। বাহিরে তপ্ত রোদ। সূর্যের ক্ষোভ, রাগ যেন ধরণীতে তাপদাহ সৃষ্টি করছে। কিছুক্ষণ ছাতা বা ছাউনি ছাড়া দাঁড়ালে মনে হবে শ*রীরের চা*ম*ড়া ঝ*ল*সে যাচ্ছে। মীরা সবে মাত্র ভার্সিটিতে এসে পৌঁছেছে। আর আধঘণ্টা পরেই তার ক্লাস। সে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে গিয়ে নিজের অফিস রুমের কাছে যেতেই খুব পরিচিত এক চেহারা দেখে যথাস্থানে থেমে যায়। ব্যাক্তিটি যে তার কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, এতটাও কল্পনা করেনি। ব্যাক্তিটি এগিয়ে এসে ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। শুধায়,
“কেমন আছো, মীরু?”
মীরা জবাবের পরিবর্তে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“তোমার সাথে দেখা করতে, মীরু। তুমি তো আমার নাম্বার বারবার ব্লক করে দিচ্ছ। তারপর তো তোমার নাম্বারে কলও ঢুকছে না।”
মীরা আশেপাশে চোখ বুলালো। দুই-একজন স্টুডেন্ট টিচারদের জন্য অপেক্ষা করছে বা এমনিতে দাঁড়ানো। লোক সমাগম কম হলেও এখানটায় প্রতিটা টিচারদের বিচরণ থাকে। তাই বাহিরে বাকবিতণ্ডা না করে নিজের অফিস রুমের লক খুলে প্রবেশ করলো। সাথে বর্ণও! মীরার অন্য দুই কলিগ এখন রুমে নেই। একজন ক্লাসে আছে। আরেকজনের আজকে ক্লাস আরও পরে তাই আরেকটু পর আসবে। মীরা দরজা লক করে নিজের চেয়ারে বসে বলল,
“দেখুন প্লিজ, এটা আমার কর্মক্ষেত্র। এখানে ঝামেলা করবেন না। আপনার সাথে কথা বাড়াতে আমি ইচ্ছুক না। আপনার নাম্বার বারবার ব্লক করছি কেন? কেন নিজের নাম্বার বন্ধ করে রেখেছি? নিশ্চয়ই আমি চাইছি না, আপনার সাথে কথা বলতে। তারপরও কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন?”
“ভালোবাসি বলে!”
‘ভালোবাসি’ শব্দটা যেন মীরার কর্ণে উত্তপ্ত লা*ভার ন্যায় শোনালো। তৎক্ষণাৎ নয়নে বারিধারা ভর করলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
“আপনার ওই পিছলে যাওয়া জবানে এই শব্দটা উচ্চারণও করবেন না। আপনার জবান খনিকেই রং বদলায়। অন্তত কাউকে ভালো তো আপনি বাসতেই পারেন না। শুধু নিজেকে ভালোবাসতে পারেন। আপনার ভালোবাসা হচ্ছে চোখের মায়া!”
মীরার চোখে চোখ মেলাতে পারল না বর্ণ। নত মস্তকে মিনতি করে বলে,
“আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। আসলে বুঝতে পারিনি। ওখানে গিয়ে আমি টোটালি একা হয়ে পড়েছিলাম, তারপর মিটুসুকোর সাথে পরিচয়। তারপর….”
“থামুন। আপনার প্রেমকাহিনী শুনতে চেয়েছি আমি? আপনি আপনার লাইফে কী করবেন না করবেন আপনার ব্যাপার। আমাকে আর সেসবে দয়া করে টানবেন না। একবার যখন রাস্তা আলাদা হয়েছে, তো হয়েছেই।”
বর্ণ করুণ দৃষ্টিতে চাইলো কিন্তু মীরা সেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বর্ণ ফের বলল,
“শুনলাম বিয়ে করছ?”
মীরা জবাব দিতে না চাইলেও দিলো। কারণ বর্ণকে বোঝাতে হবে সে অতীতে আটকে নেই।
“হ্যাঁ।”
“শেহজাদ স্যারকে?”
মীরা কপাল কুঁচকে তাকালো। ফের বলল,
“সব তো তবেই জেনেই এসেছেন। তাহলে প্রশ্ন করে নিজের ও আমার সময় নষ্ট করছেন কেন?”
“মীরা, উনি তোমার স্যার হয়।”
“হুম তো?”
“মীরা, উনার একটা বাচ্চাও আছে। পাঁচ বছরের।”
বর্ণ যতটা বিস্ময় নিয়ে কথাটা বলেছে, মীরা ঠিক ততোটাই সরল কণ্ঠে জবাব দিলো।
“হ্যাঁ জানিতো।”
“তুমি তাও বিয়ে করবে?”
“আমি তো বাচ্চাটার জন্যই বিয়ে করছি। সো প্লিজ, এভাবে বাচ্চা আছে বলে ভয় দেখানোর কোনো মানেই হয় না।”
“ওকে ফাইন। তুমি বাচ্চার জন্য বিয়ে করছ তো? তাহলে প্লিজ আমার লাইফে ব্যাক করো। আমার বাচ্চা তো আরও ছোটো। মাত্র ছয় মাস। ওর মা ও-কে ছেড়ে চলে গেছে।”
মীরার মুখশ্রী তৎক্ষণাৎ কঠোরে রূপ নিলো। এতক্ষণ কিছুটা হলেও শান্ত হয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু এবারে! চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে বলে,
“আপনার মতো গি*র*গি*টির কাছে ফিরব আমি? স্বপ্নেও না। আমার তো মনে হয়, আপনার স্ত্রীও আপনার ফিদরত বুঝে গেছে। আপনার সুন্দর মুখশ্রী ও যত্নশীল ব্যবহারের আড়ালে লুকানো মানুষটাকে চিনে গেছে। আপনার মনে আছে? আপনি কী কী করতেন? কতোটা পজেসিভ, কেয়ারিং ছিলেন আমার প্রতি! তখন যে কেউ দেখলে বলতো, এমন ভালোবাসা বিরল। আমি তো এতেই আটকে গিয়েছিলাম। যেই বর্ণ আমাকে সামান্যতম স্যাড ফেইসে দেখতে পারতো না, সেই বর্ণ আমাকে দুঃখের সাগরে ধা*ক্কা দিয়ে নিজে সুখে থাকতে চলে গেছিল। ভুলিনি আমি। শিক্ষা হয়েছে। আমি কিন্তু আপনাকে তখনও কোনো অভিযোগ করে কাঠগড়াতে দাঁড়া করাইনি। সবসময় চঞ্চল আমি, শুধু নিরব হয়েছি। ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেনও আপনি, সেটাকে ভেঙেছেনও আপনি। আমি কোথায়? শুধু তাল মিলিয়েছিলাম। সেসময় কোনো মেয়ে আপনার ডেস্পারেট ভালোবাসাতে তাল না মিলিয়ে থাকতে পারতো বলে আমার মনে হয় না। কারণ মেয়েরা তেমন লাইফ পার্টনারই তো চায়। আমার সব শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। আমি গতানুগতিক রিলেশন চাইনি, তাও মেনে নিয়েছিলেন। আমি অসুস্থ হলে রাত-বিরেতে হোস্টেলের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন মনে আছে?
এখন বুঝতে পারছেন? কতোটা গভীর ভাবে আপনি আমায় ভেঙেছেন? যার প্রতিক্রিয়াতে আমি নিরবতা বেছে নিয়েছি।”
“মীরা, অ্যাই অ্যাম সরি। প্লিজ মীরা। একটা সুযোগ দাও। আমি কখোনো তোমাকে কষ্ট দিবো না।”
মীরার মাথার নিউরন গুলো ধপধপ করছে। তার ক্লাসের আর ১০ মিনিট আছে। কলিগের ক্লাসের সময় শেষ। এখনি হয়তো চলে আসবেন। মীরা অনুনয় করে বলল,
“প্লিজ, চলে যান। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন। খুব খুব ভালো আছি আমি। আজ আপনার প্রস্তাবে রাজি হলে, আমি এটুকুও ভালো থাকব না। যেই আমি চোখ বন্ধ করে আপনাকে ট্রাস্ট করতাম, সেই আমি আপনাকে বিন্দু পরিমানও ট্রাস্ট করতে পারব না। এর কষ্ট বোঝেন? আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি। আপনার জন্য দোয়া করব যেন সত্যি সত্যি কাউকে মৃত্যু পর্যন্ত আগলে রাখার মতো ভালোবাসতে পারেন এবং তার থেকেও তেমন অপার ভালোবাসা পান। সেই কেউ টা আমি নই, বর্ণ!”
বর্ণ একদৃষ্টিতে মীরার পানে চেয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে,
“একটা রিকুয়েস্ট রাখবে?”
“বলুন।”
“একটা গান গাও না। শুধু একবার। লাস্টবার। আমি চলে যাব। আর আসব না।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড নিরুত্তর চেয়ে থেকে একটা গানের কলি ধরলো,
“কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে,
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহ মেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না,
মোহ মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না,”
“গাইলাম। এবার প্লিজ… আমার কলিগ চলে আসবে।’
বর্ণ উঠে দাঁড়ালো। মলিন হেসে বলল,
“ভালো থেকো, মীরু। আমার মতো ভাঙতে তোমার জীবনে কেউ না আসুক।”
মীরা মুচকি হাসলো। বর্ণও দরজা খুলে বেরোবে তখনি মীরার কলিগ কনক ম্যাম রুমে প্রবেশ করলেন। অফিস রুমে অপরিচিত পুরুষকে দেখে মীরাকে প্রশ্ন করলেন,
“মীরা, কে উনি?”
মীরা ততক্ষণে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। কৃতিম হেসে বলে,
“আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। আমরা সেম ফ্যাকাল্টির আন্ডারে রিসার্চ করেছি। ভাইয়া, কয়েকদিন আগে জাপান থেকে ছুটিতে এসেছেন। ওখানে পিএইচডি করছেন তো। যখন শুনলেন আমি এখানে জয়েন করেছি, তখন দেখা করতে আসলেন।”
“ওহ আচ্ছা। পিএইচডি করে কি দেশে ফিরবেন?”
(বর্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন)
বর্ণ কৃতিম হেসে প্রত্যুত্তর করে,
“এখনও শিউর না। দেখি জীবন কোথায় নিয়ে যায়।”
“বেস্ট অফ লাক। ভালো থাকবেন।”
বর্ণ এরপর সৌজন্য দেখিয়ে চলে যায়। মীরাও নিজের ক্লাসে যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে নেয়। মাথাব্যাথার দ্রুত কার্যকরের একটা টা*ফ-নিল খেয়ে নিলো। অতঃপর ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
_________
শেহজাদ নিজের অফিস রুমে বসে পিসিতে কিছু কাজ করছে। হঠাৎ হোয়াটসএপে মেসেজ আসে। মেসেজ টোন বেজে উঠলে হাতের কাজটা শেষ করে চেক করে। অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ। সেখানে কিছু স্ক্রিনশট। কারও কথোপকথনের স্ক্রিনশট। শেহজাদ খুলে দেখলো না। ফোন সাইলেন্ট করে ক্লাসের জন্য চলে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
দেরির জন্য সবসময় দুঃখিত। রাইটিং ব্লকে পড়ে গিয়ে যা লিখি সব আওলে যাচ্ছে। ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।